“রূপগঞ্জের রূপসী” পর্ব- ৫

0
1157

“রূপগঞ্জের রূপসী”
পর্ব- ৫
(নূর নাফিসা)
উৎসর্গে – Imran Mahmudul
.
.
বাসায় এসে দেখে সুমি আপুর বাসা থেকে মেহমান এসেছে। সুমি আপু, দুলাভাই , আরোশি আর আরোশির দাদা-দাদি। আরোশি নানুর কোলে বসে দুষ্টুমি করছে।
ইমরান আরোশির দাদা-দাদিকে সালাম দিয়ে তার নিজের রুমে চলে গেলো। আগে জানলে সে এখন বাসায় আসতো না৷ কারণ তার এখন একা সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে। মানুষজন সব বিরক্ত লাগছে! কিন্তু চলে এসেছে যেহেতু তাই আর মেহমান বাড়িতে রেখে বেরিয়ে যেতে পারলো না সে!
কিছুক্ষণ পর, মা ও সুমি আপু ইমরানের কাছে এলো। ইমরান খাটে বসে মেঝের দিকে তাকিয়ে মাথা দু’হাতে চেপে রেখেছে। সুমি আপু ও মা পাশে বসলো। ইমরান মাথা তুলে তাকিয়ে বললো,
“তোমরা হঠাৎ এখানে! ভাইয়া, আংকেল, আন্টি চলে গেছে?”
সুমি জবাবে বললো,
“না। একটু পর চলে যাবো। আমরা এসেছি পাবেলের (আরোশীর চাচা) বিয়ের দাওয়াত নিয়ে। ২সপ্তাহ পর ওর বিয়ে।”
“অহ, ভালো।”
“বড় আপু বার বার কল করছে, রিসিভ করছিস না কেন?”
“এমনি।”
সুমি তার মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“মা,আপু তোমাকে কিছু বলেছে?”
“হুম বলেছে।”
ইমরান ব্রু সামান্য কুচকে তাদের কথার ভিত্তিতে বললো,
” কি বলবে বড় আপু?”
সুমি তার জবাব দিলো,
“বড় আপু তোকে আপুর কাছে আমেরিকা চলে যেতে বলেছে। তোকে ফোন করে পায়নি। তাই তোর ভাইয়াকে বলেছে সব ব্যবস্থা করে দিতে।”
ইমরান কিছুটা ক্ষেপে গিয়ে বললো,
“মা, এসব কি বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না! আমার গানের রেকর্ডিং এর কি হবে! তোমরা কিছু বলোনি?”
মিসেস হক জবাব দিলেন,
” আমি বলেছি কয়েকদিন পর যেতে, কিন্তু নীলা বললো এখন যাওয়াটাই ভালো হবে। পাসপোর্ট আছে যেহেতু, তোর তো আর যাওয়া আসায় কোনো সমস্যা নেই।”
মায়ের পরপরই সুমি বললো,
“আমিও বলেছি পাবেলের বিয়ের পর যেতে, আপু বললো দুই তিন দিনের মধ্যে যেতে। আর তোর রেকর্ডিং সেখানে থেকেই হবে।”
“সব কিছুতেই ভালো বুঝো তোমরা। আমার ভাবনাটাই শুধু খারাপ হয়ে যায়। অযথা আমাকে আর জিজ্ঞেস করা কি প্রয়োজন! ওকে, চলে যাবো। বলো ভাইয়াকে সব ব্যবস্থা করতে।”
ইমরান বিরক্তি নিয়ে কথাটা বলে আরোশীকে সাথে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। সব দিক থেকে যন্ত্রণা সহ্য হচ্ছে না কিছুতেই। তাকে বোঝার মতো কি কেউই নেই! এইদিকে তার পরিবার আর ওইদিকে সেই মেয়েটা। অসহ্যকর যন্ত্রণার চাপে ফেলেছে তাকে!
ছয়দিন পর ইমরান চলে যাচ্ছে ইউএসএ। ছোট দুলাভাই পারভেজ ভাইয়া আর মা এসেছিলো এয়ারপোর্টে। এখন প্লেনে আছে সে। হৃদয়ে গভীর শূন্যতা অনুভব করছে! একদিকে পরিবারকে ছেড়ে যাবার বিষন্নতা, আর অন্যদিকে সেই একটা মানুষের নিকৃষ্ট অবহেলা। আসা যাওয়া ব্যাপার না তবে আসবে কোন স্বার্থে? তার পরিবারই তো তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে দূরে! সেই মেয়েটাও তাকে তাড়িয়ে দিলো! একটাবার মুখে আটকালো না তার এভাবে কথা বলতে! বার বার রূপসীর কথাগুলো তীরের মতো ইমরানের মগজে গেথে যায়। ভুলতে পারছে না কিছুতেই। নতুন করে ভাবতেও পারিছে না কিছু! এদিকে প্লেন শূন্যে ভাসছে আর রূপসীর কথাগুলো এখনো মাথায় যন্ত্রণা হয়ে ঘুরছে।
ভাবনার সাথে তার মাথায় হোচট খেলো কিছু একটা! আপুর সাথে কথা বলার পর রূপসী যখন ইমরানের সাথে অপমানজনক কথা বলেছিলো, তখন তাকে সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছিলো! তার আচরণ, কথার ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন! সে এভাবে তো কখনো কথা বলেনি! তার কথাগুলোর মধ্যে আধুনিকতার ছোয়া মিশে ছিলো। তার মানে সে গেয়ো মেয়ে হলেও স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে পারে! যেটা অন্যসময় প্রকাশ পায়নি তার কাছে! গত পাঁচ দিনে তো তার মাঝে এমন কিছু দেখা যায়নি! এর রহস্য কি!
