“রূপগঞ্জের রূপসী” পর্ব- ৬

0
1237

“রূপগঞ্জের রূপসী”
পর্ব- ৬
(নূর নাফিসা)
উৎসর্গে – Imran Mahmudul
.
.
আরোহী জেলিপপ নিয়ে খুশিতে লাফাচ্ছে। ইমরান তার হাত ধরে বললো,
“চলো, আরোশির সাথে কথা বলবো।”
“ওকে।”
সুমি আপুকে ভিডিও কল দিয়ে আপু ও আরোশির সাথে আরোহী আর ইমরান কথা বললো। আরোশিও অনেক কথা বললো তাদের সাথে, কিন্তু আরোশির ভাষা বুঝতে তারা অক্ষম!
রাতে ইমরান রুমে বসে আছে চুপচাপ। নিলা এসে বললো,
” কি ভাবছিস?”
ইমরান ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এসে বললো,
“কিছু না।”
“কেমন চুপচাপ হয়ে গেছিস! আমার সাথে কথা বলতেও যেন তোর বাধে! ইমরান তোর জীবন মাত্র শুরু। এই সাতাশ বছরেই জীবনটাকে থামিয়ে দিস না।”
“থামিয়ে দিলাম কোথায়! আমি চাইলেই কি জীবন থেমে যাবে! জীবন থামানোর সাধ্য কি আমার আছে? সৃষ্টিকর্তা সব চলমানই রেখেছেন।”
“এখন আমার সোজা কথাতেও তুই বাক নিবি সেটা আমি বেশ ভালো জানি। ওই মেয়ের জন্য সবসময় এমন বিষন্ন থেকে কি লাভ। সবার সাথে সবাইকে মানায় না। ম্যাচুরিটি বলেও কিছু আছে। তুই যেটাকে ভালোবাসা ভাবছিস, সেটা ভালোবাসা না। সেটা ভালোলাগা। ওসব বিষন্নতায় ডুবে না থেকে লাইফটাকে এনজয় কর।”
“আপু বাদ দাও তো। ভালো লাগছে না এসব শুনতে।”
“হুম, আমিও চাইছি বাদ দে এসব ভাবনা। কাল তোর ভাইয়ার সাথে স্টুডিওতে যাবি। এখানে থেকেই যা করার করবি। এখন চল ডিনার করবি।”
পরের দিন বিকেলে ভাইয়াকে নিয়ে মিউজিক স্টুডিওতে যায় ইমরান। মিউজিক স্টার্ট করবে সে এখানে থেকেই। ভাইয়া নাকি আগেই সব ঠিক করে রেখেছে আপুর কথায়।
স্টুডিওর লোকজনদের সাথে কথা বললো, যারা উপস্থিত ছিলো তারা ইমরানের সাথে পরিচিত হলো। একটু পর ইমরানকে রেখে সুমন কোথায় যেন গেলো। ইমরান ছোট ছোট কদম ফেলে আশপাশ দেখছে। কয়েকজন আর্টিস্টও আছে এখানে। হঠাৎই একটি মেয়ে এগিয়ে এলো ইমরানকে দেখে। বয়স বিশ-একুশ হবে হয়তো। হ্যান্ডশেক এর জন্য হাত বারিয়ে দিয়ে মেয়েটি বললো,
“হাই, আ’ম নেহা।”
ইমরান হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বললো,
“ওহ! আ’ম ইমরান মাহমুদুল।”
“ফ্রম বাংলাদেশ?”
“ইয়াহ।”
“আ’ম অলসো বাংলাদেশী। বাট, আই স্টে হেয়ার ফ্রম মাই চাইল্ডহুড।”
“গুড।”
হঠাৎই সুমন ফিরে এলো এবং বললো,
” ওহ! নেহা তুমি এখানে! তোমাকেই খুজতে গিয়েছিলাম। ইমরান ও হচ্ছে নেহা। আমাদের ফ্ল্যাট এর পাশেই ওদের ফ্ল্যাট। ও এখানকার আর্টিস্ট। আর নেহা, ও হচ্ছে….”
