রোদেলা লেখা: মাহাবুবা মিতু পর্ব: ৪৬

0
608

রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৪৬

সুফিয়ান রোদেলাকে প্রথম দেখেছিলো ওর মিলের খুপড়ি ঘরে, যেখানে তাসের আড্ডা বসে প্রতিদিন। রাত তখন দেড়টা, সুফিয়ান তখন অর্ধ মাতাল। কারন ওরা আসার কিছুক্ষণ আগেই কয়েক পেগ ম*দ নিয়েছিলো ও। হঠাৎ ঐ ঘরে রোদেলাকে আসতে দেখে ওর অর্ধ গলিত চেতনা যেন ফিরে আসে। রোদেলা সে রাতে কালো একটা বোরকা পরে ছিলো। ভাইকে আটকে রাখার পরিস্থিতিতে কেও সেজেগুজে আসে না। একেবারে সাদামাটা ভাবে এসেছিলো ও। ওকে এত পবিত্র লাগছিলো দেখতে যে সুফিয়ান একেবারে গা ঝাড়া দিয়ে বসে। কেন এমন হয়েছিলো তা আজও ও জানে না।

মেয়েদের প্রতি সুফিয়ানের আগ্রহ শূন্যের কোঠায়। কারন মেয়েদেরকে অস্পৃশ্য মনে হতো ওর। এটা কোন রোগ না ব্যাধি তা ও জানে না। কিন্তু মেয়েদের প্রতি ওর এই অনুভূতিহীনতা কিন্তু সবসময় ছিলো না। ওরও ভালোবাসায় পূর্ণ একটা মন ছিলো।

সে রাতে কফি নিয়ে রোদেলা যখন ব্যাস্ত ছিলো, সুফিয়ান ব্যাস্ত ছিলো রোদেলাকে দেখায়। না, কোন কামুক চোখে না, দেখছিলো যেন এক পবিত্র মানবীকে। এত স্নিগ্ধতা, আর সরলতা ছিলো ওর মাঝে যা সকলের কাছে হয়তে সাধারণ কিছু, কিন্তু ঐ স্নিগ্ধতা, পবিত্রতা ওর ভালো লেগেছিল। কেমন একটা ব্যাথা বুকে চিনচিন করে উঠেছিলো সে রাতে।এটাকেই হয়তো বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট…..

রোদেলা ভুল করে যখন ওর পার্স ফেলে গেলো, অভদ্রের মতো সুফিয়ান পার্স থেকে ওর ছবিটা রেখে সেটা ফেরত দিয়ে আসে নিজে গিয়ে। ও কেন এমন করেছিলো তা নিজেও জানতো না। তবে মনের জং ধরা ধূলোপড়া অন্ধকার ঘরটায় একফালি আলো এসেছিলো যেন সে রাতে, যে আলো কলুষতাহীন, উষ্ণ, পবিত্র।

এরপর নোভেলের মারফতে রোদেলার সব জেনেছিলো সুফিয়ান। ওর জীবণ, অতীত, বর্তমান, পছন্দ, অপছন্দ সব। এত বছরে অবহেলায় যে নিজকে ঠেলে দিয়েছিলো অনিশ্চিত এক জীবণের দিকে, যার দায়িত্ব ছিলো শুধুই মা-ভাই-বোনের প্রতি। নিজের জন্য কোন সময়, ভাবনা ছিলো না সে সুফিয়ান একটু যেন থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকায়। নিজের প্রতি করা অন্যায় যেন এত বছরে গোচর হয় ওর চোখে। ও তো কোন অন্যায় করে নি, শুধু ভালোবেসেছিল। ঐ জীবণে যা ছিলো তা ভালোবেসে, তাতে কোন কলুষতা ছিলো না। তাহলে ও নিজেকে কেন শাস্তি দিচ্ছে দিনের পর দিন। ও যেন একটা ঘুমে ছিলো এতদিন, যা ভেঙে দিয়ে গেছে রোদেলা।

