“রূপগঞ্জের রূপসী” পর্ব- ৩

0
1318

“রূপগঞ্জের রূপসী”
পর্ব- ৩
(নূর নাফিসা)
উৎসর্গে – Imran Mahmudul
.
.
বিকেলে ঘুম ভাঙলো ইমরানের। রিসাদ এখন ও ঘুমাচ্ছে। এটা যে কি! এসেছে বেড়াতে এখানেও সারাদিন ঘুমায়। ইমরান তাকে না ডেকেই উঠে পড়লো। রূপসীর কথা মনে হতেই পুকুর পাড়ের দিকে হাটতে শুরু করলো সে। যা ভেবেছে তা ই! রূপসী পুকুরের উপর পেয়ারা গাছের ডালে বসে একা একা পেয়ারা খাচ্ছে। ইমরান তাকে ডেকে বললো,
“রূপসী আজও একা বসে আছো? ভুতের ঘাড় মটকাতে গিয়ে আবার পড়বে তো!”
রূপসী একবার ইমরানের দিকে তাকিয়ে আবার আগের মতো সামনে তাকিয়ে পা ঝোলাতে লাগলো।
কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে ইমরান আবার বললো,
” পেয়ারা কি একাই খাবে, নাকি আমাকেও দিবে?”
রূপসী আবার পেছনে ফিরে বললো,
“আপনি নিজে লইয়া খান।”
“আমি তোমার মতো গাছে উঠতে পারি না।”
” এই গাছে তো পোলাপাইনই উঠতে পারে। আর আপনে এমন বুইড়া হইয়াও পারেন না!”
“সেটাই তো ভয়! আমি বুইড়া বলেই তো যদি ডাল ভেঙে পড়ে যাই!”
“পড়বেন না। ডাল শক্ত আছে। ওইটা মচকানো ছিলো। আহেন।”
“ওকে, চেষ্টা করছি।”
ইমরান জুতা খুলে গাছে উঠে এলো। রূপসী যে ডালে বসেছে, সেটা একটু মোটা হওয়ায় ইমরান তার পাশেই বসলো রূপসীর মতো পা ঝুলিয়ে। তবে এক হাতে অন্য ডাল ধরে। তারপর পেয়ারা নিয়ে খেতে লাগলো। আর রূপসীর সাথে কথা বলছে। মাঝে মাঝে রূপসী ইমরানের কথা শুনে হাসছে। আর ইমরান কথার ফাঁকে তার হাসি লক্ষ্য করছে। খুব সুন্দর রূপসীর হাসি। ও হাসলে ওর বাম গালে টোল পড়ে। চুল গুলোও মোটামুটি লম্বা আর খোলা থাকে সবসময়। এখানে আসার পর থেকে ইমরান লক্ষ্য করছে গ্রামের অন্যান্য মেয়েরা সালোয়ার কামিজ পরে আর বিবাহিত নারীরা কয়েকজন শাড়ি পড়ে। কিন্তু কিশোরীদের মধ্যে শুধুমাত্র রূপসীই অন্যরকম ভাবে শাড়ি পড়ে। তাকে দেখলেই বুঝা যায় সে গ্রামের মেয়ে। সবার চেয়ে আলাদা। ভাবতে ভাবতে ইমরানের দৃষ্টি স্থির হয়ে গিয়েছিলো রূপসীর মুখের দিকে। রূপসী লক্ষ্য করতে পেরে বললো,
“এমনে চাইয়া রইছেন কে?”
ইমরানের ভাবনার ছেদ ঘটলো। সে ইতস্তত হয়ে বললো,
“হুম! কই! একটা গান শুনাই?”
“ক্যা? এহন বুঝি আপনের মনমানসিকতা ভালা হইছে?”
