“রূপগঞ্জের রূপসী”
পর্ব- ৪
(নূর নাফিসা)
উৎসর্গে – Imran Mahmudul
.
.
পরেরদিন সকালে ইমরান আর রিসাদ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ব্যাগ গোছাতে। বাসায় ফিরে যাবে তারা। খালা এসে বললো,
“আরে এতো তাড়া ক্যা! আরও কয়ডা দিন থাকতি।”
রিসাদ বললো,
“খালা, আবার লন্ডন ফিরতে হবে তো। বাসায় যেতে হবে। শহরের পরিবেশ ভালো লাগে বলে ৫দিন ই তো এখানে কাটালাম। বাকি ৩দিন মায়ের কাছে থাকি।”
“আইচ্ছা। আবার আইলে খালার কাছে আইয়া পড়বি। তোর মা রে ও কইছ আইতো। এহন আগে নাস্তা কইরা ল।”
” আচ্ছা।”
” ইমরান, বাবা তুমি তো আর বিদেশ যাইবা না। তোমার মা রে লইয়া আবার আইয়ো।”
“আচ্ছা খালা।”
ইমরান, রিসাদ নাস্তা করে তৈরি। ইমরান একটু তাড়াহুড়ো করে বললো,
“রিসাদ, তুই বস। আমি একটু আসছি।”
“কোথায় যাস?”
“আসছি ৫মিনিট।”
কথা বলতে বলতে ইমরান বেরিয়ে গেলো। তারপর সোজা পুকুর পাড়ে এলো। কিন্তু আজ এখানে রূপসীকে পেলো না। হতাশ হয়ে রূপসীর বাড়ির দিকে পা বাড়ালো, বাড়ির কাছে যেতেই দেখলো কড়ই গাছের ছোট দোলনায় রূপসী বসে আছে। সে ইতস্তত বোধ করে বাড়িতে প্রবেশ করলো। রূপসীর কাছে গেলে রূপসী তার দিকে একবার তাকিয়ে আবার অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। দৃষ্টিতে কেমন এক অভিমান প্রকাশ করছে মেয়েটা। যেটা ইমরানের কাছে পরিষ্কার! ইমরানের ভেতরটায়ও কেমন যেন ভারি লাগছে! এখানে এসে এমন কিছু সৃষ্টি হবে তার মনে সেটা কখনো ভাবতেও পারেনি সে! মানুষের মন কখন কি চায় একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারোই বুঝার সাধ্য নেই! রূপসীর অভিমানের বিপরীতে সে মুখ ফুটে বললো,
“বাসায় চলে যাচ্ছি রূপসী। কথা বলবে না?”
“তো আমি কি করতাম? আপনাগো বাড়িত দিয়া আইতাম?”
ইমরান ঠোঁটের এক কোনে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,
“না, আমাদের সাথেই চলে এসো।”
রূপসী অন্যদিকে তাকিয়েই ভেঙচি কাটলো। ইমরান আশেপাশে তাকিয়ে ছোট এক নিশ্বাস ফেলে আবার বললো,
“মিস করবো তোমাদের রূপগঞ্জকে, তোমার সাথে কাটানো সময়গুলোকে।”
রূপসী কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না তার কথায়। ইমরান একটু থেমে আবার বললো,
“আর তোমাকেও।”
শেষ কথায় রূপসী ইমরানের দিকে এক পলক তাকিয়ে সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলো। ইমরান রূপসীর চোখে পানি স্পষ্ট দেখতে পেল। কিন্তু সেটা চোখের কোটারে আটকে গেছে। ইমরানের ভেতরটা একটু মোচড় দিলো! সে রূপসীকে তার দিকে তাকাতে বললো।
“রূপসী, তাকাও আমার দিকে। রূপসী..!”
