রোমান্টিক ডাক্তার,পার্ট: ১৭,১৮

0
1969

রোমান্টিক ডাক্তার,পার্ট: ১৭,১৮
লেখিকা: সুলতানা তমা

মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে, আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম। হসপিটালের ICU তে আছি আমি, মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো, হাতেও কিসব যেন লাগানো। রাতের কথা আস্তে আস্তে সব মনে পড়লো, এতো কিছুর পর আমি বেঁচে আছি ভাবতেই পারছি না। হঠাৎ কারো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসলো, আস্তে আস্তে পাশ ফিরে তাকালাম, কাব্য সিজদায় পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ও এতো কাঁদছে কিন্তু আমি ওকে ডাকতে পারছি না, একটু নড়তেই পেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হলো। হঠাৎ রুমে একজন সিস্টার এসে ঢুকলো, ওকে দেখে হাত নাড়ার চেষ্টা করলাম।
সিস্টার: এইতো ম্যাডাম এর জ্ঞান ফিরেছে। (সিস্টারের কথা শুনে কাব্য তাড়াতাড়ি উঠে আমার কাছে আসলো)
কাব্য: তিলো তুমি ঠিক আছ তো (পাগলের মতো কাঁদছে ও কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারছি না খুব কষ্ট হচ্ছে)
সিস্টার: স্যার কি করছেন এভাবে কাঁদলে ম্যাডাম এর সমস্যা হবে (সিস্টার কাব্য’কে সরাতে আসলো কিন্তু কাব্য সিস্টারকে ধাক্কা মারলো, সিস্টার তাড়াতাড়ি বাইরে চলে গেলো)
কাব্য: পুরো দুদিন পর তোমার জ্ঞান ফিরেছে সবাই বলেছিল তুমি বাঁচবে না কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি, তুমিই বলো আমার তিলো পাগলী কি আমাকে একা রেখে চলে যেতে পারে। আমি নামাজ পড়েছি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি আর দেখো তোমার জ্ঞান ফিরে এসেছে আল্লাহ্‌ আমার কথা শুনেছেন (কাব্য’র কান্না দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না ইচ্ছে হচ্ছে ওর চোখের পানি মুছে দেই কিন্তু আমি তো হাতই নাড়তে পারছি না)
আদনান: কাব্য কি করছিস পাগল হয়ে গেছিস (সিস্টারটা গিয়ে আদনানকে নিয়ে এসেছে। আদনান কাব্য’কে টেনে আমার থেকে দূরে নিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু কাব্য যাচ্ছে না)
আদনান: তুই একজন ডক্টর হয়ে এমন পাগলামি কেন করছিস? বুঝতে পারছিস না এভাবে কাঁদলে ভাবির সমস্যা হবে।
কাব্য: আমি আর কাঁদবো না প্লিজ ওর কাছে আমাকে থাকতে দে।
আদনান: দিয়েছিলাম তো কিন্তু এভাবে কাঁদলে…
কাব্য: আর কাঁদবো না। (কাব্য চোখের পানি মুছে নিয়ে আমার পাশে এসে বসলো। আদনান এসে কিছু চেকাপ করলো)
আদনান: এইতো ভাবি সুস্থ হয়ে গেছে তুই অযতা কান্নাকাটি করছিস।
কাব্য: তিলো তো সুস্থ হবে কিন্তু…
আদনান: কাব্য চুপ কর (কাব্য আবার ঢুকরে কেঁদে উঠলো, কি লুকুচ্ছে ওরা আমার থেকে)
আদনান: দেখ ভাবি সুস্থ হয়ে গেছে এবার যা তুই ফ্রেশ হয়ে নে (কাব্য’র দিকে তাকালাম সেই রাতের পাঞ্জাবীটা এখনো ওর পরনে, পুরো পাঞ্জাবীতে রক্তের চাপ লেগে আছে। কাব্য’কে দেখে কোনো সুস্থ মানুষ মনে হচ্ছে না, ওকে এখন পাগল পাগল লাগছে)
কাব্য: আমি কোথাও যাবো না।
আদনান: কিছু অন্তত খেয়ে নে প্লিজ।
কাব্য: আমার খিদে নেই (কাব্য এখনো কিছু খায়নি এভাবে না খেয়ে থাকলে তো ও অসুস্থ হয়ে পড়বে। আদনানকে ইশারা দিয়ে অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দিতে বললাম। মাস্ক খুলে দিতেই আস্তে আস্তে কথা বলার চেষ্টা করলাম)
আমি: ডাক্তারবাবু…
কাব্য: তিলো তুমি কথা বলতে পারছ?
আদনান: কাব্য আস্তে কথা বল, একজন ডক্টর হয়ে এসব পাগলামি করছিস কিভাবে?
আমি: ওকে বকো না প্লিজ, ও আমার এই অবস্থা দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না তাই এমন পাগলামী করছে, প্লিজ ওকে বকো না।
আদনান: হুম।
আমি: ডাক্তারবাবু যাও কিছু খেয়ে নাও।
কাব্য: খিদে নেই।
আমি: যাও বলছি।
ভাবি: খাবার বাসা থেকে নিয়ে এসেছি কিন্তু ও তো খেতে চাইছে না।
আমি: ভাবি তুমি? (চারদিকে চোখ বোলালাম কোথায় আছি বুঝতে পারছি না)
কাব্য: তিলো তোমাকে ঢাকা নিয়ে এসেছি আমাদের হসপিটালে।
আদনান: এখানে ভীড় করো না প্লিজ, কাব্য যা খেয়ে আয়।
কাব্য: তিলোর কাছে বসে খাই (কাব্য’র বাচ্চামি কথাগুলো শুনে হাসি পাচ্ছে, পাগলটা কতো ভালোবাসে আমায়, চোখের আড়ালই করতে চাইছে না আমাকে)
আদনান: আগে ফ্রেশ হয়ে আয় যা।
আমি: তিশা কোথায়?
আদনান: একটা কাজে গেছে একটু পর চলে আসবে।

