রোদেলা লেখা: মাহাবুবা মিতু পর্ব : ৪২

0
710

রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব : ৪২

রাত এগারোটা, স্থান বুড়িগঙ্গা ব্রীজের উপরে। এত রাত হওয়ায় লোকসমাগম কমেছে এখানে, এমনিতে অনেক ভীড় থাকে, ঢাকা শহরের মানুষের বিনোদনের জায়গা খুবই কম। তাইতো বুড়িগঙ্গার পঁচা পানির গা গুলানো গন্ধ থাকার পরও কত মানুষ আসে এখানে ঘুরতে।

এত রাত হওয়া সত্ত্বেও জোড়া জোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিছু মেয়েও স্থানে স্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেমন উদ্ভট সাজ সেজে। বিশ্রী অঙ্গভঙ্গিতেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তাদের দাঁড়িয়ে থাকার কারন।

রোদেলা দাঁড়িয়ে আছে বুড়িগঙ্গা ব্রীজের উপরে ফুটপাতের রেলিং ধরে। ভাবছে আ*ত্ন*হ*ত্যাটা কিভাবে করলে কম কষ্টে অল্প সময়ের মধ্যে ম*রা* যাবে। পানিতে লা*ফ দেওয়ার কথা ভেবেছে, ও সাঁতার জানে, তাছাড়া এখানে ঝাঁপ দিলে জানাজানি হয়ে যাবে, ম*রার নিশ্চয়তা এক্ষেত্রে ৫০/৫০।

বড় একটা গাড়ি দেখে সামনে দাঁ*ড়ি*য়ে যাবে কি…?
গাড়ি গুলো দেখেই ভয় করছে ওর। ব্যাগের ফোনটা অনবরত বেজেই চলেছে। বাড়ির লোক ফোন করছে নিশ্চয়ই। সেদিকে খেয়াল নেই রোদেলার। ও দ্রুত ভাবতে থাকে কম কষ্টে আর কম সময়ে কিভাবে কাজটা করা যায়…

ফোনটাকে এরোপ্লেন মুড করে রাখে রোদেলা। ভাবতে থাকে জীবণের কথা। ওদের কৃষ্ণচূড়া বাড়িটা এখান থেকে দিনের বেলা দেখা যায়। এখন অন্ধকার হওয়ায় দেখা যাচ্ছে না। ও দাঁড়িয়ে থাকে চোখ বন্ধ করে। একটু ভাবার চেষ্টা করে, হাতড়ে বেড়ায় এমন কোন কারন যাকে অবলম্বন করে এ যাত্রায় বাঁচা যায়। কি চেয়েছে জীবনে, অর্থ, বিত্ত, জশ, প্রতিপত্তি কিছুই চায় নি, চেয়েছে নিজের মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা। জীবণটা এমন ওদের যে বাবা-মা দুজন থাকা সত্ত্বেও ওরা এতিম। কারো ভালোবাসা পায় নি জীবণে, অবজ্ঞা, অবহেলা, লাঞ্ছনা, এই ছিলো ওদের প্রাপ্তির ঝুলিতে ভরতি। আজ যে জীবন ওকে এখানে দাঁড় করিয়েছে তার জন্য একমাত্র এবং একমাত্র দায়ী ওর বাবা মা।

আজ যে এত কঠোর ও হয়েছে জীবণের প্রতি এটার কারন কি….?

সবাই কঠোরতা দেখে কিন্তু ওদের পরিস্থিতি কেও বুঝে না। একটা সময় ভাবতো রোদেলা বড় হয়ে চাকরী করবে, অফিসার হবে, কিন্তু ও এখন বুঝে গেছে সবার আগে একটা মেয়ের ভালো মা হওয়া কতটা জরুরি। ওর মা সব সময় ভাবতো মেয়েরা তো আমার আছেই, কই আবার যাবে আমায় ছেড়ে, ওদের তাই তোষামদ করবার কিছু নেই। তাই সব সময় নিজের মেয়েদের চেয়ে অন্যকে প্রায়োরিটি দিতো। যা একসময় ওদেরকে কোনঠাসা করতে করতে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে…..

