রোদেলা লেখা: মাহাবুবা মিতু পর্ব: ৪৯

0
591

রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৪৯

এত এত খারাপ খবরের ভীড়ে একটা ভালো খবর হচ্ছে নাতাশা আর কল্লোলের ঘর আলো করে ফুটফুটে এক ছেলে এসেছে। দুই পরিবারের সবাই ভীষণ খুশি একে নিয়ে। সাতদিনের মধ্যেই আকীকা দিয়ে নাম রাখা হয়েছে। বিষাদের ঘন অন্ধকার যেন কাটতে শুরু করেছে ওই ছোট্ট সোনামণিরই মধ্য দিয়ে। এ্যামী সিলেট যেতে যে উদ্যোগ নিয়েছিলো তা চুলোয় গেলো। এমন পরিস্থিতিতে যাওয়াটা ঠিক হবে না, তার উপর ও নিজেও গিয়ে শান্তি পাবে না।
কল্লোলের ছেলে এ বংশের প্রথম সন্তান। তাকে নিয়ে সবার আমোদ তাই একটু বেশীই….
এতদিনে যেন একটু সুযোগ পেয়েছে মানুষগুলো হাসবার…
আনন্দ করবার…

এ্যামী তাই শ্বাশুড়িকে কোনমতে কনভেন্স করেন আরো কয়েকটা দিন থাকতে। সব পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি অমত হন নি। সত্যি বলতে এ্যামীর শ্বাশুড়ি ওকে অনেক ভালোবাসে। কারন এ্যামী যেমনি বড় ছেলের বউ তেমনি নিষ্ঠার সাথে সব দায়িত্ব হাসিমুখে পালন করে এসেছে এত বছর ধরে। বিয়ে কিংবা অনুষ্ঠান ছাড়া তেমন আসা হয় না ওর বাবার বাড়িতে। তাই হয়তো….

শোভন এ আমেজে নিজে যোগ না দিলেও যারা নতুন বাবুকে দেখতে আসে তারা একটু সময় শোভনকেও দিয়ে যায়। সকাল বিকেল মানুষের এমন আসা-যাওয়ায় বাড়িটা গমগম করতো সারাদিন। এসব শোভনের ভালো লাগতো না। ও একা থাকতেই ভালোবাসতো….

নাতাশার মা আসতে পারে নি অসুস্থ স্বামীকে রেখে।হসপিটালে তাই নাসিমারা তিন বোন ভাগাভাগি করে ছিলো নাতাশার সাথে। বড় মামী যদিও প্রতিদিনই আসেন মেয়েকে দেখতে। প্রিসিলা ততক্ষণ মামাকে দেখে রাখে। ওদেরকে বাসায় আনার পর প্রিসিলা একদিন বড় মামীর সাথে আসে নাতাশার বাচ্চাকে দেখতে। প্রিসিলা শোভনের সাথে দেখা করতে যায়। সেখানে ও শোভনের এমন অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে যায় । শোভন তখন বারান্দার মেঝেতে বসে ছিলো। চেয়ার টেবিলে সাজানো এত সুন্দর একটা বেলকনিতে শোভন কিনা বসে আছে মেঝেতে…!
প্রিসিলার ঘরে ঢোকার শব্দ শুনে সেদিকে তাকায় শোভন…
প্রিসিলাকে দেখে একটা মলিন হাসি হাসলো শোভন।

থমকে দাঁড়িয়ে থাকে প্রিসিলা শোভনের এ হাল দেখে , যেন ওর পুরো পৃথিবীটা থেমে গেছে। শোভন দেখতে খুবই সুদর্শন একজন পুরুষ। এ কয়দিনের ব্যাবধানে কি অবস্থা হয়েছে তার…! মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, উস্কো খুস্কো চুল…
শোভনের এমন অবস্থার কথা প্রিসিলা জানতো না। তাই ওর অবাক হওয়াটা একটু বেশীই…