কাব্য পাশে বসে খাচ্ছে আমি চোখ দুটু বন্ধ করে শুয়ে আছি আর ভাবছি লোকটা ম্যাডাম ডাকলো কাকে। কার কথামতো ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিল। আচ্ছা শুভ্রা নয় তো? হতে পারে সেদিনের থাপ্পড়ের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু এভাবে? এতোটা খারাপ কেউ হতে পারে?
তিশা: কাব্য এই নাও শুভ্রাকে নিয়ে এসেছি (তিশার কথা শুনে দরজায় তাকালাম, তারমানে তিশা শুভ্রাকে আনতে গিয়েছিল)
কাব্য: শুভ্রা কেন করলে এমন?
আমি: আরে খাবার রেখে কোথায় যাচ্ছ? (আমার কথার উত্তর না দিয়ে ও শুভ্রাকে টেনে এনে আমার পায়ের কাছে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো)
শুভ্রা: তোমরা আমার সাথে এমন করছ কেন কি করেছি আমি?
তিশা: মনে হচ্ছে ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না।
শুভ্রা: কি করেছি বলবে তো আর তিলোত্তমা ICU তে কেন? (শুভ্রা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে তাহলে কি ও সত্যি কিছু করেনি)
কাব্য: আমার তিলোকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে এখন কিছু না জানার ভান করছ।
শুভ্রা: কি? আমি তিলোত্তমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছি, কি বলছ এসব?
আদনান: তাহলে তুমি এই দুদিন হসপিটালে আসোনি কেন?
শুভ্রা: হসপিটালে আসিনি এজন্য আমি এখন অপরাধী? আমি তো ছুটি নিয়েছিলাম কারণ আম্মু অসুস্থ। তিশাকে জিজ্ঞেস করো ও দেখে এসেছে আম্মু অসুস্থ।
তিশা: হ্যাঁ দেখেছি কিন্তু তাই বলে তুমি কিছু করনি তা বিশ্বাস করবো কিভাবে? লোক দুটুকে তুমি টাকা দিয়েছ আর ওরা তোমার কথা মতো কাজ করেছে।
শুভ্রা: কোন লোক কি বলছ তোমরা, কতোবার বলবো আমি কিছু করিনি।
আদনান: আস্তে চেঁচামেচি করো আর বাইরে চলো সবাই ভাবির সমস্যা হবে।
আমি: দাঁড়াও আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই।
কাব্য: এখন কোনো কথা বলতে হবে না তুমি রেস্ট নাও।
আমি: না আমি শুভ্রার সাথে কথা বলতে চাই।
শুভ্রা: বিশ্বাস করো আমি কিছু করিনি তুমি হসপিটালে আছ সেটাও আমি জানতাম না। আম্মু অসুস্থ আমি দুদিন বাসাতেই ছিলাম। আমি কাব্য’কে ভালোবাসি তাই তোমার সাথে খারাপ আচরণ করি কিন্তু আমি এতোটা খারাপ না যে তোমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করবো। (শুভ্রাকে দেখে তো মনে হচ্ছে সত্যি ও কিছু জানেনা তাহলে কে করলো এই কাজ)
শুভ্র: নিজের আম্মুকে নিয়ে তো কেউ মিথ্যে বলে না বিশ্বাস করো আমি আম্মুর কাছে ছিলাম দুদিন তাই হসপিটালে আসতে পারিনি আর এসব ব্যাপারে আমি কিছু জানিনা।
আমি: ঠিক আছে তুমি তোমার আম্মুর কাছে যাও।
কাব্য: কি বলছ এসব পাগল হয়ে গেছ?
আমি: ওকে যেতে দাও।