“আপনার আগেই পরিচিত হয়ে গেছি ভাইয়া।”
“তাই নাকি! চিনলে কিভাবে?”
“যে বাংলাদেশ চিনে, আশা করি সে ইমরানকেও চিনবে।”

ইমরান নেহার উদ্দেশ্যে বললো,
“এখানকার অনেক আর্টিস্ট আমি চিনি। কিন্তু আপনাকে প্রথম দেখলাম।”
নেহা মৃদু হেসে জবাব দিলো,
“আমি আপনার মতো এতো ফেমাস নই। এক বছর হলো আমি অফিসিয়ালি স্টার্ট করেছি।”
“অহ!”
তারপর আরো অনেক কথাই হলো নেহার সাথে। মিউজিসিয়ানদের সাথেও। অত:পর ইমরান বাসায় ফিরে এলো ভাইয়ার সাথে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট এর জন্য গেলে ইমরান নেহাকে আপুর সাথে গল্প করতে দেখতে পেল। দেখেই বুঝা যাচ্ছে আপুর সাথে অনেক ফ্রি। ইমরানও এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লো।
নেহা ইমরানকে দেখে সামান্য উত্তেজনার সাথে বললো,
“হেই, ইমরান! গুড মর্নিং।”
ইমরান কুশলাদি জানাতে ঠোঁটের কোনে সামান্য হাসি ফুটিয়ে বললো,
” মর্নিং।”
“আপনি তো আমার চেয়ে অনেক বড়। ভাইয়া বলে ডাকবো? নাকি, নাম ধরে ডাকবো?”
“যেমনটা ইচ্ছা।”
“আমার ইচ্ছে নাম ধরে ডাকবো।”
“ওকে। আপু, ভাইয়া কোথায়?”
নীলা জবাব দিলো,
” অফিসে চলে গেছে।”
“আরোহী?”
“ঘুমাচ্ছে।”
ইমরান গ্লাসে পানি নিয়ে পান করলো। নীলা খাবার এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
“ইমরান, আজ বিকেলে আমরা বেলী টাওয়ারে যাবো ঘুরতে। তোর ভাইয়া অফিস থেকে আমাদের সাথে জয়েন করবে।”
“ওকে।”
ব্রেকফাস্ট শেষে নেহার সাথে স্টুডিওতে গেলো ইমরান। প্রথম গানটা ওর সাথেই শুরু করবে সে। তার দক্ষতা দেখার জন্যই এখন স্টুডিওতে আসা। লিরিক কনফার্ম করে দিলো ইমরান। নেহার কণ্ঠে গান শুনার পর তার মনে হলো ভালোই গাইতে পারে মেয়েটা। দুই ঘন্টা যাবত তার ও নেহার প্রাক্টিস চললো। এবার বেরিয়ে এলো তারা। স্টুডিও থেকে বের হতেই নেহা জিজ্ঞেস করলো,
“এখন বাসায় চলে যাবেন?”
“হুম। কেন?”
“বাসায় জরুরি কাজ আছে?”
“না, তেমন কিছু না।”
“তাহলে লেকের পাশে হাটা যাক। সামনেই একটা লেক আছে।”
ইমরান কয়েক সেকেন্ড ভাবার পর জবাব দিলো,
“ওকে।”
ইমরান ও নেহা লেকের পাশে হাটছে, আর একটু-আধটু কথা বলছে। ইমরান আগের চেয়ে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। কোনোভাবেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারছে না সে। বারবার তার মাঝে রূপসী নামক একটা যন্ত্রণা এসে হানা দেয়! খুবই অদ্ভুত একটা ব্যাপার! মাত্র পাঁচ দিনের পরিচয়ে হাজারটা অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছে ইমরান! অনুভূতি গুলো কখনো প্রশান্তির সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আবার কখনো নর্দমায় ডুবিয়ে দেয়! নিষ্কাশনও চলে তবে তার মুক্তি মিলে না! ইমরানকে এমন চুপচাপ হাটতে দেখে নেহা নিজ থেকেই বারবার কথা তুলছে। যেমনটা এখনো তুললো,
“আমার গান কেমন হলো? মানে, কেমন গাইলাম আমি।”
“ভালো।”
“তাহলে, প্রথম গানটা আমার সাথে শুরু করা যাবে?”