আর ভাববে না এসব রোদেলা, ম*র*বা*র আগে জীবণের সুন্দর সুন্দর স্মৃতি গুলো মনে করার চেষ্টা করে ও। এলোমেলো বাতাসে ওর মুখের উপর চুল আছড়ে পরছে। সামনে সুন্দর নদীর রাতের দৃশ্য…
ক্ষণে ক্ষণে আসা জাহাজ কিংবা লঞ্চের আলো পরে পানি চিকচিক করছে।

দ্রুত জোড়া লাগাচ্ছে ও সব আনন্দের টুকরো টুকরো স্মৃতি গুলোকে। দু-একজন মধ্য বয়সী লোক ঘুরঘুর করছে রোদেলার আসেপাশে। চোখে তাদের বিশ্রী ইঙ্গিত হয়তো। সোখানে তাকায় না রোদেলা। তারা এখনো দেখছে ওকে, অন্য দিকে মুখ করা রোদেলা তবুও বুঝতে পারে তারা চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলছে ওকে ।

একটা ছেলের বাজে কথায় হঠাৎ সংবিৎ ফিরে রোদেলার, কেমন যেন অস্বস্তি লাগে ওর। ছেলেটার কথায় ওর কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে যেন। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় ও এক পলকের জন্য। মনে মনে ভাবে এত সুন্দর চেহারা অথচ ভিতরটা ততই কুৎসিত …..।

কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল ওর, কিন্তু কিছু না বলোই দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে ও। ছেলে দুটো ওর পিছু পিছু হেঁটে চলছে…..

এমন পরিস্থিতিতে একটু যেন ভয় পায় রোদেলা। ব্রিজটা মোটামুটি ফাঁকাই, ছেলে দুটো একটা বাইকে করে স্লো করে রোদেলার পাশ দিয়ে যাচ্ছে। কথাবার্তায় অশ্লীল ইঙ্গিত। পেছনের ছেলেটা বললো নিয়া নেই লগে কইরা মামা, রাইখা খামুনি….!

রোদেলার বুক কেঁপে উঠে, এমন কথায়, দ্রুত পা চালায় ও। দৌড় দিলেও পারবে না, কারন ওরা বাইকে করে পিঁছু নিয়েছে। কোন দিকে না চেয়ে সোজা হাঁটে ও, বাইকের পেছনের ছেলেটা রোদেলার ওড়না ধরে টান দেয়। রোদেলা কেন মতে ওড়নাটা ছাড়ায়, ভয় ঢুকে যায় ওর মনে। দ্রুত সাই-সাই করে বড় বড় গাড়ি চলে যাচ্ছে, তারা হয়তো এসব লক্ষ্যই করছে না।

এদিকে ছেলেদুটির কুৎসিত হাসি আর কথা বার্তায় রোদেলা এত ভয় পাচ্ছে যে ওর পা কাঁপা শুরু করলো। একটু আগে যে ও আ*ত্ন*হ*ত্যা করবার সহজ পথ খুঁজছিলো তা ভুলেই গেলো বেমালুম। মাথা থেকে জাস্ট উড়ে গেলো সব। এই মুহূর্তে এখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচে ও ।

পেছন থেকে একটা সিএনজি এসে বাইকের সামনে থামলো। চেয়ে দেখলো সেটা খালি। ড্রাইভার যাত্রী সিটের গেটটা খুলে দিলো। কোন কিছু না ভেবে সিএনজি তে উঠে পরে ও। নিজেই আটকায় সেই গেইটটা। বাইকে করে ছেলে দুটো তখনো পিছু পিছু আসছে। রোদেলা বলে, মামা একটু জোরে চালান।
বাইকটা সিএনজির পাশাপাশি চলছে। দুজনেই খুব গালাগালি দিতে থাকে ড্রাইভারকে। ভয় দেখায় শাসায় গাড়ি থামাতে। না থামালে কি পরিস্থিতি করবে ওর তাও বলতে থাকে ওরা। এ পর্যন্ত ড্রাইভার কোন কথাই বলে নি।

এমন সময় হাসনাবাদের মোচড়ে একটা বড় গাড়ি ইউটার্নে ঘুরবে, সিএনজির ড্রাইভার হয়তো বুঝতে পেরেছে ঐ ছেলে দুটোর খারাপ মতলবের কথা তাই তিনি অনেক বড় একটা রিস্ক নিয়ে সিএনজিটা ঐ বড় কাভার্ড ভ্যানের মোড় ঘুরানোর আগেই পার হওয়ার জন্য স্পিড বাড়ালেন। ড্রাইভার হয়তে নিজেও জানতো না কি করতে যাচ্ছেন তিনি। পুরো দৃশ্যটা পুরোই সিনেমাটিক। এ দৃশ্যের বর্ননা ভাষায় দেয়া সম্ভব না।

