#রৌদ্র_কুয়াশা,পর্ব ৩৩,৩৪
Suvhan Årag(ছদ্মনাম)
পর্ব ৩৩
ইলা ছলছল চোখে মাহিরের দিকে তাকালো।
-আপনি আমার সাথে এমনটা করতে পারলেন মাহির!
মাহির ইলার কথা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া না করে দাড়িয়ে ফোন হাতে নিয়ে তাতে মনোযোগ দিল।
ইলা আরো রেগে গেল।
-মাহির।
-কি হয়েছে?
-আপনি কি জানেন আপনি পৃথিবীর সব থেকে খারাপ স্বামী।আপনার গুণে নুন দেওয়ার জায়গা নেই।আপনি একদম আলুনি তরকারি।
মাহির ইলার দিকে একনজর তাকিয়ে আলমারির দিকে গেল।টিস্যু বক্স বের করে এনে ইলার হাতে দিল।
-নেও ধরো।কেঁদে নেও।
-মাহির!
-শুনছি তো।
-আপনি এটা করতে পারেন না।
-আমি কি খারাপ করেছি পানিজল?
-আপনিই মনে হয় পৃথিবীর প্রথম তিতা ফ্রেভারের স্বামী যে কিনা বউকে এক কাটুন ভরা বই খাতা কলম গিফট করে।আবার ভেতরে তিনটা বেত রেখে চিরকুটে লিখে দেয়-“পড়া ঠিক মতো না পড়লে দুই ঘা বেতের বাড়ি খেতে হবে”।
ইলা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেই দিল।মাহিরের বেশ হাসি পাচ্ছে ইলাকে দেখে।মাহির ইলার পাশে ভাবলেসহীন ভাবে বসে পড়লো।
-দেখো পানিজল পড়াশোনা তো সব চাদ ও না মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়েছো।তোমার আর পড়াশোনার সম্পর্ক এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে,”সূর্যে ও চিনেনা,চানদেও চিনে না।তোমরা দুজন দুজনকে একদম চেনো না “।
ইলা নাক টেনে মাহিরের দিকে তাকালো।
-মাহির আপনি ভুল করছেন।
-কোনো ভুল না।তুমি কি ভেবেছো এ কদিন টোটো কম্পানি করে বেড়িয়েছো বলে আমি সব ভুলে গেছি?
-মাহির।কেন এসব টেনে আনছেন।এখন কই সংসার করব।হালি হালি বাচ্চা কাচ্চা পালবো।ওদের বিয়ে দেব।তারপর ওদের বাচ্চা কাচ্চা পালবো।আমি নানী দাদী হবো।
-আহা।কি ইচ্ছে!শুনে তো আমার নিজেকে কলাগাছে র সাথে ঝুলাতে মন চাইছে।মানুষ বিয়ে করে সংসার এর চিন্তা করে পারেনা উনি নাতি নাতনি অবধি চলে গেছে!একদম চুপ করে বসে আমার কথা শুনবে।
মাহিরের বকা খেয়ে ইলা কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছে।মাহির ইলার কাছে গিয়ে ইলার একটা হাত টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।
-পানিজল।
-,,,,,,,।
-পানিজল।
-উফ!শুনছি তো।আমি কানে কম শুনিনা।
-দেখো আমি চাইনা তুমি পরিচয়হীন থাকো।আমি চাই তুমি নিজের একটা পরিচয় গড়ো।শুধু শুধু সারাদিন বসে বসে টোটো কম্পানি করে বরের টাকায় বসে বসে খাবে সেটা আমি দেখব না।আর তুমি,,,,,,,।
এর মধ্যে মাহিরের ফোন বেজে উঠলো।ম্যানেজার এর ফোন দেখে মাহির ফোন হাতে নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল।ইলা তো হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে।সে ভেবেছিল পড়াশোনা নামক ভাইরাস থেকে সে মুক্তি পেয়েছে।তাকে আর এসব করতে হবে।কিন্তু সেগুড়ে বালি।ইলা মেনেই নিতে পারছে না।আরো মাহির কিনা আজ তাকে পড়াশোনার জন্য খাওয়ার খোটা দিল!ইলা যেন কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
-আজ এই পড়াশোনার জন্য মাহির আমাকে খাওয়ার খোটা দিল।আল্লাহ এই দিন দেখার ছিল।এই পড়াশোনা যে কে আবিষ্কার করছে তাকে একবার পাইতাম।আমার পছন্দের মুরগীর ঝোলের কসম ওরে গুলি করে ওর খুলি উড়াই দিতাম।একদম এই পার থেকে ওপারে পাঠাতাম।কিন্তু এর খোঁজ পাব কি করে?