ইমরান মৃদু হেসে বললো,
“হুম, যায়।”
“আচ্ছা, আমরা একে অপরকে তুমি করে বলতে পারি না?”
ইমরান জবাব না দিয়ে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে শুধু তাকালো তার দিকে। আর নেহা তার দৃষ্টি দেখেই বলে উঠলো,
“আমরা তো একসাথে কাজ করবো, সবসময় আপনি করে বলতে আমি আনইজি ফিল করি। তাই বলছিলাম…”
নেহাকে এমন ইতস্তত বোধ করতে দেখে ইমরান হাসির সাথে ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
“নিশ্চয়ই বলতে পারেন।”
ইমরান আপনি সম্বোধন করায় নেহা বললো,
“এইযে, পারছো না তুমি।”
ইমরান এবার শব্দ করে হেসে বললো,
” ওকে, চেষ্টা করবো।”
“ওকে।”
নেহা এবার মিষ্টি করে হাসলো। আরও কিছুক্ষণ হেটে তারা বাসায় চলে এলো।
বিকেলে নীলা আপু, নেহা , আরোহী ও ইমরান বেলী টাওয়ারে এলো। কিছুক্ষণ পর সুমন ভাইয়াও এসেছে। একসাথে ঘুরলো, শপিং করলো, তারপর রেস্টুরেন্টে ডিনার করে বাসার দিকে রওনা দিলো। ভাইয়া গাড়ি ড্রাইভ করছে, আপু ভাইয়ার পাশেই বসা। নেহা আর ইমরান পেছনে। আরোহী নেহার কোলে বসে আছে। এমন সময় সুমি আপু ভিডিও কল করলো ইমরানের ফোনে। ইমরান রিসিভ করে বললো,
“কেমন আছো আপু?”
অপর পাশ থেকে সুমি জবাব দিলো,
“এইতো ভালো। তোরা কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“গাড়িতে আছিস মনে হচ্ছে!”
“হুম, শপিং করে বাসায় যাচ্ছি।”
“ওহ! আমরা ও আজ পাবেলের বিয়ের শপিং এ যাবো।”
“ওহ! আরোশি কোথায়?”
“এখানেই।”
সুমি আপু আরোশিকে সামনে আনলো। ইমরান একটু কথা বলার পর নীলা ফোন সামনে নিয়ে কথা বললো। এদিকে আরোহী চিৎকার শুরু করেছে আরোশির সাথে কথা বলার জন্য। তারপর আরোহী ফোন নিয়ে নিলো। কিছুক্ষণ কথাবার্তা ও দুষ্টুমি করে কল কেটে দিলো। নেহার কোলে থাকা আরোহী ইমরানের ফোনের স্ক্রিনে টাচ করতে করতে বললো,
“নেহা আন্টি….”
“হুম?”
“নানু, আরোশির পিক দেখবে?”
“হুম, দেখাও।”
এবার আরোহী ফোনের গ্যালারিতে ছবি দেখা শুরু করলো। নেহাও দেখছে আর আরোহী নিজেই ছবি নিয়ে কথা বলছে। কিছুক্ষণ পর নেহা প্রশ্ন করলো,
“এটা কে?”
আরোহী জবাব দিলো,
“চিনি না! মামা, এটা কে?”