“হুম। হয়েছে।”
“আইচ্ছা, তাইলে হুনান।”
“ইশ্ কি সুন্দর যে তুই,
যার তুলনা হয়না কিছুই।
ইশ্ কি সুন্দর যে তুই,
যার তুলনা হয়না কিছুই।
টোল পড়া ওই হাঁসি,
আমি খুব ভালবাসি।
ডুবেছি তোর প্রেমের নেশায়,
কাটবেনা এ ঘোর সহসায়
ডুবেছি তোর প্রেমের নেশায়,
কাটবেনা এ ঘোর সহসায়…….”
রূপসী এই গানের মানে হয়তো কিছুটা হলেও বুঝে গেছে, আর এটাও হয়তো বুঝে গেছে কেন ইমরান এই গানটা গাইছে। তাই গান শেষ না হতেই ইমরানকে থামিয়ে দিলো সে,
” অনেক ভালা হইছে, গিটার ছাড়াই ভালা গাইছেন। হেল্ললাইগা কি আপনে বিখ্যাত গায়ক?”
ইমরান উত্তরে শুধু মুচকি হাসলো।
রূপসী হঠাৎই বললো,
“ডাব খাইবেন?”
ইমরান বিস্ময়ের সাথে বললো,
“এখন ডাব পাবে কোথায়!”
“খাইবেন কিনা কন।”
“হুম খাবো।”
“আইচ্ছা তাইলে নিচে নামেন।”
ইমরান ও রূপসী নিচে নেমে এলো। পুকুর পাড়েই নারিকেল গাছের নিচে দাড়িয়ে রূপসী উপরের দিকে তাকালো। কিছু একটা বুঝে হাসি দিলো। ইমরান তার হাসির কারণ খুঁজে না পেয়ে বললো,
” হাসছো কেন?”
“এই গাছের ডাব খাইতে মজা লাগবো।”
“তুমি কি এখন গাছে উঠবে!”
“হু।”
“রূপসী, একদম না। পড়ে গেলে হাড়গোড় ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে যাবে। চঞ্চলতা ভালো তবে এতোটা চঞ্চল হওয়া ভালো না।”
রূপসী হেসে বললো,
“আমি এতো উচা গাছে উঠতে পারি না। দাড়ান, আইতাছি।”
“কোথায় যাও?”
কোনো উত্তর না দিয়েই রূপসী একটা বাড়িতে চলে গেলো। ইমরান সেখানেই দাড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর রূপসী একটা দা আর একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে এলো। ছেলের বয়স ১৩/১৪ হবে। ছেলেটি সোজা গাছে উঠে গেলো দা নিয়ে। ছেলেটি গাছে উঠতে উঠতে রূপসী নিচে দাড়িয়ে বললো,
“অশান্ত চারটা ডাব নামাবি।”
“আইচ্ছা।”
তার মুখে এমন নাম শুনে ইমরান বিস্মিত হয়ে বললো,
“অশান্ত! এটা আবার কেমন নাম!”
রূপসী হেসে বললো,
“হের নাম শান্ত। কিন্তু এলাকার সেরা বান্দর। হেল্ললাইগা সবাই অশান্ত কয়।”
ইমরান হাসলো তার কথায়। ওদিকে অশান্ত গাছে থেকে বললো,
“আমার নাম লইয়া চেসলামি করছ। খাড়া তোর মাথায় ডাব ফালামু।”
রূপসী তার প্রত্যুত্তরে বললো,
“তুই নাইমা আয়। তোরে ২দিন কাদায় ডোবায় রাখমু।”
“আইচ্ছা, দেখমুনে!”
অশান্ত চারটি ডাব নামিয়ে আনলো। রূপসী দুইটা ডাব নিজের কাছে রেখে বাকি দুইটা অশান্তের হাতে দিয়ে বললো,
“১টা তোর, আর একটা আম্মার কাছে দিয়া যাবি।”
“আইচ্ছা।”
অশান্ত চলে গেলো। রূপসী দা নিয়ে ডাব কাটতে গেলে ইমরান বাধা দিয়ে বললো।
“আমার কাছে দাও।”
“ডাব কাটতে পারেন?”
“দেখো পারি কিনা!”
ইমরান দুইটা ডাব কেটে একটা রূপসীর হাতে দিলো, আর একটা নিজের হাতে রাখলো। অত:পর বললো,
“কাটা হয়েছে?”