ইমরান হাত মুঠিবদ্ধ করে মুখ সংকুচিত করে মনে মনে নিজের উপর বিরক্ত হয়ে বললো,
“ওফ! মাথা কেন এতো দেড়িতে কাজ করে! যখন কথাগুলো বলছিলো তখন কেন মাথায় ধরা দিলো না!
এখন সেসব মনে করেই বা কি হবে! অনেক লেট করে ফেলেছি! তবে আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দেয়া তোমার উচিত হয়নি রূপসী। নিজেও কষ্ট পেলে, আমাকেও শেষ করে দিলে। তবুও ভালো থেকো তুমি।”
কিন্তু নিজের উপর থেকে রাগটা যে এখন সরাতে পারছে না! রূপসীর উপর অভিমান করে গত ছয়দিনে তাকে নিয়ে সেভাবে ভাবেনি যেভাবে এখন ভাবলো! এতোদিন শুধু অপমানবোধটাই তার মাঝে জাগ্রত ছিলো। আর এখন ভাবলেও তা ব্যর্থ!
অবশেষে মাতৃভূমি ছেড়ে পা রাখলো ইউএসএ। বড় দুলাভাই সুমন ভাইয়া এয়ারপোর্টে এসেছে তাকে নিতে। দেখা হওয়ার পর ইমরান সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো শালাবাবু ।”
” আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ। খুব ভালো আছি। তোমাকে দেখার পর তো আরও অনেক বেশি ভালো হয়ে গেছি।”
“হাউ ফানি! বাসায় যাবো নাকি এখানেই থাকবো!”
“ওহ, শিওর। চলো গাড়িতে বসে কথা বলা যাবে।”
“হুম।”
তারা দুজনই এসে গাড়িতে বসলো। সুমন ভাইয়া ড্রাইভ করতে করতে বললো,
“আরোহী খুবই এক্সাইটেড তুমি আসবে বলে।”
“আমিও খুব মিস করছিলাম ওকে।”
“যাক, তোমার আপু তোমার মিস করার সুযোগ কেড়ে নিয়ে এখানে নিয়ে এলো। আর মিস করবে না।”
ইমরান মৃদু হেসে বললো,
“একজনকে মিস করার সুযোগ কেড়ে নিলেই কি হবে! ওদিকে যে কয়েকজন পড়ে আছে! এখন তো তাদেরও মিস করা শুরু হবে।”
সুমন হেসে বললো,
“হুম! তাহলে সবদিক পূর্ণ করার জন্য সবাইকে আনতে হবে।”
“তবুও কিছু অপূর্ণতা থেকেই যাবে।”
“কি?”
“কিছু না।”
বড় আপুর বাসায় আসতেই আরোহী মামা বলে দৌড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়লো ইমরানের কাছে। ইমরানও কোলে নিয়ে দুষ্টুমিতে মেতে উঠলো। কতদিন পর প্রত্যক্ষ দেখা আরোহীর সাথে।
নীলা আপুর একমাত্র মেয়ে আরোহী। বয়স ৪ বছর। আরোহী, আরোশি দুজনেই মামা বলতে পাগল। ওদিকে সুমি আপুর মেয়ে আরোশির বয়স ১বছর। আর আরোহীর বয়স যখন ২বছর তখন নীলা আপু নিজ দেশ ছেড়ে ইউএসএ আসে।
ইমরানকে দেখে নীলা জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছিস?”
ইমরান মুখে তাচ্ছিল্যের হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
“আমার মতো ভালো আর কে থাকবে! কেমন আছো তুমি?”
“জোর দিয়ে কথা বলতে শিখে গেছিস খুব!”
