রোমান্টিক ডাক্তার,পার্ট: ২
লেখিকা: সুলতানা তমা
হসপিটাল থেকে হোটেল এ চলে আসলাম। রুমে এসেই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। তিশার উপর খুব রাগ হচ্ছে এতোক্ষণ তো কাব্য’র কান্ড দেখে হাসছিল এখন আবার আমার সাথে আসেনি, কি যে করছে ওখানে। আর কাব্য কিসব করলো ভাবতেও পারিনি আজকের দিনটা এতো খারাপ ভাবে যাবে আমার। উফফস এখনো মনে হচ্ছে কাব্য আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, হাসছে আর বার বার কানের কাছে এসে একটাই কথা বলছে I Love U For A Thousand More.
কাব্য’র ভূত মাথা থেকে সরানোর জন্য মোবাইলটা হাতে নিয়ে গেইম খেলতে বসলাম।
তিশা: আসতে পারি ম্যাডাম (তিশা এসেছে ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার গেইম খেলায় মন দিলাম। কথা বলবো না আজ ওর সাথে)
তিশা: দোষ করলো ডাক্তার আর শাস্তি পাচ্ছি আমি
আমি: (নিশ্চুপ)
তিশা: কিরে কথা বলবি না আর এই সন্ধ্যা বেলায় একা একা চলে এসেছিলি কেন
আমি: তো কি করতাম তোর জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে কাব্য’র আরো পাগলামি দেখতাম
তিশা: বাব্বাহ্ ডাক্তারবাবু থেকে কাব্য (তিশা হাসছে ইচ্ছে হচ্ছে কয়েকটা দেই)
তিশা: যাই বল ছেলেটা কিন্তু দারুণ, এইটা তুই অস্বীকার করতে পারবি না। (আসলেই তো কাব্য দেখতে অনেক সুন্দর। ফর্সা লম্বা আর ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখতে বেশ সুন্দর আর…)
তিশা: কিরে কোথায় হারালি
আমি: আমরা কাল চলে যাবো তাই না
তিশা: হ্যাঁ
আমি: আর কয়টা দিন থাকতে পারলে ভালো হতো
তিশা: কি ব্যাপার মনে হচ্ছে ডাক্তারবাবুর জন্য টান পড়েছে
আমি: তোকে তো এখন আমি মেরেই ফেলবো
তিশা: এই না না আর বলবো না
আমি: মামির কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না তাই…
তিশা: হুম বুঝেছি কি করবো বল আব্বু তো অনেক চেষ্টা করেছেন তোকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু তোর মামি দিলো না। পাশাপাশি বাসায় থাকি আমরা তাও তোর মামির অত্যাচার থেকে তোকে রক্ষা করার উপায় নেই।
আমি: কখনো কখনো আপন মানুষ পর হয়ে যায় আবার কখনো পর মানুষ খুব বেশি আপন হয়ে যায়। আব্বু আম্মুর মৃত্যুর পর মামার কাছে চলে আসি প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে তোর সাথে পরিচয়, একটা সময় তুই তোর পরিবার আমাকে আপন করে নিলি। কিন্তু মামি আমার আপন হয়েও আমাকে পর করে দিলো। দুনিয়ার নিয়ম খুব অদ্ভুতরে।
তিশা: হ্যাঁ এবার কাব্য তোকে আপন করে নিলেই আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি
আমি: কি বললি
তিশা: কিছু নাতো
আমি: এখনি তো আস্তে আস্তে কি যেন বললি
তিশা: আমার মনে হয় কাব্য তোকে সত্যি ভালোবাসে
আমি: ছাই ভালোবাসে এভাবে হুট করে ভালোবাসা যায় নাকি
তিশা: কতো মানুষ তো প্রথম দেখায় ভালোবাসে তাহলে কাব্য কেন পারবে না