শুভ্রা চলে গেলো, সবাই চুপচাপ বসে আছে। বুঝতেই পারছি না শুভ্রা এমন না করলে করলো কে। শুভ্রা ছাড়া আমাদের নতুন কোনো শত্রু আছে আর সেটা কোনো মেয়ে কারণ লোকটা ফোনে ম্যাডাম বলে ডেকেছিল। এতো বড় শত্রু কে আমাদের যে কিনা আমাকে খুন করতে চেয়েছিল।
কাব্য: শুভ্রাকে যেতে দিলে কেন?
আমি: শুভ্রা কিছু করেনি ওর চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছি।
কাব্য: চোখ দেখে বুঝা যায়?
আমি: কেউ মিথ্যে বললে তার চোখ দেখলেই বুঝা যায়, শুভ্রা মিথ্যে বলেনি।
কাব্য: তাহলে কে করলো এমন?
— ভাইয়া ভাইয়া (হঠাৎ কে যেন জোরে জোরে চিৎকার করে রুমে এসে ঢুকলো সাথে অয়ন)
কাব্য: হিয়া আস্তে কথা বল।
অয়ন: হিয়া কি করছিস আস্তে চেঁচা।
হিয়া: কিসের আস্তে আজকে ভাবির এই অবস্থা হয়েছে শুধুমাত্র তোমার জন্য (হিয়া কাব্য’র শার্টের কলার ধরে ফেললো)
আদনান: হ্যাঁ কাব্য ভাবির এই অবস্থা করেছে আর তুই এখন চেঁচামেচি করে ভাবির অবস্থা আরো খারাপ করে দে (আদনান এর কথা শুনে হিয়া কাব্য’কে ছেড়ে দিয়ে আমার পাশে এসে বসলো)
হিয়া: সরি ভাবি ভাইয়ার জন্য তোমার এই অবস্থা হলো।
আমি: কেন ডাক্তারবাবু আবার কি করলো?
হিয়া: তুমি না করার পরও হানিমুনে গিয়েছিল, ছোট ভাইয়া আমাকে সব বলেছে। গতকাল রাতে ভাবি আমাকে জানিয়েছে তোমার এই অবস্থা তাই তো সকালের ফ্লাইটেই চলে আসলাম।
আমি: তোমার ভাইয়ার কোনো দোষ নেই আমরা জানতাম নাকি এতো খারাপ কিছু হবে।
হিয়া: সব দোষ ভাইয়ার, সবকিছুতে ও বাড়াবাড়ি করে আর তার ফল ভোগ করতে হয় আমাদের (হিয়া কাঁদছে কাব্য দূরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কাঁদছে। হিয়া এমনিতেই কাব্য’র উপর রেগে আছে এখন আবার এই অবস্থা, এখন তো হিয়া আরো রেগে যাবে)
আদনান: হয়েছে সবার দেখা এখন সবাই বাইরে যাও আর ভাবি তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো।

