রেইনকোট আরোহী
পর্ব- ১
(নূর নাফিসা)
.
.
ঝপঝপে বৃষ্টির শুরু বিকেলের সূচনা থেকে। এখন পড়ন্ত বিকেল। প্রায় আধ ঘন্টা যাবত স্টার লাইন বাস কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সৈয়দ আবরার। পরনে রেইনকোট। মাঝে মাঝে ঘড়িতে সময় দেখছে। আবার মাঝে মাঝেই দেখছে বৃষ্টিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা দূরতর পথঘাট। যেন বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। অথচ কোনো বাসেই সে চড়ছে না। যেন তার প্রত্যাশিত বাসটা আসছে না! দুএকজনের নজরে পড়লেও কেউই নজর স্থির রেখে বসে নেই তার দিকে। যার যার কাজের তাড়নায় সে ছুটছে। কিছু লোক বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে যাত্রী ছাউনির নিচে। মাথার উপর ছাতা ধরে কিংবা পলিব্যাগের নিচে মাথাটুকু আশ্রিত করে কেউ কেউ ছুটে গিয়ে কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করছে। বাস থামছে তো বৃষ্টিতে ভিজেই দৌড়ে উঠে পড়ছে৷ আবার পর্যাপ্ত সিটের অভাবে উঠতে না পেরে কেউ কেউ ফিরে এসে দাঁড়াচ্ছে ছাউনিতে। ছাউনির ভিড় কিছুটা কমলে আবরাব এসে দাঁড়িয়েছে ছাউনির নিচে। তার চোখে চশমা পরা, মুখে মাস্ক। বেশে গড়নে দেখতেও ভদ্রলোক। সে একপাশে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে বাটন সেটের ফোনটা বের করলেন। ফোন সাইলেন্ট অবস্থায় রাখা আছে। কেউ ফোন করেছে কি না, নিশ্চিত হতে চেক করে নিলেন। একটু টিপেটুপে পুনরায় রেখে দিলেন পকেটে। ছাউনিতে এখন খুবই কম মানুষ। আবরারের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একজন ষাটোর্ধ বৃদ্ধ, তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ছয়-সাত বছর বয়সী বাচ্চা সাথে নিয়ে বাচ্চার বাবা-মা, এবং তার পরেই বেঞ্চিতে বসে আছে এক বোরকা পরা মহিলা। বড়সড় এক ব্যাগ নিয়ে সাবধানেই আরাম করে বসে আছেন বৃষ্টি শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। বৃদ্ধ লোকটি আবরারকে জিজ্ঞেস করলেন,
“বাড়ি কই বাবা?”
“জ্বি চাচা, এদিকেই।”
“যাবা কই?”
“কোথাও যাবো না। কারো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি।”
“ও, আচ্ছা।”
“আপনার বাসা কোথায়?”
“এই যে, পেছনের রাস্তায়ই।”
“আপনি কোথায় যাবেন?”
“চায়ের দোকানে।”
“এই বৃষ্টির মধ্যেও দোকানে এসে চা খেতে হবে? বাসায় ব্যবস্থা নেই?”
“দোকানের চায়ে স্বাদ বেশি। না খাইলে বুঝবা না।”
ফিসফিস করে বললেন বৃদ্ধ। আবরার মৃদু হেসে বললো,
“হুম। দোকানের চায়ের সাথে আড্ডা মেশানো থাকে। এটার মজা অন্যরকমই হয়। বাসায় তো আর আড্ডা গেলার সুযোগ নেই।”
“ধুর! এমনিতেই মজা বেশি।”
“এখন যে এক কাপ চায়ের জন্য আধ ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছেন, সেটা তো আরও বেশি মজা। তাই না?”
“কেডায় জানতো, এমন খাড়া নামবো!”
“বৃষ্টির দিন, সাথে ছাতা রাখা প্রয়োজন ছিলো। আকাশ তো সারাদিনই মেঘলা।”
“ভাবতাছি তোমার মতো একটা কোটই কিনা দিতে কমু। ছাতা আবার ধইরা রাখবো কেডা! আমার হাত বিষ হইয়া যায় ছাতা ধরতে গেলে।”
হেটে হেটে চায়ের দোকানে আসতে পা ব্যাথা হয় না, অথচ ছাতা ধরতে হাত ব্যাথা হয়ে যায়! চায়ের আড্ডার প্রগাঢ় নেশায় আসক্ত লোকের চায়ের কাপ দীর্ঘসময় মুখের সামনে তুলে রাখার শক্তিটুকুও আবার ঠিকই বজায় থাকে হাতে। আবরার আর প্রত্যুত্তর করলো না। বৃদ্ধর কথায় নিশ্বাসে কিঞ্চিৎ হেসে পূর্বাবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলো। বৃষ্টি অনেকটাই কমে এসেছে। আবরার শুধু ঘড়িতে সময় দেখছে। এরই মধ্যে একটা বাস থামলে বাসের হেল্পার সিগনাল দিলো ছাউনির দিকে। ভেতরে সিট ফাঁকা আছে। বাচ্চাসহ সেই দম্পতি ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে ছুটে গেলো। চারজন নামতেই তারা উঠে গেলো বাসে। নেমে যাওয়া চারজন যাত্রীর মধ্যে দুজন এসে দাঁড়ালো ছাউনিতে৷ বাকি দুজন চলে গেলো অন্যান্যদিকে। বৃদ্ধ উঁকিঝুঁকি মেরে আকাশ দেখলো। বৃষ্টির গতি দেখে আবরারকে বললো,
“এই বৃষ্টির মাঝে এইটুকু তো যাইতেই পারমু। কি কও?”
