#রোদেলা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ১৬
ক্লাস টেনে থাকতে রোদেলা জীবণে প্রথমবারের মতো প্রেমে পরেছিলো। নিভৃতে অনেকেই কড়া নেড়েছিলো, তবে এর আগে ঠিক প্রেম যা তা হয়ে উঠে নি ও পাত্তা না দেওয়ার কারণে। তাছাড়া ও পড়াশোনা ও এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস এ ব্যাস্ত থাকতো। ছবি আঁকা, গান শেখা, আবৃত্তি এসবের ক্লাস নিয়েই ব্যাস্ত সময় কাটতো।
তখন ওরা থাকতো নারিন্দায় ভাড়া বাসায়। বাবা, মা, আর দুই বোনের ছোট্ট সংসার।
ছেলেটা থাকতো পাশের বাসায়। স্কুলে যাওয়া আসার পথে পিছু নিতো। বেশ কিছু দিন যাবার পর রোদেলার এক বন্ধু সিমি ব্যাপারটা বলে ওকে। বেখেয়ালি রোদেলা তখনো টের পায় নি কিছু। একদিন একাডেমিতে প্রোগ্রাম থাকায় বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ওদের বাসাটা মেইন রোড থেকে একটু ভিতরে।
রিকশা থেকে নেমে হেঁটে যখন গলিতে পা রাখে ও হঠাৎ লোডশেডিং এ অন্ধকারে ডুবে যায় গলিটা। সামনের পথটা চিনে নিতে কিছুটা সময় লাগে ওর। ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে ও। বড় কেও আসলে তার পিছু পিছু যাবে। এমন সময় কোত্থেকে যেন বেরিয়ে এলো একজন। মিষ্টি একটা গন্ধে আশপাশ ভরে উঠলো। অবয়বটা যখন এগিয়ে এলো তখন রোদেলা বুঝতে পারে এটা সেই পিছু নেয়া ছেলেটা। খুব সম্ভবত ও বুঝতে পেরেছে যে রোদেলা ভয় পাচ্ছে।
ছেলেটা কিছু না বলেই মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে হন হন করে ওকে ক্রস করে হাঁটা দিলো। কোন কথা না বার্তা না কিচ্ছু না…
রোদেলা কিছু না বোঝার ভান করে ওর পিছু পিছু হেঁটে ওদের বাড়ির গেইটে ঢুকে পরে। ঢুকে ও বাড়ির ভিতরে যায় না, গেইটের আড়ালেই দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলেটা কি করে তা দেখার জন্য। কারন ঐ দিকে না আছে রাস্তা না কোন বাড়ি। রোদেলা জানে এ গলিতে ওরা থাকে না। ওদের বাড়ি মেইন রোডের সাথেই। তাছাড়া ও যেদিকে হাঁটা শুরু করেছে সেখানে রাস্তা শেষ। একটু দাঁড়িয়ে থেকে ও দেখলো যে ছেলেটা ওর বাড়িতে ঢুকবার সাথে সাথেই ইউটার্ন নিয়ে গলি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। রোদেলা মুচকি হেসে বাড়ির ভিতরে চলে যায়।
এ ঘটনার পর রোদেলার মনে একটা সফ্ট কর্ণার তৈরী হয় ওর জন্য। ক্লাসের বোরিং সময়ে, রিকশায় বসে, পড়তে বসে হঠাৎ, এমনকি খাবার খেতে বসেও ঐ সন্ধ্যার কথা মনে করে মুচকি হাসি হাসতো ও।
রোদেলা ওকে ফলো করবার ব্যাপারটা জানার পর প্রায়ই ওকে ওদের বাড়ির আশেপাশে দেখতে পায়। সারাদিনে দুই-বার। একবার সকালে ও যখন স্কুলে যায় তখন, আরেকবার বিকেলে কোচিং থেকে ফিরবার সময়।
রোদেলা তাকাতো না। তবুও বুঝতো ওর উপস্থিতি। একটা সময় এমন হয়ে যায় যে ওকে না দেখতে পেলেই চিন্তা হতে থাকে ওর।
একদিন সিমি সন্ধ্যায় ওদের বাসায় আসে। ওরা ওদের বাসায় পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। এসে রোদেলাকে একফাঁকে বলে যে আঁকিব ভাইয়া তোর সাথে একটু কথা বলতে চায়। কেস তো ভালো না রে…
তোর প্রেমে বেচারা কাহিল….
