রোদেলা লেখা : #মাহাবুবা_মিতু পর্ব : ৩৯

0
594

#রোদেলা
লেখা : #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব : ৩৯

রোদেলারা “কৃষ্ণচূড়া” তে এসেছে তিনদিন। আসার পর থেকে ঘর গুছানোই যেন শেষ হয় না। সব কিছু আগের মতো গুছগাছ করা হলো। তবুও কিছুই যেন আগের মতো নেই। কিছু একটা মিসিং এ বাড়ি থেকে। সবাই তা বুঝতে পারছে, কিন্তু কেও বলছে না, বলতে পারছে না। সবাই সবার মতো করে ব্যাস্ত। তবুও যেন ঐ মিসিং জিনিসটা সবার চলাচলের ছন্দ পতন করছে প্রতিনিয়ত।

সেদিন বড় মামী বললো নাসিমার বড় ভাইয়ের প্রতি টানের কথা, সত্যি বলতে নাসিমার মনে সবার জন্যই টান।

নোভেল ইস্যুতে ছোটভাই এর সাথে নাসিমার সম্পর্ক খুব একটা ভালো না। দু-এক দিন পর পরই ঝগড়া হতো ওকে নিয়ে..

তবুও তার মনে লুকানো কষ্ট তিনি বাড়ি এসেছেন কিন্তু তার ভাই নেই। খেতে বসে কোন একটা পদ রান্না হলো যা ছোট ভাইয়ের পছন্দের তা নিয়ে আলোচনা। বিকেলে ছাদে গেলো তো ছোটনের হাতে লাগানো গাছ গুলো ছুঁয়ে বলতো সেই গাছ লাগানোর গল্প। কোথায় নেই সেই ভাইয়ের গল্প, রান্নাঘরে বাসন মাজা থেকে শুরু করে নামাজের বিছানা…
সবখানে ভাইয়ের কথা মনে পরে তাঁর।

সবাই রাগী নাসিমাকে দেখে, কিন্তু তার ভিতরের কোমল যে মেয়ে রয়েছে একটা, যা আটকা পরে আছে জীবণ নামক গোলকধাঁধায় তার খবর কেও রাখে না….

যার সবচেয়ে বেশী জানার কথা ছিলো তার সম্পর্কে, সেই বোধহয় সবচেয়ে কম জানে। বিয়ের বয়স ২৬ হলেও সব মিলিয়ে ২৬ মাসও স্বামীকে কাছে পেয়েছেন কিনা তাও নাসিমা জানে না। সেই জীবণের শুরু থেকেই এমনি লুকোচুরি খেলেছে সে তাঁর সঙ্গে।

সংসার চলছে ভালোই…
আগের মতো এক ছাদের নিচে, এক রান্নায় পুরো পরিবার। এদিকে বড় মামার যাবার দিন ঘনিয়ে এসেছে। বড় মামী মোটে দুই লক্ষ টাকা জোগাড় করেছে। সেটা নিয়েই রওনা দিবেন তাঁরা।

দেখতে দেখতে বড় মামা-মামী চলে গেলো ভারতের চেন্নাইতে। সেখানেই মামার চিকিৎসা শুরু হবে।একদিকে কল্লোলের অনুপস্থিতি আরেকদিকে বাবা মায়ের চিন্তায় নাতাশার শরীর অসুস্থ হয়ে পরলো। খাওয়া দাওয়া বন্ধ প্রায়, সারাদিন কাঁদে।

এরমধ্যেই একদিন খবর আসে মাথা ঘুরে বাথরুমের সামনে পরে গেছে নাতাশা। নাসিমা তার বোনদেরকে নিয়ে দৌড়ে যায় ভাতিজির শ্বশুর বাড়িতে ওকে দেখতে। তাদের কপালে চিন্তার ভাজ। কি না কি হলো মেয়েটার…! গিয়ে দেখে বাড়ি ভর্তি মেহমান। নাতাশার খালা শ্বাশুড়ি, মামী শ্বাশুড়ি, সবাই ওকে ঘিরে বসে আছে। গিয়ে তারা যা শুনলেন খুশিতে চোখ ভিজে গেলো সবার। এত দুঃখের মাঝে একটা খুশির খবর। মা হতে চলেছে নাতাশা। উত্যপ্ত মরুভূমিতে যেন এক পাশলা বৃষ্টির মতো মনে হলো সবার এই খবরটাকে। খুশি যেন বাঁধন হারা। ওদের পরিবারের সবার বড় কল্লোল, তার সন্তান মানে এ পরিবারের প্রথম নাতি নাতনি আসতে চলেছে। তাই খুশী সবারই একটু বেশী।

