“রেইনকোট আরোহী”
পর্ব- ১২,১৩
(নূর নাফিসা)
১২
.
রোহান ও ইলহাম রেডি হওয়ার জন্য ছাদ থেকে সিড়ি দিয়ে দোতলায় নামতেই মারওয়া ছুটে এলো,
“বাবাই! তুমি কখন এসেছো?”
“আরে! এটা কে? কে তুমি?”
“আমি, আমি।”
“আমিটা কে?”
“আমি মারওয়া। তুমি আমাকে চেনো না?”
“না তো। তুমি তো মারওয়া না। আমার মারওয়া তো অন্যরকম। কিউট বেবি আমার। মারওয়া, মারওয়া কোথায় তুমি?”
“আরে! আমি, আমি মারওয়া।”
“নাহ! তুমি মারওয়া হতেই পারো না। মারওয়া তো এভাবে সাজে না।”
“আমি পার্লার থেকে সেজে এসেছি মামনির সাথে।”
“উহুম, আমি তোমাকে চিনি না।”
“ধ্যাৎ!”
ইলহামের দুষ্টুমিতে মুখটাকে কাচুমাচু বানিয়ে মারওয়া ফিরে রোহানের রুমে চলে যেতে লাগলো আবার। লেহেঙ্গা পরে পার্লার থেকে সেজে এসেছে সে। তার রাগের উপর হেসে ইলহাম পিছু পিছু রুমে গিয়ে তাকে পাজা কোলে তুলে নিলো।
“ছাড়ো আমাকে। তুমি পঁচা বাবাই।”
“বাবাই তো সমসময়ই পঁচা!”
ইলহাম গালে চেপে গভীর চুমু খেলো আদুরীকে।
“আমার পরী মা টা।”
“ওফ্ফ, বাবাই! এতো জোরে আদর দেয় কেউ!”
“কেন, এতো জোরে আদর দিলে কি হয়?”
“আমার মেকাপ উঠে যাবে না তবে!”
“সর্বনাশ! এখনই এই অবস্থা! রোহান, এইটুকু বাচ্চার মাথা পুরো গুলিয়ে দিয়েছে তোমার বোনেরা।”
“ছাড়ো, নামাও। আমার আব্বুই সুন্দর আদর দিয়েছে আমাকে। একদম মেকাপ উঠে না।”
“তাই? কিভাবে আদর দিয়েছে আব্বু?”
ইলহামের মাথা টেনে কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
“এভাবে।”
ইলহাম দুষ্টুমি করে আবার কপাল নামিয়ে দিয়ে বললো,
“কিভাবে?”
“ওফ্ফ! এই ভাবে।”
মারওয়া আবারও আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। রোহান তাকে আরেকটু ভরকে দিতে বললো,
“আম্মু, তোমার লিপস্টিক উঠে যাচ্ছে তো!”
“আ…! সত্যি! বাবাই, ছাড়ো ছাড়ো! আমার সব সাজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছো তুমি!”
“না, আরেকটু আদর দিবো বাবাইকে।”
“না…!”
মারওয়া রেগে যাচ্ছে তাই হেসে ছেড়ে দিলো ইলহাম। সে ছুটে গেলো ওপাশের রুমে, মায়ের কাছে। মিমি পার্লার থেকে এসেই আবরারের পোশাক বের করে সামনে দিচ্ছে তৈরি হওয়ার জন্য।
“কত দিনের ছুটি নিয়েছো?”
“কাল রিমিকে বিদায় দিয়েই চলে যাই। কি বলো? আমার তো কাজ নেই এখানে।”
“কাল কেন আর? আজই যাও। রিমিকে আমরাই বিদায় দিতে পারবো।”
“দেখো, কান্না করো না কিন্তু আবার।”
“কান্না কেন করবো। দ্বিতীয় বার তোমার কিশোরগঞ্জ আসাটা শুধু বন্ধ হবে।”
এরইমধ্যে মারওয়া এসে বললো,
“আম্মু, আমাকে আবার পার্লারে নিয়ে চলো।”
“কেন?”
“আমার সব সাজ নষ্ট করে দিয়েছে বাবাই।”
“কোথায় সব সাজ নষ্ট করে দিয়েছে?”