আমি: প্রথম দেখা… আসলে দোষটা আমার, সবসময় তো আমি বোরকা পরেই চলাফেরা করি তাহলে কাল কেন এভাবে বের হই আর কাব্য’র চোখে পড়ি।
তিশা: কক্সবাজার এসে কেউ বোরকা পরে সমুদ্রের পাড়ে ঘুরতে যায় নাকি আর তুই কি জানতি যে এই অবস্থায় হসপিটাল যেতে হবে।
আমি: তাও বোরকা পড়লে কাব্য কেন কোনো ছেলেই তো আমার দিকে…
তিশা: যে সত্যি তোকে ভালোবাসবে সে তোকে বোরকা পড়া অবস্থাতেই চিনবে এবং ভালোবাসবে।
আমি: তাই বুঝি
তিশা: জ্বী এবার খেয়েদেয়ে ঘুমান সকালে চলে যেতে হবে।
বিছানায় শুয়ে আছি কিন্তু ঘুম আসছে না চোখে। গত দুদিন এখানে ছিলাম মনে হয়েছিল কোনো এক শান্তির রাজ্যে আছি কিন্তু এই শান্তি তো কালই শেষ হয়ে যাবে। আবার শুরু হবে মামির চেঁচামেচি, একটু কিছু হলেই আম্মু আব্বুকে নিয়ে গালাগালি, এসব অসহ্য লাগে। তিশা আর আঙ্কেল মামিকে কতো কিছু বুঝিয়ে কক্সবাজার আসার ব্যবস্থা করলো কিন্তু মামি শুধু দুদিনের সময় দিলো, তাও তিশা মেনে নিয়েছিল শুধুমাত্র আমাকে একটু খুশি দেখার জন্য। তিশার দিকে তাকালাম চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে, ওর ঘুমন্ত মুখটা কি নিষ্পাপ লাগছে। সত্যি তিশার মতো মেয়ে আরেকটা আছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। যেখানে আজকের দিনে সবাই নিজের স্বার্থ নিয়ে পাগল সেখানে তিশা কিনা আমাকে এতো ভালোবাসে আমার জন্য এতোকিছু করে।
তিশা: তমা উঠ নামাজ পড়বি না
আমি: উহু পরে
তিশা: উঠ বলছি।
তিশা আমার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলো। চোখ ডলতে ডলতে ওর দিকে তাকালাম, নামাজ পড়ার জন্য রেডি হয়ে আছে। তিশার এই জিনিসটা আমার খুব ভালো লাগে যতোই ভালোবাসুক নামায না পড়লে তিশা খুব রেগে যায়।
তিশা: যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ওজু করে আয়
আমি: ওকে মহারাণী।
নামাজ পড়ে এসে দুজন বসে বসে চা খাচ্ছি তখনি আমার ফোন বেজে উঠলো। উফফফ আবার মামির ফোন।
আমি: হ্যালো
মামি: কখন আসছিস তোরা
আমি: আচ্ছা মামি তুমি তো আমাকে সহ্য করতে পারো না তাহলে আমি দুদিনের জন্য এখানে আসাতে এতোবার ফোন করছ কেন তাড়াতাড়ি যেতে বলছ কেন। না মানে আমি বাসায় না থাকলে তো তোমার খুশি হবার কথা।
মামি: এতো পাকামো করতে হবে না। প্রয়োজন আছে তাড়াতাড়ি চলে আসিস।
আমি: হুম। (ফোন রেখে দিয়ে তিশার দিকে তাকালাম, ও ভ্রু কুঁচকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো)
তিশা: তোর মামির মাথায় কি প্ল্যান চলছে বলতো
আমি: প্ল্যান
তিশা: হ্যাঁ, তোকে তো এই মহিলা কখনোই সহ্য করতে পারেনি আর তোর মামা মারা যাওয়ার পর তো রীতিমতো তোর উপর অত্যাচার শুরু করে দিয়েছে। কক্সবাজার এসেছিস দুদিনের জন্য তাই এতোবার ফোন করছে নিশ্চয় কোনো খারাপ মতলব আছে এই মহিলার।
আমি: দূর কি বলছিস এসব
তিশা: আচ্ছা তমা কাব্য ছেলেটাকে তোর ভালো লেগেছে তো (কাব্য’র কথা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম)
আমি: কেন ভালো লাগবে ও কি কোনো দেশের রাজকুমার
