রোদেলা লেখা : মাহাবুবা মিতু পর্ব: ২৯

0
714

রোদেলা
লেখা : মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ২৯

মুখের উপর দড়জা আটকে দিলেও শোভন কিন্তু কষ্ট পায় না মোটেই, উল্টো হেসে দেয়। যোহরের আজান ওর এই হাসির কারন। কারন কোথাও ও শুনেছে আজানের সময় দোয়া কবুল হয়, মনে মনে বলে আল্লাহ ওর দোয়া যেন কবুল করে।

কিছু সময় দাঁড়িয়ে আবার টোকা দেয় শোভন। কোন সাড়া পাওয়া যায় না ওপাড় থেকে। আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার টোকা দেয়। এবার রাগে তেড়ে আসে রোদেলা। খুব করে কিছু একটা শুনিয়ে দিবে বলে মনে মনে প্রস্তুতি নেয় দড়জার কাছে এগুতে এগুতে…..

প্রচন্ড আক্রোশে দড়জা খুলতেই দেখে প্রিসিলা দাঁড়িয়ে। সমুদ্রস্নান শেষে রুমে ফিরে এসেছে। প্রিসিলা ঘরে ঢুকতেই রোদেলা বাইরে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক খুঁজে শোভনকে, নাহ…
কোত্থাও নেই সে….
: প্রিসিলা বলে কি দেখছিস আপা…?
: নাহ্ কিছু না…

দুপুরে খাবার সময় হলে কোন মতে তৈরী হয় রোদোলা। এবার যদি না যায় তাহলে খারাপ দেখাবে ব্যাপারটা। সবাই অযথাই চিন্তা করবে ওকে নিয়ে। তাই তৈরী হয়, কিন্তু মনে প্রাণে প্রতিজ্ঞা করে, শোভনের দিকে তাকাবে না ও….

যেই ভাবা সেই কাজ, ডাইনিং টেবিলের এক কোণে বসে রোদেলা সাথে প্রিসিলা। সবাই একে একে আসলো ডাইনিং হলে, অশোভন ছেলেটা হুট করে কোত্থেকে আসলো।
শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রোদোলার চোখ পরে গেলো শোভনের দিকে। শোভন ওর পাশের চেয়ারটাতে এগিয়ে আসতেই রোদেলা ওর হাতের ব্যাগটা রেখে দিলো সেই চেয়ারটাতে । ছোটবেলায় ক্লাসে বন্ধুদের জন্য জায়গা রাখার ভঙ্গিতে। এ ছেলেকে বিশ্বাস নেই। হুট করে বসে পরবে ওর পাশেই…
ও ওর পাশে বসতে দেবে না শোভনকে।

শোভন ও কি কম যায়…! চেয়ারে রাখা ছোট ব্যাগটাকে হাতে তুলে বসে পরলো রোদেলার পাশের চেয়ারটাতে। ব্যাগটাকে ওর কোলে রেখে দিলো এক হাত দিয়ে ধরে। রাগে শরীর রিরি করছে রোদেলার, কেমন ফাজিলের ফাজিল। লজ্জা শরম একটু যদি থাকতো।

শোভনের বোন এ্যামির একটু দেরি হয়ে গেলো আসতে। বাচ্চাটাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে এসেছেন তিনি। এসেই রোদেলার পাশে শোভনকে দেখে একটু বিরক্ত হন তিনি। ভ্রু কুঁচকে তাকায় একবার সেখানে।

রোদেলা দ্রুত খাবার শেষ করলো। তেমন কিছু খেতে পারলো না। গত রাতে জ্বর এসেছিল। মুখে সব কিছু বিস্বাদ লাগছে ওর। খাওয়া শেষ করে বসে রইলো রোদেলা ব্যাগটার জন্য। ব্যাগটা চাইতে ইচ্ছে করে না ওর পাছে কথা বলতে হবে ওর সাথে। একটু ভেবে শেষে উঠে গিয়ে প্রিসিলাকে বললো
: খাওয়া শেষে আমার ব্যাগটা নিয়ে আসিস মনে করে…

হাত ধোয়ার জন্য বেসিনের কাছে গিয়ে দেখলো কল্লোলের মা গুলশান আরা বেগমের সাইড ব্যাগের হাতল ছিড়ে গিয়েছে। তিনি সেটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ।

রোদেলা কি হয়েছে জানতে চাইলে বললো-
: দেখো তো কি অবস্থা হলো, একটাই ব্যাগ এনেছি, সেটার হাতলটাও ছিঁড়ে গেলো। এখন কি হবে….!?