“গালের মেকাপ নিয়ে গেছে বাবাই আদর দিয়ে, লিপস্টিকও মুছে গেছে মামা বলেছে।”
“কিছুই হয়নি। দুষ্টুমি করেছে মামা।”
“না, নিয়ে চলো তুমি।”
“মারওয়া, জেদ করবে না এসময়। সব সাজ ঠিক আছে।”
“আব্বু, তুমিই আমাকে নিয়ে চলো তো।”
আবরার তাকে কোলে তুলে বললো,
“কোথায় নিয়ে যাবো তোমাকে?”
“পার্লারে। এই দেখো না, সব নষ্ট করে দিয়েছে! আমাকে আবার সাজতে হবে।”
“উম্মম… সবই তো ঠিক আছে দেখছি। কিছু নষ্ট হয়নি।”
“আমার লিপস্টিক ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছে তো।”
“এই গালের মেকাপটাও কি ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ, মেকাপও ঠিক আছে।”
“ওফ্ফ! বাবাইটা শুধুশুধু আমাকে ভয় দেখায়। তুমি বকে দিয়ো তো।”
“ওকে, দিবো।”
“মামাকেও দিয়ো। মামাও দুষ্টুমি করে।”
“ওকে, মামাকেও দিবো।”
মিমি বললো,
“মারওয়া, নামো কোল থেকে। আব্বুকে রেডি হতে দাও। বারবার কোলে উঠলে তো আব্বুকেও বকে দিতে হবে। নিউ ড্রেস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না, বারবার কোলে উঠছো যে।”
“ও, তাইতো।”
মারওয়া নেমে চলে গেলো দাদুনের সাথে সাক্ষাৎ করতে। আবরার রেডি হয়ে গেলে দুজনেই ছাদে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। মিমি আবার বললো,
“বললে না, কত দিনের ছুটিতে এসেছো?”
“এক সপ্তাহের হলে খুশি?”
মিমি খুশি মনোভাব ব্যক্ত করে বললো,
“কম যেন না হয় আবার।”
সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় এক লোককে থামিয়ে আবরার বললো,
“আপনি এখানে কি করছেন?”
“কাজ। কাজ করতে আসছি।”
মিমি বললো,
“ডেকোরেশনের লোক।”
“ডেকোরেশনের লোক বুঝলাম, কিন্তু ঘরে উনার কি কাজ? ঘরে কিংবা ছাদে তো কোনো কাজ নেই।”
“আরে, কাজ থাকতে পারে না? আসবাবপত্র রাখছে, নিচ্ছে।”
মিমি পরবর্তী জবাব দিতে দিতে লোকটা চলে গেছে তার পথে। আবরার তাকিয়েই রইলো তার যাওয়ার দিকে। মিমি তার সন্দেহের দৃষ্টি দেখে বিড়বিড় করলো,
“চলো, সবসময় বেশি বেশি।”
ইলহাম সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে হয়তো লক্ষ্য করেছে, তাই এরই মধ্যে মিমির কথায় সুর টানলো,
“আইনের লোক তো। বুঝতে হবে, ভাবি। ভাতেও সন্দেহ, ঘা’তেও সন্দেহ।”
ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি রেখে পাশ দিয়ে নেমে গেলো ইলহাম। তার কথা শুনে মিমি মুখ চেপে হাসলেও আবরার বিনা প্রতিক্রিয়ায় পা বাড়িয়েছে। ইলহাম চলে গেছে একটু রিমির সাথে দেখা করতে। রিমি আর সে প্রায় সমবয়সী। তবে দুজন দুজনকে আপা, ভাইয়া সম্বোধনই করে। এদিকে রিমির রুমে মোটামুটি ভীড়। ইলহাম দরজার সামনে থেকেই হাক ছেড়েছে, “রিমি আপা কোনদিকে?”
রিমি সাড়া দিতেই সে “সাইড, সাইড” বলতে বলতে ভেতরে প্রবেশ করলো। রিমিকে দেখে বললো,
“যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই! আপনার বিয়ে, আপনার সাজ কোথায়? বাকিরা দেখি এক একজন ডানাকাটা পরী!”
উপস্থিত সবাই-ই হেসে উঠলো। রিমি বললো,
“কি বলেন, ইলহাম ভাই! এই যে, সেজেছি না!”