আরোহীর ডাকে ইমরান স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো রূপসীর ছবি! সে ফোন নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে বললো,
“কেউ না। ফোন দাও আরোহী।”
“না, বলো এটা কে?”
“চিনবে না তুমি। ফোন দাও। মামার কাজ আছে।”
আরোহী চেহারায় কিছুটা বিষন্নতা এনে বললো,
“ওকে।”
ইমরান ফোন নিয়ে লক করে পকেটে রেখে দিলো। অত:পর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো।
রাত,
তবুও অন্ধকার না।
নেই চাঁদ,
তবুও আলোকিত হয়ে যা!
ল্যাম্পপোস্ট,
সে তো স্থির দাঁড়িয়ে আছে কৃত্রিম আলো ছড়িয়ে!
দৃষ্টি,
সে যে অনুভূতিহীন হয়ে পড়লো, অন্ধকার নেই বলে!
বাসার সামনে গাড়ি থামলে, নামার সময় ইমরান লক্ষ্য করলো আরোহী ঘুমিয়ে পড়েছে নেহার কোলে। নেহার কাছ থেকে আরোহী কে নিয়ে ফ্ল্যাট এ প্রবেশ করলো ইমরান।
আপুর রুমে আরোহীকে রেখে সে নিজের রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে আবার রূপসীর ছবিগুলো দেখতে লাগলো। এটা তার নিয়মিত অভ্যাস হয়ে দাড়িয়েছে। ছবিগুলো দেখলে তার হাসতে ইচ্ছে করে কাদতেও ইচ্ছে করে। কিন্তু কোনটাই বাস্তবায়ন করে না সে, শুধু সেই মুহুর্তগুলো অনুভব করার চেষ্টা করে। হয়তো এজন্যই পারছে না স্বাভাবিক হতে! প্রতিটা দিন শুরু ও শেষ হয় রূপসীর ছবি দেখে। দিন শেষে রাত নেমে এলে ফোনটা বুকের উপর রেখে কিংবা বিছানায় হাতের তালুর নিচে রেখে এই কথাটা বলতেও তার কখনো মিস হয় না,
“শুভ রাত্রি, রূপসী।”
.
“স্বল্প কয়েক দিনেই নেহার সাথে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ইমরানের। সাথে স্টুডিওর আরো অনেকের সাথেই ভাব জমেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন রাফসান। রাফসান একজন আর্টিস্ট। ও নেহার বন্ধু, কিন্তু মিউজিক লাইফে সে নেহার আগেই এসেছে। তিনজনের মধ্যে খুবই ভালো বন্ধুত্ব হওয়ায় সবসময় একসাথে ঘুরাফেরা, পার্টি এরেঞ্জমেন্ট, শপিং, আড্ডা, একসাথে গান সবই বেশ ভালো জমেছে।
এভাবেই কেটে গেছে তিনটি বছর। এরমাঝে প্রতিদিনই মা, ছোট আপুর সাথে কথা হয়েছে। বাংলাদেশের বন্ধুবান্ধবদের সাথেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্পর্ক বজায় রেখেছে ইমরান।
একদিন সন্ধ্যায় আরোহীকে নিলা পড়াচ্ছে, আর ইমরান পাশে বসেই ফেসবুকে নিউজফিডে ঘুরছে। এমন সময় নেহা কল করলো। ইমরান রিসিভ করতেই নেহা বললো,
“ইমরান, তুমি কি ফ্রি আছো?”
“কেন?”
“তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো। যদি একটু ফাইভ স্টারে আসতে..”
“এখন!”
“হুম।”
“কি কথা, সেটা ফোনে বলা যায় না?”
“কেন? তুমি বিজি?”
“না।”
“তাহলে?”