এমনিতেই রূপসীর আম্মার ডাক পড়লো ঘরের ভেতর থেকে। তিনি জানালা দিয়ে দেখেছেন ইমরানকে তার সাথে কথা বলতে। বৃদ্ধা বয়সী মহিলাটি কোনো কাজের জন্য রূপসীকে ডাকলো,
“রূপসী, এদিকে আয় তো মা।”
রূপসী দোলনা থেকে উঠতে উঠতে বললো,
“সাবধানে যাইয়েন। আল্লাহ হাফেজ।”
রূপসী দোলনা থেকে নেমে ইমরানের দিকে না তাকিয়েই,
কথাটা বলে চলে গেলো। ইমরান রূপসীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। একটাবার কি তার দিকে তাকাতে পারলো না! এসময় কি এভাবে কথা বলাটা খুব জরুরী ছিলো তার! বিষন্ন মন নিয়ে ইমরান চলে এলো সেখান থেকে। অত:পর রিসাদের সাথে ঢাকায় ফিরে এলো। ইমরান সোজা আপুর বাসায় উঠলো। কেননা মা এখানে আছে।
আপুর বাসায় একদিন থেকে পরদিন মা কে নিয়ে নিজের বাসায় ফিরে এলো সে। রিসাদ চলে গেছে লন্ডন। চলে যাওয়ার সময় ইমরান এয়ারপোর্টে গিয়েছিলো তার সাথে। অত:পর সে ৪দিন কাটিয়ে দিলো ব্যস্ততার মাঝে। কিন্তু প্রতিটি মুহূর্ত রূপসীকে অনুভব করছে। মন চাইছে ছুটে যেতে সেই রূপগঞ্জে। আবারও সেই মুহুর্তগুলো উপভোগ করতে। সেই দিনগুলো আবারও ফিরে পেতে! মন যেন সেখানেই পড়ে আছে তার। টানা চারদিন ব্যস্ততার মাঝে কাটানোর পর তার মাঝে একটা মানসিক যন্ত্রণা কাজ করছে! বারবার রূপসীর ছবিগুলো দেখতো আর বারবারই সেই শেষ দিনের ঘটনা তার চোখে ভাসতো! কেমন একটা বন্দী জীবন লাগছে! অনুভূতিটা মনের মাঝে বন্দী হয়ে আছে যা বের হওয়ার রাস্তা খুজে পাচ্ছে না! এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে আসতে পরবর্তী সপ্তাহে অবশেষে মা আর সুমি আপুকে রূপসীর কথা জানালো। কিন্তু তারা ইমরানের কাছে রূপসীর বর্ননা শুনে রূপসীকে পছন্দ করে নি। তার পদমর্যাদার সাথে রূপসীর কোনোভাবেই মিল হয় না! মানুষকে সবদিক বিবেচনা করেই জীবনের হাল ধরতে হয়। ইচ্ছে হলেই কেবল হুটহাট তা করে ফেলা যায় না।
রূপসীর ব্যাপারে তারা যথাসাধ্য বুঝানোর চেষ্টা করেছেন ইমরানকে কিন্তু ইমরানের ভাবনা রূপসীকেই তার প্রয়োজন। অবশেষে ইমরান তার বড় বোনকেও জানালো, রূপসীর ছবিও দেখালো। বড় আপু আমেরিকা থাকে। তিনি রূপসীর সাথে কথা বলতে চাইলেন। তার দুদিন পর ইমরান একাই রূপগঞ্জে এলো। খুব সকালে রওনা দেওয়ায় সকাল নয়টার দিকে পৌছে গেছে। কিন্তু খালার বাসায় না এসে সোজা রূপসীর বাসায় চলে এসেছে সে। কিন্তু রূপসীরা কেউ বাসায় নেই। রূপসীর আপন বলতে একমাত্র তার আম্মাকে ই দেখা গেছে। রূপসী তো নেই ই, তিনিও বাসায় নেই। হতাশ হয়ে যখন বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় এলো তখনই রূপসীকে দেখা গেলো তার আম্মার সাথে। ইমরানের হতাশাগ্রস্ত মুখে হাসি ফুটে উঠলো! রূপসীও ইমরানকে দেখে কিছুটা অবাক হলো। সে বুঝতে পারছে ইমরান তার সাথে কথা বলতে চাইছে। তাই সে আম্মার উদ্দেশ্যে বললো,
“আম্মা, তুমি বাড়ি যাও। আমি আইতাছি।”
“আইচ্ছা।”
ইমরান রাস্তার একপাশে দাড়িয়ে আছে। আম্মা চলে গেলো, রূপসী ইমরানের কাছে এসে দাড়ালো। ইমরান বললো,
“কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?”
“আমিও আলহামদুলিল্লাহ। কোথায় গিয়েছিলে?”
“আম্মারে নিয়া ডাক্তারের কাছে।”
“উনি অসুস্থ? এখন কেমন আছে?”
” সবসময় এমনই। হঠাৎ এহানে আইলেন যে?”