কলেজে পড়বার সময় ও যখন রাজনীতি করতো তখন একটা মেয়েকে ভালোবাসে ও। এক প্রকার জোর করেই ভালোবাসতে বাধ্য করে মেয়েটাকে। তারপর একে একে পাঁচ পাঁচটা বছর কাটে ভালোবাসায় ডুবে। সম্পর্কের গভীরতা এমন ছিলো যে কেও কাওকে ছেড়ে যাওয়া অসম্ভব। বিয়েতে সুফিয়ানের কোন সমস্যা ছিলো না। এমনকি সুফিয়ানের মা পর্যন্ত জানতে ওদের সম্পর্কের কথা, সম্পা প্রায়ই যেতো ওদের বাসায়। সুফিয়ানের মা ও ভালোমন্দ রান্না করলে ওকে নিয়ে আসতে বলতো। ছোট ভাইবোনরা তো রীতিমতো ভাবীই ডাকতো সম্পাকে। কিন্তু সম্পার বড় বোনের তখনো বিয়ে হয় নি, তাই ওর বিয়ে করা সম্ভব ছিলো না তখন। গোপনে বিয়ে করতেও তাড়া দিয়েছিলো সুফিয়ান অনেকবার। কারন ওকে হারানোর ভয় ছিলো সুফিয়ানের। কিন্তু সম্পা….
ও তো হারিয়ে যেতে চেয়েছিলো, তাই তো বাঁধা পরতে চায় নি বিয়ে নামের বন্ধনে। তাই হয়তো এত গড়িমসি বিয়েতে।

অনার্স যখন শেষ হলো, তখন সম্পা হুট করে কলেজ বদলে ফেললো। ওদের গ্রামের কলেজে মাস্টার্স ভর্তি হলো ও । বাড়িতে কি অসুবিধা হয়েছে এই অযুহাতে। সুফিয়ান মনে নিয়েছিলো সেটা। কিন্তু চোখের আড়াল মানেই তো মনের আড়াল। আস্তে আস্তে সম্পর্কের রঙ কেমন বদলে যেতে শুরু করে। সম্পা নানান বাহানায় ব্যাস্ততায় ওকে এড়িয়ে চলতে থাকে। ব্যাস্ত সুফিয়ান হঠাৎ করেই সম্পাকে ফলো করতে লোক ঠিক করে।

সে জানায় নতুন করে সম্পর্কে জড়িয়েছে সম্পা।
সুফিয়ান বিশ্বাস করে না। ওদের সম্পর্কের গভীরতা এত, এটা অসম্ভব। তবুও মনের কোথায় যেন সুতার টান লাগে। একটা সময় ওর সামনে সব পরিস্কার হয়ে যায়। প্রমান সহ হাতেনাতে ধরে ওদেরকে।

ও প্রায়ই যেতো ঐ ছেলের ফ্ল্যাটে…..
ছেলের বাবা মা দুজনই চাকুরীজীবি, তাই সুযোগ পেলেই ওরা এক হতে সেখানে। এত কিছু জানার পর ঘৃণায় সুফিয়ানের ওর সাথে কথাও বলতে পারছিলো না।

তবুও সম্পাকে জিজ্ঞেস করেছিলো কেন ও এমন করলো ওর সাথে । কোন উত্তর দিতে পারে নি সম্পা….. শুধু কেঁদেছিলো….

পরে সুফিয়ান জেনেছিলো সম্পা ওকে প্রয়োজনে ব্যাবহার করেছিলো। ওর যাবতীয় খরচ সুফিয়ান বহন করতো। সপ্তাহে সপ্তাহে মার্কেটিং, লং ড্রাইভে ঘুরতে যাওয়া, সাজেক, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবন, সেন্টমার্টিন এমন কোন জায়গা নেই যেখনে ওরা যায় নি এ পাঁচ বছরে। কি না করেছে ও এই মেয়ের জন্য….
আর দিনশেষে কি পেলো….?

অনেক কিছু করতে পারতো সুফিয়ান, কিন্তু কিছুই করে নি, জাস্ট থ মেরে গিয়েছিল, নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো সবকিছু থেকে। এরপর থেকে মেয়েদেরকে অস্পৃশ্য ভাবতে শুরু করে ও। যারা শুধু শরীরের প্রয়োজনে একজন পুরুষের শরীর খোঁজে….

অনেক ভেঙে পরেছিলো ও, ঘরবন্দী করে ফেলেছিলো জীবণকে। একটা সময় পরে অবশ্য সব ছেড়ে বাবার ব্যাবসায় ঢুকে নিজেকে ব্যাস্ত করে ফেলেছিলে। তাই তো বিয়েও করা হয় নি এই বত্রিশ বছর জীবনে।

যে সুফিয়ান রোদেলার জন্য নিজেকে খুঁজে বের করেছে আতীতের বন্ধ কুঠুরী থেকে সে নাকি ম*রে
গেছে….