ইলা আসন গেড়ে বসে হাঁটুতে এক হাত ভর করে গভীর চিন্তায় মগ্ন।
-আর আমি তোমাকে ইমিডিয়েট পাবনা ভর্তি করব না সেটার খোঁজ নিচ্ছি।
মাহিরের গলা পেয়ে ইলা পেছনে মাহির কে দেখে ঢোক গিলে চুপচাপ বসে রইলো।মাহির ইলার পাশে এসে বসলো।
-শোনো খাওয়ার খোটা দেইনি।ইলা মানুষ চিরন্তন নয়।আমি আজ আছি।কাল থাকব না।আমার সবকিছু তোমার ই।কিন্ত কি হবে জানো?মানুষ বলবে সব তোমার স্বামীর।তুমি কি করেছো?আমি এজন্য ই চাইছি তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াও।তুমি আমার কথা না শুনেই উল্টা বুঝো।আমি তোমাকে খোটা কেন দিবো?স্বামী হয়ে দায়িত্ব ই যদি না নিতে পারব তাহলে বিয়ে করব কেন?বুঝেছো আমার কথা।
-হুম।
-কি হুম?
-কিন্তু আমার হালি হালি বাচ্চা কাচ্চা।ওদের কি হবে?
ইলা বাচ্চা বাচ্চা মুখ করে মাহিরকে প্রশ্ন করলো।মাহিরের চোখ বড় বড় হয়ে গেল ইলার কথা শুনে।আবার ভেতরে ভেতরে পুরানো কষ্ট টা যেন খোঁচা দিতে লাগলো।
গম্ভীর মুখে মাহির বললো,
-ঘুমিয়ে পড়ো।কাল থেকে কলেজ যাবে।আর ডেইলি যেতে হবে না।আমি তোমার নোটের ব্যবস্থা করব।সময় মতো পরীক্ষা দিলেই হবে।ভালো করে পড়ো।আরেকঁ টা কথা ।
-কি?
-ইলা বাচ্চা বাচ্চা করো কেন?বাচ্চা না থাকলে কি খুব ক্ষতি হবে।
মাহিরের কথা শুনে ইলা ভড়কে গেল।
-কি বলছেন কি আপনি?মাথা খারাপ হয়েছে?বাচ্চা না থাকলে কি আর সংসারহয়!
-ওহ।
মাহির মলিন হেসে উঠে দাড়ালো।মাহিরের হাসিটা ইলার ভালো লাগলো না।নিমিষেই যেন মাহিরের মুখ থেকে দুষ্টুমি র ছাপ মুছে একরাশ অন্ধকার ছেয়ে গেছে।মাহির চলে যেতে নিলেই ইলা মাহিরের হাত টেনে ধরলো।
-কি হয়েছে?
-আপনার কি হলো?মুখটা এমন করে আছেন কেন?
-কিছু না।
-বাচ্চার কথা বলতেই এমন মুখ ভার হলো যে?
-বাচ্চা বাচ্চা করলেই কি হয় পানিজল?তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না।সংসার টা তো অনেকটা এক তরফা করছি আমি।তোমার অসুবিধা গুলো দেখছি।নিজের পছন্দ মতো তোমাকে বিয়ে করেছি।তোমার মতামত নেইনি।আমি তখন এটা বুঝতে পারিনি এভাবে এক তরফা হবে সব।বুঝলে এই কাজটা করতাম না।
মাহির মূলত নিজের কষ্ট টার জন্য কথাটা ঘুরিয়ে দিল ইলাকে।যদিও এটাও সত্যি।আর এই সত্যি টা মাহিরকে আরো কষ্ট দেয়।কিন্তু কেন যেন ইলার খুব কষ্ট হচ্ছে মাহিরের অবস্থা দেখে।
-মাহির।
-হাতটা ছাড়ো।ঘুমিয়ে পড়ো।রাত হয়েছে।
-আপনি ঘুমাবেন না?