“আচ্ছা আসছি।”
ইমরান খাট ছেড়ে নেমে যাওয়ার সময় নীলা বললো,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
ইমরান পেছনে ফিরে বললো,
“নেহা কল করলো, কি যেন প্রয়োজন।”
“আচ্ছা যা।”
ইমরান ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই দেখলো নেহা রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছে। অত:পর নেহার সাথে ফাইভ স্টারে এলো। ফাঁকা একটা টেবিলে দুজনে মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। নেহা একটু আশেপাশে তাকালো আর ইমরান বললো,
“বলো, কি বলবে?”
নেহা ইতস্তত বোধ করে বললো,
” ইমরান, অনেক দিন ধরেই তোমাকে বলতে চাচ্ছি। কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠছে না। আর কখনো সুযোগ পেয়েও বলতে পারছি না।”
ইমরান কিছুটা কনফিউজড হয়ে বললো,
“এমন নার্ভাস কেন তুমি! বলে ফেলো কি বলবে।”
“আমি তোমার কাছে কেমন মেয়ে? মানে, আমার আচার-আচরণ, চলাফেরা তোমার কাছে কেমন মনে হয়?”
ইমরান কয়েক সেকেন্ড নেহার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে, তারপর বললো,
“আই থিংক, তুমি খুবই ভালো, ভদ্র একটি মেয়ে। আধুনিক যুগের সাথে মানিয়ে চলো, যথেষ্ট স্মার্ট। আর্টিস্ট হিসেবেও অনেক ভালো। সবদিক থেকেই পারফেক্ট।”
“ডু ইউ লাইক মি?”
“হুম, যে কেউ তোমার আচার-আচরণে তোমাকে পছন্দ করবে।”
“আই হোপ, ইউ ডন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট আই স্যা! ইমরান, আই লাভ ইউ। ডু ইউ লাভ মি?”
ইমরান মোটেও অবাক হয়নি নেহার কথায়। সে ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটিয়ে দৃষ্টি টেবিলের দিকে রাখলো। নেহা তার জবাবের আশায় পলকহীন তাকিয়ে আছে। তার ভেতরটায় ধুকপুক করছে ইমরান কি জবাব দিবে সেটা ভেবে! নেহা জিজ্ঞেস করার প্রায় এক মিনিট পর ইমরান এক আঙুল দ্বারা টেবিলে আঁকিবুঁকি করতে করতে বললো,
“নেহা, আমি জানি এটাই তোমার মেইন পয়েন্ট ছিলো। তোমার সাথে চলে আমি অনেক আগেই এটা বুঝে গেছি তুমি আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু আমি তোমাকে শুধুমাত্র একজন ভালো বন্ধু হিসেবেই দেখেছি সবসময়। এর বেশি কখনো ভাবিনি, আর না কখনো ভাবতে পারবো! সরি, তোমাকে ভালোবাসা কখনো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ইউ ক্যান ফরগেট মি।”
এমনিতেই ধুকপুক করছে আত্মা আর এখন ইমরানের কথা শুনে নেহার চোখে পানি এসে পড়েছে! ব্যথাটা গিয়ে হৃদপিণ্ডে লেগেছে। কিন্তু সে পরিষ্কার গলায় বলল,
“কেন সম্ভব নয় ইমরান? মানুষ চাইলেই সব সম্ভব করতে পারে। এটাতো তোমার সাধ্যের বাইরে নয়। তাহলে কেন সম্ভব নয়?”