সারা দুনিয়ায় এখন রোদেলার মৃ*ত্যু প্রতিষ্ঠিত, একমাত্র আবু সুফিয়ানই মানে না যে রোদেলা নেই। তাই ও ঐ বাড়িতে যায় না। যে বাড়িতে সবাই মেনে নিয়েছে রোদেলা মৃ*ত, ও ভাবে ওখানে গেলে হয়তো ও নিজেও মেনে নিবে এটাই সত্য। যেখানে কাছের মানুষেরা এত বছর চোখের সামনে দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো আর ও কয়দিন দেখেছে রোদেলাকে….?
সুফিয়ানের এই চিন্তা যদি মিথ্যা ও হয়, ও তাই নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। তাইতো ও সেদিন রোদেলার নামবাহী লা*শ*টার জানাযায় যায় নি।

তবে ওর ভীষণ আফসোস হয় রোদেলাকে মনের কথা বলতে না পারায়। নোভেলের কাছে শোভনের ব্যাপারটা জানার পর ও পিছিয়ে গিয়েছিল। ও মনে প্রাণে চেয়েছিলো রোদেলা ভালো থাকুক, সুখী হোক। তাই তো কাওকে কিছু না বলেই ফিরে এসেছিলো সেন্টমার্টিন থেকে।

কিন্তু পরে যখন জানলো যে ওর আর শোভনের বিয়ের ব্যাপারে রোদেলার অমত ছিলো তাই মা-মেয়ের কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে রোদেলাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় ওর মা, তা জানার পর সুফিয়ান যেন অন্ধকারে একটু আলো দেখতে পায়। ভাবে রোদেলাকে খুঁজে আর কালবিলম্ব না করে বলে দিবে মনের কথা। কিন্তু কি হলো…..

খোঁজাখুঁজি ঐ নাতিদীর্ঘ সময়ে একটি বারের জন্য ও ওর মনে হয়নি রোদেলা মা*রা যেতে পারে। অভিমানে কোথাও আত্নগোপনে আছে এটাই ছিলো ওর একমাত্র চিন্তা। কিন্তু কি হলো হঠাৎ করে….

তবে ওর মন বলছে রোদেলা আছে, তা না হলে মানুষ অপরিচিত মানুষের জানাজায় ও তো যায়, ওর কেমন যেন দ্বিধা লেগেছিল তখন। মন মানছিলো না যেতে। আয়রণ মিলের অফিসে ঘরে বসে কেমন ঘোরের মধ্যে ছিলো সে সময়টায় ।

হসপিটালের মর্গে যখন লা*শ*টাকে প্রথম দেখানো হলো ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো সেটার পায়ের পাতার দিকে। আর কিই বা দেখর ছিলো লা*শ নামের সে শরীরটার। পায়ের আঙুল গুলো কেমন অপরিচিত লেগেছিলো ওর।

রোদেলা যখন গান গেয়েছিলো সেন্টমার্টিনের দ্বীপে তখন দুই হাত দিয়ে হাঁটু ধরে হাঁটুর উপর থুতনি রেখে উবু হয়ে বসে গানটা গেয়েছিলো। তখন সুফিয়ান দেখেছিলো রোদেলার পা দুটো। সুফিয়ানের স্পষ্ট মনে আছে…. রোদেলার পায়ের আঙুলে মেহেদী পরা ছিলো, এ নিয়ে অনিমার সাথে কথাও হয়েছিলো একবার, এত সুন্দর রঙ দেখে অনিমা জিজ্ঞেস করেছিলো নেইল পলিশ কি না…?
রোদেলা তখন বলেছিলো সেটা পাতা মেহেদীর রং ছিলো। ও পাশ থেকে শুনেছিলো ওদের সেই আলাপ।

আর মর্গের ঐ পা গুলোর নখ ছিলো সাদা, পাতা মেহেদীর রঙ যেতে অনেকটা সময় লাগে, সেন্টমার্টিন থেকে ওরা এসেছে দুই মাসও হয় নি। এর মধ্যেই নখের মেহেদী চলে গেলো….?

যদিও একটুতেই এত বড় সিদ্ধান্তে আসা যায় না, যে ওটা রোদেলা না, তবুও ওর দৃঢ় বিশ্বাস রোদেলা আছে। এটা ওর মস্তিষ্ক কল্পনা প্রসূত ভাবনা নাকি সত্য তা ও জানে না। তবে ও যেটা জানে তা হচ্ছে রোদেলা আছে…..
এবং ও রোদেলাকে খুঁজে বের করবেই….

চলবে….
Previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=472921141539086&id=100064636124543
Next:
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=475325531298647&id=100064636124543

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here