রোদোলা ঐদিনের ঘটনাটা বলে। এরপর দুজনেই হেসে গড়িয়ে পরে। রোদেলা সেদিন জানতে পারে ছেলেটা অনার্সে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, তাছাড়া ওর বাবা মা চায় ও পড়াশোনা করতে বিদেশ যাক। সেজন্য পড়ার পাশাপাশি আইইএলটিএস কোচিং ও করছে।
এরপর প্রিটেস্ট পরীক্ষা চলায় এসবে মন ছিলো না ওর। এরমধ্যেই একদিন স্কুল থেকে ফিরছিলো ও গলির এক পিচ্চি ছেলে ওর হাতে একটা ভাঁজ কর কাগজ দেয়। কাগজটা হাতে নিয়ে আশেপাশে একবার চোখ বুলায় ও, কেও রয়েছে কি না…
বাসায় এসে একের পর এক ব্যাস্ততা। খালামনিরা এসেছেন ওদের বাসায়। একটুও ফুরসত পেলো না কাগজটা খুলে দেখবার। একবার মনে করলো বাথরুমে নিয়ে পরবে। আবার ভাবলো না… কাগজটাকে আলমারির কাপড়ের ভাঁজে রেখে দিলো।
অবশেষে রাতে বইয়ের ফাঁকে কাগজটা খুলে রেখে দেখলো। বিশাল এক চিঠি…
এমন চিঠির অভিজ্ঞতা ওর সেটাই প্রথম। এর আগে যেগুলো পেয়েছিলো তা ফালতু টাইপ। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় চিঠিতে কোথাও কারো নাম নেই। চিঠির উত্তেজনায় সে রাতে ওর ঘুম এলো না।
পরদিন সকালে কিংবা বিকেলে কোত্থাও আঁকিবকে দেখা গেলো না। তার পর দিন ও না, তার পরও না…..
একটা মানুষ হঠাৎ করে এমন হাওয়া হয়ে গেলো….?
সিমিকে দিয়ে খবর লাগলো রোদেলা। সিমির এক বন্ধুর মারফত জানতে পারলো ও ঢাকায় নেই চিটাগং গিয়েছে ওর চাচার বিয়ের দাওয়াতে। চাচার বিয়ে বলে কথা। বেশকিছু দিন থাকবে ওরা এটা বোঝা গেলো। রোদেলা একটু অস্থির বোধ করলো। কার চিঠি কে পাঠালো এসব ভেবে। তাছড়া আঁকিবকে তো জিজ্ঞেস ও করা যাবে না যে – এই চিঠিটা কি তুমি দিয়েছো….?
কি যন্ত্রণা…!
এরপর কেটে গেলো দিন পনেরো। রোদেলাদের বাসায় একটা ঝামেলা হয় ওর বাবাকে নিয়ে। এসব ঝামেলা নতুন না। সেই ছোট বেলা থেকেই তিনি ঝামেলা পাকায় আর
ঝগড়া করে ওদের নিয়ে নানু বাড়ি চলে যেত ওদের মা। মামারা সমাধান করে আবার পাঠিয়ে দিতেন। এতে করে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হতো ওদের কোমল মন আর পড়াশোনার। এটা বাবা কিংবা মা কেওই বুঝতেন না। রোদেলার বাবা মানুষটা অতি মিষ্টিভাষী, বিনয়ী। কথা বললে মনে হবে তার মত ভালো মানুষ দুনিয়াতে আরেকটা নেই । তবে বাস্তবে তিনি বেশী সুবিধার ছিলেন না। মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জন করে নিজের প্রয়োজনে তার ক্ষতি করতেও বাঁধতো না তার। একটা ঘটনা বললে ব্যাপারটা পরিস্কার হবে।
রোদেলার মেঝো মামার বিয়ে। তিনি বড় হওয়া স্বত্বেও এতদিন বিয়ে করেন নি বিদেশে ছিলেন তাই। ছোট মামাকে তার আগেই খুব অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন নানু। খুব স্বাভাবিক রোদেলার বাবার বোনজামাই হিসেবে কিছু দায়িত্ব রয়েছে। তিনি ওর বড় মামাকে বললেন তার পরিচিত লোক আছে কম দামে গরু আর মুরগীর ব্যাবস্থা করে দিতে পারবেন। বড় মামা বিশ্বাস করে তাকে কিছু টাকা এডভান্স করতে দেন। তখন তিনি বললেন পুরো টাকাটা দিলেই এই তারা এই দামটা রাখবেন। অগত্যা বড় মামা পুরো টাকাটাই দিলেন। এমনকি তিনি নিজে পর্যন্ত যান না ঐ লোকের সাথে কথা বলতে। ওর বাবাকেই সব দায়িত্ব দিয়ে দেন।