-আমার অফিসের কিছু কাজ আছে।সেটা শেষ করে ঘুমাব।
-এতো রাতে অফিসের কাজ!
মাহির ইলার কথার উওর না দিয়ে হাত টা ছাড়িয়ে নিল ইলার থেকে।ল্যাপটপ নিয়ে পা বাড়ালো বেলকনির দিকে।
মাঝরাত।পুরো শহর ঘুমে আচ্ছন্ন।আশে পাশের যতদূর অবধি দেখা যায় বিল্ডিং গুলো অন্ধকার।দু এক জায়গায় আলো জ্বলছে।মাহিরের মনে হচ্ছে হয়তো মাহিরের মতো ও কোনো রাত জাগা পাখি আছে।যাদের কাছে দিনের আলো থেকে রাতের আঁধার টাই অধিক পরিষ্কার।রাস্তায় রাস্তায় ল্যামপোস্টে বাতি জ্বলছে।মাহির সিগারেটে টান দিচ্ছে।মুখ থেকে ধোয়া বের করে উড়িয়ে দিচ্ছে আধারের ঘনঘটায়।মাহির সিগারেট খায়না।কিন্ত তার কাছে একটা প্যাকেট থাকে সব সময়।আরিয়ান বলেছিল সিগারেটের ধোয়ায় নাকি কষ্ট গুলো ও উবে যায়।তাই আজ সেই কথাতেই মাহির একটা চেষ্টা করে দেখলো।ইলার কথা মাথায় আসতেই মাহির এর আরো কষ্ট হচ্ছে।সে নিজ হাতে ইলার জীবনটা শেষ করে দিলো নাতো?
-এই আপনার অফিসের কাজ?ঘরে বউকে একা ফেলে আপনি সিগারেট নামক সতীনকে ধরেছেন।তাকে আবার ঠোঁটের সাথে আলিঙ্গন করছেন।ছিহ মাহির।এটা আপনার থেকে আশা করিনি।আপনি আমাকেও বোধ হয় এ তো টা আলিঙ্গন করেননি।
কারোর কন্ঠ পেয়ে পেছনে ফিরলো মাহির।ইলা কোমড়ে দু হাত রেখে দাড়িয়ে আছে।শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে রাখা।দেখে মনে হচ্ছে কোমড় বেধে ঝগড়া করতে আসছে।মাহির মুখ থেকে সিগারেট টা সরালো।ইলার দিকে দু কদম এগিয়ে এসে ইলার মুখের ওপর সব ধোয়া ছেড়ে দিল।ইলা একটু কেশে ভ্রু কুচকে তাকালো মাহিরের দিকে।
-আপনাকে এর শাস্তি পেতে হবে।
-ভেতরে যাও।এর গন্ধ শুকলে তোমার কষ্ট হবে।
-আর এটা খেলে যে আপনার শরীর খারাপ হবে।
-ভেতরে যাও ইলা।
-যাবো না।
-ইলা আমি বলছি তো ভেতরে যাও।
ইলা মাহিরের দিকে একনজর তাকিয়ে একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়লো মাহিরের ওপর।কাধের ওপর থেকে দু হাত ছড়িয়ে পা উঁচু করে মাহিরকে অন্য ভাবে আলিঙ্গন করলো।এতক্ষণ ধরে মাহির আর সিগারেটের মিলন দেখে যেমন কষ্ট হচ্ছিল সেটা যেন পুষিয়ে নিল।মাহির ও কিছু বললো না।একটু চমকে গেল।মাহিরের হাত থেকে সিগারেট টা পড়ে গেল ফ্লোরে।সিগারেট টা একটু জ্বলতে জ্বলতে একা একাই নিভে গেল।কিন্তু এদিকে যে দুটো মানুষের মনের আগুন নেভেনি।উল্টা দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে।
৯৩
সকাল সকাল খাবার টেবিলে বসে আছে আরিয়ান।একটু পর থানায় যাবে সে।নিত্যদিনের মতো খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে।এর মধ্যে অনু এলো।কাঁচুমাচু হয়ে আরিয়ান থেকে অনু বেশ দূরেই দাড়িয়ে আছে।
-আরিয়ান সাহেব।
অনুর গলা শুনে পত্রিকা থেকে চোখ উঠালো আরিয়ান।কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলেই রেখে দিল।উঠে দাঁড়ালো।সকাল থেকেই গম্ভীর হয়ে আছে আরিয়ান।কেন?অনু জানেনা।তবে আরিয়ান জানে কাল রাতটা সে ঘুমোতে পারেনি।অনুর সাথে কথা বলার ইচ্ছে টাও নেই।আরিয়ান অনুর কথার উওর না দিয়ে উঠে দরজার দিকে পা বাড়ালো।অনু দু কদম এগিয়ে গেল।
-আরিয়ান সাহেব।দাড়ান।আমার কিছু বলার আছে আপনাকে।
অনুর আবদার মিনতি আরিয়ান আর ফেলতে পারলো না।দাড়িয়েই গেল।কিন্ত পিছু ঘুরলো না।
উল্টো দিকে ফিরেই বললো,
– কি হয়েছে?