“হুম। অনেক সুন্দর হইছে। শহরের মানুষ তো এইসব পারে না। ডাবের ব্যবসা করছেন নাকি কোনোদিন!”
কথা বলে নিজেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ইমরান মৃদু হেসে বললো,
“না। ডাব কিনার সময় বিক্রেতাকে দেখেছি কাটতে। আবার অনেক সময় নিজেই কেটে খেয়েছি। সেই সূত্রেই পারি আরকি।”
“অহ! আইচ্ছা। এহন খান। একদমে পুরাটা খাইতে পারবেন?”
ইমরান রূপসীর কথায় উৎফুল্ল হয়ে বললো,
“খাই নি কখনো, তবে চেষ্টা করতে পারি।”
“আইচ্ছা। দেহি, কারটা আগে শেষ হয়। শুরু করেন।”
” ওকে।”
রূপসী খাওয়া শুরু করলো, সাথে ইমরান ও খাচ্ছে আর রূপসীর খাওয়া দেখছে।
রূপসীর খাওয়া আগে শেষ হলো। তারপর রূপসী ডাবের মুখটা উপুড় করে ইমরানকে দেখালো যে তার খাওয়া শেষ। ইমরান ও মুচকি হেসে একই কাজ করলো। রূপসী অবাক হয়ে তারপর হেসে দিলো। তার মানে, দুজনের খাওয়া একসাথে শেষ হয়েছে। তার একদমে ডাব খাওয়ার অনুভূতি জানতে রূপসী বললো,
“কেমন লাগছে?”
“ডাবের পানি প্রচুর মিষ্টি আর প্রতিযোগিতা তো দারুণ মজা ছিলো !”
“আরও একটু মজা বাকি আছে।”
“আবার কি?”
তার জবাব না দিয়ে রূপসী ইমরানের হাত থেকে ডাব নিয়ে দা দিয়ে মাঝখানে এক কোপ বসিয়ে ডাব দুভাগ করে ফেললো। তার নিজের ডাবটাও একই ভাবে কাটলো। ইমরানের টা ইমরানের হাতে দিয়ে বললো,
“ডাবের নলি খাইলে আরও মজা পাইবেন।”
“এসব আবার খায় নাকি! একদম পাতলা আস্তরণ! আর এগুলো এমনিতে খাওয়াও যাবে না।”
তারপর রূপসী ডাবের মুখ কাটা অংশ থেকে ছোট করে টুকরো নিলো নলি খাওয়ার জন্য।
“এই নিন চামচ। এটা দিয়ে খান।”
ডাবের নলি খেতে খেতে তারা অন্যরকম মজা উপভোগ করলো। ইমরান বাসায় ফিরে রিসাদের সাথে উক্ত ঘটনা বললে রিসাদ বললো,
“ভালোই তো! আমাকে রেখেই একা একা ঘুরছিস!”