গায়ে হলুদের বিরিয়ানির জন্য গোশতো পাঠানোর কথা সেদিন সকালে। তাকে খবর দেওয়ায় বললো তারা গরু জবাই করে গোশত কেটে পাঠিয়ে দিবে৷ দুপুর হয়ে যায় গোশতের খবর নাই। উপায়ন্তর না দেখে বড় মামা রোদেলাদের বাড়ি যায়। গিয়ে দেখে বাড়ি তালা দেয়া। রোদেলার মা তার দুই মেয়েকে নিয়ে বিয়ে উপলক্ষে বাবার বাড়ি সেই আগে থেকে। সন্ধ্যা হয়ে যায়, তবুও রোদেলার বাবা কি গোশত কোনটারই খবর নেই। উপায় না দেখে তখন বড় মামা তার বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে গরুর গোশত কিনে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য । রান্না হতে হতে সেদিন দশটার মতো বেজে যায়।
পরের দিনও তার কোন খবর নেই। চলন যাবে সেই প্রস্তুতি চলছে। রোদেলার বাবা টাকাটা নিয়ে হাওয়া। এদিকে বাড়ি পুরো গরম। কেমন অমানুষ হলে এমন সময় এ কাজ করতে পারে তা বলছিলেন বড় খালামনি। তিনি রোদেলার নানার আগের পক্ষের বড় মেয়ে। বড় মামা সব বুঝতে পারেন। কারন এর আগেও রোদেলার বাবা এমন ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। বিয়ে বাড়ি তখন মরা বাড়ির মতো অবস্থা।
এত বড় একটা কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে। মানুষের মুখে মুখে এই কথা। প্রায় সাতশো মানুষের আয়োজন কি মুখের কথা। বড় মামা পুরো টাকাটাই তাকে দিয়ে দিয়েছিলেন।
কোন উপায় না দেখে চড়া সুদে টাকা নেয় বৌভাত অনুষ্ঠানের জন্য। রোদেলাদের মুখ দেখানো দায়। ওরা পারে না মাটির নিচে ঢুকে যায় । ওর নানু বাসার এক ভাড়াটিয়ার বৌ রোদেলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে- কি গো রোদেলা তোমার বাবা নাকি অনুষ্ঠানের টাকা নিয়ে ভাগছে…?!
রোদেলা এ কথার উত্তরে কি বলবে ভেবে পায় না। লজ্জায় চলে আসে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে। রোদেলা তখন ক্লাস এইটে পড়তো। ততটুকুও ছোট না। সব বুঝতো৷ তাছাড়া ওর বাবা এবারই প্রথম এমন করে নি। এর আগেও বেশ কয়েকবার এমন করেছেন তিনি। বলতে গেলে ওর মায়ের সাথে বিয়ের পর থেকেই ওর মা এসব যন্ত্রণায় জর্জরিত। বড় বোন হওয়া সত্ত্বেও সবার কাছে ছোট তিনি তার স্বামীর এমন কার্যক্রমের জন্য।
কোন মতে বৌভাত অনুষ্ঠানটা হয়। রোদেলার মা লজ্জায় এসব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। তিনি বাড়িতেই থাকেন।
রোদেলা ওর মামার সাথে বৌদের বাড়ি যায়। ও মনে মনে ভাবে যাক এখানে কেও ওকে এসব জিজ্ঞেস করে বিব্রত করবে না। ঐদিকে যা হয় হোক। এক প্রকার গা বাঁচানো লজ্জা থেকে। নতুন মামীদের বাসায় ভালোই কাটলো দুদিন। তারা নানান পদের খাবার রান্না করে খাওয়ালো। তাদের আত্নীয়রাও এলো নতুন বর দেখতে। । মামীর কাজিনরাও এসেছে। রোদেলা ওদের সাথে মিশে ওদের একজন হয়ে গেলো৷ আড্ডা গল্প চললো বিকেল পর্যন্ত। সন্ধ্যায় নাশতা খাচ্ছিলো সবাই একসাথে। বিকেলে রোদেলার মেঝো খালু এসেছে ওদের দেখতে। তিনিও যোগ দিলেন ওদের সাথে।
রোদেলা এত খাবার থেকে নকশি পিঠা খাচ্ছিল। এমন সময় ওর নতুন মামীর বড় দুলাভাই হেসে হেসে বললেন – রোদেলা….! তোমার বাবা নাকি টাকা পয়সা নিয়ে পালায়া গেলো শুনলাম…! তা ফোন টোন করছিলো নাকি…?