টেবিল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইমরান নেহার দিকে তাকাতেই দেখলো তার চোখে পানি। সে সাথে সাথেই দৃষ্টি আবার টেবিলে নামিয়ে ফেললো। কারণ একমাত্র রূপসীর অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে সে বুকের বাঁ পাশে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করেছিলো। দ্বিতীয় বার কোনো মেয়ের চোখ যেন বুকে চিনচিন ব্যাথা না উঠায় সেজন্য সে দৃষ্টি সংযত করে নামিয়ে বললো,
” মেয়েদের চোখের পানি আমার সহ্য হয় না। নেহা, চোখ মুছো আগে। তারপর বলছি তার কারণ।”
ইমরানের কথায় নেহা চোখ মুছার চেষ্টা করছে, কিন্তু পানি সরছে না। মুছে নিলেই যেন আবার ঝাপসা হয়ে আসে। এবার নেহা উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ইমরান টেবিলের উপর দুহাত মুঠিবদ্ধ করে টেবিলে একদৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর নেহা চোখেমুখে পানি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে চেয়ারে বসলো। এবং পরিষ্কার গলায় বললো,
“বলো এবার…”
ইমরান পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে রূপসীর ছবি বের করে ফোনটা নেহার দিকে এগিয়ে দিলো। নেহা ফোন হাতে নিয়ে ছবিটি দেখে তার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো। এবার ইমরান বলতে শুরু করলো,
“ভালোবেসেছিলাম তাকে আমি তিন বছর আগে। সে-ও হয়তো আমাকে ভালোবাসতো, কিন্তু বলেনি কখনো আর কোনোভাবে বুঝতেও দেয়নি। তবে যেদিন আমি নিজের অনুভূতিগুলো মুখে প্রকাশ করতে এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিলাম, কোনো কারণে সেদিন সে আমাকে আরও দুইধাপ পিছনে ঠেলে দিয়েছে। সেই কোনো এক জানা-অজানা কারনে আমি আমেরিকা চলে আসি। চলে আসি বললে ভুল হবে, আসতে বাধ্য হয়েছি। সকল পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে। এখানে এসে নিজেকে সবকিছু দিয়ে ব্যস্ত রেখেছি কিন্তু গত তিন বছরে এক মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি তাকে। আমার প্রতিটি দিন শুরু ও শেষ হয় তাকে নিয়ে। পরিচয় আমাদের খুবই অল্প দিনের ছিলো। কিন্তু সেই পরিচিতি বোধহয় যুগের পর যুগ শেষ হলেও তার অন্ত ঘটবে না। এখনো তার জন্য আমার অনুভূতি গুলো হাসে আবার কাদেও। এটাই ছিলো কারণ। আ’ম সরি।”
নেহা খুব মনযোগ দিয়ে শুনছিলো। এবার ইমরান থামতেই সে জিজ্ঞেস করলো,
“ইমরান, সে কি এখনো তোমার অপেক্ষায় আছে?”
“অবশ্যই না। সেদিন ফিরিয়ে না দিলে ভেবে নিতাম এখনো অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এমন ভাবনার কোনো দিক সে আমার জন্য উন্মুক্ত রাখেনি।”
“তাহলে তুমি কেন তার অপেক্ষায় আছো?”
“আমি কখন বললাম যে আমি তার অপেক্ষায় আছি!”
নেহা কিছুটা বিরক্তিকর ভাবে বললো,
“আশ্চর্য! তাহলে আমাকে রিজেক্ট করা, তার ছবি দেখানো আর এসব শুনানোর মানে কি!”