ইমরান তার পিঠ চাপড়ে বললো,
“ব্যাটা, তুই ঘুমা সারাদিন।”
আজও সন্ধ্যার পূর্বে তারা ঘুরতে বের হলো। নদীর ধারেই গিয়েছে। সাথে বিচ্ছুবাহিনী নিয়ে গেছে। তাদের সাথে নিলে যেন আলাদা একটা মজা পায় ইমরান ও রিসাদ। নদীর তীরে সাঁকো বাধানো আছে। এদিকে আগে নৌকা চলাচলের ঘাট ছিলো। তার জন্যই এই সাঁকো বাধানো হয়েছে। জোয়ারে পানি উপরে উঠে এলে সাঁকো ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে নৌকা ঘাট অন্যত্র সরিয়ে লোকেদের গোসলের জন্য এই ঘাট ছেড়ে দিলো মাঝিরা। তবে সাঁকোটা রয়ে গেছে এখনো। তারা বিচ্ছুবাহিনী সহ সাঁকোতে উঠে দাড়ালো। ইমরান সেল্ফি তুললো বাচ্চাদের সহ। তাদের আগে উঠতে দিয়ে রূপসী পেছনের দিকেই ছিলো। সেল্ফি তুলতে গিয়ে শাওনের ধাক্কায় ইমন পানিতে পড়ে গেছে! তা দেখে সবাই স্তব্ধ! পরক্ষণে সমান তালে হেসে উঠলে ইমন রেগে শাওনকে বকাঝকা করতে করতে সাঁকোর খুটি ধরে ঝাকাতে লাগলো! সাঁকো দুলছে তো দুলছেই! রূপসী হাসতে হাসতে লাফিয়ে নেমে পড়লো। পুরোনো সাঁকো মটমট করছে, এদিকে তারা ইমনকে থামতে বললে সে থামছেও না। আর এভাবে নাড়াচ্ছে বিধায় তারা কেউ নামতেও পারছে না! শক্ত করে খুটি ধরে রেখেছে একএকজন! ভারসাম্য হারিয়ে হাত পিছলে বাঁশ ছেড়ে দিলে রিসাদও হেলেদুলে পড়ে গেলো! আর ভিজে গেলো অর্ধেক! তা দেখে বাকিরা হাসাহাসি! প্রথমে ইমনকে ঠুসি দিয়ে এবার রিসাদও পকেট থেকে ফোন তীরে রেখে সাঁকো ঝাকাতে লাগলো। যার ফলে পঁচা বাঁঁশের সাকোটাই ভেঙে গেলো! একদিকে ঢাল হয়ে এবার সবগুলোই স্বল্প কাদাময় পানিতে! শুধু মিমি শক্ত খুটি ধরে এখনো ভাঙা সাকোতে ঝুলে আছে এবং কান্না করে দিয়েছে ভয় পেয়ে! রূপসী উচুতে দাড়িয়ে হাসতে হাসতে বেহুশ হওয়ার অবস্থা! মিমিকে উদ্ধার করার জন্যও এগিয়ে আসতে পারছে না সে! ইমরান প্রচুর রেগে গেছে! সে দ্রুত পকেট থেকে ফোন ওয়ালেট বের করে শার্টে মুছে তীরে রাখলো। অত:পর মিমিকে উদ্ধার করে সে পানিতে গেলো। রিসাদ তার ভয়ে হাসতে হাসতে আরও দূরে যাচ্ছে! তবে বেশি দূর যেতে পারেনি! ইমরান কোমড় পানিতে এনে চুবিয়েছে তাকে! ওদিকে বাচ্চারা কাদায় মাখামাখি! ইমনের অবস্থা নাজেহাল! কাদা দিয়ে পুরো মাখিয়ে দিয়েছে বাকিরা! রূপসী আরেকটু পিছিয়ে উপরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে শুধু উপভোগ করলো তাদের মজা৷ ইমন কাদা ছোড়ার জন্য উঠে আসতেই সে আর মিমি দৌড়ে স্থান ত্যাগ করলো। বাকিরা শীতলক্ষ্যায় ঝাপাঝাপি করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলো।
পরদিন সকালে নাস্তা করেই রিসাদ, ইমরান, শাওন ও রূপসী বেরিয়ে গেলো রূপগঞ্জ ঘুরে দেখতে। প্রথমে রূপসী তাদেরকে রূপগঞ্জের রাজবাড়িতে নিয়ে গেলো। যেটা বর্তমানে সরকারি মুড়াপাড়া কলেজ হিসেবে পরিচিত। রাজবাড়ির সামনের রাস্তায় দাড়িয়েই ইমরানের মন্তব্য,
“অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গা।”
রূপসী বললো,
“রাস্তায় থাইকাই কন সুন্দর! আগে পুরোটা ঘুরেন।”
“দাড়াও প্রথমে এখান থেকেই ছবি তুলে নেই। এখান থেকে সম্পূর্ণ এরিয়াটা খুব সুন্দর লাগছে।”
অত:পর তারা সবাই ছবি তুলে রাজবাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। চারিদিকটা খুবই সুন্দর। রাজদরবারের সামনে একটা বড় পুকুর, ডানপাশে বিশাল আমবাগান, বামপাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি। রাজদরবারের পিছনেও পুকুর আছে। অনেক পুরনো হলেও এখনো খুব সুন্দর সবকিছু। আরও বিভিন্ন ভবনও হয়েছে। পেছন দিকে বিভিন্ন গাছের সমাহার, সবুজে ঘিরে আছে সব। একটা ফুলের বাগানও আছে। সম্ভবত এখানে চারাও বিক্রি করা হয়।
রিসাদ ও ইমরান দুজনেই ছবি তোলায় ব্যস্ত।
তারপর, রূপসী তাদের দিঘির পাড় নামক একটা জায়গায় নিয়ে গেলো। ভীষণ সুন্দর জায়গাটি। খুবই বড় একটা দিঘি। তার চারিদিকে নারিকেল গাছ। তার মাঝখানে অর্থাৎ পানির মধ্যখানে একটা দ্বিপ যেখানে একটা পাকা ঘর রয়েছে। ঘরের চারিদিকে বিভিন্ন ফলের গাছ লাগানো। সেখানে যাওয়ার জন্য একটা নৌকা রাখা আছে। কিন্তু মাঝি নেই!
সেখানে যাওয়ার ইচ্ছায় এবার রিসাদ বললো,
“এবার কি হবে! সেখানে না যেতে পারলে তো উদ্দেশ্য সার্থক হবে না!”
“দাড়ান দেখতাছি কি করা যায়!”
রূপসী গিয়ে নৌকায় উঠে গেলো। তারপর দেখলো নৌকায় তালা দেয়া। তাই আবার ফিরে এলো।
ইমরান জিজ্ঞেস করলো,
” কি দেখলে?”
“নৌকায় তালা দেওয়া।”
“তালা দেয়া না থাকলে কি তুমি নৌকা চালাতে?”
“আপনার কি মনে হয়! এত্ত বড় বৈঠা আমি উঠাইতে পারমু!”
“তাহলে?”
“আপনাগো দিয়া চালাইতাম।”
ইমরান ও রিসাদ উভয়েই একত্রে বলে উঠলো,
“কি..!”
অত:পর ইমরান বললো,
“আমি পারিনা নৌকা চালাতে।”
তার পরপরই রিসাদও বললো,
“আমিও পারিনা।”
রূপসী ভেঙচি কেটে বললো,
“পারেনটা কি আপনারা! ঘোড়ার ডিম?”
শাওন বিস্মিত হয়ে বললো,
“আপ্পু, ঘোড়ায় ডিম পারে?”
ইমরান ও রিসাদ শব্দযোগে হেসে উঠলো! রূপসী কোনো মন্তব্য না রেখে চলে গেলো তাদের কাছ থেকে।
রিসাদ কিছুটা বিস্ময়করভাবে বললো,
“আরে! রূপসী রাগ করলো নাকি!”
প্রত্যুত্তরে ইমরান বললো,
“কি জানি! কোথায় গেলো সে! আমাদের রেখে চলে গেলো নাকি আবার। কোথায় খুজবো আবার তাকে! চিনি না তো কিছুই এদিকে! কার না কার বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো!”
শাওন জবাবে বললো,
“আরে না। আপু আমাগো রাইখা যাইবো না। কোনো দরকারে গেছে মনে অয়।”
কিছুক্ষণ পর রূপসী ফিরে এলো। সবাই ছোট একটা নিশ্বাস ছাড়লো তাকে দেখে। কেননা তারা এতোক্ষণ রূপসীর অপেক্ষায় নারিকেল গাছের পাশে দাড়িয়ে ছিলো। তার সাথে একটা যৌবনপ্রাপ্ত লোক। লোকটি নৌকায় উঠে তালা খুলে বৈঠা হাতে নিলো। রূপসী নোকায় উঠে পড়ল। তারা কেউ এগিয়ে আসছে না বলে রূপসী বললো,
“কি? আপনারা যাইবেন না?”
