রেইনকোট আরোহী” পর্ব- ৩

0
217

“রেইনকোট আরোহী”
পর্ব- ৩
(নূর নাফিসা)
.
.
অথচ কি হলো! মাঝপথ থেকে ফিরে আসতে হলো! আইন মন্ত্রণালয়ে তাকে আবারও ডাকা হয়েছে, কোনো পরিকল্পনা ব্যতীত! জটিল একটা মামলা নিয়ে সমস্যা হয়ে গেছে, যা তৎক্ষনাৎ না সামলালেই নয়! অথচ এমনিতে তার কত অবসর সময় যায়! তার মর্জিমাফিক সে কাজ পরিচালনা করে। এমন জরুরি মুহুর্তগুলো খুব কমই আসে তার কর্মজীবনে। উল্টো কত বড় বড় অফিসার এসে তার অফিসে বসে থাকে তার সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু জরুরি মুহুর্তেই এই জরুরি কাজগুলো হাজির হয়ে যায়! আর কাজকে এতোই ভালোবেসে গ্রহণ করেছে যে, কাজটাই তার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। পারিবারিক শুভকাজগুলো তাকে ছাড়াও সম্পন্ন হবে। তাই শুভকাজে গুরুত্বটা একটু কমই দেয়। ব্যাস তো! সেদিন থেকেই মিমি তার সাথে কথা বলা একদমই বন্ধ করে দিয়েছে। শ্বশুরের কাছ থেকেও ক্ষমা চেয়ে অনুমতি নিয়ে নিয়েছে, সে আর আবরারের ঘরে ফিরতে চায় না। এই সংসার তার আর আপন মনে হয় না। সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গেছে! এই সংসার ত্যাগ করতে চায় সে। ছোটখাটো আরও অনেক প্রয়োজনেই আবরারকে অনুভব করতো। কিছু প্রকাশ করতো, আবার কিছু অপ্রকাশিত রেখে দিতো আবরারের ব্যস্ততার পিঠে। সেসব অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু জীবনের এই বড় আয়োজন গুলোতেও যখন তাকে পাওয়া যাচ্ছে না, তবে আর তার কিসের প্রয়োজন? তাকে পাওয়ার আর প্রত্যাশাও রাখছে না। তাই শ্বশুর শ্বাশুড়িকে অনুরোধ করেছে, তারা যেন তাকে আর না ডাকে। শ্বশুরও অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন, প্রাধান্য দিয়েছেন মিমির ইচ্ছাকে। আবরারের বাবাও ভীষণ ক্ষিপ্ত তার প্রতি! এর আগে তার মায়ের ভীষণ জ্বর হয়েছিলো। আবরারকে ফোনে খবর দেওয়া হয়েছিলো। তখন একটা মিশনে এতোটাই মনযোগ দিয়েছিলো যে, সে ঠিকমতো শুনতেই পায়নি তার মায়ের অসুস্থতার কথা। ভেবেছে এমনি তাকে যেতে বলেছিলো। তখন থেকে তার বাবাও কথা বলা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে। বাড়িতে যাওয়ার পর তো দারুণ রাগ দেখিয়েছেন তিনি! আবরারেরও তখন বেশ খারাপ লেগেছিলো! এতোটা বেখেয়ালি সে কিভাবে হতে পারে! আজ যদি মায়ের কিছু হয়ে যেতো, সে তো মাকে দেখতেই পেতো না এই এক সপ্তাহ পর এসে! এরপর প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তার বাড়ি যাওয়া হতো। পরিস্থিতিও খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিলো। এরই মধ্যে প্রায় এই তিনমাস যাবত তার সেই আগের অভ্যাস আবার দেখা দিয়েছে! আবারও ক্ষেপে উঠেছেন প্রিয়জনেরা! এটা স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের মাঝে স্বাভাবিকতা আনতে পারছে না আবরার। নিজেকে এতো জরুরী মিশনে নিজেই জড়াতে চাইছে সে! কাজে হেয়ালিপনা করতে কর্মজীবনে পা রাখেনি। আবার পরিবারের মনোমালিন্যও ভালো লাগছে না! সবমিলিয়ে বর্তমানটা তার কাছে জটিল এবং একটু বিষাদময়!
