রোদেলা লেখা: মাহাবুবা মিতু পর্ব: ৪৫

0
600

রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৪৫

আজ একমাস হলো রোদেলা নেই। রোদেলার মৃ*ত্যুতে সবচেয়ে বেশী ভেঙে পরেছে নাতাশা। একে তো শরীর এমনিতেই খারাপ তার উপর বাবার মারণ অসুখের চিন্তা, বরটাও প্রবাসে গেলো এই তো সেদিন তার সাথে যোগ হলো রোদেলার এমন আকস্মিক মৃ*ত্যু। এসবের জন্য নিজেকে দায়ী ভাবে ও। ও মনে করে ওর উচিত ছিলো রোদেলার সাথে এসব নিয়ে খোলামেলা আলাপ করা। ও আসলে রোদেলার রংহীন জীবণে একটু রঙের পসরা সাজাতে চেয়েছিল। ওর বোনটি যে কত অভাগা তা ওর চেয়ে বেশী কে জানে।

নিজের বোন না হলেও বাবা মায়ের পর সবচেয়ে বেশী ভালো ও রোদেলাকে বেসেছে। কিছুতেই মানতে পারছে না রোদেলা নেই। খাবার সময় আপা আপা করে ডাকছে, খেতে আসার জন্য তাড়া দিচ্ছে। অদৃশ্য রোদেলার সাথে কথা বলছে কলোলের বিষয়ে, রান্নার বিষয়ে, নতুন যে আসছে তার বিষয়ে….

একটা সময় পর যখন বাস্তবে ফিরে আসে….
তখন কেঁদে কেঁদে বলে-
: আপা তুই না বলছিলি বাবু হওয়ার পর যাবি আমাদের বাড়িতে, বাবুকে তো তোরই দেখাশোনা করার কথা ছিলো, কেন এত জলদি চলে গেলি তুই….
কিসের এত তাড়া ছিলো তোর…………

নাসিমার সেদিন পর থেকে খাওয়া দাওয়া বন্ধ। শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে প্রায়। নানীর অবস্থা ও এখন যায় তখন যায়। সবাই বিমর্ষ, প্রিসিলার ও পড়ায় মনোযোগ নেই, বোনের এমন প্রস্থান মানতে পারছে না ও নিজেও। কিন্তু ওর আবেগ প্রকাশ ক্ষমতা কম। সবার মতো কাঁদতে পারে না, বলতে পারে না বোনকে কত মিস করছে। দিনটা কোনমতে কেটে যায় সবাই দেখে স্বাভাবিক প্রিসিলাকে কিন্তু বোনের স্মৃতি হাতড়ে প্রতিটি রাত ওর কাটছে নির্ঘুম…

সেই ছোট্ট বেলা থেকে ওর স্মৃতিতে নেই যে ওর মা ওকে আদর করে ঘুম পাড়িয়েছেন, গোসল কিংবা খাবার খাইয়েছেন। মা তো তখন নোভেলের দখলে। কত কত দিন আমার মা আমার মা বলে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে গেছে।
মা রূপি এই বোনটিই সেগুলো করেছে পরম মমতায়। ছোট্ট বোনের সব কথার একমাত্র ধৈর্যশীল স্রোতা ছিলো সে, চুল বেঁধে দেয়া, পছন্দের নাশতা টিফিনের জন্য তৈরী করে দেয়া, যে কোন আবদার মেটানো সব সব মনে পরে ঐ রাতটা এলে।

প্রিসিলার মনে আছে একবার শবেবরাতে ও তারাবাতি চেয়েছিল বোনের কাছে। বোন ওকে জমানো টাকা দিয়ে এক বাক্স তারাবাতি কিনে দিয়েছিলো। জীবণে সবচেয়ে বেশী খুশি ও সেদিন হয়েছিল।

কে এখন ওর কথা শুনবে, কে ওর আবদার রাখবে, কে ওকে ভালোবাসবে এখন….? কারো সাথে সহজে মিশতে না পারা প্রিসিলা যে বড্ড একা হয়ে গেলো এই বিশাল পৃথিবীতে। বড্ড একা…..!