“এইটুকু সাজ!”
পাশে উর্মি ছিলো, তাকে ইশারায় তাক করে বললো,
“দেখো তো, উর্মিকে চেনাই যাচ্ছে না মেকাপের ভারে। আর তুমি সেই পুরনো রিমি আপাই!”
“বেশ তো। বদলে গেলে হাসব্যান্ডের চিনতে অসুবিধা হবে না আবার! আগে কি দেখে পছন্দ করলো, পরে কি হলো!”
“তা-ও তো কথা। কিন্তু ক্যামেরাম্যানের কনেকে খুঁজে পেতে জটিল সমস্যা হয়ে যাবে আজ!”
তার দুষ্টুমির বিপরীতে রিমি আফসোসের সুর টেনে বললো,
“তাই, না? আসলে হয়েছে কি, সবাইকে মেকাপ করতে করতে আমার বেলায় শর্ট পড়ে গেছে। কি আর করার বলুন তো!”
“ভারি চিন্তার বিষয়। রিমির পরিবর্তে না আবার উর্মিকে তুলে নিয়ে যায় বরপক্ষ। আমিই তো কনফিউজড, বিয়ে রিমির নাকি উর্মির!”
“ইশ! বেচারা ইলহাম ভাই আর বেচারা ক্যামেরাম্যান। কিছু করার নেই। এভাবেই খুঁজে নিতে হবে।”
এদিকে উর্মি আবারও তার বিদ্রুপে চেহারা কাচুমাচু করে বললো,
“ভাইয়া!”
ইলহাম এক গাল হেসে বললো,
“উহুম, এটা ঠিক হয়নি। উর্মির বিয়েটাই আগে দেওয়া উচিত ছিলো। নাহয় দুজন একসাথে বিদায় হলেই চলতো।”
উর্মি একদমই বিরক্ত হলো না। লজ্জা পেয়ে মুখ চেপে হেসে বেরিয়েই যাচ্ছে। তারপর ইলহাম তাড়া দিতে লাগলো তাড়াতাড়ি ছাদে যাওয়ার। প্রোগ্রাম কোন রাতে শুরু হবে নয়তো! বেশি দেরি করা ঠিক হবে না। মূলত সে এখানে এসেছেই এজন্য। এরপর শুরু হলো ক্যামেরাম্যানের ব্যস্ততা। প্রোগ্রামের এক পর্যায়ে বাড়িতে হৈচৈ শুরু হলো। একেবারে আবরারের সন্দেহটাই প্রস্ফুটিত হয়েছে! রোহান প্রোগ্রামের এক পর্যায়ে ছাদ থেকে দোতলায় নেমে এসেছিলো ক্যাবল নিয়ে যেতে। দরজা ঠেলে রুমে পা রাখতেই দেখতে পেলো একটা লোক তার আলমারি খোলার চেষ্টা করছে হাতে চাবির মতোই ছোট একটা যন্ত্র দিয়ে। লোকটা পালাতে চাইলেও হাতেনাতে ধরা খেয়েছে। হৈচৈ শুনে অনেকেই ছুটে এসেছে। মিমি, আবরার এসে দেখলো এটা সেই লোকটাই! চুরি করার উদ্দেশ্যেই ঘরে ঘোরাফেরা করছিলো। মিমির বিস্মিত চেহারায় তাকিয়ে আবরার মন্তব্য করলো,
“বেশি বেশিটাই ঠিক হলো তো এবার?”