মেঝেতে শোভনের পাশে বসে ওকে জিজ্ঞেস করে –
: এমন অবস্থা কেন আপনার….?
উত্তরে আবার একটা মলিন হাসি হাসে শোভন…, এটাই যেন ওর প্রশ্নের উত্তর….
: কেন এমন কষ্ট দিচ্ছেন নিজেকে…
এবার প্রিসিলার চোখে চোখ রাখে শোভন…
কিছু সময় চেয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়..
: যা হওয়ার তা হয়েছে, তাতে তো আপনার কোন হাত ছিলো না, খোদা হয়তো এতেই আপনার মঙ্গল লিখে রেখেছেন…
কিছুক্ষণ মৌন থেকে শোভন বলে-
: তাকে কে বলেছে আমাকে নিয়ে এত ভাবতে, খুব তো ছিলাম আমি অপেক্ষায়, রোদেলাকে পাবো, পাবো….
পরিবারের সাথে যুদ্ধ করে যখন সব গুছিয়ে নিলাম, তিনি…….
তিনি…. রোদেলাকেই উঠিয়ে নিলেন। এই হচ্ছে তোমার খোদা, যিনি সারাটা জীবন আমার সাথে একটার পর একটা অন্যায় করেই গেছেন, করেই গেছেন…..
: ভাইয়া প্লিজ এসব আর ভাববেন না আপনি..
আয়নায় দেখেছেন নিজের চেহারা….
: আয়না….
তোমার বোন আমার জীবনের আনন্দ, সুখ, ভালোবাসা সব সাথে করে নিয়ে গেছে….
কাঁদতে থাকে প্রিসিলা….
: একটা মজার কথা শুনেছো….? বাড়ির সবাই আমাকে বিয়ে দিবে ভাবছে….
বলেই হাসতে থাকে শোভন…
আমি ভেতর থেকে আগেই ভাঙাচোরা, আর রোদেলা আমাকে গুড়িয়ে দিয়ে গেছে… এই গুড়িয়ে দেয়া মানুষকে কিভাবে…. ধ্যাত বাদ দাও…
প্রিসিলা শোভনকে বলে- আমি শুনেছি এ কথা… তারা আপনার ভালোই চায়…. বিশ্বাস করুন আমি যদি আরেকটু বড় হতাম, আমিই আপনাকে বিয়ে করতাম…
আপনি রাজি না থাকলেও জোর করে আপনাকে বিয়ে করতাম…,
কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয় শোভন, চোখ মুছতে মুছতে হাসে প্রিসিলাও…

আপনি নিজের জীবণকে কেমন এলোমেলো করে রেখেছেন, আমি এতদিন শুনেছি শুধু আপনার শরীর ভালো না, আজ দেখলাম কি করেছেন নিজেকে। এসব বাদ দিয়ে স্বাভাবিক হন, আপনি কি চান আপা কষ্ট পাক….
: মানে…
: তাকে কষ্ট দিতেই তো এসব করছেন আপনি….
তা না হলে কেন এমন করবেন নিজেকে….
: তুমি অনেক ছোট্ট, এসব জটিল ব্যাপার তুমি বুঝবে না…
: এতটাও ছোট আমি নই….
: মুচকি হাসে শোভন…
: ভাইয়া প্লিজ আপনি এসব ভাবা বন্ধ করুন, আপনাকে ভালো থাকতে হবে… আপনার চিন্তায় চিন্তায় সবাই অসুখী…
আপনি তা জানেন….?!
: যদি এতটাই সহজ হতো, যতটা সহজে তুমি বলছো আমাকে স্বাভাবিক হতে….
অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে আসে প্রিসিলা….
শোভন পেছন থেকে ডাকে ওকে…
কিছু একটা বলতে চায় হয়তো… আবার চুপ হয়ে যায় ও বলে-
: কিছু না তুমি যাও, ভালো থেকো….

সেখান থেকে বের হয়ে যায় প্রিসিলা। নতুন বাবুকে দেখা হলে ফিরে যায় বাড়িতে…..

এদিকে সেদিনই হঠাৎ করে বেশ অসুস্থ হয়ে যায় শোভন, হসপিটালে এডমিট করতে হয় ওকে। হঠাৎ প্রেশার ফল করায় কেমন যেন অচেতন হয়ে যায় ও। অতিরিক্ত চিন্তাই হয়তো এসবের কারন। একদিন থেকে পরদিন ই রিলিজ করে দেয় ডাক্তার। কিছু ঔষধ দেয় প্রেসার কন্ট্রোলের জন্য। ওর বন্ধুরা বাসায় আসে ওকে দেখতে। কাছের কিছু বন্ধুরা খুব জোড় করে ব্যাপারটা জানতে… কি হয়েছে ওর, কেন এই অবস্থা… সেখানে এ্যামী সব খুলে বলে শোভনের সম্পর্কে।
ওরা ওর খুব কাছের বন্ধু তাই তিনি আর কিছু লুকান না।

সব শেষে ওদেরকে বলে শোভনের জন্য একটা মেয়ে দেখতে। যতদ্রুত সম্ভব ওকে বিয়ে দিতে চায় সবাই….
এ কথা শুনে চোখ চাওয়া চাওয়ি করে ওরা।

এ্যামী বলে তারা এমন একটা মেয়ে চায়- যে সব জেনে শুনে ওকে ভালোবেসে আগলে রাখবে…
আর কোন চাহিদা নেই তাদের…
সেদিনকার মতো রাতে সব বন্ধুরা চলে যায়।