“কেন? এসেছি বলে কি খুশি হওনি?”
“সোজা উত্তর দিলেই খুশি।”
ইমরান ঠোঁটের এক কোনে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
“রূপসী, কেন জানি মনে হচ্ছে হঠাৎ করেই তোমার মাঝ থেকে বাচ্চামো ভাবটা বিলীন হয়ে গেছে!”
রূপসী কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না তার কথায়। ইমরান বললো,
“পুকুর পাড়ে যাবে? সেখানে বসে কথা বলি।”
“আইচ্ছা।”
ইমরান আর রূপসী পুকুর পাড়ে এসে বসলো। রূপসী বসার সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করলো,
“কন কি কইবেন?”
ইমরান নির্দ্বিধায় বলে ফেললো,
“ভালোবাসো আমাকে?”
রূপসীর চোখজোড়া কিছুটা বড় হয়ে গেছে এবং থমকে তাকিয়েছে ইমরানের দৃষ্টিতে! ইমরান আবার বললো,
“বলো? ভালোবাসো আমাকে?”
রূপসী বোকা বনে প্রশ্ন করলো,
“ভালোবাসা কি?”
ইমরান স্তব্ধ! সেদিন তার দৃষ্টি দেখে তো মনে হয়নি যে সে ভালোবাসা বুঝে না! তাহলে এমন প্রশ্ন কেন করলো! তার মুখে এমন প্রশ্নে ইমরান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“আমাকে তোমার কেমন লাগে?”
রূপসী নির্দ্বিধায় বলে ফেললো,
“আপনারে দেখতে তো ভালোই লাগে। আপনার চুল গুলা অনেক সুন্দর।”
ইমরান শরীর কাপিয়ে হেসে বললো,
“আমার বড় আপু তোমার সাথে কথা বলবে। যা জিজ্ঞেস করবে, শুধু তার উত্তর দিবে। ওকে?”
“আমার পরীক্ষা লইবো?”
“হুম।”
“পাশ করলে কি হইবো?”
“আগে পাশ করো, তারপর বলছি।”
“আইচ্ছা।”
তারপর ইমরান বড় আপুর কাছে কল করলো। ওপাশে রিসিভ হতেই রূপসীর দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললো, “কথা বলো।”
রূপসী ফোন হাতে নিয়ে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
ওপাশ থেকে নীলা বললো,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি নিশ্চয়ই রূপসী?”
“হু, কেমন আছেন?”
“ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
” তোমার বাসায় কে কে আছে?”
“আমার আম্মা আর আমি।”
“আচ্ছা। ইমরানকে ভালোবাসো?”
এমন প্রশ্ন শুনে রূপসী চুপ হয়ে গেল। কি উত্তর দিবে এই প্রশ্নের! ইমরানকে তো মজা করে থামিয়ে দিয়েছে, এখন কি বলবে? এদিকে ইমরান রূপসীকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ইশারায় জিজ্ঞেস করছে “কি হয়েছে?” কারণ ফোন লাউড স্পিকারে না থাকায় সে আপুর কথা শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু রূপসী তার প্রশ্নেও জবাব দিলো না।
ওপাশ থেকে নীলা বললো,
” কি হলো! বলো….?”