মিমি সাথে সাথেই ইলহামের দিকে তাকালো। সে-ও তো বিদ্রুপ করেছিলো তখন! ইলহাম হালকা কেশে কেটে পড়লো তাদের পাশ থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো এটা ডেকোরেশনের লোক নয়। ডেকোরেশন পার্টির যারা এসেছে, তারা তাকে চেনেই না। এদিকে চোর লোকটির যত আকুতি মিনতি! সে গরীব, ঘরে বউ বাচ্চা আছে, পেটের দায়ে চুরি করতে নেমেছে, আর জীবনেও চুরি করবে না বলে বলে ক্ষমা চাওয়া। কে জানে, কতটুকু সত্য! তবে খুব একটা ঝামেলায় যাওয়া হলো না এই সুন্দর মুহুর্তে। লোকটাকে দেখতে আসলেই গরীব মনে হচ্ছে। অতঃপর হালকা ধাওয়া দিয়ে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
বিয়ের কার্যক্রম শেষ করে তিনদিন পর আবরার নিজ বাড়িতে ফিরেছে বউ বাচ্চাকে নিয়ে৷ বাকিরা আগেই এসে পড়েছে। আর ইলহাম? শুধু হলুদের প্রোগ্রামের বিশেষ দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলো বলে সেই সন্ধ্যায়ই একটু বেশি সময় কাটিয়েছিলো। পরদিন দুপুরে খেয়েই উধাও! তাকে আর দেখাই যায়নি! বৌভাতেও উপস্থিত হয়নি। কোথায় নাকি ঘুরতে চলে গেছে বন্ধুবান্ধবদের সাথে! আবরার একসপ্তাহেরও দুদিন বেশি সময় পরিবারের সাথে কাটিয়ে তারপর আবার ফিরেছে কর্মজীবনে। কেউই এবার অভিমান নিয়ে বসে নেই। মিমি তো খুব আনন্দের সাথেই চলাচল করছিলো। মনেই হয়নি আবরারের উপর সে অভিমান করেছিলো কখনো। চলে যাওয়ার সময় খারাপ লাগলেও তা ঢেকে রেখে হাসিমুখে বিদায় জানিয়েছে পরিবার। অপেক্ষা বুনতে শুরু করেছে পরবর্তী সময়ে ফেরার। একমাত্র মেয়েটাই হাসিমুখে বিদায় দেয়নি বাবাকে। কখনোই দেয় না। সে একদমই ছাড়তে চায় না তার বাবাকে। এক মুহুর্তের জন্যও না। মুখের উপর হালনাগাদ প্রকাশ করে দেয় তার মনের অবস্থা। মেয়েকে কত আদর দিয়ে বুঝিয়ে তারপর বাড়ির সীমানা ছেড়েছে আবরার। অপেক্ষা তারও, পরিবারে ফেরার। আবার অপেক্ষা তারও, কর্মক্ষেত্রে পরিকল্পিত কাজ সম্পন্ন করার!
“রেইনকোট আরোহী”
পর্ব- ১৩
(নূর নাফিসা)
.
.
গভীর রাত। পথে হেলেদুলে হাটছে ইলিয়াস৷ ওইতো বাড়ি৷ নিজ বাড়ি চিনতে কি ভুল হয় কারো? ইশ, পা টা আর চলতে চাইছে না। দারোয়ান ব্যাটা এসে এইটুকু পথ তাকে নিয়ে গেলেই কি হতো না! মাসে মাসে মোটা বান্ডেলটা কি অহেতুক দেওয়া হয় নাকি তাকে! হাটছে তো হাটছেই, কিন্তু বাড়ির গেইট ছুতে পারছে না। হঠাৎ কেন জানি মনে হলো কেউ তার একা পথের হাটার সঙ্গী হয়েছে! ঘাড় ঘুরিয়ে ডানে তাকালো, কিছুই দেখা হলো না। আবারও হাটতে লেগেছে সে। আবারও মনে হলো বামে কেউ আছে তাই ঘাড় ঘুরিয়ে বামেই তাকালো। হায়! বামেও কেউ নেই। নিজের বোকামির উপর হাসতে গিয়েও যেন হাসা হলো না। একটু থেমে, একটু শব্দযোগে যেন হেটেই চলেছে কেউ সাথে সাথে। ওফ্ফ! তার তো পিছু তাকানো হয়নি। সঙ্গীদের কেউ আসছে নাকি তাকে ডাকতে! কিছু ফেলে এসেছে নাকি সেখানে? তাকে মোড়ে নামিয়ে দিয়ে মোটরসাইকেলটাও তো নিয়ে গেলো বন্ধু। নয়তো এতোক্ষণে ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে থাকতো। খুব দূর নয়। নিজ বাড়ির বাউন্ডারির অতি নিকটেই অবস্থান করেছে ইলিয়াস। পিছু ফিরে তাকিয়ে এবার অন্ধকারের আবছা আলোতে ঝাপসা চোখে কিছু পা দেখতে পেলো৷ ঠিক কয়টা, গুণতে পারছে না। মনে হচ্ছে চারটা, আবার মনে হচ্ছে, পাঁচটা, আবার মনে হচ্ছে একটা। ধুর এক পা আবার হয় নাকি কারো! কে এখানে? সামনে আর এগোচ্ছে না কেন? বন্ধুদের কাউকে তো মনে হচ্ছে না। তবে ছুটে আসতো। কিন্তু এই পা গুলো তো এগিয়ে আসছে না আর। কেউ ফলো করছে তাকে? কার এতো দুঃসাহস, যে তার পিছু নিয়েছে?