রোদেলা বললো
: চিন্তা করবেন না আন্টি…
একটু অপেক্ষা করুন আমি আসছি….
একটু পরই সুঁই সুতা হাতে রোদেলা এলো ওর রুম থেকে। দাঁড়িয়েই সেটাকে সুন্দর করে সেলাই করে দিলো রোদেলা। বললো আপাততঃ এভবােই চলুক। কোন মুচি চোখে পরলে মজবুত করে সেলাই করে নিবেন।

তিনি তো সেই অবাক, এই দ্বীপদেশে সুঁই সুতা কোত্থেকে আসলো। জিজ্ঞেস করতেই উত্তরটা দিলো বড় মামী। তিনি বললেন-
: আরে আপা আমাদের রোদেলা তো পুরোদস্তুর লক্ষ্মী একটা মেয়ে। ওর লাগেজের পকেট হাতরে আপনি ম্যাচ, মোম, কাপড় শুকানোর দড়ি, সুই সুতা, কেঁচি সবই পাবেন..

শোভন কোত্থেকে এসে বললো-
ম্যাচ দিয়ে কি হবে…?!
আপনাদের রোদেলা আবার সিগারেট খায় নাকি…!?

শুনে সবাই একসাথে হেসে দিলো, রোদেলার মুখে বিরক্তির ভাব। সে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। খাওয়া শেষ করে এ্যামি এসে ব্যাগটা রোদেলার হাত থেকে নিয়ে দেখতে দেখতে বললো-
: ব্যাগ ভালোই সেলাই হয়েছে। আসলেই লক্ষ্মী মেয়ে রোদেলা, তবে জানেন তো একটা কথা আছে- “অতি বড় রুপসী না পায় বর, অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর”
কথাটা বলে ব্যাগটা ফেরত দিয়ে তিনি দ্রুত ভঙ্গিতে চলে গেলো।

মুহূর্তেই সকলের মুখ পানসে হয়ে গলো। যেন হঠাৎ একটা দমকা ঝড় বয়ে চলে গেছে সেখানে… তার আকস্মিকতা এই নিরবতার কারন। রোদেলা ব্যাগটা তার হাতে দিয়ে সুঁই সুতা গুছিয়ে ওর রুমে চলে যেতেই ওর হাতটা ধরলো কল্লোলের মা গুলশান আরা…

: রাগ করেছো মা…
: না আন্টি, ছোটবেলা থেকে এসব শুনে আমাদের অভ্যাস আছে…
বলেই মলিন একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। বড় মামী ও আহত হলেন এ্যামীর এ ব্যাপারে… তারপর তারা সেখানে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন। শোভন ওর রুমে গেলো। শেষ কথাটা ওর বুকে যেন বিঁধলো।

বিকেলে ছেড়া দ্বীপে যেতে ঝুঁক উঠালো নোভেল। বড়রা কেও যাবে না বললো কারন অনেক দূর থেকে নাকি ট্রালার থেকে নৌকায় নামিয়ে দেয় এবড়ো-থেবড়ো কোরালের কারনে।
বড়দের এসব ধকল সইবে না। এ্যামি আপুও গেলেন না তার বাচ্চা ছোট….

কল্লোল গেলো ট্রলার ভাড়া করতে, সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে। তাই দেরি না করেই রওনা দিলো ওরা। বাকীরা যে যার মতো ঘুরবে বীচে।

প্রিসিলা, নোভেল, এ্যামির বর শাহেদ, কল্লোল, আর নাতাশা। এরাই গেলো। কল্লোল আবু সুফিয়ান কে কল দিয়ে জানালো তারা যাবে কি না। মিনিট পনেরো পর তারা তিনজনও যোগ দিলো। কিন্তু রোদেলা এলো না। শোভন মনে মনে ভেবেছিলো ওখানে গিয়ে ওকে সুযোগ বুঝে সরি বলবে। কিন্তু রোদেলা না গেলে তো তা সম্ভব না।

নাতাশাকে জিজ্ঞেস করলো রোদেলার কথা। নাতাশা বললো ও তো আসবে না, শোভন বললো আহা…! এত সুন্দর জায়গাটা মিস করবে…

আচ্ছা ভাবি আরেক বার বলে দেখেন তো, রাজি হয় কি না।
নাতাশাকে দিয়ে কল করালো শোভন রোদেলাকে। রোদেলা বললো ও আসবে না। ওর ভালো লাগছে না….