একে একে সবাই বাইরে চলে গেলো, আমি চুপচাপ শুয়ে আছি চোখ দুটু বন্ধ করে। কিছুক্ষণ পর মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেলাম, জানি কাব্য এসেছে। চোখ খুলে আর তাকালাম না মাথা আর পেটে অসহ্য যন্ত্রণা করছে তাই চোখ বোজে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। কবে যে সুস্থ হবো আর কে এসবের পিছনে আছে তা জানতে পারবো আল্লাহ্‌ জানেন।
আদনান: কাব্য ভাবি ঘুমিয়েছে?
কাব্য: হুম। (কাব্য উঠে চলে গেলো, ওরা কথা বলছে তাও চোখ খুলে তাকালাম না। তাকাবো কিভাবে পেটে যে খুব বেশি ব্যথা হচ্ছে)
আদনান: এইনে রিপোর্ট, তোর কথা মতো আমি বার বার টেস্ট করেছি কিন্তু রিপোর্ট একটাই আসছে। বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে। (আদনান এর কথা শুনে চমকে উঠে ওদের দিকে তাকালাম, কার বাচ্চার কথা বলছে? কাব্য ফ্লোরে বসে পড়েছে খুব কাঁদছে ও তারমানে আমার বাচ্চা… হাতে লাগানো ছিল কিসব এগুলো টেনে সরিয়ে পেটে হাত রাখলাম, তারমানে আমি প্রেগন্যান্ট ছিলাম আর আমার বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম, আমার কান্না শুনে আদনান আর কাব্য একে অন্যের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে, ওরা তো ভেবেছিল আমি ঘুমে)
কাব্য: তিলো কি করছ পাগলামি করো না।
আমি: আমার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে আর তোমরা আমাকে জানাও নি লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলে।
আদনান: কে বললো নষ্ট হয়েছে তুমি প্রেগন্যান্ট ছিলে নাকি? আমরা তো অন্য পেসেন্টের কথা…
আমি: আর মিথ্যে বলোনা প্লিজ। (আদনান কাব্য দুজনই চুপ হয়ে কাঁদছে, আমি উঠে বসতে চাইলাম কিন্তু পেটের ব্যথায় পারছি না)
কাব্য: তিলো পাগলামি করো না প্লিজ এভাবে কাঁদলে তুমি আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।
আমি: আমার বাচ্চা মারা গেছে আমি বেঁচে থেকে কি করবো হ্যাঁ, আমার বাচ্চা এনে দাও। (আমার চিৎকার শুনে ভাবি হিয়া সবাই চলে আসলো)
ভাবি: তিলোত্তমা আমার কথা শুন।
আমি: আমার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে আর তোমরা আমার থেকে এতো বড় কথাটা লোকাতে চেয়েছিলে।
হিয়া: তুমি এমন পাগলামি করবে এই ভয়েই তো আমরা বলতে চাইনি।
আদনান: সবাই বাইরে যাও আমি ভাবিকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
আমি: ঘুমাবো না আমি, আমার বাচ্চা এনে দাও।
কাব্য: প্লিজ এভাবে চিৎকার করোনা তোমার শরীর ভালো নেই।
আমি: ওরা নাহয় আমার থেকে লুকিয়েছে কিন্তু তুমি, তুমি কেন লুকিয়েছ? আমার বাচ্চা এনে দাও।
কাব্য: সব দোষ আমার আমি বুঝতে পারিনি তুমি যে প্রেগন্যান্ট, বুঝতে পারলে ওখানে তোমাকে নিয়ে যেতাম না সাবধানে রাখতাম তোমাকে।
আদনান: কাব্য কেন অযতা নিজেকে দোষী করছিস?
কাব্য: আমি একজন ডক্টর হয়েও আমার তিলোকে সাবধানে রাখতে পারিনি বাঁচাতে পারিনি আমার সন্তানকে।
আদনান: কাব্য তুই এমন পাগলামি করলে ভাবিকে সামলাবে কে, ভাবিকে শুয়ে দে। (কাব্য আমাকে শুয়ে দিতে আসলো, ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। কাব্য জোর করে আমাকে শুয়ে দিলো আর আদনান এসে ইনজেকশন দিয়ে দিলো)
কাব্য: আর কেঁদো না প্লিজ ঘুমাও, বিশ্বাস করো আমি বুঝতে পারিনি তুমি প্রেগন্যান্ট ছিলে, বুঝতে পারলে কি ওখানে নিয়ে যেতাম?
কাব্য আমার কপালে ওর কপাল ঠেকিয়ে পাগলের মতো কাঁদছে, ওর গলা জরিয়ে ধরে আমিও কাঁদছি। আমাদের সাথে এমন হবে কখনো ভাবতে পারিনি। মাথা ব্যথা আর পেটের যন্ত্রণার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে এইটা ভেবে, আমাদের সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই ওকে খুন করে দিলো। আর ভাবতে পারছি না ঘুমে আস্তে আস্তে চোখ দুটু বোজে আসছে।

চলবে?