-আপনাকে কিছু বলার ছিল।
-বলে ফেলুন।
-আরিয়ান সাহেব আমি কাল রাতে অনেক ভেবেছি।
-কি ভেবেছেন?
আরিয়ানের কথায় বিরক্তির সুর।
-আপনি ঠিক বলেছেন।জানোয়ার কখনো মানুষ হয়না।
আরিয়ান যেন কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল।সাথে সাথেই পিছনে ঘুরলো।
-মানে?
-আমি ওনাকে ডিভোর্স দেব।আমি একা বাঁচব।কিন্তু বাঁচার মতো বাচব।
আরিয়ান যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।রাত জাগা রাগ মুহূর্তেই উবে গেল।খুশিতে চোখ চকচক করে উঠলো আরিয়ানের।অনু এখনো মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।
চলবে———
#রৌদ্র_কুয়াশা
Suvhan Årag(ছদ্মনাম)
পর্ব ৩৪
অনু আবার বলে উঠলো,
-আরিয়ান সাহেব,আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।আপনি আমার জন্য অনেক কিছুই করেছেন।বলতে গেলে আমার পরিবার ও আমার জন্য করেনি।আপনি যা বলছেন অবশ্যই সব ভেবেই বলছেন।আমি গতকাল হুট করে বুঝতে পারিনি।আপনাকে ওভাবে অসম্মান করতে চাইনি।
অনুর কথাতে আরিয়ান সোজা হয়ে দাড়ালো।দু হাত প্যান্টের দু পকেটে রাখলো।
-অনু আপনি এতো বেশি কেন ভাবেন বলুন তো?সেই এক কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে।
আরিয়ানের কথায় অনু কোনো উওর দিল না।চুপ করে দাড়িয়ে রইলো।
-কি হলো?
-মাফ করবেন।আপনাকে অযথা বিরক্ত করলাম।
-আবার সেই!আচ্ছা আসি।আল্লাহ্ হাফেজ।
-আল্লাহ্ হাফেজ।
-ও শুনুন।
-জি।
-আমি রিক্সা ঠিক করে রেখেছি।আপনাকে দিয়ে আসবে।আর আশার সময় আমি নিয়ে আসব।
-আপনি?
-হ্যাঁ আমি।আপনার আসতে আসতে অনেক বেলা হবে।রাস্তাঘাটে তখন লোকজন ও কম থাকে।আপনি কিছুই চেনেন না।তাই আমি নিয়ে আসব।অসুবিধা আছে?
আরিয়ানের প্রশ্ন শুনে অনু দুপাশে মাথা নাড়লো।আরিয়ান মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।
-আল্লাহ্ হাফেজ।সাবধানে যাবেন।তুলির কাছে আপনার জন্য একটা ফোন রেখেছি।ওটা নিয়ে যাবেন।কোনো প্রয়োজন হলে কল করবেন।তুলি আপনাকে শিখিয়ে দেবে।
-আচ্ছা।
আরিয়ান পেছনে ঘুরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।অনু ও দরজা দেওয়ার জন্য দু কদম এগিয়ে গেল।আরিয়ান কি ভাবে দাড়িয়ে গেল।আবার পেছনে ঘুরলো।
-অনু।
-কিছু বলবেন আরিয়ান সাহেব?