সিএনজির এমন আ*ত্ম*ঘা*তী স্পিড দেখে এত বড় গাড়িটা হার্ড ব্রেক করলো। ভাগ্যিস সময় মতো হার্ড ব্রেক করেছিলেন। তা না হলে এত বড় কাভার্ড ভ্যানের তলায় সিএনজি পিষ্টে যেতো। সিচুয়েশনটা এমন যেন কেও হাতে করে ঐটুকু পার করে দিলো ওদের । কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে লাগলো সিএনজির ড্রাইভারকে। তিনি ওভারটেক করে এমন পরিস্থিতিতে গাড়ি মুভ করায়। রোদেলা সিএনজি থেকে মুখ বের করে দেখলো পেছনে। মোটরসাইকল আটকে পরেছে কাভার্ড ভ্যানের পেছনে। সেটা টার্ন না নেয়া পর্যন্ত ওরা সেখান থেকে আসতে পারবে না।

সিএনজির ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো আপা কোথায় যাবেন। রোদেলা দ্রুত ভাবলো কোথায় যাবে ও…?

আতংকের ঘোর তখনো কাটেনি ওর। ড্রাইভারের প্রশ্নে ওর যেন হুঁশ ফিরে এলো। এই বিশাল দুনিয়াটাকে ভীষণ ছোট্ট মনে হলো ওর।
যাবার যে একমাত্র জায়গা তা থেকে ওকে বের করে দেয়া হয়েছে এই তো ঘন্টাখানেক আগে। কোন আত্নীয়ের বাড়ি যাবে না ও। আর বাইরের দুনিয়াটা কত জটিল তার রূপ তো কিছুক্ষণ আগেই দেখা হয়ে গেলো। ঘড়িতে তাকায় রোদেলা রাত পৌনে বারোটা। ড্রাইভার আবার তাগাদা দেয় কোথায় যাবে তা জানতে। কি ভেবে যেন রোদেলা বলে- ইকুরিয়া চলেন। ইকুরিয়ার রোড ছেড়ে এসেছে ওরা অনেক আগেই। ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে ভিতরের রাস্তা দিয়ে সিএনজি টা চললো। মিনিট সাতাশ পর রোদেলার বলে দেয়া রাস্তা ধরে সিএনজিটা পৌঁছে গেলো এক বিশাল পাঁচিল ঘেরা বাড়ির সামনে। ঘড়িতে তখন বারোটা পনেরো।
ড্রাইভারকে ভাড়া দিয়ে বললো-
অনেক ধন্যবাদ ভাই, আপনি না থাকলে…..

ড্রাইভার হেসে বলল-
আপা এত রাইতে একলা বাইর হওয়া ঠিক না, দিন কাল ভালো না, রাইতের দুনিয়াডা রাইতের মতোই অন্ধকার। রাইতের গাড়ি চালাই তো। এহন এসব ডাইল-ভাত আমাগে কাছে। একটু সাবধানে চলবেন…

বলে কোন প্রতিত্তোর না শুনেই গাড়িটা টান দিলেন তিনি। রোদেলা মনে মনে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে তার প্রতি। নিজ হাতে খোদা ওকে সাহায্য করেছেন। তা না হলে…..

বাড়ির মেইন গেইটে নক করে রোদেলা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পরেছেন তারা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার নক করে। দারোয়ান তার ঘর থেকে আসছে তা বোঝা যাচ্ছে তার ঘরের গেইট খোলার শব্দে। ওপাশ থেকে গেইট না খুলেই জিজ্ঞেস করে কে….?
আমি রোদেলা….
কন্ঠটা পরিচিত দারওয়ানের কাছে, তাই দ্রুত গেইট খুলে বললেন..
আফা এত রাইতে….!
হ্যা সামাদ ভাই, সবাই কি ঘুমিয়ে পরেছেন…
না…
বাড়িতে অনুষ্ঠান ছিলো আজ, মেহমান আসছিলো। চলেন আপনি, তারা মনে হয় ঘুমায় নাই এখনো…

রোদেলা বলে আপনার আসা লাগবে না কষ্ট করে, আমিই যাচ্ছি… তবুও পিছুপিছু গেলেন তিন। ভৃত্য বলে কথা…

কলিং বেলে চাপ দিল রোদেলা। একটু অপেক্ষা করে আবার চাপ দিতেই গেইট খুললেন এক মহিলা….
শাড়ি আর গহনায় মোড়া সম্ভান্ত্র এক গৃহিণী। যার পোশাক আর অলংকারে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট।
তিনি বিগলিত হাসি মুখে বললেন-
আরে…
রোদেলা যে, এত রাতে…

চলবে…

(খুবি দুঃখিত এত দেরি করায়, আসলে আমি একটু ভাবতে সময় নিয়েছিলাম, আর ব্যাস্তও ছিলাম)
previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=463027469195120&id=100064636124543
next:
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=469686995195834&id=100064636124543

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here