রাগান্বিত ইলিয়াস দুইকদম পিছু এগিয়েও থেমে গেলো। একা যাওয়াটা ঠিক হবে না। মানুষের চেহারা দেখা যাচ্ছে না, তবে এ যে মানুষ সেটা বেশ বুঝা হচ্ছে। মনে হচ্ছে এক পোশাকে আবদ্ধ পুরো শরীর। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে থাকায় এতোটা দূরের দৃশ্য একদমই স্পষ্ট হচ্ছে না চোখের সামনে। এই অবস্থায় এগিয়ে যাওয়া তো একদমই অনুচিত। হ্যাঁ, আবার এগিয়ে আসছে দেখা যায় তারা! উহুম, সে তো একা। তার সেদিকে না যাওয়াই উত্তম। একটা ভয় অনুভব করলো ইলিয়াস। সে পিছু ফিরতে ফিরতেই এবার দ্রুত গতিতে হাটতে লাগলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। হ্যাঁ, তার পিছুই নিয়েছে কেউ। তারা আরেকটু এগোতেই ল্যাম্পপোস্টের ফকফকে আলোয় বুঝতে পারলো মানুষ বা মানুষগুলো রেইনকোট পরনে! বাপরে, কেউ তাকে হত্যা করতে আসেনি তো! ভাগ্যিস, দ্রুত এসে পৌঁছতে পেরেছে গেইট পর্যন্ত! গেইটের ভেতর তাকিয়ে ঝাপসা চোখে দারোয়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বললো,
“গেইট খোল! হা করে কি দেখছিস? একটু এগিয়ে যেতে পারলি না?”
দারোয়ান কথা না বলে চুপচাপ গেইট খুলে দিলো। গেইট লাগাতে গেলেই সে আবার বললো,
“বেরিয়ে দ্যাখতো কে আমার পিছু নিয়েছে? সবকটার চান্দি উড়িয়ে দেয়ালে বেঁধে দে। সকালে দেখে নিবো।”
দারোয়ান কথামতো গেইটের বাইরে এলো তবে ঠিক চান্দি উড়াতে নয়। দেখতে এসেছে কে বা কারা? না, কেউই নেই। শুধু ওই দূরে খানিক আলো ছুটে যেতে দেখা গেলো। কোনো গাড়ির আলো। রাস্তা যেহেতু, গাড়ি তো আসাযাওয়া করতেই পারে। এছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি। এই গাড়ি তার পিছু নিয়েছে নাকি? সেদিকে ধ্যান না দিয়ে সে চুপচাপ ভেতরে চলে এলো। ইলিয়াস বললো,
“ফিরে এলি যে?”
“কেউ নেই।”
“ভালো করে দ্যাখ।”
“দেখেছি। নেই কেউ।”
“আমি দেখলাম, আছে। তুই বলিস নেই! মালটাল খেয়ে চোখ ঘোলা করে রাখিস নি তো?”