রোমান্টিক ডাক্তার
পার্ট: ১৮
লেখিকা: সুলতানা তমা

হঠাৎ কারো কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙলো, আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি কাব্য একটু দূরে চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কতোক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা মনে তো হচ্ছে এখন গভীর রাত, দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালাম রাত দুইটা বাজে। হুট করে বাচ্চার কথা মনে পড়ে গেলো, একটা হাত আস্তে আস্তে পেটের উপর নিয়ে রাখলাম। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু কাঁদতে পারছি না, আমি কাঁদলে যে কাব্য আরো ভেঙ্গে পড়বে।
আমি: ডাক্তারবাবু (আমার ডাক শুনে কাব্য তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে চোখের পানি মুছে নিলো, আমাকে লুকাতে চাইছে হায়রে পাগল)
কাব্য: ঘুম ভেঙেছে?
আমি: হুম। (আমার পাশে বসে পেটের উপর রাখা আমার হাতটা ওর হাতের মুঠোয় পুরে নিলো তারপর আমার হাতে একটা চুমু খেলো)
কাব্য: এইতো তুমি সুস্থ হয়ে গেছ দেখো আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি: আচ্ছা তুমি এতো সুন্দর করে কষ্ট লুকাতে পারো কিভাবে (কাব্য মুখে হাসির রেখা টানার বৃথা চেষ্টা করে আমার বুকের উপর ওর মাথা রাখলো। একটা হাত ওর চুলের মধ্যে রাখলাম, জানিনা আর কতো কষ্ট পেতে হবে ওকে)
কাব্য: তিলো আমাকে ক্ষমা করে দিও প্লিজ।
আমি: কেন কি করেছ তুমি?
কাব্য: এইযে তুমি ভয় পাওয়ার পরও জেদ করে কক্সবাজার গেলাম, আর তোমাকে চোখে চোখে না রেখে সবার সাথে আনন্দ করছিলাম।
আমি: আমি ছোট বাচ্চা নাকি যে আমাকে চোখে চোখে রাখবে, এতে তো আমারো দোষ আছে। আমি কেন তোমার থেকে দুরে ছাদের অন্যপাশে গিয়েছিলাম, না গেলে তো এমন হতো না।
কাব্য: মানুষের জীবনে কখন কি ঘটে তা তো আগে থেকে বলা যায় না, যা হবার ছিল তা হয়ে গেছে। এখন তুমি নিজেকে শক্ত করো প্লিজ আর তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো।
আমি: হুম। আচ্ছা কে করিয়েছে এসব জানতে পেরেছ?
কাব্য: না চিন্তা করো না খুব শীঘ্রই জানতে পারবো। আর যেই করুক ওকে এমন শাস্তি দিবো দেখো আর কখনো কারো ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না।
আমি: হুম।
কাব্য: তিলো জানো হিয়া আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।
আমি: কেন?
কাব্য: আমি নাকি আমাদের সন্তানকে ইচ্ছে করে মেরে ফেলেছি। আচ্ছা তুমি বলো কোনো বাবা কি নিজের সন্তানকে খুন করতে পারে। আমি তো জানতাম না তুমি প্রেগন্যান্ট, বুঝতেই পারিনি, জানলে তো জেদ করতাম না আ…
আমি: আম্মু আব্বুর সাথে তুমি ঝগড়া করে ওকে নিয়ে বাসা থেকে চলে এসেছিলে এই ধারণা নিয়েই তো ও ছোট থেকে বড় হয়েছে, তাই তোমার প্রতি ওর মনে কিছুটা রাগ জমে আছে আর এখন এই ঘটনার পর ওর রাগটা আরো বেড়ে গেছে তুমি কেঁদো না দেখো হিয়া একদিন ঠিক তোমায় বুঝবে।
কাব্য: হুম তুমি এখন ঘুমাও।
আমি: তোমার চোখ দুটু লাল হয়ে আছে তুমি একটু ঘুমাও।
কাব্য: না ঘুমুতে ইচ্ছে করছে না।
আমি: ঠিক আছে ঘুমাতে হবে না এখানে শুয়ে আমার বুকে মাথা রাখো আমার ভালো লাগবে (কাব্য শুয়ে পড়লো তারপর আমার বুকে মাথা রাখলো। ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লো। ওর মাথায় একটা চুমু দিয়ে বললাম)
আমি: চিন্তা করোনা ডাক্তারবাবু আমি তোমার সব কষ্ট দূর করে দিবো। সুস্থ হয়ে আমার প্রথম কাজ হবে আব্বু আম্মুকে খুঁজে বের করা। সবার রাগ অভিমান ভাঙিয়ে আমরা সবাই একসাথে থাকবো।

