“রূপগঞ্জের রূপসী”
পর্ব- ১৫
(নূর নাফিসা)
উৎসর্গে – Imran Mahmudul
.
.
“জানো না? তাহলে চলো কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে আসি।”
নাফিসা বিস্মিত হয়ে বড় বড় চোখ করে তাকালো ইমরানের দিকে! ইমরান ঠোঁটের কোনে দুষ্টুমি হাসি রেখে বললো,
“এভাবে তাকানোর কি আছে। তোমার তো যখন তখন অদ্ভুত ফিলিং হয়। আর বারবার মতামত পাল্টে যায়। এখন যেহেতু মত আছে তো চলো, ঝটপট বিয়েটা সেড়ে আসি।”
ইমরানের দুষ্টুমি বুঝতে পেরে এবার নাফিসার চেহারায় লজ্জিত ভাব ফুটে উঠেছে। সে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপুরা এবার আপনাকে সত্যি সত্যি ত্যাজ্য করবে।”
“আচ্ছা! আমার তো সেটা দেখার ইচ্ছে যে বউ কি করবে!”
নাফিসা আর কথা বাড়ালো না। কিন্তু ইমরান সত্যি সত্যিই কাজী অফিসের সামনে এসে গাড়ি থামালো! তা দেখে নাফিসা অবাক দৃষ্টিতে তাকালো! ইমরান কি পাগল হয়ে গেছে!
নাফিসাকে এভাবে তাকাতে দেখে ইমরান বললো,
“চলো।”
কথাটা বলে ইমরান নেমেও গেছে গাড়ি থেকে। আর নাফিসা হতবাক! নাফিসার চেহারা দেখে ইমরান হেসে বললো,
“কি হলো! চলো?”
নাফিসা সামান্য ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
“আমি বাসায় যাবো।”
“বাসায় তো যাবোই তবে তার আগে বিয়ে করে যাবো। তারপর ডিরেক্টলি তোমার শ্বশুর বাড়ি।”
“না!”
“না মানে! এইটুকু আসতেই আবার মত পাল্টে গেলো!”
“এভাবে বিয়ে করার মত কিন্তু আমি দেইনি।”
ইমরান হাসতে হাসতে একটু পেছনের দিকে চলে গেলো। নাফিসা উঁকি দিয়ে দেখলো সে তো কাজী অফিসে নয়! পাশের রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে! নাফিসা সামান্য হেসে জানালা দিয়ে মাথা বের করে বললো,
“নেমে আসবো?”
ইমরান পিছু ফিরে বললো,
“না। বসো, আমি আসছি।”
ইমরান কিছু খাবার কিনে আনলো। খাবার কিনতে যতটা না লেট হয়েছে তার চেয়েও বেশি লেট হয়েছে জনগণের সাথে সেলফি তুলতে! রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে এগিয়ে আসতে আসতে বাইরে এসে গেছে। পিছু নিতে নিতে গাড়ি পর্যন্তও এসে পড়তে পারে তাই ইমরান সেখানে দাড়িয়ে সেলফি তুলে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলো। নাফিসার দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে সে গাড়ি স্টার্ট দিলো। জুস ও কোকা কোলা সামনে রেখে প্যাকেট হাতেই রাখলো নাফিসা৷ প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে গাড়ি চলছে। নাফিসা এখনো প্যাকেট হাতে রেখেই বসে আছে। ইমরান বললো,
“বসে আছো কেন?”
নাফিসা বোকা বনে গেলো! গাড়ি চলছে বসে থাকবে না তো কি করবে! সে বোকার মতোই প্রশ্ন করে বসলো,
“তো কি করবো?”
“প্যাকেট কি কোলে নিয়ে বসে থাকার জন্য দিয়েছি?”
“আমি খাবো!”
“কেন? তোমার দাত নেই?”
নাফিসা ব্রু সামান্য কুচকে বললো,
“আমি খাবো না এখন। একটু আগে মাত্র বাসা থেকে খেয়ে এসেছি।”
“আসতে আসতেই হজম হয়ে গেছে। খাও।”
“সম্ভব না। আপনি খান।”
“তুমি প্যাকেটই খোলনি, আমি খাবো কি করে!”