নোভেল সবচেয়ে দ্রুত এ শোক কাটিয়ে উঠেছে। কাজ করছে নিয়মিত। রোদেলা যেন নিজের বিনিময়ে ওর অগোছালো জীবণকে ঠিকঠাক করে গেলো। এত বড় শোকে ওর জীবণ অমূল বদলে গেছে।

কাজকর্মে ওর নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা দেখে সুফিয়ান ওকে নতুন এক প্রোজেক্টে ম্যানেজারের সহকারী হিসেবে কাজ দিয়েছে। বলেছে ঠিকঠাক কাজ শিখে নিলে ওকেই ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দিবে। আসলে সুফিয়ান চাইলেই ওকে এখনি এ পদে বহাল করতে পারতো। কিন্তু কাজের পারদর্শিতা আর একাগ্রতা তৈরীতেই তার এই সময় নেয়া। উনি চান নোভেল নিজেকে ভেঙে গড়ে তুলুক।

এদিকে ওর বাবা ওকে তাড়া দেয় চলে আসার, সেই সুন্দর নিশ্চিত জীবণ ওকে আকর্ষণ করে না। এখানকার কাজে অনেক কষ্ট, এই রোদ মাথায় করে মালামাল চেক করা, এগুলো আপলোড, আনলোড করা, তাছাড়া পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় অনেক কাজই নিজ হাতেই শিখতে হচ্ছে ওকে।
কষ্ট হলেও ও এখানেই থাকবে।

রোদেলার মৃ*ত্যু*র পর এ বাড়িতে আর আসে নি আবু সুফিয়ান। ঐ যে ওর লা*শ পৌঁছে দিয়ে গেলো এরপর আর আসে নি এদিকে। এমন কি জানাজায় ও দেখা যায় নি ওকে। তবে সুফিয়ান ঐ পরিবারে ছায়ার মতো পাশে আছে । নিয়মিত খোঁজ রাখছে সবার। পূর্বাচলের আফজাল হোসেনের কাছ থেকে কিছু টাকা ও তুলে দিয়েছেন একজনের সাহায্য নিয়ে। বাকী টাকা তিনি আস্তে আস্তে শোধ দিবেন তাও জানিয়েছেন। সে টাকা দিয়েই তৃতীয় দফায় চিকিৎসা শুরু হয় বড় মামার। তার এ বাড়িতে না আসাটা রহস্যজনক।

এ ঘটনায় যার জীবণ এলোমেলো হয়ে গেছে সে হচ্ছে শোভন। খাওয়া নেই নাওয়া নেই গৃহবন্দী জীবণ যাপন করছে ও। ওর জীবণের ছন্দ যেন রোদেলার মতোই হারিয়ে গেছে।

সেন্টমার্টিনের দিন গুলোই আওড়াচ্ছে স্মৃতির পাতা থেকে।
কল্লোলের কাছে একটা গিফট পাওনা ছিলো শোভনের, সেন্টমার্টিনে যাবার সময় শোভন বলেছিলো সময় হলে ও চেয়ে নিবে। রোদেলার হাত যে রাতে ও কেটে ফেললো সে রাতেই কল্লোলের কাছে ও আত্মসমর্পণ করেছিলো। আর বলেছিল ভাই – রোদেলাকে আমার করে দে….

তাই তো নাতাশা-কল্লোল এত তাড়াহুড়ো করে সব ম্যানেজ করে। কথা বলে সবার সাথে। প্রপোজ করার জন্য একটা প্ল্যানও করে। কত খুশি ছিলো ও তখন, আর এখন….? অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছে সারাক্ষণ। কেন ও এমন করতে গেলো, কেন একটু অপেক্ষা করলো না, আজ ওর জন্য রোদেলা এই পৃথিবীতে নেই। নিজেকে কোন মতেই ক্ষমা করতে পারে না ও। নিজেকে তাই ঘরে বন্দী করে রেখেছে এর দায়ে। একবার নিজেকে শেষও করতে গিয়েছিল ও। ওর মা ভয়ে ওর সাথেই থাকছে, রুমের দড়জার নক ভেঙে দিয়েছে। কখন কি করে বসে। তারা ওকে নিয়ে খুবই চিন্তিত।

ওর জীবণটা অনেক জটিল আর এলোমেলো , ভেবেছিলো রোদেলাকে নিয়ে অগোছালো এই জীবণটা গুছিয়ে নিবে। এমন লক্ষ্মী মেয়ে ছাড়া আর কে ভালো পারতো এমন জীবণটাকে গুছাতে….