তিশা: না তবে কোনো একজনের রাজকুমার (ওর সাথে যতো কথা বাড়াবো ততোই কাব্য’র ভূত আমার মাথায় চেপে বসবে)
আমি: চল ব্যাগ গুলো গুছিয়ে নেই
তিশা: ঠিক আছে।
সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে এসে বসলাম একটু পর চলে যাবো। চলে যাবো ভাবতেই মনে হলো এখান থেকে চলে গেলে তো কাব্য’র সাথে আর কখনো দেখা হবে না। আচ্ছা কাব্য’র সাথে আর কখনো দেখা হবে না এইটা ভাবতেই আমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেন।
তিশা: তমা আমি ভাবছিলাম যাওয়ার পথে হসপিটালে গিয়ে ছেলেটাকে একবার দেখে যাই
আমি: হসপিটাল
তিশা: হ্যাঁ শুধু একবার দেখেই আমরা চলে যাবো
আমি: উহু আমি যাবো না
তিশা: যার জীবন বাঁচিয়েছিস তাকে একবার দেখবি না
আমি: কিন্তু ওখানে তো কাব্য আছে
তিশা: তো কি হইছে আমরা তো আজ বোরকা পড়ে যাবো ও তো চিনতেই পারবে না
আমি: ঠিক আছে।
হোটেল থেকে বেড়িয়ে সোজা হসপিটাল চলে আসলাম। আজ কাব্য আমাকে চিনতেই পারবে না ওর সামনে দিয়ে চলে যাবো হিহিহি। গতকাল যদি বোরকা পড়ে বের হতাম তাহলে এতোকিছু হতো না। বোরকা ছাড়া বের হলে তো যেকোনো ছেলের নজরে পড়বো এটাই স্বাভাবিক, কাব্যকে দোষ দিয়ে তো লাভ নেই দোষ তো আমার বোরকা পড়িনি।
তিশা: তমা এদিকে চল ছেলেটির কেবিনে যেতে পারবো
আমি: হুম।
ছেলেটির কেবিনে এসে চুপি দিলাম ও ঘুমিয়ে আছে, দেখে তো মনে হচ্ছে মোটামুটি সুস্থ।
তিশা: তমা তুই এদিক দিয়েই বাইরে যা আমি একটু আসছি
আমি: কোথায় যাচ্ছিস
তিশা: আসছি দুমিনিট।
এই তিশা আবার কোথায় চলে গেলো। দ্রুত হাটছি যেন কাব্য’র সামনে না পড়ি, হঠাৎ দেখি সামনে কাব্য এদিকেই আসছে। আসুক আমাকে তো আর চিনতে পারবে না কারণ আমার চোখ দুটু ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কাব্য’র সামনে দিয়ে চলে আসলাম কিন্তু বেশি দূর আসতে পারলাম না কে যেন ডেকে উঠলো।
“তিলো ও তিলো” আশ্চর্য আমার নাম ধরে এভাবে কে ডাকছে, পিছন ফিরে তাকালাম কাব্য দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু ও তো অন্যদিকে ঘুরে কিসের যেন একটা রিপোর্ট পড়ছে। যে খুশি ডাকুক আমি আগে এখান থেকে বের হই। পা বাড়াতেই কাব্য আমার হাত ধরে ফেললো।
কাব্য: তিলো কি ভেবেছিলে বোরকা পড়লে আমি তোমাকে চিনতে পারবো না (এইরে এইটা কি হলো ও তো চিনে ফেলছে)
কাব্য: আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই তুমি যে অবস্থাতেই থাকো আমি ঠিক চিনতে পারবো (হাত ধরে টান দিয়ে ওর সামনে এনে দাড় করালো)
কাব্য: চলে যাচ্ছ আজকে (ওর কন্ঠ কেমন যেন ধরে আসছে, ওর দিকে তাকালাম ওর চোখে তো পানি। আমি চলে যাচ্ছি বলে ও কাঁদছে)
কাব্য: আমার রুমে চলো (আমাকে টানতে টানতে ওর রুমে নিয়ে আসলো। আমি বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছি, আমাকে যেন চিনতে না পারে বোরকা পড়লাম কিন্তু ও তো ঠিকি চিনে ফেললো)