নাফিসা দ্রুত প্যাকেট খুলে দিলো। বাঁঁদিকে থাকায় ইমরান বাঁ হাতেই নিতে গেলে নাফিসা বললো,
“আমি দিচ্ছি।”
নাফিসা তার মুখের সামনে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তুলে ধরলে ইমরান মুখে না নিয়ে মুচকি হেসে ডান হাতে নিয়ে বললো,
“এটা বিয়ের পর।”
করতে গেলো উপকার আর পেল লজ্জা! যার ফলে নাফিসা বাইরে তাকিয়ে রইলো। এবং বললো,
“গাড়ি পার্ক করে আগে খেয়ে নিন।”
“উহুম, বেশি খাবো না। আমিও বাসা থেকে নাস্তা করে বেরিয়েছি। তোমার জন্যই নিয়ে এলাম। তোমাকে নিয়ে এখন রেস্টুরেন্ট যাবো না, তাই প্যাকেট করে গাড়িতে নিয়ে এসেছি। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য যে ব্যর্থ! কিছু একটা তো খাও। জার্নির সময় খাওয়ার মজাটাই আলাদা যেটা তুমি ইগনোর করছো।”
নাফিসা বড় প্যাকেট থেকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের প্যাকেট তুলে ইমরানের ডানপাশে রাখলো যাতে ডান হাতেই নিয়ে খেতে পারে। আর সে জুসের বোতল হাতে নিয়ে বললো,
“আমি এটা খাই।”
অত:পর বোতলের মুখ খুলতে খুলতে বললো,
“সানগ্লাস তো চোখে রাখলেই সুন্দর দেখায়। গলায় ঝুলছে কেন!”
তখন রেগে খুলতে বললো আর এখন নরমাল হয়ে সুন্দর বলছে তাই ইমরান মুচকি হেসে সানগ্লাসটা তার দিকে এগিয়ে দিলো। নাফিসা সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি পড়ার জন্য বলিনি। আপনার চোখেই ভালো মানায়।”
ইমরান সানগ্লাস আবার টিশার্টে ঝুলিয়ে বললো,
“উহুম, রূপসীকে আমি সানগ্লাসে দেখবো নাকি। এক পলক তুমি দর্শনে দৃষ্টিতে কোনো আবরণ রাখবো না তো এই আমি।”
“ইশ! তখন যে রাখলেন!”
“ক্ষেপেছিলে না খুব? যখন দেখবো তুমি এভাবে ক্ষেপে যাচ্ছো তখন সানগ্লাস পড়ে পড়ে দৃষ্টি লুকিয়ে আরও রাগিয়ে দিবো তোমায়।”
বলেই ইমরান নিঃশব্দে শরীর কাপিয়ে হেসে উঠলো আর নাফিসা লজ্জায় বাইরে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে সে কিভাবে কথা বলছিলো তার সাথে, তা মনে হতেই লজ্জায় মিশে যেতে ইচ্ছে করে!
তিন-চার ঘন্টা তারা গাড়িতেই ঘুরেছে। একবার শুধু বাহাদুর শাহ পার্কে নেমে হেটেছিলো পনেরো বিশ মিনিটের জন্য। নাফিসার ভালোই লেগেছে এই কড়া রোদ আর তীব্র বাতাসে ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়িতে ভ্রমণ করতে। এর মাঝে ইমরানের ইচ্ছায় দুজনেই একটু পরপর খেয়ে সম্পূর্ণ খাবার শেষ করেছে। অত:পর নাফিসাকে তাদের বাসার কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে গেছে কিন্তু বাসার সামনে আসেনি ইমরান। কারণ কেউ দেখলে আবার তাকে বাসায় যেতে বলবে কিন্তু সে যে এখন যাবে না। কোকা কোলাটা খায়নি তারা। নাফিসা খায় না আর ইমরানের পেট ফুলফিল। তবে বাসার সামনে এসে সেটা নাফিসার হাতে ধরিয়ে দিলো সাঈদকে দেওয়ার জন্য। আরও কিছু কিনে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলো কিন্তু নাফিসা নিষেধ করলো।
.