-হুম।কিছু বলার ছিল।
-বলুন।
-সব সময় সব কিছু বিরক্তির হয়না।কিছু কিছু বিরক্তির কারণ গুলো ভালো লাগে।বড্ড বেশি ভালো লাগে।এ ধরনের কারণ হলে তো আমি বার বার বিরক্ত হতে রাজি।
আরিয়ানের কথা শুনে অনু শুধু হা করে তাকিয়ে আছে।
-কিছু বোঝেন নি?
-না আরিয়ান সাহেব।এতো কঠিন কথা বুঝতে পারিনি।
-থাক বুঝতে হবে না।সব সময় বোঝার দরকার নেই।কিছু কিছু সময় না বোঝাটাই উওম।যেদিন সময় হবে সুযোগ আসবে সব বুঝিয়ে বলব।বোঝার মতো করে বলব।কিন্ত চিন্তা একটাই ধকল টা আপনি সামলাতে পারবেন কি না?
-কি এমন বলবেন?কিছুই বুঝলাম না।
-আসি।
আরিয়ান চলে গেল।অনু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দরজা লাগিয়ে দিল।কি বোঝাতে চাইলো আরিয়ান?অনুর মাথায় একদম ঢোকেনি।
৯৪
টেবিলের ওপরে থাকা পেপার ওয়েট নিয়ে বার বার খেলছে নিবিড়।সামনে মানসিক বিশেষজ্ঞ ডা:তন্ময় লাহা বসে আছেন।তিনি আজ না বরং ছোট থেকেই নিবিড়কে দেখে আসছেন।
-নিবিড়।কেমন আছো?
ডাক্তারের কথা শুনে নিবিড়ের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল।পেপার ওয়েট টা জোরে টেবিলে ছুড়ে মারলো সে।এতোটাই জোরে শব্দ হলো যে ডা:তন্ময় লাহা নিজেই কেঁপে উঠলেন।
-দেখতে পারছেন না আপনার সামনে খাম্বার মতো বসে আছি।আবার জিজ্ঞাসা করছেন কেমন আছো?এই ব্যাটা ভালো না থাকলে কি আপনার সামনে বসে থাকতাম!
ডাক্তার একদমই বিরক্ত হলেন না নিবিড়ের আচরণে।নিবিড় এর এসব আচরণ সম্পর্কে তিনি আগে থেকেই অবজ্ঞত।
-সরি নিবিড়।
-হুম।
-আচ্ছা নিবিড় তুমি এই পৃথিবীতে কাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসো ?
-কাকে মানে!এটাও আপনাকে বলে দিতে হবে!আম্মাজান কে।আমার আম্মাজান কে।
-হুম।তারপর কাকে?
-আমাকে!আই লাভ মাইসেলফ।আমি জানি আমি খুবই বিশেষ একজন ব্যক্তি।আমাকে যে কেউ ভালোবাসতে বাধ্য।তাই আমিও বাধ্য হয়েছি।
-হুম জানি।পাগলেই তো বলে পৃথিবীর সবাই পাগল।
ডাক্তার তন্ময় কথাটা আস্তেই বললেন।নিবিড় অবধি পৌছালো না।গলা ঝেড়ে ডাক্তার তন্ময় আবার বলতে শুরু করলেন,
-আচ্ছা নিবিড় তোমার পর তুমি কাকে ভালোবাসো?
-কে আবার।অনুকে।আমার বউকে।তিন লাখ টাকা একশত পচাত্তর পয়সা দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করেছি।ওকে।
-তোমার বউ কোথায়?
-শয়তানের বাচ্চাটা কোনো নাগরের সাথে পালিয়েছে।বেশ্যা মা*** একটা।
-আচ্ছা নিবিড় তোমার সবচেয়ে পছন্দ এর কাজ কি?
-অনুকে পেটানো।ইচ্ছে মতোপেটানো।জানেন আমার না খুব ভালো লাগে অনু যখন কাদে।আমি চাই ও সারাদিন কাদবে।কিন্তু না ও সারাদিন চুপচাপ থাকে।কেন থাকবে?ওকে সারাদিন কাঁদতে হবে।আর আমি ওকে দেখব।
নিবিড়ের কথা শুনে ঘেমে যাচ্ছেন ডাক্তার লাহা।রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে তার।
-আচ্ছা নিবিড় তোমার কাছে বউ এর কাজ কি?