কাব্য: তিলো (আমাকে টান দিয়ে ওর একদম কাছে নিয়ে গেলো। একটা হাত দিয়ে আমার কোমর জরিয়ে ধরে আছে। ওর বুকের সাথে যেন মিশে যাচ্ছি, ওর প্রতিটা হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। আমার কপালের সাথে ওর কপাল ঠেকিয়ে কেঁদে দিলো)
আমি: কাঁদছেন কেন (আমি জিজ্ঞেস করতেই আচমকা আমাকে খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরলো)
কাব্য: চলে যাচ্ছ কেন আর দুইটা দিন এখানে থাকো প্লিজ। আমি তোমাকে না দেখে থাকবো কিভাবে। (ওর কান্না কেন যেন ভালো লাগছে না, বুকের ভিতর কোথাও যেন কষ্ট হচ্ছে খুব)
আমি: আপনি এভাবে কাঁদলে আমি এখনি চলে যাবো
কাব্য: কোথায় আমি কাঁদছি না তো (আমাকে ছেড়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। খুব অসস্থি হচ্ছে ওর এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে কিন্তু কিছু বলতে পারছি না। আবার আমার কাছে এসে দুহাত দিয়ে আলতো করে আমার দুগালে ধরলো)
কাব্য: বোরকা পড়লে তোমায় খুব মিষ্টি লাগে সবসময় বোরকা পড়ে বের হবে বুঝেছ। বোরকা পরে বের হলে আমার বউটার দিকে অন্য কোনো ছেলে নজর দিতে পারবে না (বউ শব্দটা শুনে ওর চোখের দিকে তাকালাম সাথে সাথে ও চোখ টিপ মেরে বসলো, কি অসভ্য)
আমি: অনেক হয়েছে এবার ছাড়ুন আমাকে তিশা খুঁজছে হয়তো
কাব্য: উহু তিশা খুঁজবে না। আর তো কখনো দেখা হবে না তাহলে এতো তাড়া দিচ্ছ কেন।
আমি: (নিশ্চুপ)
কাব্য: ও তিলো
আমি: তিলো কে
কাব্য: তুমি, তিলোত্তমা এতো বড় নামে আমি আমার বউকে ডাকতে পারবো না তাই ঠিক করেছি তিলো নামে ডাকবো।
আমি: আর কখনো দেখা হলে তো ডাকতেন একবার যাই এখান থেকে আর কখনো আপনার সামনে আসবো না
কাব্য: এই আস্তে আস্তে কি বলছ
আমি: যেতে হবে এবার আমাকে ছাড়ুন
কাব্য: ছাড়তে পারি এক শর্তে আমাকে Love U বলো ছেড়ে দিবো
আমি: হুহ সখ কতো (এক ঝটকা দিয়ে ওকে দূরে সরিয়ে দিয়ে চলে আসলাম, দরজায় আসতেই আবার ডাক দিলো)
কাব্য: তিলো ও তিলো “I Love U” (ওর দিকে একবার তাকিয়ে বাইরে চলে আসলাম)
তিশা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য ইসস কাব্য’র জন্য কতো দেরি হয়ে গেলো।
তিশা: আসার সময় হলো আপনার
আমি: দুর কাব্য…
তিশা: জানি
আমি: জানিস মানে
তিশা: তোকে কাব্য’র কাছে দেখেই তো বাইরে এসে তোর জন্য অপেক্ষা করছি
আমি: ওর কাছে দেখলি অথচ আমাকে আনলি না
তিশা: কেন আনবো আমি তো জানি তুই কাব্য’র কাছে থাকলে সেইফ থাকবি
আমি: রাগাস না চল
তিশা: ওকে ম্যাডাম।
বাসে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। কাব্য’র ভেজা চোখ দুটু বার বার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ছেলেরা নাকি খুব বেশি কষ্ট না ফেলে কাঁদে না তাহলে কি কাব্য সত্যি আমাকে ভালোবাসে…? এতোক্ষণ তো কাব্য কাঁদছিল এখন তো আমার চোখ দুটু বার বার ভিজে যাচ্ছে। কেন যেন যেতে ইচ্ছে করছে না খুব কষ্ট হচ্ছে, মনে হচ্ছে এখানে কিছু একটা ফেলে রেখে যাচ্ছি অনেক মূল্যবান কিছু….
চলবে?