“একটু তো ভিজবেনই। সমস্যা নেই। গরম চায়ের তাপে শুকিয়ে যাবেন।”
“ধুর, যাইগা।”
বৃদ্ধ বেরিয়ে গেলো ছাউনি থেকে। আবরারের মুখের প্রত্যুত্তর রসাত্মক থাকলেও সে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে রইলো। নেমে আসা যাত্রী দুজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। এরই মধ্যে বোরকা পরা সেই মহিলা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ব্যাগটা হাতে নিয়ে ছাউনির বাইরের পরিবেশটা দেখলেন। তারপর বেরিয়ে হাটতে লাগলেন ভেতরের রাস্তার দিকে। বুঝাই যাচ্ছে তিনি কোনো বাসের অপেক্ষায় বসে ছিলেন না। তিনি বৃষ্টির আক্রমণ থেকে বাঁচতে এখানে সময় কাটিয়েছেন মাত্র। মহিলা কিছুটা এগিয়ে যেতেই আবরারও বেরিয়ে গেলো সেই পথে। সে নিজেই তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নিয়েছে। যেন যার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলো, সে আর এলো না। আর পারবে না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হতে। এমন একটা ভাব নিয়ে সে ছাউনি ছাড়লো।
মহিলাটি ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ঘনঘন পা ফেলে নিরিবিলি পথে হাঁটছেন৷ অন্যসময়ের তুলনায় এই পথ একদমই জনশূন্য। বৃষ্টিই তার একমাত্র কারণ। হালকা ভিজতে থাকলেও কালো বোরকায় পানি মিলিয়ে যাচ্ছে মহিলার৷ মূল রাস্তা থেকে এগিয়ে আসার পর যেন তার হাটার গতি দিগুণ বেড়েছে। ডানে বামে তাকাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু-একটা রিকশা ব্যতিত কিছুই চলছে না আর৷ মহিলাটি বার দুয়েকের জন্য পেছনেও তাকিয়েছিলো। রেইনকোট পরহিতা আবরারকে দেখেছিলো। তখন আবার হাটার গতি কমিয়ে স্বাভাবিকে নিয়ে এসেছে। আবরারও স্বাভাবিক গতিতেই হেঁটে চলেছে। মহিলাটি এডভোকেট আব্দুল মান্নানের বিশাল বাউন্ডারি সমৃদ্ধ বাড়িটার মাঝামাঝি পথে অবস্থান করে যখন আবার পিছু ফিরে তাকালো, সেই রেইনকোট পরহিতা আবরারকে আর দেখতে পেলো না। মুহুর্তেই হাটার গতি আবারও বেড়ে উঠেছে। এই পথে এখন কোনো মানুষই নেই। বেশ নিস্তব্ধ নিরাপত্তার সাথে পা চালাচ্ছেন তিনি। কিছুটা এগিয়ে যেতেই হঠাৎ এডভোকেটের বাড়ির সীমানার শেষ গেইট দিয়ে আবরারের আগমন ঘটলে যেন থমকে গেছেন মহিলা! এক মুহুর্তের জন্য তার হাটাচলাও বন্ধ হয়ে গেছে! লোকটা তো তার পেছনে ছিলো! সামনে এলো কিভাবে! তবে কি এই বাড়ির সীমানার সেই প্রথম গেইট দিয়ে প্রবেশ করে দৌড়ে এসে তাকে ওভারটেক করলো! বুঝতে আর বাকি রইলো না, তাকে অনুসরণ করতে করতেই এই রেইনকোট ওয়ালার আগমণ! খানিক ঘাবড়ে গেলো মহিলা। আবরার মোটেও তার দিকে তাকিয়ে নেই। সে ধীর পায়ে সামনে হেটে যাচ্ছে। মহিলা বুঝতে পারছে না সামনেই এগিয়ে যাবে, নাকি পিছু পথে ছুটবে! মনের ভেতর ভয় আকুপাকু করছে। তবুও তার উপর থেকে সন্দেহের অবকাশ দূর করতে একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় সামনেই অগ্রসর হলো। পিছু ছুটলেই তো সন্দেহ বাড়বে! আবরার আরেকটু সামনে এগিয়ে থেমেই গেলো। হাতে একটা ভিজিটিং কার্ড। একটু চিন্তিত ভঙ্গিতেই পেছনে ফিরে কয়েক কদম এগোলো। ঠিক মহিলার সম্মুখ পথে! মহিলা আবারও থমকে দাঁড়িয়ে গেলো কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখেই। আবরার আরেকটু এগিয়ে এসে ভিজিটিং কার্ডে মনযোগ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কি অদিতি ওয়ার্কশপ সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন? এইটা কোন পথে?”