“এসব শুনানোর মানে হচ্ছে, আমি একজনকেই ভালোবেসেছি, আর কখনো কাউকে তার জায়গায় বসাতে পারবো না। তাছাড়া আমার মাঝে ভালোবাসার এমন নতুন কোনো জায়গাও সৃষ্টি করতে পারবো না। তুমি যদি বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখতে চাও তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু এর বেশি কিছু প্রত্যাশা করো না। করলেও সেটা আমার জন্য অসম্ভব। আশা করি সবটা তুমি বুঝতে পেরেছো। আমি এখন বাসায় যেতে চাচ্ছি।”
ইমরানের এ ধরনের কথাবার্তায় নেহা রেগে উঠে দাড়ালো এবং তাকে রেখেই দ্রুত উঠে চলে গেলো ফাইভ স্টার হোটেল থেকে। দু’মিনিট চুপচাপ বসে থেকে একটা কোকা কোলা নিয়ে ইমরানও বেরিয়ে এলো এবং বাসায় ফিরে এলো।
তিন দিন কেটে গেছে, এর মাঝে নেহা আর দেখাও করেনি, কথাও বলেনি। হয়তো মেয়েটা ইমরানের কথায় কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু কষ্ট পেলেও তার কিছুই করার নেই। এই তিনদিন সে রাফসানের সাথে ঘুরেছে, আড্ডা জমিয়েছে। রাফসান চেষ্টা করেছে নেহাকে সাথে নিতে কিন্তু নেহা আসেনি।
সকালে ব্রেকফাস্ট শেষে আরোহীর সাথে দুষ্টুমি করছে ইমরান। আজ আরোহীর স্কুল অফ। আপু রুমে এসে বললো,
“ইমরান তোর সাথে কিছু কথা আছে।”
” হুম বলো।”
“নেহাকে তোর কেমন লাগে?”
ইমরান এক পলক আপুর দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনযোগ দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললো,
” আপু, তুমি যা ইংগিত করছো তা কখনো সম্ভব না।”
“কেন সম্ভব না? ও তোকে অনেক ভালোবাসে। তোর সাথে মানাবেও ভালো।”
“কিন্তু আমি মানিয়ে নিতে পারবো না। আর আগামী সপ্তাহেই তো বাংলাদেশ ফিরছি, এখন এসব বলছো কেন!”
“হুম, তুই মত দিলে আমি বাংলাদেশে যাওয়ার আগে নেহার বাবা-মা এর সাথে কথা বলবো।”
“দিচ্ছি না মত। আমি বাংলাদেশ থেকে আর ইউএসএ ফিরছিও না। সেখানেই থাকবো।”
এবার নীলা কিছুটা রেগে গিয়ে বললো,
“ঠিক আছে, তুই বাংলাদেশেই থাকিস। কিন্তু সেখানে গিয়েই বিয়ে করবি। সুমি ছবি পাঠিয়েছিলো পাবেলের শালীর। মেয়ে মেডিকেলে পড়ছে। সুমি, মা সবারই পছন্দ, আমারও পছন্দ হয়েছে। আমি আজই বলবো যেন সুমি কথা বলে তাদের সাথে। তোর পছন্দের আশায় আর বসে থাকছি না। অনেক হয়েছে তোর পছন্দ আর অপছন্দ দেখা।”
কথা বলেই নীলা বসা থেকে উঠে হনহন করে চলে গেলো। ইমরান মাথা ভর্তি যন্ত্রণা নিয়ে মেজাজী গলায় বললো,
“ওফ! কি শুরু করেছো তোমরা সবাই! একজন এদিকে, আর একজন সেদিকে! শান্তি পাবো কোথায় আমি!”
এমন সময় নেহা কল করলো। একটু অবাক ই হলো ইমরান। কারণ তিনদিনে আর কথা হয়নি বলে সে ভেবেছে আর কখনো হয়তো কথা হবে না তাদের মাঝে। কিন্তু নেহা নিজ থেকেই কল করলো আজ! ইমরান রিসিভ করে বললো,
“কেমন আছো?”
“হুম ভালো। এই, ইমরান তুই কোথায় আছিস রে?”
নেহার কথায় আজ ইমরান বিস্মিত! হঠাৎ তার এমন আচরণ দেখে চমকে গেছে সে। তাই আবার স্কিনে নামটা ভালো করে দেখে নিলো। হুম নেহা ই তো! ইমরান জবাবে বললো,
“মানে?”
কথা বুঝতে পারছিস না? নেটওয়ার্কে প্রব্লেম?”
“না।”
“কোথায় আছিস? বাসায়?”
“হুম!”
“ওকে, থাক তুই। আমি আসছি।”
“হেই, ওয়েট ওয়েট! তুমি হঠাৎ এভাবে কথা বলছো কেন?”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here