রূপসী চুপ করেই আছে। তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। নীলা আবার বলতে লাগলো,
“দেখো রূপসী, ইমরান একজন বিখ্যাত গায়ক। তার স্ট্যাটাস অনেক বেশি। তার সাথে তোমাকে মানায় না। আমি তোমার সম্পর্কে যা শুনেছি তাতে বুঝেছি তুমি অনেক ভালো ও সহজ সরল মেয়ে। তোমার ছবিও দেখেছি। ভালো লেগেছে। কিন্তু তোমাকে ইমরানের সাথে মানায় না। ইমরানের জন্য ঠিক ওর লেভেলের মেয়েই প্রয়োজন। ওর সাথে চলতে হলে তোমাকে ওর অবস্থানে আসতে হবে। ওর যোগ্য হয়ে উঠতে হবে তোমাকে। সবদিক থেকে মানানসই হলেই না জীবনে তাল মিলিয়ে চলা যায়। তোমার মাঝে সেই এবিলিট অনুপস্থিত। আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছো ব্যাপারটা। ইমরান বুঝতে চাইছে না কিছুতেই। তোমার কাছে রিকুয়েষ্ট, তুমি বুঝাও তাকে। ইমরানের মতো শুধু একদিন দেখে না। উভয়দিক থেকে ভেবে দেখো আমার কথাগুলো। আমার পরিবারের বাকি সদস্যও তোমাকে তেমনভাবে মেনে নিতে পারছে না৷ আরেকটু বেশি যোগ্যতা প্রয়োজন ছিলো তোমার। তোমার ব্যাপারটা মিডিয়ামে থাকলেও আমরা মানিয়ে নিতাম। কিন্তু তোমার কাছে শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি, আমরা মানিয়ে নিতে পারছি না তোমাকে। কষ্ট পেও না, আমার কথাগুলো ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে নিয়ে বুঝার চেষ্টা করো।
রূপসীর চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। সে কোনোমতে ধাধানো কন্ঠে বললো,
“আল্লাহ হাফেজ।”
রূপসী ইমরানের কাছে ফোন দিয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। ইমরানের হাতে চাপ লেগে কল কেটে গেছে! সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে রূপসীর চোখে পানি দেখে সে দ্রুত উঠে দাড়িয়ে কিছু বলতে লাগলে রূপসী থামিয়ে দিলো!
“রূপসী…!”
” ফিরে যান।”
“রূপসী শুনো, জানিনা আপু কি বলেছে! আপুকে আমি বুঝিয়ে বলবো। তুমি শুধু..”
“কে বলেছিলো আপনাকে আসতে। আমি কি বলেছি আপনি আমার কাছে আসেন? কেন এসেছেন!”
ইমরান কিছুটা থমকে গেলো! অত:পর কঠিন গলায় বলল,
“ভালোবাসি তাই এসেছি। ভালোবাসোনা তুমি আমাকে? বলো…?”
রূপসী অশ্রুসিক্ত নয়নে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
“কখনো বলেছি আমি আপনাকে ভালোবাসি?”
“না, বলোনি।”
“তাহলে এতো বেশি বুঝে নিচ্ছেন কেন?”
“আমি বেশি বুঝিনি। যদি ভালো না ই বাসো, চলে যাওয়ার কথা শুনে সেদিন মন খারাপ করে বসে ছিলে কেন? আমি চলে যাওয়ার সময় তোমার চোখে পানি ছিলো কেন? বলো!”
“তেমন কিছুই ছিলো না। আপনার দেখার ভুল ছিলো শুধু। আর কোনোদিন আমার সামনে আসবেন না। আমি আপনার মুখও দেখতে চাই না। আপনার কাছে অনুরোধ, ফিরে যান। দয়া করে আর কিছু বলার চেষ্টা করবেন না আমাকে।”
কথাটা বলে আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে রূপসী দৌড়ে চলে গেলো বাড়ির দিকে। ইমরান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ যেন কেউ তার হৃদয়ে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করেছে। মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই এসব। হঠাৎ করেই কি এমন দুর্বলতা তাকে ঘেরাও করলো, আবার হঠাৎ করেই মুক্ত করে দিতে চাইলো! এমন কেন হচ্ছে তার সাথে! সে তো মুক্ত হতে পারবে না ঘিরে থাকা এই দুর্বলতা থেকে! এদিকে কল কেটে যাওয়ায় বড় আপু বার বার কল করেই যাচ্ছে। কিন্তু ইমরানের সেদিকে খেয়াল নেই! সে এখানে স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে!
রূপসী ইমরানকে এভাবে ফিরিয়ে দিতে পারবে ইমরান তা ভাবতেও পারেনি। কত আশা নিয়ে রূপগঞ্জে আসা, সব ব্যর্থ হয়ে গেল। ইমরানের মনটা আজ এলোমেলো লাগছে। হয়তো সে আজ প্রথম অপমানিত হলো, না হয় আজ প্রথম সে কারো জন্য এতো কষ্ট পেলো।
চায়নি ও চায় না মন
তবুও হয়ে গেছে প্রেম!
বুঝেও বুঝলো না সে
মনে বাধানো রঙিন ফ্রেম!
রঙ যে মুছে গেলো
ভিজে নোনা জলে,
সূচনাতেই কীট জমে
প্রেম গেলো ইতি হয়ে!
এমনটাই কি হওয়ার ছিলো!
ইমরান ফোন অফ করে দিয়েছে। অত:পর হতাশ হয়ে বাসায় ফিরে এসেছে।