নাতাশার বাবা-মা ও ভীষণ খুশি এ খবরে। তাদের আদরের ছোট্ট নাতাশা মা হতে চলেছে…. নাসিমা নাতাশাকে তাদের সাথে নিয়ে আসতে চায়, রাখতে চায় তাদের কাছে।
নাতাশার শ্বাশুড়ি দেন না, বলেন আমরা কত লোক রয়েছি, চিন্তা করবেন না। ও তো আমাদের ঘরের বৌ না, আমার ঘরের মেয়ে। ওর সেবাযত্নে কোন ত্রুটি হবে না। কথা অবশ্য তারা মিথ্যে বলেন নি…! নাতাশাকে তারা মেয়ের মতোই ট্রিট করে। অবশেষে তারা ফিরে এলো ওকে না নিয়েই।

কল্লোল ভালোভাবেই পৌঁছে গেছে। দুইদিন রেস্ট করে, সব গুছগাছ করে নিয়ে অফিসে জয়েন করেছে তিনদিন হলো।

কল্লোলও ভীষণ খুশি এ খবরে। বাবা হতে যাচ্ছে ও। এ অনুভূতি মায়েরা কত ভাবে প্রকাশ করে, কত কত মায়েদের কত গল্প রয়েছে এ অনুভূতি নিয়ে, কিন্তু একজন ছেলের বাবা হওয়ার অনুভূতির গল্প কজন জানে….?!

মায়েদের কত আয়োজন নতুনকে নিয়ে, কিন্তু বাবাও যে অধীর অপেক্ষায় থাকে তাকে ছুঁয়ে দেখবার জন্য, আদর করবার জন্য জীবণের দৌড়ে দৌড়াতে দৌড়াতে তা প্রকাশিত করতে পারে না বেশীরভাগেই।

টুকটুক করে চলছে মামার ট্রিটমেন্ট। মামীর হাতের টাকা শেষের দিকে। এদিকের অবস্থা ও নাজুক। আর মামা…! তিনি এ বয়সে কেমোথেরাপির ধকল নিতে পারছেন না। আর কত ধকল নিবে শরীর। একটার পর একটা বড় বড় ধাক্কা যেন দড়জায় অপেক্ষা করছে।

২য় কেমোথেরাপির পর মামাকে আর চেনাই যাচ্ছে না। চুল, ভ্রু সব পরে গেছে। মনে হচ্ছে মানুষটা দিনে দিনে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যেন। সবাই তা জানে তবুও কেও যেন জানেই না। সবার আপ্রান চেষ্টা তাকে বাঁচিয়ে রাখার।

বোনেরা কিছু টাকা দিলেন। নাসিমা তার মায়ের দেয়া বল চেইনটাও বিক্রি করে টাকা দেয়। রোদেলা কিছুই বলে না। সবই তো গেলো। এটা থেকে আর লাভ কি। মামার যা পরিস্থিতি এখন এসব হিসাব নিকাশের সময় না। সব মিলিয়ে লাখ দুয়েক টাকা পাঠানো হলো চেন্নাইতে। সেটা দিয়ে চললো আরো কিছুদিন। ঔষধ, টেস্ট, থাকা খাওয়া সব মিলিয়ে কোনমতে চললো।

বড় মামা বলেন চলো আমরা ফিরে যাই, যে কটাদিন বাঁচি একসাথে থাকি সবাই। এভাবে চলতে থাকলে আমি তো মরবোই সাথে সবাইকে নিয়ে মরবো। কথাটা বলে হাসতে চেষ্টা করেন মামা। হাসির দমকে তার কাশি শুরু হয়।