এর কোনো জবাব দিলো না দারোয়ান। এর জবাব আর কি হতে পারে? প্রশ্ন জুড়েই তো হাস্যকর ব্যাপার! ইলিয়াসও অপেক্ষায় নেই তার জবাবের। সে প্রশ্ন করেই চলে গেছে ঘরের দিকে।
গতকালের আবহাওয়াটা ঝলমলে রোদে ঝরঝরে ছিলো। যদিও রাতের কিছুটা সময় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়েছিলো। তবে আজ সকাল থেকেই থেমে থেমে ঝপাঝপ বৃষ্টি। অথচ আজ ক্যান্টনমেন্টে প্রোগ্রাম। ক্যান্টনমেন্টের প্রতিষ্ঠাতার স্মরণার্থে দশম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজন অনুষ্ঠিত হবে। এডভোকেট আব্দুল মান্নান সেখানে উপস্থিত থাকবেন প্রধান অতিথি হিসেবে। এমনটাই তো দেখতে পাওয়া গেছে ব্যানারে। আবরার সময়টার দিকেও একটু নজর দিয়েছে। আয়োজন অনুষ্ঠিত হবে সকাল দশটা থেকে শুরু হয়ে দুপুর দুইটা পর্যন্ত। প্রধান অতিথির আগমন থাকে শেষ মুহুর্তে। অর্থাৎ এডভোকেট সাহেব সেখানে থাকবেন যোহরের দিকে!
যোহরের পরপর দেহে রেইনকোট চাপিয়ে তিনজন লোক প্রবেশ করলো এডভোকেট আব্দুল মান্নানের বাড়ির গেইট দিয়ে। সকালে ঝপাঝপ বৃষ্টি থাকলেও এসময় তার বেগ কমে ঝরছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। তাদের কোনো গাড়িতে চড়ে আসতে দেখা যায়নি। হেটেই এসেছে এ বাড়ি পথে। কোনো সম্ভ্রান্ত লোক এলে তো গাড়ি নিয়েই আসতো। যাকে তাকে বাড়িতে প্রবেশ করতেও তো দেওয়া হয় না। তাই দারোয়ান আপত্তি জানাতেই তাদের মধ্যে একজন আইডি কার্ড দেখাতেই দারোয়ান একপাশে চেপে দাঁড়িয়ে হইলো। এ তো র্যাব কর্মকর্তা! কিন্তু তাতে কোনোরকম সন্দেহ জারি করেনি দারোয়ান। কারণ এমন অনেক বড় বড় লোকেরই আগমন ঘটে এই বাড়িতে। দারোয়ান শুধু নিচু গলায় এইটুকু সুর তুললো যে, এডভোকেট স্যার বাড়ি নেই। রেইনকোট পরহিতা ব্যক্তিরা সেদিকে তোয়াক্কা করলো না। তারা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। তারা র্যাব কর্মকর্তা হয়েও গাড়ি নিয়ে কেন এলো না, তা নিয়ে একবার ভেবে দারোয়ান গেইটের বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে এপাশ ওপাশ তাকালো। বাড়ির বাউন্ডারির শেষ সীমানায় একটা গাড়ি দাঁড় করানো দেখতে পাওয়া গেছে। তবে এইটুকু তারা হেটেই এসেছেন নিশ্চিত। দারোয়ান আবার ভেতরে চলে এলো। তিনজন রেইনকোট পরহিতা ব্যক্তি দরজার সামনে এসে কলিং বেল চাপতেই কাজের লোক এসে দরজা খুলে দিলো। বাড়িতে আবদুল মান্নানের স্ত্রী আছে কি না জিজ্ঞেস করতেই তিনি এসে দাঁড়ালেন। আবরার নিজের মাস্কটা খুলে ফেলতেই তিনি দারুণ অবাক হয়ে আতিথেয়তা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু আবরার বাঁধা দিয়ে বললো, সে পরিদর্শনে এসেছেন। এতেই যেন চেহারায় একটু চিন্তিত ভাব নেমে এলো! হঠাৎ পরিদর্শনে কেন! আবরারের কথায় বুঝতেও পারলেন, এডভোকেট যে বাসায় নেই সেটাও সে জানে। তবুও পরিদর্শনে এসেছে। কিন্তু এডভোকেট না থাকলেও তার ছোট ভাই ছিলেন উপস্থিত। তাকে সাথে নিয়েই পুরো বাড়িটা তারা পরিদর্শন করতে নেমে পড়লেন। কিন্তু প্রবেশ করলেন না এডভোকেটের বেডরুমে, প্রবেশ করলেন না এডভোকেটের মেয়ের রুমে, প্রবেশ করলেন না এডভোকেটের ভাতিজার রুমে। অথচ প্রবেশ করতে ভুললেন না, এডভোকেটের ছোট ভাইয়ের রুমে! আব্দুল মান্নানের ছোট ভাই আব্দুল মোতালেব কিছুটা বিস্ময়কর ও আপত্তিকর পরিস্থিতিতে পড়লেন৷ তিনি মুখ ফুটে বলেই ফেললেন,
“কি অবস্থা? স্যার, আমি কি বড় ভাইকে কল করে আসতে বলবো আপনার সাথে দেখা করার জন্য?”