রাতের খাবার সন্ধ্যায় শেষ করে সে বাসভবন থেকে বের হলো। গার্ড বিহীন সাধারণ একজন মানুষের মতোই হাটতে হাটতে প্রবেশ করলো উত্তরা র‍্যাব হেডকোয়ার্টারে। অবশ্য এইটুকু হাটতে গার্ডের প্রয়োজন নেই তার। তবুও গেইটের পাশ থেকে দুজন তাকে সম্মান প্রদর্শন করে সাথে আসতে চেয়েছিলো, সে হাতের ইশারায় নিষেধ করে একা একাই কার্যভবনে অগ্রসর হলো। কার্য ভবনের মূল দরজা থেকেই আবার তাকে সম্মান প্রদর্শন করে চারজন তার সাথে অগ্রসর হলো নির্দিষ্ট কক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য। বাইরেই বাস ভবন থেকে সে গার্ড ছাড়া হেটে এসেছে। এখানে ভেতরে তো তাদের প্রয়োজনের প্রশ্নই আসে না। তবুও তারা তাদের নির্দিষ্ট নিয়মানুসারে কাজ করে যাবে। তবে আবরার সেদিকে লক্ষ্য রাখেনি। তার মাথায় ঘুরছে অন্যকিছু। নিজস্ব কক্ষে এসে বসতেই পিওন এসে বললো,
“স্যার, চা কফি দিবো?”
“মারফত স্যারকে ডেকে দিন।”
“ওকে, স্যার।”
আবরার এসেছে শুনে মারফত সাহেব দুমিনিটের মধ্যেই হাজির হলেন। অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই আবরার তাকে বসতে বললো,
“বসুন। ওই মহিলা কি কোনো চাতুরী করার চেষ্টা করেছে?”
“না, স্যার৷ কোনো চান্স নেই।”
“ব্যাগ থেকে কি পাওয়া গেছে?”
“একটা বাচ্চা।”
“বয়স?”
“দুই বছরের বেশি হবে না।”
“এতোটা সময় ব্যাগের ভেতর থাকার পর সুস্থ অবস্থায় পেয়েছেন তো!”
“কোনো একটা মেডিসিন প্রয়োগ করে বেহুশ বানিয়ে রাখা হয়েছে, স্যার। গাড়িতে বসেই যখন ব্যাগটা খোলা হয়েছিলো, বাচ্চার মুখে ট্যাপ লাগানো ছিলো। হাত দুটোও ট্যাপে বাঁধা।”
আবরার ক্ষণিকের জন্য চোখদুটো বন্ধ করলো। এইটুকু বাচ্চার উপরও তাদের এমন অত্যাচার! ধীর নিশ্বাস ফেলে বললো,
“এখন কি অবস্থা?”
“ট্রিটমেন্ট করা হয়েছে। ঘুমাচ্ছে, স্যার।”
“আর সেই মহিলা?”
“সে খুব একটা বলতে পারেনি। তার কাজ নাকি ওই রাস্তাটুকু পাড় করে দেওয়াই ছিলো। এইটুকুতেই তার আয়। আমরা আরও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছি স্যার। বাচ্চাটার পরিবারের সন্ধানে বিজ্ঞপ্তির ব্যাবস্থাও করছি।”
“ওকে। আসুন, আমি একটু দেখবো বাচ্চাটাকে।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আবরার। মারফত সাহেবও সাথে সাথেই আসন ত্যাগ করে তার সাথে যেতে লাগলো। অবসরে প্রায়ই সাধারণ বেশে পথেঘাটে চলাচল করে আবরার। উদ্দেশ্যই থাকে পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝার। বাস কাউন্টারের ওদিকটায় আজ একটু সময় কাটানোর পর হঠাৎই চোখে পড়লো একটা মহিলা বাসে উঠলো খালি হাতে কিন্তু আবার সাথে সাথেই নেমে গেলো। চোখের পলকেই যেন সন্দেহ হলো সে উঠার সময় মহিলাটাকে খালি হাতে উঠতে দেখেছে। তবে এই ব্যাগটা এলো কিভাবে হাতে! তারউপর মহিলাটি অন্যত্র যাওয়ার জন্য সাথে সাথেই স্থান ত্যাগ করেনি। আশ্রয় নিয়েছে ছাউনিতে। যেন একটু বিশ্রাম নিতে চাইছে বৃষ্টির অযুহাতে! দৃষ্টিভঙ্গিই একটু অন্যরকম ভয়ার্ত লাগছিলো। ব্যাগটাকে কেমন যত্নে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছিলো। তাই আবরারও এতোটা সময় সেখানে পাড় করলো। সন্দেহ তার সেখানেই দেবে গেছে! এরপর র‍্যাব ফোর্সকে এলার্ট করে রাখলো ফোনে টেক্সট করে। সুবিধাজনক স্থানে আটক করলো স্বল্প সময়ের পরিকল্পনাতে।
মারফত সাহেবের সাথে বাচ্চাটাকে দেখতে এলো আবরার। ইতোমধ্যে সে ঘুম থেকে উঠে বসে আছে। কান্না করছে অপরিচিত জায়গা ও অপরিচিত মানুষদের দেখে। চেহারা ও পরিধেয় পোশাকের বেশ দেখে ধারণা করা যায় ধনাঢ্য পরিবারের বাচ্চা। আবরার পাশে এসে বসে বাচ্চাটাকে পায়ের উপর কোলে বসালো। গাল মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,
“নাম বলতে পারো? নাম কি তোমার?”