কাব্যর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বাচ্চাটার কথা ভাবছিলাম। এমন না হলে তো ও আস্তে আস্তে আমার মধ্যে বেড়ে উঠতো আর একদিন আমাদের ঘর আলো করে ও আমার কোলে আসতো। হঠাৎ কাব্য’র ফোন বেজে উঠলো, এতো রাতে আবার কে ফোন দিলো। একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে, কাব্য গভীর ঘুমে এখানে কথা বললে সমস্যা হবে না তাই ফোনটা রিসিভ করলাম। আমি কিছু বলার আগেই অপর পাশ থেকে কথা বলতে শুরু করলো।
–কি কাব্য তোমার বউয়ের এমন অবস্থা কে করলো এইটা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছ নাতো? ছাড়ো আমিই বলছি তাতে তোমার কষ্টটা অনেক গুণ বেড়ে যাবে আশা করছি। কাব্য মনে আছে তোমার অতীতের কথা? তুমি না বড্ড বোকা কাব্য তাই তো অতীতটা একেবারে ভুলে বসে আছ। এভাবে ভুলে গেলে হয় বল?
আমি: (নিশ্চুপ)
— কথা বলছ না যে? ওহ চমকে উঠেছ ভাবছ আমি কেন এসব করছি। যা করেছি আমার স্বার্থে করেছি এইটা নিয়ে আর ভেবো না ভুলে যাও। যদি আমাকে খুঁজার চেষ্টা করো তাহলে কিন্তু তোমার তিলো পাগলীর চেয়ে খারাপ অবস্থা হবে তোমার বোন হিয়ার (ওর কথা শুনে চমকে উঠলাম, কে এই মেয়ে? ও তো দেখছি আমাদের সম্পর্কে সবকিছু জানে)
— কি বিশ্বাস হচ্ছে না আমি যে হিয়ার ক্ষতি করবো? চলো আমিই বিশ্বাস করিয়ে দিচ্ছি, হিয়াকে একবার ফোন দিয়ে বলো ওর রুমের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে তাহলেই ও দেখতে পাবে আমার দুজন লোক ওকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখছে। হিয়া যখন দেশে ফিরেছে মানে এয়ারপোর্ট থেকেই ওর পিছনে আমার লোক লাগিয়ে দিয়েছি সো কাব্য চৌধুরী বুঝতেই পারছ আমি যেকোনো সময় তোমার বোনের ক্ষতি করতে পারি। আগেই ওয়ার্নিং দিয়ে দিচ্ছি যা হয়েছে ভুলে যাও এক বাচ্চা নষ্ট হয়েছে আবার বাচ্চা হবে কিন্তু এই বাচ্চার কথা ভেবে বোনের জন্য বিপদ ডেকে এনো না কারণ বোন মারা গেলে আর বোন পাবে না আর আমি জানি হিয়ার কিছু হলে তুমি এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে। (আর শুনতে পারলাম না ফোনটা কেটে দিলাম। মেয়েটার কথা শুনে ভয়ে আমার সারা শরীর ঘামছে। মেয়েটা কতোটা ভয়ঙ্কর সেটা ও একবার প্রমাণ করে দিয়েছে এখন যদি ও হিয়ার কোনো ক্ষতি করে… আমি হিয়ার কোনো ক্ষতি হতে দিবো না আমি ওকে আগলে রাখবো)