কথা শুনে কেঁদে দেন বড় মামী। তিনি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করতে চান। নাতাশা টাকাপয়সার খোঁজ করে। কল্লোলকে বলে টাকা পাঠাতে চায়। কিন্তু বড় মামী না বলে। জানায় তার হাতে এখনো টাকা রয়েছে। দরকার হলে তিনি জানাবেন নাতাশাকে। আসলে ওদের কাছ থেকে আর নিতে চান নি কিছু। তাই তার এই লুকোচুরি মেয়ের সাথে। উপায়ন্তর না দেখে বড় মামী নোভেলের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ফোন করে ছোট মামাকে। কুশলাদি বিনিময়ের পরপরই ছোটমামা তার সমস্যার কথা বলতে থাকেন বড় মামীকে। এখানে এসে কি সমস্যায় আছে, টাকার জন্য পছন্দের বাড়িতে উঠতে পারে নি, আপাততঃ ভাড়ার এপার্টমেন্টে উঠেছে। তার নিজেরই টাকার দরকার, কিন্তু বড় মামার এ অবস্থা তাই তিনি চাচ্ছেন না ইত্যাদি ইত্যাদি….

বড় মামী নিজে বোকা বনে গেলেন। ফোন করলেন নিজের দুঃখের কথা বলতে, আর উল্টো দেবরই মনে করিয়ে দিলেন পাওনা টাকার কথা। দুঃখে তার কলিজা যেন ফেটে যায়, পছন্দের বাড়ির কথা বলছিলো ও… আর ওর ভাই যে দুনিয়া থেকেই বিদায় হতে যাচ্ছে টাকার অভাবে তা একটা বার শুনলোও না.. কৌশলে এড়িয়ে গেলো।

এসব ভেবে যখন হসপিটালের বারান্দায় দাড়িয়ে কাঁদছেন নাতাশার মা, তখন নাতাশার বাবা পিছনে এসে দাঁড়ায় চুপিসারে। বৌকে বলে- চলো আমরা ফিরে যাই….
মরতে তো একদিন হবেই, দুদিন পর যেতাম একটু আগেই নাহয় যাবো, তাই বলে আমি তোমাকে মানুষের কাছে ছোট করতে পারবো না। ছোট তো কম করলাম না তোমায় জীবণে। চলো বৌ…
আমরা ফিরে যাই….

চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখেই একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেন তারা। কেওই কিছু জানে না। কাওকেই বলে নি তারা কিছু। কি আর বলবে…?

দেশে ফিরে পূর্বাচলের বাড়ি যাদের কাছে বিক্রি করেছেন তাদের সাথে দেখা করতে চান। যদি তাদের মনে একটু দয়া হয়…। পরপর তিনদিন ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেও ঐ লোকের সাথে তিনি দেখা করতে পারেন না। শেষ ভরসাও যখন হারিয়ে যায় তখন বেঁচে থাকা কষ্টের হয়ে পরে।

কষ্টে তার কলিজা ফেটে যায়। শেষ বয়সে এমন দিন দেখতে হবে তারা কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন এমনটি…?!
ভাবেন নি… অথচ জীবণ তাদের কোথায় এনে দাঁড় করায়।

মামার অবস্থা দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। খাবার খেয়ে কিছুই রাখতে পারছে না। শরীর কঙ্কালসার হয়ে যাচ্ছে। নাসিমা বড় ভাবিকে বলেন, ভাবী একটা কথা বলি…?
যদি কিছু মনে না করেন….

বড় মামী এক পলকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ নাসিমার দিকে। যেন তাকে পড়তে কিছুটা সময় নিচ্ছেন তিনি, একটু সময় পর মৌনতা ভেঙে তিনি নাসিমাকে বলেন-
: নিশাদের ব্যাপার বাদে যদি কিছু বলতে চাও তো বলো….

নাসিমা অবাক হয়ে যায় এ কথায়। তিনি মনে মনে তাদের একমাত্র পুত্র নিশাদের সাথে ওর বাবার ব্যাপারে কথা বলতে চায়। যদি ও ছেলে হয়ে বাবার জন্য কিছু একটা ব্যাবস্থা করে….

নাসিমা উঠে চলে যায়, বড় মামী আপন মনে সবজিই কাটতে থাকে টেবিলে বসে। কাটতে কাটতে ছয়জনের জন্য আলুভাজা তৈরীতে দেড় কেজি আলু কেটে ফেলেন তিনি।

চলবে….

previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=459613892869811&id=100064636124543
next:
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=461358776028656&id=100064636124543

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here