এবার তারা বুঝতে পেরে সবাই নৌকায় উঠে পড়ল। এসে পড়লো দ্বীপে। বাড়িটা অনেক সুন্দর। বাইরে বসার জন্যও ব্যবস্থা আছে। অনেকটা সময় তাড়া সেখানে কাটিয়ে বিকেলের দিকে তারা ফিরে এলো সেখান থেকে। মুড়াপাড়া বাজারে এসে তারা হোটেলে খেয়ে নিলো। হোটেল থেকে বের হতেই একটা বাচ্চা মেয়ে এসে রূপসীর সামনে হাত পাতলো সাহায্যের জন্য। মেয়েটার চেহারা বড্ড মায়াবী! যার মাঝে একটু হলেও মায়া আছে সে এই অসহায়ের মায়ায় পড়তে বাধ্য। রূপসী মেয়েটির সামনে হাটু ভেঙে বসে পড়লো। এবং জিজ্ঞেস করলো,
“এই তোর নাম কিরে?”
“লিমা।”
“থাকস কই?”
“বাজারের পিছের গলিত।”
“তোর বাবা-মা নেই? তুই বাইরে ঘুরছ ক্যা? টাকা দিয়া তুই কি করবি?”
“আব্বায় আমারে আর মা রে থুইয়া দূরে গেছে গা। মা কইছে টাকা না নিলে খাওন দিতো না।”
এইটুকু একটা বাচ্চা মেয়েকে থ্রেড দেয় টাকা না নিয়ে গেলে খাবার দিবে না! এ কেমন মা! দুনিয়াতে এমন মা-ও আছে! রূপসীর গাল গড়িয়ে সাথে সাথে পানি পড়লো। কারো চোখ এড়ায়নি সেটা। রূপসী দ্রুত চোখ মুছে তার শাড়ির আঁচল থেকে একশো টাকা নিয়ে মেয়েটির হাতে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
“আজ মা রে কইবি বেশি কইরা খাবার দিতে।”
লিমা খুশি হয়ে বললো,
“আইচ্ছা।”
ইমরান নিজেও একশো টাকা দিলো মেয়েটির হাতে। অত:পর মেয়েটি চলে গেলো। রূপসী ও ভালো করে সবার আড়ালে চোখ মুছে নিলো। কিন্তু ইমরান, রিসাদ সেটা ঠিকই লক্ষ্য করেছে। অত:পর তাদের উদ্দেশ্যে বললো,
“আরও কোথাও যাইবেন?বিকেল হইয়া গেছে তো!”
“কাল তো চলেই যাবো আজ, তাই ভাবলাম আজ নৌকায় ঘুরবো।”
রূপসী অস্পষ্ট বিষন্নতার সাথে বললো,
“কালই চইলা যাইবেন?”
ইমরান একটু অবাক হয়ে তাকালো রূপসীর দিকে। রূপসীও তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। ইমরানের কাছে একটু ভিন্ন মনে হলো তার চাহনি! রূপসীর চোখ যেন কিছু বলছে। সত্যিই কি রূপসীর চোখ কিছু বলছে নাকি ইমরানের ভাবনাটাই অন্যরকম! এদিকে রিসাদ বললো,
“তুমি বললে থেকে যাই আরও বছর খানেক! রান্নাবান্না করে খাওয়াতে পারবে তো?”
কথা বলে নিজেই হাসতে লাগলো রিসাদ। অন্যসময় রূপসী খিলখিলিয়ে হাসে কিন্তু এখন মৃদু হেসে বললো,
“ঘাটে চলেন।”
তারপর ঘাট থেকে একটা নৌকা ভাড়া করে শীতলক্ষ্যা নদীর উপর ভ্রমণ করছে। রিসাদ মোবাইলে ছবি তুলছে। শাওন আশপাশের বর্ননায় বকবক করে চলেছে। রূপসী হাটুতে মাথা রেখে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে সীমান্তে তাকিয়ে। আর ইমরান বিরতি নিয়ে বারবার তাকাচ্ছে রূপসীর দিকে। আশপাশ দেখার পাশাপাশি সে ভাবছে রূপসী কি সেই অসহায় মেয়েটির জন্য মন খারাপ করে আছে! নাকি তাদের চলে যাওয়ার কথা শুনে মন খারাপ করেছে!