এ্যামি আর শোভনের বাবা একজন হলেও মা কিন্তু দুইজন। এ্যামির যে মা তিনি একে একে তিনটি মেয়ের জন্ম দেন। তারা বাঁচতো না, রহস্যজনক ভাবে মা*রা যেত এক বছর বয়সের মধ্যে। এ্যামির মা হুজুর বাড়ি, পানি পরা, আর তাবিজ কবজ করে ওকে জমের হাত থেকে কেড়ে এনেছিলো। তারপর ও আরো দুইটি মেয়ে হয়েছিল তার। তারা অবশ্য একটু বড় হতেই মা*রা গিয়েছিল। কিন্তু শোভন…..

শোভনের জন্ম হয় এক গণিকালয়ে। তার বাবার এক রক্ষিতার গর্ভে। তার বহুগামী পিতা এমন কত সন্তান কত জনের গর্ভে দিয়ে আসছে তার হিসেব কে জানে। এই যে এ্যামির মা, তার যে এত কষ্ট তার জন্য দায়ী এই স্বামী নামের লোকটা। তিনি নামমাত্র স্বামী ছিলেন তার পুরো জীবণে। আর ঐ লোকটার জীবণ ছিলো ব্যাবসা, ম*দ আর নারী নিয়ে। পুত্র সন্তান হওয়ায় তিনি শোভনকে এ বাড়িতে নিয়ে আসলেও মর্যাদা পান নি শোভনের জন্মদাত্রী মা। কে ওর মা, দেখতে কেমন তা ও জানে না। এই এক লোকের জন্য ওদের পরিবারটায় আনন্দ নেই, সুখ নেই। এত যে বয়স হয়েছে তার সেই স্বভাব এখনো ছাড়েন নি তাকে।

শোভনের ব্যাপারটা এ পরিবারে ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে আবার কেও জানে না। শোভন ওর জন্মের ইতিহাস ও জেনেছিলো ওর বাবার কাছ থেকেই, একবার ঝগড়া হয়েছিল তাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে ঐ লোকটা খোঁটা দিয়েছিলো তার পুত্র সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা নিয়ে। তার ছেলের দরকার ছিলো তাই নাকি তিনি…..

ছোট্ট বয়সে এসব না বুঝলেও আশেপাশের মানুষের ব্যাবহার ওকে ধীরে ধীরে বুঝতে শিখায় ও এই পরিবারের একজন হলেও সবার থেকে আলাদা। যদিও এ্যামি আপু কিংবা তার মা কখনই ভালোবাসায় কার্পণ্য করেন নি। আপনের মতোই আগলে রেখেছ। শোভনও মা কিংবা বোনকে ভালোবাসে আপনের মতোই। শোভনের যত রাগ, ক্ষোভ তার বাবার প্রতি। এমন একটা ঘটনা শোভনের জীবণে ছোটবেলা থেকেই ওকে কোনঠাসা করে রেখেছে। এই গাঢ় ক্ষত ও বয়ে বেড়িয়েছে ছোট্ট বয়স থেকেই। কে ওর মা, কোথায় আছে, বেঁচে আছে কি নাই… এসব প্রশ্ন ওকে খুব তাড়া করে। তাইতো নিজে এক কাঙাল হয়ে ধরতে চেয়েছিলো আরেক কাঙালের হাত। যে ওর কষ্টটা খুব করে বুঝবে। কিন্তু কি হলো……..

জীবণ কোন আপোসই করলো না কষ্ট দেবার বেলায়….
দুঃখ কত যত্ন করে কানায় কানায় ভরিয়ে দিলো ওর জীবণটাকে….

চলবে…

Previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=470586731772527&id=100064636124543
next:
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=474430081388192&id=100064636124543

(সবাই অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবা তোমাদের মতামত, অনুমান, ভাবনা গুলো…, আর যুক্ত হতে পারো আমাদের ফেসবুক গ্রুপ- Storymania-স্টোরিমেনিয়া তে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here