আবরার জবাব দিলো,
“আমি দেখা করতে আসিনি। দেখা করার হলে আমিই উনাকে ডাকতে পারতাম আমার অফিসে। কষ্ট করে আর আমাকে আসতে হতো না।”
“স্যার, কষ্ট করে যখন এসেছেন। আমাদেরকে আপ্যায়ন করার সুযোগটাও দিন।”
“সে নাহয় অন্য একদিন।”
“কিন্তু এভাবে তল্লাসির ব্যাপারটা…”
“কেন? আপনার বিশেষ আপত্তি ঠেকছে দেখছি!”
“আপত্তি হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়, স্যার? কারো বাড়িতে এভাবে…”
“জুলুম তো করছি না। ভয় পাচ্ছেন কেন?”
“না, স্যার। ভয়ের আর কি!”
“আমি কিন্তু নিচতলা থেকে আপনাকে এবং আপনার পরিবারের কাছে বলেই এসেছি পুরো বাড়িটা পরিদর্শন করবো।”
“না, তা ঠিক আছে। কিন্তু তল্লাসির ব্যাপারে তো বলা হয়নি কিছু। আর কোনো কারণও প্রকাশ হয়নি আমাদের সামনে।”
“কারণ তো অবশ্যই আছে। কারণ ব্যাতিত কাজের সময় আমাদের নেই। আপনি কাইন্ডলি একটু থাকুন আমার সাথে।”
খুব বেশি নাড়াচাড়া হলো না আব্দুল মোতালেবের বেড রুমে। তবে টেবিলের কোণ থেকে চাবিসহ একটা খোলা তালা হাতে নিয়েছে আবরার। সে জানে, পেছনে একটা রুম ফেলে এসেছে। আর সেটা এডভোকেটের ছেলে ইলিয়াসের। কিন্তু ইলিয়াস বাড়িতে আছি কি না সে জানে না। মূলত সন্দেহের দৃষ্টিতেই তালাটা নিয়ে নিয়েছে কাজে লাগতে পারে বলে। আবরার মোতালেবের রুম থেকে বেরিয়ে আবার ফেলে আসা পথে পা বাড়ালো। বিনা জিজ্ঞাসা ও বিনা সংকোচেই দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো ইলিয়াসের রুমে! ঘরে এলোমেলো হয়ে বিছানায় পড়ে আছে ইলিয়াস। বড় লোকের অকেজো বেটাদের যেমনটা অভ্যাস আরকি। বেলা না গড়ালে রাতের ঘুমই ভাঙে না। অবশ্য রাতের নয়। তাদের ঘুম শুরুই হয় ভোর থেকে। সুতরাং ভোরের ঘুমই ভাঙেনি ইলিয়াসের। মোতালেব হয়তো ডাকতে যাচ্ছিলো। এমনি আবরার বাঁধা দিয়ে বললো,
“ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক। ডিসটার্ব করার কি প্রয়োজন। চলুন, আমরা অন্যদিকে যাই।”
আবরার পিছু মোর নিয়ে বেরিয়ে গেলো আবার। কোনো তল্লাশি চালালো না। শুধু নিরবে দরজাটা লাগিয়ে তাতে বন্ধ তালা ঝুলিয়ে দিলো! মোতালেব বিস্ময়ের চূড়ায়! কিন্তু কিছুই বলার সুযোগ হলো না। আবরার মোতালেবকে সাথে চলতে ইশারা করে হাটতে লাগলো বাড়ির গোডাউনের দিকে। সামনে আবরার, মাঝখানে মোতালেব, তার পেছনেই সাথের দুজন র্যাব কর্মী। অর্থাৎ তিনজন র্যাবের মাঝখানে হাটছে মোতালেব! ভাইকে বোধহয় ভীষণ প্রয়োজন ছিলো এসময়, তাই ফোন করার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু তিনজনের মাঝখানে অবস্থান করে সাহসটা পাচ্ছে না। আবরার তো নিষেধই করলো তখন, ভাইকে ডাকতে!