মহিলাটি তার গোল গোল চোখজোড়া ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাথা নাড়লো, সে কিছুই বলতে পারবে না। আবরার আফসোসের রেশ টেনে বললো,
“এদিকেই তো ছিলো, খুঁজে পাচ্ছি না কেন!”
মহিলা কিছুটা অদ্ভুত ভঙ্গিতেই তাকালো। কারণ সে ছাউনিতে থাকতে শুনেছিলো, এই লোকটা বৃদ্ধর কাছে বলছিলো তার বাড়ি এদিকেই। তবে এখন কেন আবার তাকেই ওয়ার্কশপের ঠিকানা জিজ্ঞেস করছে! আবরার বললো,
“ওকে, ধন্যবাদ। আপনি যান।”
মহিলাকে যেতে বলে আবরার একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। ভিজিটিং কার্ড হাতের মুঠোয় চেপে রেখে তাকিয়ে রইলো মহিলার চলার দিকে৷ পরিমাপ করছে তার চলার গতি। মুহুর্তেই সামনের দিক থেকে এক মাইক্রো দৃশ্যমান হলো। অথচ এতোক্ষণ যাবত সীমিত সংখ্যক রিকশা ব্যতিত কোনো যানই চলাচল করতে দেখা যায়নি। কিন্তু কারো নজরই সেই মাইক্রোর দিকে স্থির রইলো না। মহিলা ঘনঘন পা ফেলে চলছে নিজ পথে। আবরার তাকিয়ে আছে যথাস্থানে দাঁড়িয়ে। একবার পিছু ফিরে আবরারকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুবই ভীতি অবস্থায় পড়তে হলো মহিলাকে। কিন্তু সেই অবস্থায় বেশিক্ষণ স্থির থাকতে হলো না। মাইক্রোটা রাস্তায় দৃশ্যমান হওয়ার পরপরই একদম মহিলার সামনে রং সাইডে এগিয়ে আসছে। তাকে চাপা দিতে আসছে নাকি! থতমত খেয়ে সে নিজেই বিপরীত পাশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু মাইক্রো আবার বাঁক নিয়ে একদম রাস্তার মাঝখানে মহিলার নিকটে এসে ব্রেক নিয়েছে। মহিলা ছোটখাটো চিৎকার দিয়ে উঠেছে তাকে এক্ষুনি চাপা দিয়ে ফেলবে ভেবে! কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। যে-ই ড্রাইভারের প্রতি রাগান্বিত হয়ে ধমক দেওয়ার জন্য ড্রাইভারের জানালার সম্মুখে এলো, মাইক্রোর পেছনের দরজাটা খুলে একটা ব*ন্দুক বের করে তাকে গাড়িতে উঠার ইশারা করলো। একটা শব্দও উচ্চারিত হলো না আর মহিলার মুখে! সে একবার শুধু পেছনে ফিরে সেই রেইনকোট পরহিতা লোকটাকে দেখলো। এতোটা এগিয়ে আসার পরও লোকটা একই জায়গায় একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে এদিকেই তাকিয়ে! এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ে তার বুঝতে আর একদমই অসুবিধা হয়নি যে, এই লোকটা তাকে আটক করতেই এতোটা সময় সেই বাস কাউন্টারের কাছে কাটিয়েছে! এতোক্ষণ যাবত তাকেই অনুসরণ করেছে। মহিলা আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। বেশ বুঝতে পারছে, তার সীমানা এখানেই শেষ হয়ে গেছে। পালানোর বৃথা চেষ্টা করে আর কোনো লাভ হবে না। মহিলাকে তুলে দরজা লক করে মাইক্রো আবার মূল রাস্তার দিকে চলতে লাগলো। আবরার রাস্তার মাঝখান থেকে সরে মাইক্রোর রাস্তা পরিষ্কার করে দিলো। হাতের মুঠোয় ভিজিটিং কার্ডটা মুড়িয়ে ছুড়ে ফেলা মাত্র উড়ে গিয়ে পড়লো রাস্তার পাশের ছোট ছোট ঘাসে আচ্ছাদিত ঝোপে। এবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টির উপভোগ্য মুহুর্তকে মনের কোণে ঠাই দিয়ে আবার হাটতে লাগলো ফেলে আসা পথে। এই বৃষ্টিতে রেইনকোটের প্রয়োজন হয় না। এই বৃষ্টিতে মানুষ ভিজেও যায়না। এই বৃষ্টি মানুষের মন নাচাতে সক্ষম। তবুও তার জন্য রেইনকোটই বিশেষ প্রয়োজন। খুব বেশি না, তার মাত্রই দুইটা কারণ। এক হচ্ছে তার কর্মতৎপরতা, দ্বিতীয়ত মনের সুখের ডানা বাঁধা! এই মানুষগুলোর মন পরম আনন্দে নাচে খুবই কম। তারা গম্ভীর, নিস্তব্ধতায় ঘেরা তাদের প্রাণ!