-খুবই সহজ।বউ এর উচিত সারাদিন স্বামী সেবা করা, স্বামীর কথাতে উঠবস করা, তার চাহিদা মেটানো তার হাতে মার খাওয়া।
-আচ্ছা তুমি কি অনুকে ফিরে পেতে চাও?
-হুম চাই।খুব চাই।
-অনু ফিরে আসলে তুমি কি করবে?
-আগে ওকে ধরে রান্নাঘরে পাঠাব।জানেন ও কতো ভালো রান্না করে।আমি কতোদিন হলো পেট পুরে খাইনা।ওকে দিয়ে বিরিয়ানি,রুটি,হালুয়া ,সুজি,সেমাই, লটপটি সব রান্না করাবো।
-তার পর?
-তার পর সব খাব সব।তার পর আমি কোল্ড ড্রিঙ্কস খাব।
-তার পর?
-তারপর আয়েশ করে বসবো।তারপর একটা মোটা লাঠি দিয়ে ওকে পেটাবো।আচ্ছা করে পেটাবো।এতোই পেটাবো ওর চামড়া ফেটে রক্ত বের হবে।ও চিৎকার করবে।আর আমি আনন্দ করব।
কথা বলার মাঝেই নিবিড় এর মুখে পৈশাচিক হাসি।নিবিড়ের চাহনি দেখেই ডাক্তার লাহা বুঝে যাচ্ছেন বলার সাথে সাথে নিবিড় যেন সামনে একবার দৃশ্যটা কল্পনা ও করে নিলো।
-নিবিড়।তুমি বরং বাইরে যাও।তোমার মাকে এখানে পাঠাও?
-কে মা?আমার কোনো মা নেই।আম্মাজান আমার।
-আম্মাজান কেই পাঠাও।
-আচ্ছা।
নিবিড় উঠে চলে।একটু পর ইসমাত বেগম ভেতর আসলেন।ডাক্তার লাহা ইশারায় ওনাকে বসতে বললেন।
-বলুন ডাক্তার।কি দেখলেন ওকে?
-ভাবি,আপনি হয়তো মা।একটা সত্যি কথা বলি।আজ যদি নিবিড় আমার নিজের ছেলে হতো তো বলে রাখছি আমার বাড়িতে যতো জুতো আছে না একটার ও তলা থাকতো না।ওকে উঠতে বসতে শুধু জুতো দিয়ে পেটাতাম।এতোটা পৈশাচিক চিন্তা কিভাবে আনতে পারে ও?ও পাগল হয়ে গেছে।সাইকো পুরো সাইকো।অনুকে পেলে তো মেরেই ফেলবে ও।
-আপনি তো জানেন সব।কি করব?ওকে যে ফেলতে পারিনা।আমি নিজেও চাই না অনু ফিরে আসুক।আর আসলেও আমি ওকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেব।নিবিড় মানুষ না আমিও জানি।কি করব বলুন?ও যে অসুস্থ হচ্ছে বার বার।
-আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি।নিবিড়ের কন্ডিশন ভালো না।ও কখন কি করবে নিজেও জানে না।আপনি সাবধানে থাকবেন।
-হুম।
ইসমাত বেগম উঠে চলে গেলেন।বাইরে বের হতেই নিবিড় এসে জড়িয়ে ধরলো ইসমাত বেগমকে।
-আম্মাজান শিগগিরই চলুন।আজ অনুকে বলেছি চিতই পিঠা আর গরুর মাংস ভুনা করতে।তাড়াতাড়ি চলুন নাহলে ঐ শয়তান টা সব খেয়ে ফেলবে।
নিবিড় এর কথা শুনে ইসমাত বেগমের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
৯৫
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে মাহির।অফিসের জন্য বের হবে সে।বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে ইলা এখনো ঘুমিয়ে।কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে সে।
গতকাল রাতে অনেক কিছু ঘটতে গিয়ে ও ঘটেনি।মাহির আর ইলার মাঝের দেওয়াল টা মাহির ও ভাঙেনি।কিন্তু ইলা হয়তো বেশিই মত্ত ছিল কাল।মাহির নিজেই হিমশিম খেয়েছে ইলাকে সামলাতে।কাল রাত থেকেই ইলা বেশ রেগে আছে মাহিরের প্রতি।একে তো বই খাতা।তারপর মাহির ইলাকে বলেছে সে ভালো ফলাফল না করলে তাকে মাহির ভালোবাসবে না।মাহিরের কাছে যেতে হলে তাকে পড়াশোনা করতে হবে।
মাহির বিছানার কাছে গিয়ে একটানে ইলার গা থেকে কাথা টা সরিয়ে নিল।ইলা এক লাফে উঠে বসলো।রাগি দৃষ্টিতে মাহিরের দিকে তাকালো।
-এই সমস্যা কি আপনার হ্যাঁ?ঘুমিয়ে ছিলাম সেটাও সহ্য হচ্ছে না।
-যাও হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসো।
-আল্লাহ !তুমি এভাবে আমার সুখের দিন গুলো শেষ করে দিলে।আবার পড়াশোনা নামক বাঁশ টা পেছনে লাগলো।
-তুমি কি উঠবে?নাকি আমি মোটা লাঠি নিয়ে আসবো?