পরদিন ল্যাব থেকে আসার সময় আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে এসেছে নাফিসা। দুপুরে লাঞ্চ করে সোফায় বসে সে আর সাঈদ দুইটা চামচ নিয়ে এক বাটিতে খাচ্ছে আর টিভিতে মিনা কার্টুন দেখছে। কে যেন কলিং বেল বাজালো। নাফিসা সাঈদকে বললো,
“সাঈদ দরজা খুলে দিয়ে আয়।”
সাঈদ মুখের উপর বলে দিলো,
“পারবো না, তুমি যাও।”
“একটা থাপ্পড় দিবো! যা বলছি।”
“না!”
“ফাজিল একটা। আমার আইস্ক্রিম দে!”
নাফিসা রেগে বাটি নিয়ে চলে গেলো দরজা খুলতে। এসময় দরজার বাইরে ইমরানকে দেখে চমকে গেলো! ইমরান ব্রু নাচিয়ে বললো,
“কি?”
“আপনি এখানে!”
কথা বলতেই পেছনে পারভেজ ভাইয়া ও সুমি আপুকে দেখতে পেল নাফিসা। ইমরান বললো,
“এ সময় আইস্ক্রিম খাওয়া ধরেছো!”
“গরমে আইস্ক্রিম খাবো না তো চা/কফি খাবো!”
“তা-ও ঠিক। কিন্তু এই গরমে এমন বরফ গিলতে থাকলে সর্দিকাশিতে আক্রান্ত হবে। ভেতরে যেতে দিবে না নাকি?”
নাফিসা দরজার কাছ থেকে সরে এসে বললো,
“অহ! হ্যাঁ, আসুন।”
সবাই ভেতরে এসে সোফায় বসলো। সুমি বললো,
“ওফ! কি গরম পড়েছে! নাফিসা, ফ্রিজের ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়।”
“ওকে বসো। আমি আসছি।”
নাফিসা পানি এনে আপুর কাছে দিলো। তার মা এসে তাদের সাথে কথা বললো। সাঈদ এদিকে সুযোগ পেয়ে সব আইস্ক্রিম ভেনিস করে ফেলেছে! নাফিসা তাদের উদ্দেশ্যে বললো,
“তোমরা কি এখন আমাকে নিতে এসেছো? আমি কিন্তু যাবো না।”
পারভেজ বললো,
“যাবে না কেন? না গেলে, বেধে নিয়ে যাবো।”
“না, ভাইয়া। আমি কিছুদিন এখানে থাকবো।”
সুমি বললো,
“পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হ। শপিং এ যাবো। পরে এসে থাকিস।”
“এখনই শপিং!”
“এখন নয় তো আর কবে! সময় নেই বেশি। তারাতাড়ি যা।”
“আপুরা যাবে না?”
“আপু, সুমন ভাইয়া আর শান্তা সকালে বেরিয়েছে একটা কাজে। সেখান থেকে এখন শপিং মলে যাবে। পাবেল অফিস থেকে যাবে আর আমরা এখান থেকে।”
সবাই শপিংমলে যাচ্ছে তাই নাফিসার মা জিজ্ঞেস করলো,
“বাচ্চারা কোথায়?”
“বাবা-মা এর কাছে বাসায় রেখে এসেছি, আন্টি। ওদের নিয়ে তো ঘুরতে পারবো না।”
“আচ্ছা ভালো হয়েছে। হাতমুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া করে নাও।”
“না, আন্টি। মাত্র খেয়ে এসেছি। নাফিসা তুই দ্রুত যা। দেরি হলে তারা আবার রাগারাগি শুরু করবে। তাছাড়া বাচ্চাদের বাসায় রেখে পালিয়ে এসেছি। তারাতাড়ি ফিরতে হবে।”
নাফিসা পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে বেরিয়ে এলো। গাড়ির পাশে এসে ইমরান ড্রাইভিং সিটে বসেছে। আপুদের সামনে ইমরানের পাশাপাশি বসবে না তাই নাফিসা পেছনের সিটে বসে পড়লো। এবং সুমির উদ্দেশ্যে বললো,
“আপু তুমি এখানে আসো।ভাইয়া সামনে বসুক।”
“ওকে।”
পারভেজ বললো,
“সেকি! নাফিসা ইমরানের সাথে বসতে।”
নাফিসা কিছু বলার আগে ইমরান জবাব দিলো,
“না ভাইয়া, আপনিই সামনে এসে পড়ুন। বিয়ের আগে নাকি কিছু রুলস আছে, সেগুলো মানতে হবে তো!”