কাব্য’র ফোন থেকে নাম্বারটা ডিলিট করে ফেললাম, আমি চাই না কাব্য এই বিষয় নিয়ে আর খুঁজাখুঁজি করুক আর হিয়ার বিপদ ডেকে আনুক। কাব্য মেয়েটাকে শাস্তি দিতে গেলে যদি হিয়ার কোনো ক্ষতি করে বসে তখন? হিয়া তো কাব্য’র সব, হিয়ার কিছু হলে কাব্য শেষ হয়ে যাবে। আমি আমার জন্য ওদের ভাই বোনের কোনো ক্ষতি হতে দিবো না। কিন্তু মেয়েটি কে যেকিনা আমাদের সম্পর্কে সবকিছু জানে? শুভ্রা যে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত কারণ কন্ঠটা শুভ্রার ছিল না তাহলে মেয়েটি কে?

কাব্য: তিলো উঠো (কাব্য’র ডাকে সকালে ঘুম ভাঙলো)
কাব্য: কিছু খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও তারপর আবার ঘুমিয়ে যেও সমস্যা নেই।
আমি: বাসায় যেতে পারবো কবে?
কাব্য: এই অবস্থায় তুমি বাসায় চলে যেতে চাইছ?
আমি: এখানে তো তুমিই সেবা করছ তাহলে বাসায় এই সেবাটা করলে দোষ কোথায়?
কাব্য: তোমার সাথে কথায় পারবো না, আচ্ছা এক সপ্তাহ পর বাসায় নিয়ে যাবো।
আমি: আরো এক সপ্তাহ।
কাব্য: তুমি ভালো করে সুস্থ নাহলে হবে বলো, তোমার যদি কিছু হয়ে যায় আমি কি নিয়ে বাঁচবো (কাব্য আমার গালে একটা হাত রেখে বললো, ওর দুচোখ দিয়ে পানি ঝরছে। কতোটা ভয় পায় ও আমাকে নিয়ে)
আমি: বাসায় যাওয়ার কথা আর বলবো না একেবারে সুস্থ হয়েই বাসায় যাবো। (কাব্য’র হাতের উপর আমার একটা হাত রাখলাম ও মুচকি হেসে আমার মুখে খাবার তুলে দিলো)
আদনান: কাব্য আসবো?
কাব্য: হুম আয়।
আদনান: ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই রিপোর্ট ভালো এসেছে।
কাব্য: সত্যি?
আমি: কিসের রিপোর্ট? (আদনান কাব্য’র দিকে তাকিয়ে রিপোর্টটা রেখে বেড়িয়ে গেলো)
কাব্য: আমরা ভয় পেয়েছিলাম এতো বড় আঘাতের পর তুমি যদি মা হবার…
আমি: ওহ বুঝেছি (আমি আবার মা হতে পারবো এইটার রিপোর্ট ভালো এসেছে আমি তো ভেবেছিলাম আমার বাচ্চাটা বুঝি বেঁচে আছে)
কাব্য: তিলো আমি বুঝতে পারছি তুমি কি ভেবে খুশি হয়েছিলে, মন খারাপ করোনা দেখো আল্লাহ্‌ আবার আমাদের কোলজোড়ে সন্তান দিবেন।
আমি: হুম।