বাচ্চা কোনোরকম জবাব দিলো না। “আম্মু” উচ্চারণ করতে করতে কেঁদেই যাচ্ছে। আবরারের মনে পড়ে গেলো মারওয়ার কথা। তার রাজকন্যাও একসময় এভাবে কান্না করতো আম্মুকে ডেকে! আবরার তাকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, ক্যালেন্ডারে পাখির ছবি দেখিয়ে বললো,
“এইযে, দেখো কি। কি সুন্দর পাখি! ধরো তো একটা। কেমন ধরতে পারো দেখি।”
বাচ্চাটা কান্না থামিয়ে একবার আবরারের মুখের দিকে তাকালো। পরক্ষণে ক্যালেন্ডারের ছবিতে স্পর্শ করলো। আবারও আম্মুকে ডেকে কেঁদে উঠলো। আবরার জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় তোমার আম্মু?”
বাচ্চা আঙুলের ইশারা করে তাকে দরজার বাইরে যাওয়ার জন্য ঠেলতে লাগলো। সে ভাবছে বাইরে গেলেই আম্মুকে পাওয়া যাবে। বাচ্চার কেয়ারে থাকা কনস্টেবল ঐশী জানালো,
“স্যার, তার কথা স্পষ্ট না। আম্মু, বাবা, টুকটাক শব্দগুলো উচ্চারণ করতে পারে। ফোনে কার্টুন দেখিয়ে এতোক্ষণ পর্যন্ত শান্ত রাখার চেষ্টা করেছি।”
“তাকে খেতে দিন কিছু। পেট ভরা থাকলে কান্নাটা কম করবে। খেলার জন্যও পাশে কিছু দিন। চিপস চকলেটের প্যাকেট দেখলেও বাচ্চারা আকর্ষিত হয়।”
“জ্বি, স্যার।”
আবরার বাচ্চাটাকে রেখে চলে গেলো আবার তার কক্ষে। যাওয়ার পথে সেই মহিলাটাকে একবার দেখে গেলো। মহিলা তার দিকে তাকালেও বুঝার উপায় নেই সে নিজেই যে তাকে আটক করেছে। একজন রেইনকোট পরা লোক ছিলো, কিন্তু তার চেহারা মনে রাখার মতো স্পষ্ট দেখতে পারেনি সে। এখন তিন-চারজন র‍্যাবকে গার্ড হিসেবে সাথে থাকতে দেখে বুঝে নিয়েছে এটা কোনো বড় অফিসার তাকে দেখে গেলো! ফলে চেহারাটা আরও ঘাবড়ানো হলো। আবরার রুমে এসে বসতেই অপারেটর রুমের ডিটেইলস পাঠানো হলো তাকে৷ সেই মহিলার সেলফোন থেকে নম্বরগুলো পর্যবেক্ষণ করে তারা খুব শীঘ্রই পুরো গ্যাংটাকে কব্জা করার চেষ্টা করছে। বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়ে গেছে বাচ্চার পরিবারের সন্ধানে। সকল তথ্য সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েই আবরার রাত দশটার পরপর আবার বাসভবনে ফিরে এসেছে। এবার গার্ড এসেছিলো তাকে এগিয়ে দিতে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here