প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেছে তারা নৌকায় ঘুরছে। এর মাঝে রূপসী একটা কথাও বলেনি। শাওন আর রিসাদ কথার ঝুড়ি খুলে বসেছে। ইমরান মাঝে মাঝে রিসাদ শাওনের সাথে কথা বললেও একটু পর পর রূপসীর দিকে তাকাচ্ছে। কেন জানি তার বলতে ইচ্ছে করছে, “রূপসী, তোমাকে এমন উদাসীন হয়ে থাকা মানায় না। তুমি পূর্বের মতো হাসিখুশি থাকো। কথায় কথায় হাসলেই তোমাকে ভালো লাগে।”
কিন্তু কথাগুলো মন ভেদ করে আর বাইরে বেরিয়ে এলো না! সেটা মনের ভেতরই আটকে গেলো কোনো কারণে!
রূপসীর নিরবতায় রিসাদই বলে ফেললো,
“রূপসী, তুমি এমন চুপ কেন? চঞ্চলতা ছাড়া তোমাকে মানায় না।”
রূপসী মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বললো,
“কই!”
“তাহলে কোনো কথা বলছো না কেন?”
রূপসী মাঝিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“মামা, ব্রিজের খাম্বায় নৌকা থামান।”
রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যার নতুন ব্রিজের একটা খাম্বার নিচে নৌকা থামানো হলো। শাওন নেমেই লাফালাফি শুরু করেছে। আর রিসাদ তাকে বার বার বাধা দিচ্ছে। মোটামুটি সাতার জানলেও গভীর পানিতে পড়লে সেটা ঝুঁকিপূর্ণ। বয়সে বড় লোকজনই ভারসাম্য রাখতে পারে না আর সে তো বাচ্চা ই!
প্রচুর বাতাস সেখানে। রূপসী একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। চুলগুলো বাতাসে এদিক থেকে সেদিকে উল্টাপাল্টা করে দিচ্ছে। তাই রূপসী চুলগুলো খোপা করে নিলো। ইমরানের দৃষ্টিতে পড়তেই ইমরান এসে পাশে দাড়িয়ে খোপাটা খুলে দিলো। রূপসী একটু বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো ইমরানের দিকে। তাই ইমরান বললো,
“খোলাই তো ভালো লাগছে।”
রূপসী আবার খোপা করতে করতে বললো,
” আপনার ভালা লাগা দিয়া আমার কি!”
ইমরান আবারও খোপা খুলে দিয়ে বললো,
“মন খারাপ করে আছো কেন?”
“কই!”
“দেখছি তো সবই। কি ভাবছো বুঝি না কিছুই? যতটা অবুঝ সেজে থাকো, তুমি যে ততটা অবুঝও না সেটাও বেশ বুঝে গেছি।”
“বুঝলে ভালা, না বুঝলে আরও বেশি ভালা। আমি বাড়িত যামু।”
কথাটা বলেই রূপসী গিয়ে নৌকায় উঠে পড়লো। ইমরান তাকিয়ে রইলো শুধু।
রিসাদ তাকে হনহনিয়ে নৌকায় উঠতে দেখে বললো,
“আরে রূপসী, তুমি চলে গেলে কেন! এখানে একটা ছবিও তো তুললে না!”
“আপনারা তুলেন। আমি বাড়িত যামু।”
রূপসীকে আরও কয়েকবার বলা হলো কিন্তু সে গেলো না। কয়েকটা ছবি তুলে তারাও সবাই নৌকায় উঠে তীরে চলে এলো। রিসাদ, ইমরান মাঝিকে ভাড়া দিতে দিতে রূপসী তাদের জন্য অপেক্ষা না করে দ্রুত বাসায় এসে পড়লো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here