বালিশে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছি, কাব্য দূরে চেয়ারটায় মন খারাপ করে বসে আছে। কাব্য’টার উপর দিয়ে বার বার ঝর বয়ে যাচ্ছে কবে যে ও একটু সুখের দেখা পাবে।
হিয়া: ভাবি আসবো?
আমি: হ্যাঁ এসো। (হিয়া কাব্য’র দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আমার পাশে এসে বসলো)
হিয়া: ভাবি আ…
আমি: তোমার ভাইয়ার সাথে কথা বলোনা কেন?
হিয়া: কোনো জেদি লোকের সাথে কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই (কথাটা শুনে কাব্য হিয়ার দিকে তাকালো তারপর চোখের পানি মুছতে মুছতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো)
আমি: ভুল করছ হিয়া, এসবে ওর কোনো দোষ নেই।
হিয়া: তোমার বেবিটা নষ্ট হয়ে গেছে তারপরও তুমি ভাইয়াকে দোষ দিচ্ছ না?
আমি: না দিচ্ছি না কারণ কোনো বাবা তার সন্তানকে মেরে ফেলতে চায় না। এসবে কাব্য’র কোনো দোষ নেই, হ্যাঁ ও একটু জেদ করেছিল কক্সবাজার যাওয়ার জন্য ব্যাস এইটুকুই।
হিয়া: তুমি ভাইয়াকে খুব ভালোবাস তাই না?
আমি: যে মানুষটা একটা অচেনা মেয়েকে প্রথম দেখায় এতোটা ভালোবাসতে পারে তাকে ভালো না বেসে কি থাকা যায়। আর হ্যাঁ একদিন তুমিও সব রাগ অভিমান ভুলে তোমার ভাইয়াকে ভালোবাসবে আমি জানি।
হিয়া: আমি তো ভাইয়াকে ভালোবাসি অনেক ভালোবাসি কিন্তু…
আমি: এই কিন্তুটা আমি দূর করে দিবো। আমাকে সুস্থ হতে দাও আমি তোমাদের সবার রাগ অভিমান ভাঙিয়ে আবার সবাইকে এক করবো (হিয়া আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে)
হিয়া: সসসবাই মামামানে?
আমি: হুম আব্বু আম্মুকে খুঁজে বের করবো দেখো তুমি।
হিয়া: সত্যি বলছ?
আমি: হ্যাঁ, যদিও আমি জানিনা কিভাবে খুঁজা শুরু করবো তা…
হিয়া: আমি তোমাকে একটা সূত্র দিতে পারি, আমি আব্বু আম্মুকে চাই প্লিজ তুমি এনে দাও।
আমি: কি সূত্র?
হিয়া: ভাইয়া ডায়েরি লিখে, কখন লিখে আর ডায়েরিটা কোথায় রাখে সেটা বলতে পারবো না। মাঝে মাঝে দেখতাম রাতের বেলা ভাইয়া ডায়েরি লিখতো আর কাঁদতো কিন্তু ডায়েরিটা কোথায় রাখে সেটা কখনো দেখিনি। আমি সিওর না তুমি ডায়েরি থেকে কিছু পাবে কিনা কিন্তু আমার মন বলছে এই ডায়েরি থেকেই একটা সূত্র পেয়ে যাবে।
আমি: কোথায় আমি তো ওকে কখনো ডায়েরি লিখতে দেখিনি।
হিয়া: বাসায় ফিরে ভাইয়ার উপর নজর রেখো তাহলেই দেখতে পারবে।
আমি: ঠিক আছে।

চুপচাপ শুয়ে আছি কাব্য পাশে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। ভাবছি হিয়ার কথা কি সত্যি? কিন্তু আমি তো কাব্য’কে কখনো ডায়েরি লিখতে দেখিনি। আর যদি সত্যি লিখে তাহলে কি ডায়েরি থেকে কিছু পাবো?
কাব্য’র দিকে নজর পড়লো একমনে ল্যাপটপের স্কিনে তাকিয়ে আছে, এতো মনোযোগ দিয়ে কি এমন কাজ করছে কে জানে। হঠাৎ একজন সিস্টার তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢুকলো।
সিস্টার: স্যার ওই পেসেন্ট’টার অবস্থা খুব খারাপ (কাব্য ল্যাপটপ হাত থেকে রেখেই দৌড়ে চলে গেলো)
কাব্য এতো মনোযোগ দিয়ে কি এতো কাজ করছিল দেখার জন্য ল্যাপটপ এর দিকে তাকালাম, স্কিনে একটা ছোট্র বাবুর ছবি দেখে বুকটায় ব্যথা শুরু হয়ে গেলো। তারমানে কাব্য কোনো কাজ করছিল না বসে বসে এই বাবুটার ছবি দেখছিল। এতোক্ষণ তো কষ্টটা একটু কম হচ্ছিল এই ছবিটা দেখে বুকের বাম পাশে ব্যথা শুরু হয়ে গেলো। কাব্য আমাকে সাহস দেয়ার জন্য সব কষ্ট লুকিয়ে আমার সামনে দিব্বি হাসে কিন্তু আড়ালে ও কতোটা কষ্ট পাচ্ছে এই ছবি না দেখলে তো বুঝতেই পারতাম না। আবার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে আর বলতে ইচ্ছে হচ্ছে “কেন হলো আমাদের সাথে এরকম”

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here