তিনি এমন একটা ভাব নিলেন যেন খুব মজার কোন কথা বললেন। রোদেলা ওর মেঝো খালুর দিকে তাকালো। তিনি তখন নাশতার প্লেট হাতে ব্যাস্ত, এমন ভাব যেন তিনি কিছু শুনতে পান নি। কলকল করা রোদেলা হঠাৎ চুপসে গেলো। এত কথা জানা মেয়েটা কোন উত্তরই খুঁজে পেলো না এই সরল প্রশ্নের। মামীর বোন তাকে ধমক দিলেন। রোদেলাকে বললেন এই তুমি আসো তো তোমাকে পিঠা বানানো দেখাই। ঠিক ঐ মুহুর্তে রোদেলার ইচ্ছে করেছিলো মরে যেতে। সেই ছোট্ট থেকে এমনি অপদস্ত হতে হয়েছে ওদেরকে। বাবা-মায়ের জন্য।
এমন বহু ঘটনা আছে ওদের জীবণে যা দিয়ে আলাদা একটা উপন্যাস লেখা যাবে। প্রতিটি ঘটনার ভয়াবহতা আগের ঘটনাকে ছাপিয়ে যায়। একটা মানুষ কি করে এত জঘন্য হতে পারে ভেবে পায় না ও। অথচ প্রথম প্রথম যখন এমন করে হাওয়া হয়ে যেতো। মাস দু-এক পর চিঠি পাঠতো। সেই চিঠিতে থাকতো কেন এমনটা করতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন তার কপট আবেগী বর্ণনা। সেসব চিঠি রোদেলা যত্ন করে রাখতো, রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে বের করে পড়তো আর কাঁদত। বাবাকে অনেক ভালোবাসতো ও। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে ও যখন বুঝতে পারতো এসব তখন থেকে সেটা ঘৃণায় রূপ নিতো।
সবার জীবণেই অনেক প্রতিকূলতা থাকে। সেসব ঝড় স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে মোকাবিলা করতে হয়। কিন্তু তিনি প্রতিটি বার ওদেরকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে নিজে হাওয়া হয়ে যেতেন। যে লোক এমন, যার কোন ভাবনা চিন্তা নেই তার এসব কার্যক্রমে কি পরিণতি হবে পরিবারের
তার কোন দরকার ছিলো না বিয়ে করার, কিংবা সন্তান জন্ম দেবার। অথচ ততদিনে ওরা দুই বোন সংসারে। সেসব দিনগুলের কথা ভেবে এখনো আৎকে উঠে রোদেলা। ঘৃণা হয় ওর মায়ের প্রতিও। কেন তিনি বার বার এই মানুষটাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। কেন তিনি তার বাবা মায়ের কথা শুনে বাদ দেন নি এই জঘন্য মানুষটাকে।
বড় খালামনি প্রায়ই একটা কথা বলতেন- তোর বাপ যদি পারতো তোদেরকেও বিক্রি করে দিতো। কথাটা সেই ছোট্ট বেলা থেকে শুনে আসছে ও। একটু যখন বড় হলো তখন বুঝলো কত গভীর এই কথা। কত সত্য…..
চলবে….
previous
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1497877100673476/
Next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1501382216989631/