ইলা অসহায় চোখে মাহিরের দিকে তাকালো।
-মাহির আমি সিরিয়াসলি বলছি।আপনি দেখে নেবেন আপনার জীবনে বিয়ে হবে না?আপনি এভাবে নারী নির্যাতন করছেন।আজ আমি পালাবো।এর পর কাউকে যদি আনেন সেও পালাবে।
ইলার কথা শুনে মাহিরের বেশ হাসি পাচ্ছে।মাহির নিজে কে সংযত করে কঠোর গলায় বললো,
-ইলা!তুমি কি উঠবে নাকি আমি লাঠি আনবো।
-উঠছি তো।খালি বকেন কেন?
ইলা মুখ গোমড়া করে উঠে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো।ব্রাশ গালে নিয়ে দাড়িয়ে আছে ইলা।ইচ্ছে মতো মাহিরকে গালাগাল করছে সে।কি এমন দরকার ছিল এই বই খাতা আনার?তার বাচ্চা কাচ্চার কি হবে?সে যদি কলেজ আর বই নিয়ে বসে থাকে তবে তার বাচ্চা গুলো না খেতে পেয়ে চিকন হয়ে যাবে।তাদের কে দেখবে?দুদিন পর দেখা যাবে তার বাচ্চারা তাকে আন্টি বলে ডাকছে।সব সময় মাকে দেখলে যা হয় আরকি।ইলা নিজের ভবিষ্যত টাকে একটু টর্চ লাইট মেরে দেখে নিচ্ছে।
-ধুর ভাল্লাগে না।অন্তত একটা ট্যাপার মা হওয়ার জন্য হলেও বই পড়তে হবে।দুদিন পর মাহিরকে গলিয়ে এক টা ট্যাপা নিতে পারলেই কেল্লাফতে।মাহির নিজেই ওসব বই খাতা ফেরি ওয়ালার কাছে বেচে পাঁপড় কিনে আনবে।তাহলে না হয় কদিন নাটক করে মাহিরকে পটিয়ে দেখি।
ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো।মাহির বিছানায় বসে ফোন দেখছে।
-তোমার সকল ভাবনার জন্য এক আর এফ বালতি ভরা সমবেদনা।তুমি যদি ভেবে থাকো তুমি আমাকে দুটো মিষ্টি কথা বলবে আর আমি ভুলে যাব তো মনে রেখো তার জন্য আরো বড় বাঁশঝাড় আনবো।
ইলা অসহায় হয়ে মাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।মাহির দুষ্ট হাসি দিয়ে ইলার দিকে তাকিয়ে আছে।
-আপনি কি ভাবে সব শুনলেন?
-ইলা তুমি এতোটাই নিরীহ ব্যক্তি যে তোমার কথা বুঝতে সময় লাগে না।
মাহির উঠে দাড়ালো।বের হতে গেলেই ইলা পথ আটকালো।
-কি হলো?
-কাল ওভাবে কেন ফেরালেন আমাকে?আপনি কি এটা চাননি এতোদিন?আপনি কেন এটা করলেন মাহির?
ইলার চোখে একরাশ অভিযোগ।কাল রাতের অভিমান।মাহিরের অনেক কষ্ট হচ্ছে ইলাকে দেখে।কিন্তু মাহির নিজেই জানে সে কেন এমন করেছে।মাহিরের কষ্ট টা যে মাহির প্রকাশ করতে পারছে না।
-কি হলো মাহির বলুন?