কি করবে শোভন কিছুই ভাবতে পারছে না। আগামীকাল কল্লোল আর নাতাশাকে রেখে সবাই ফিরে যাবে ঢাকায়। আর কি সুযোগ হবে ওর সাথে কথা বলার….

অনেক ভেবে বের করলো ও রয়ে যাবে, যাবে না ছেঁড়া দ্বীপে। কিন্তু থেকে যে যাবে তা কিভাবে….?

বুদ্ধিতে কুলোয় না, কি করবে শোভন। পরে ওর এক বন্ধুকে মিসডকল দেয়। বন্ধু ব্যাক করতোই শুরু করে নাটক…
: ও বাবা, আচ্ছা….
হ্যাঁ, আমি আসছি, আচ্ছা আচ্ছা….

ফেইক একটা কল আসার নাটক করে ট্রলার ছাড়ার আগ মুহূর্তে নেমে পরে। ওর বাবা কল দিয়ে আসতে বলেছে এমন একটা নাটক করে নেমে পরে ও। সবাই বিপদ ভেবে সাথে আসতে চায়। কিন্তু শোভন কোন মতে ম্যানেজ করে নেমে যায়।

কিভাবে যে আসলো। আল্লাহই জানে কি ভাববে ওর সম্পর্কে, নাকি কল দিয়ে জিজ্ঞেস করবে আবার ওর বাবাকে….
ব্যাপার কি তা জানতে…

রোদেলার কোথায় আছে সে খবরটা নিবে কিভাবে ভাবতে থাকে সেকান থেকে ব্যাক করতে করতে। ও যদি বীচে এলোমেলো ভাবে ঘুরে তাহলে তারা দেখে ফেলবে ওকে । একটা দোকানে বসে কল করে হাবিবকে….

খবর নিতে বলে রোদেলা কোথায়, সেখানে থেকেই কল দিতে বলে হাবিবকে। হাবিব প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট পর খবর দিলো রোদেলা সমুদ্র বিলাসের কাছে হাঁটছে আবু সুফিয়ানের মায়ের সাথে।

দ্রুত একটা রিকশা নিয়ে সেখানে পৌঁছায় শোভন দশ মিনিটের মধ্যে । দূর থেকে দেখে একটা গাছের গুড়িতে বসে কথা বলছে দুজনে। হাবিবের ফোন কল দিতে বলে ওকে, যে বল আপনারে বড় মামী আসতে বলছে…
হাবিব আমতা আমতা করে, ও সহজ সরল মানুষ, এসব ঝামেলা কম বুঝে… শোভন অনুরোধ করলো ওকে, টাকা দিয়ে ম্যানেজ হবার ছেলে হাবিব না তা এত বছরে জানে শোভন।

ফোন দেয় রোদেলাকে,
: হ্যালো আফা…
: কে…
: আফা আমি হাবিব…
: ও হাবিব…, নাম্বার কই পেয়েছ…?
: বড় মামী দিলো, তার ফোনে টাকা নাই, আপনারে জলদি আসতে বলছে রিসোর্টে…
: কোন সমস্যা…
: তা তে বলে নাই আমারে, বললো তার টাকা নাই ফোনে কল দিতে বললো…
: আচ্ছা….

ফোন কেটে আবু সুফিয়ান এর মাকে বলে চলে আসে,
তিনি জানাতে চান কোন সমস্যা হয়েছে কিনা, তাহলে তিনিও আসবেন।

রোদেলা তাকে বললো তেমন কিছু না, আমি জানাবো আপনাকে কি ব্যাপার। চিন্তা করা লাগবে না আপনার…

চলে এলো রোদেলা, বসে রইলেন তিনি রোদেলার দিকে মুখ করে। একটু দূর হাঁটতেই একটা বিশাল নৌকায় আড়াল হয়ে গেলো রোদেলা, চেয়ে চেয়ে দেখলেন আবু সুফিয়ানের মা সুফিয়া বেগম…

এই মেয়েটাকে দেখাতে তার ছেলে হুলুস্থুল করে একঘন্টার গুছগাছে নিয়ে এসেছে সেন্টমার্টিনে…
এতদূর আসা তার বৃথা যায় নি….
মনে মনে তৃপ্তির হাসি হাসেন উনি…

চলবে….

Previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1517850978676088/
next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1519216561872863/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here