ইমরান দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো বড় আপু থেকে। নীলা আবার বললো,
“ভালো আছি আমি। ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়। আরোহী, এসো আমার সাথে। মামা ফ্রেশ হবে।”
আরোহী তার মায়ের সাথে চলে গেলো।
ইমরান ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ফ্লাইটে ঘুম হয়নি তার। চোখে প্রচুর ঘুম জড়ো হয়েছে। তাই বিকেলে ঘুমিয়েছে আর পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙেছে। রাতে আর খাইনি। আপু ডেকেছিলো, ঘুমের ঘোরে কি বলেছে তার জানা নেই। গত তিন সপ্তাহে এমন ঘুম আর হয়নি তার। ভালো ঘুম হওয়াতে নিজেকে খুব ফ্রেশ লাগছে আজ। বাইরে স্নো পড়ছে। ঘরের ভেতরে ঠান্ডা তেমন লাগছে না, তবে বাইরে অনেক ঠান্ডা হবে। কিচেনে আপুর কাছ থেকে এক কাপ কফি নিয়ে আবার নিজের রুমে এসে স্নো পড়া দেখছে ইমরান। যেন হাত বাড়ালেই ধরতে পারবে। মাঝখানে শুধু একটা কাচের আবরণ। বাইরের পরিবেশটা খুব সুন্দর লাগছে। খুব রোমান্টিক ওয়েদার। শুধু সেই মানুষটা সাথে নেই। মনে পড়ে গেলো রূপসীর সাথে কাটানো সকালের সময়। শিশির ভেজা ঘাসের উপর খালি পায়ে হাটার অনুভূতি। ঠান্ডা সকালে মিষ্টি খেজুরের রস খাওয়ার মজা। একদমে মিষ্টি ডাবের পানি সাথে নলি খাওয়ার স্বাদ! ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে ইমরান!
“খালি কাপে আর কত চুমুক দিবে?”
সুমন ভাইয়ার কথায় তার ভাবনার ছেদ ঘটলো। সে পাশ ফিরে বললো,
“হুম? কিছু বলেছেন, ভাইয়া?”
” হুম, জানতে চাইলাম খালি কাপে আর কত চুমুক দিবে?”
ইমরান কাপের দিকে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই কাপ খালি! সে এটাতেই চুমুক দিয়ে যাচ্ছে এতোক্ষণ যাবত! সুমন তার পাশে এসে দাড়িয়ে বললো,
” কি ভাবছিলে এতো?”
“কিছু না, স্নো পড়া দেখছি।”
“খুব রোমান্টিক ওয়েদার। তাই না?”
ইমরান মৃদু হেসে জবাব দিলো,
“হুম।”
সুমন আবার বললো,
“শুধু মানুষটা কাছে নেই!”
ইমরান তার প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে আবার বাইরের দিকে তাকালো। সুমনও বাইরে তাকিয়ে বললো,
“আর আমার মানুষ কাছে থেকেও নেই! কিচেনে পড়ে থাকে সারাক্ষণ!”
ইমরান শব্দ করে হাসলো তার কথায়। সুমন তাকে প্রস্তাব করলো,
“চলো বাইরে যাই। অনেক ভালো লাগবে। মানুষ গুলো তো আর সাথে নেই। আমরা নিজেরাই উপভোগ করি সৌন্দর্যটা কে। কি বলো?”
“অফিসে যাবেন না?”
” তিন দিনের ছুটি আছে। একদিন কাটিয়েছি, এখনো দুইদিন বাকি আছে।”
“ওকে। চলুন তাহলে যাই।”
শুধু চেহারাটা বাকি রেখে শীতের কাপড়ে পুরো প্যাকেট হয়ে গেলো তারা শালা আর দুলাভাই। যেই বাইরে বের হবে তখনি বাধলো বিপত্তি! আরোহী সাথে যাওয়ার জন্য পিছু নিলো!
“আমি যাবো। আমি যাবো!”
সুমন তাকে আটকাতে বললো,
“বাবা, বাইরে অনেক ঠান্ডা। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
“না, আমি যাবো। তোমরা যাচ্ছো কেন?”
ইমরান বললো,
“আমরা তো বড়। ছোটরা গেলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
“না! আম্মু বলেছে আমি বড় হয়ে গেছি। এজন্যই তো আমি নিজের হাতে খেতে পারি।
নীলা চোখ পাকিয়ে বললো,
“আরোহী! বাইরে যাওয়ার জন্য তুমি বড় হওনি। আম্মুর কাছে আসো।”
“না। আমি যাবো।”
ইমরান তার উদ্দেশ্যে বললো,
“মামনি, তুমি মামার কথা শুনবে না? তাহলে কিন্তু মামা বাংলাদেশে চলে যাবে। চলে যাবো?”
আরোহী মাথা ঝাকিয়ে না করলো।
“তাহলে এখন গুড গার্ল হয়ে আম্মুর কাছে যাও।”
“ওকে। জেলিপপ আনবে।”
“ওকে।”
আরোহীকে রেখে ভাইয়ার সাথে বাইরে বের হলো ইমরান। অনেক্ক্ষণ বাইরে কাটালো তারা। রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট শেষ করলো। এর মাঝে ফোনে মা এর সাথে কথাও বলেছে ইমরান। বেশ কিছু জায়গায় বেড়ালো তারা। অত:পর দুপুরে জেলিপপ নিয়ে বাসায় ফিরে এলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here