পরদিন এ্যামীও গুছগাছ করে সিলেটে যাওয়ার জন্য। ওর একাই যেতে হবে সিলেটে, ওর বর শুক্রবারের আগে আসতে পারবে না নতুন প্রোজেক্টের কাজের চাপে। তাই ওর বাবাই ওকে পৌঁছে দিবে সিলেট। এমন কথাই তিনি বলেছেন সকালে। মা হয়তো অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছিলেন তাকে। কিন্তু হঠাৎ তারও কাজ পরে যাওয়ায় তিনি ভীষণ বিরক্ত, এ্যামীকে ফোনে সে কথা বলতেই খুবই শান্ত ভঙ্গিতে কোন উত্তর না দিয়েই মোবাইল রেখে দেয় ও। তিনি অবশ্য এ্যামীর মামাতো ভাইকে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দিলেন । কিন্তু এ্যামী বলল কাওকে যেতে হবে না আমি একাই পারবো যেতে…..

এসব ব্যাপারে এ্যামীও বিরক্ত, ও জানতো শেষ পর্যন্ত তিনি যাবেন না ওকে দিয়ে আসতে, এত বছরের জীবণে একবারও এমন হয় নি যে বাবা দিয়ে এসেছেন কিংবা আনতে গিয়েছে এ্যামীকে। এটা মেনে নিয়েছে ও। ওর অতি ব্যাস্ত বাবার জীবনে ওদের জন্য সময় খুবই কম। বাড়ি ভর্তি ছিলো মেহমানে। তারা চলে গেছে এইতো কিছুক্ষণ….
ড্রইং রুমের সোফায় বসে কাঁদছে এ্যামী….
নিজেকে বকছে ও…
কেন কাঁদছে তাই…
ওর বাবা তো শুরু থেকেই এমন…
তাহলে নতুন করে কাঁদার কি আছে….

এ্যামী এখনকার ঘটনায় কাঁদছে না কাঁদছে ছোটবেলার এক ঘটনা মনে করে। এ্যামী যখন ক্লাস টুতে পড়তো তখন একদিন ওর মায়ের হঠাৎ পা কে*টে যায় বটিতে। তাই তিনি ওর বাবার অফিসে ফোন করে দেয় যে মেয়েকে যেন বারোটার সময় স্কুল থেকে নিয়ে আসে…

সেদিন স্কুলে ছিলো বড়দের কি এক অনুষ্ঠান, ঠিক মনে পরছে না ওর। স্কুলের টিচার, স্টাফ সবাই ভীষণ রকমের ব্যাস্ত। সেদিন এ্যামী বারোটা থেকে চারটা অব্দি দাঁড়িয়ে ছিলো স্কুল গেইটের বাইরে। ওর অসুস্থ মা যখন ঘুম ভেঙে দেখে তার মেয়ে এখনো ফিরে নি স্কুল থেকে, তিনি ফোন করেন এ্যামীর বাবার অফিসে, তখন তো টেলিফোনের যুগ, হাতে হাতে ফোন ছিলো না। পিওন বলে স্যার অফিসে নেই, জরুরি মিটিং এ গেছেন…

উপায়ন্তর না দেখে কাটা পা নিয়েই তিনি স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হন, গিয়ে দেখেন তার মেয়ে স্কুলের বাইরের একটা গাছের বেদীতে মুখ গোমড়া করে বসে আছেন….

এ ঘটনাটা খুব গাঢ় ভাবে দাগ কাটে ছোট্ট এ্যামীর মনে। এরপর বেশ কিছু দিন কথাও বলে নি সে বাবার সাথে…
সময়ের আবর্তনে এসব কথা কোথায় হারিয়ে গেছে, কিন্তু জীবণে যখনই বাবার কাছ থেকে কোন কষ্ট পায় ও, এখনো ওর মনে পরে ঐ দিনটার কথা….
ঐ কষ্টের কথা।

এমন সময় কলিং বেল বাজে…
একবার…
দুইবার……
গেইটের বাইরে থাকা ব্যাক্তি কলিং বেলের শব্দের মধ্যে দিয়ে নিজের ভেতরকার অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে, উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে, বিরক্ত মুখে এ্যামী দরজা খুলতে যায়…

দড়জা খুলে অবাক হয়ে যায় এ্যামী….
এত রাতে গেইটের বাইরে যাকে দেখলো তাকে দেখে হতবাক এ্যামী, দ্রুত ঘড়িতে তাকায় ও, দেখে এগারেটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট….
দড়জায় দাড়িয়ে থাকা মেয়েটি বললো-
: কেমন আছেন আপু…?

চলবে…
(কমেন্ট না করে কেও যাবা না…😅)

Previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=476846427813224&id=100064636124543
next :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=479432694221264&id=100064636124543

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here