একদম শেষ রুমটা গোডাউন। এদিক দিয়েও নামার জন্য সিড়ি আছে। অর্থাৎ ঘরে মালামাল যা আসে, তার সবটাই এই পথে উঠে আসে। সেদিন বাড়িতে প্রোগ্রামে আসার পর যখন এডভোকেটের সাথে পরিদর্শন করছিলো, এদিকে ঘরের চালডাল সামগ্রীর গোডাউন বলে আর নিয়ে আসেনি। এতো হাবিজাবির মধ্যে আনবে কেন তাদের। অথচ এই হাবিজাবিই আবরারের সন্দেহের কারণ। না, সন্দেহ এমনি এমনি আসেনি। এমন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে চালডাল সামগ্রীর গোডাউন থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের রূপই যদি হয় অসৎ, সন্দেহ তো পায়ের জুতোতেও বসাতে হয়! সেদিন রেলস্টেশন থেকে গাড়িতে করে মালামাল নিয়ে আসার সময়ই ইলিয়াসকে চোখে গেঁথে নিয়েছে আবরার! আর আবদুল মান্নানের এতোশত ধনসম্পদ বৃদ্ধির গতিধারা তো দৃষ্টির অগ্রভাগেই লেগে আছে সেই কবে থেকেই। মানুষের উন্নতি কি এমনি এমনি হয়ে থাকে? অবশ্যই তার পেছনে গুরুতর কারণ থাকে। পন্থা শুধু সাধুতা এবং অসাধুতার।
গোডাউনের দরজায় তালা দেওয়া। আবরার মূলত মোতালেবের রুম থেকে তালাটা নিয়েছিলো এই গোডাউনের দরজায় ঝুলানোর কাজে লাগতে পারে ভেবে। যাক, সেও অকাজে আসেনি। কিন্তু গোডাউন এমনিতেই লক করা অবস্থায় আছে। আবরার বললো,
“মোতালেব সাহেব, এটার লক খুলুন।”
“স্যার, এটা আমাদের বাসার গোডাউন। চালডাল, মশলাসহ কিছু প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় আসবাব আছে এতে।”
“ঠিক আছে, কিন্তু আমি একটু দেখতে চাই আপনাদের গোডাউন।”
“চাবি তো সাথে নেই। আমি নিচ থেকে নিয়ে আসি।”
মোতালেব যেন কিছুটা স্বস্তির সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিচে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আবরার তাকে স্বস্তি এবং সুযোগ, কোনোটাই দিলো না! সে মোতালেবকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“আচ্ছা, থাকুক। আপনাকে এটুকু কষ্টও করতে হবে না। নিচে গিয়ে যদি চাবি না-ই পান, তবে আর কিভাবে হবে! রাফিন, তালা ভাঙুন।”
“জ্বি, স্যার।”
কর্মীকে নির্দেশ দিয়ে আবরার একবার মোতালেবের দিকে তাকিয়ে দেখলো চেহারায় তীব্র ক্ষিপ্ততা উপস্থিত! যেন খুব বাড়াবাড়ি মনে করছেন আবরারের কর্মকাণ্ড। তাতে আবরারের কোনোরকম পাত্তা নেই। সে অতি স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললো,
“ভাঙলে, একটা তালাই তো ভাঙবে। তাতে আর এমন ক্ষতি কি। কি বলেন মোতালেব সাহেব?”
কোনো জবাব দিলেন না আব্দুল মোতালেব। ধাতব বস্তুর আঘাতে তিন ঘাতেই র্যাব তালা ভেঙে ফেললো। তারা প্রত্যেকেই ভেতরে প্রবেশ করলো। হ্যাঁ, সারি সারি চালডালের বস্তা আছে। ঘরের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও আছে। আবার তারা যেটার সন্ধানে এসেছে, সেটাও আছে। ওইতো, শেষ দেয়াল ঘেঁষেই একটা নীল রঙের পর্দা টানানো। তাদের মধ্যে একজন গিয়ে পর্দা টেনে নামিয়ে দিতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো দেয়াল ঘেঁষে রাখা সারি সারি কার্টুন!
“এগুলো কি মোতালেব সাহেব?”