ইমরানের বিদ্রুপে নাফিসা ভেঙচি কাটলো। পারভেজ সামনে বসতে বসতে বললো,
” সেটা আবার কেমন!”
ইমরান মুচকি হেসে বললো,
“যেমন ধরুন, গাড়িতে একসাথে বসতে পারবো না।”
পারভেজ হেসে উঠলো এবং বললো,
“সুমি, আমাদের বিয়ের আগে এমন রুলস ছিলো না কেন?”
সুমিও হেসে জবাব দিলো,
” থাকবে কিভাবে! আমি কি তোমাকে আগে থেকে চিনতাম!”
“তা-ও ঠিক!”
তারা সারা রাস্তা কথা বলতে বলতে শপিং মলে পৌছে গেলো। শান্তা আপুরাও সবাই যুক্ত হয়েছে। শো রুমে প্রবেশ করে তারা বিয়ের জন্য শাড়ি দেখতে লাগলে ইমরান বললো,
“বিয়ের জন্য শাড়ি দেখো না, রিসিপশনের জন্য দেখো।”
নীলা কারণ জানতে চাইলে ইমরান বললো,
“বিয়ের শাড়ি আমি অর্ডার করে এসেছি।”
“কোথায়?”
“রূপগঞ্জে।”
সুমি বললো,
” আচ্ছা তাহলে বাকিটা আমরা কিনে নেই।”
অত:পর তারা রিসিপশনের জন্য শাড়ি দেখতে লাগলে নাফিসা তাদের কাছে থেকে কেটে পড়লো এবং পেছনে ইমরানের কাছে চলে এলো। তাকে সরে আসতে দেখে ইমরান বললো,
“পেছনে এলে কেন? পছন্দ হয়না?”
“আমাকে রেখেই একা একা বিয়ের শাড়ি পছন্দ করে এসেছেন!”
“হুম। তোমাকে রেখেই করতে হলো। কি আর করবো, তুমি তো আমাকে পাত্তাই দেও না।”
“আরো কত কি বলবেন এখন! কি শাড়ি অর্ডার করেছেন রূপগঞ্জে?”
ইমরান হেসে বললো,
“তো পেছনে আসার মেইন কারণ এটা!”
” হুম, বলুন।”
“জামদানি।”
নাফিসা অবাক-খুশি হয়ে বললো,
“কেমন শাড়ি? দেখান।”
“আমি কি এখানে শাড়ি নিয়ে এসেছি!”
” ছবি তুলে আনেন নি! ওটা দেখান।”
“না, পরে দেখবে।”
“না এখন।”
“বলেছি না পরে দেখবে। এখন শপিং করতে এসেছ, শপিং করো।”
নাফিসা চেহারায় সামান্য বিরক্তি এনে আবার সামনে চলে এলো। ঘুরেফিরে সবাই শপিং করে নিলো। রাত প্রায় ১০টা বেজে গেছে। তাই তারা সেখানেই রেস্টুরেন্টে ডিনারের জন্য গেলো। সবজায়গায়ই মেয়েদের আগে গমন। অর্থাৎ লেডিস ফাস্ট। মেয়েরা সবাই চেয়ার টেনে বসে পড়লো অত:পর ছেলেরা বসতে লাগলো। নাফিসার পাশের সিটটি খালি ছিল কিন্তু ইমরান ইচ্ছাকৃত তার বিপরীতে বসলো। সব সিট বুকিং হওয়ার পর পারভেজ খাবার অর্ডার করে নাফিসার পাশের ফাঁকা সিটে বসতে বসতে তাদের উদ্দেশ্যে বললো,
“এটাও কি রুলস?”
ইমরান হেসে জবাব দিলো,
“ধরে নিন তাই!”