-ভালো বাসো?
-,,,,,,,।
-কি হলো উওর দেও?
ইলা এবার ও নিশ্চুপ।মাহিরের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো।
-ইলা মানুষ ভালোবেসে মিলিত হয়।যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে মিলন টা নিতান্ত ই অযৌক্তিক।খেয়াল রেখো।নিচে খাবার আনিয়ে রেখেছি।খেয়ে নিও।আর তোমার আরবি টিচার আজ আসবেন।ওনার কাছে পড়ে একটু রেস্ট নিবে।একটা তরকারি রান্না করবে।বেশি কষ্ট করার দরকার নেই।আমি আসলে আরেকঁ টা পদ রান্না করব।বাকি সময় শুধু পড়বে।
মাহির ইলার কপালে চুমু দিয়ে সরতে যাবে তার আগেই ইলা মাহিরকে জড়িয়ে ধরলো।মাহির এর শার্টের বুকের অংশটা গরম অনুভব হচ্ছে।বোঝা যাচ্ছে ইলা কাঁদছে।মাহির ইলাকে জড়িয়ে নিল।
-কি হয়েছে পানিজল?আমি তোমার চোখের পানি দেখতে পারিনা।কেন বোঝো না?
-আপনি সব কিছু বোঝেন মাহির।কিন্ত আসল কথাটাই বুঝলেন না।অনেকবার বোঝাতে চাই তাও বোঝেন না।এতো অবুঝ কেন আপনি?
ইলার কথার অর্থ মাহির বেশ বুঝতে পারছে।মাহির এর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।
-কি বুঝিনা আমি?
-কারোর নিঃশ্বাসে মিশে থাকার আনন্দ টা।যেটা আমার নিঃশ্বাস কেও ঘন করে দিয়েছে।কারোর ছোটো ছোটো খুশিগুলো যেগুলো আজ আমার খুশির কারণ হয়েছে।আজ আমি নিজের জন্য ভাবিনা।আমার নিজের পরিধি টা আজ বড় হয়ে গেছে।সেটা আমার আমিতে নেই।কোনো এক আপনির সাথে মিশেছে।আমরা হয়ে গেছে।এই আমরার পরিধি টা বেশিই বড়।খুব বেশি।আমি সামলাতে পারছি না।আমি ঐ আপনি টাকে না অনেক কিছু বলতে চাই।কিন্তু বলতে পারিনা।আমি চেয়েছিলাম সে বুঝে নিক।তার বোঝা উচিত তার তুমি টা মুখ ফুটে বলতে পারে না।কিন্তু না আপনি টা বড্ড খারাপ।সেটাও বুঝলো না।কিছু বুঝে না সে।কিছু না।
– কি বুঝিনা আমি?
-আমি আপনার বাচ্চার মা হতে চাই ব্যস।
-সেই এক কথা।ইলা চুপ করো।
ইলা এবার রেগে মাহিরকে ছেড়েই দিলো।কেঁদেই দিল।
-আপনি কিছু বোঝেন না কিছু না।
-কি বুঝবো?
-আমি আপনার প্রতিটি কথাকে ভালোবাসি,আপনার মুখের হাসিটা ভালো বাসি, আপনার ঘুমন্ত মুখটা কে ভালোবাসি,আপনি রাগী চাহনি টাকে ভালোবাসি,আপনার ছোটো খাটো দুষ্টুমি গুলোকে ভালোবাসি,আমি আপনার আপনি কে ভালোবাসি,আমার আলু পাখি র লাল ঠুকটুকে আংকেল কে ভালোবাসি, আমি আপনাকে ভালোবাসি।শুনেছেন আপনি?আপনি একটুও বোঝেন না আমাকে।একটু ও না।
ইলা চোখ মুছে চলে যেতে নিলেই মাহির ইলার হাত ধরে টান মারলো।এক টানেই ইলা মাহিরের বুকে।
-সব কথা যে বুঝতে ভালো লাগে না বউ।কিছু কথা শুনতে চাই।বার বার শুনতে।যেন বিশ বছর পর ও অনুভূতি টা এমন থাকে।এই দিনটা মনে থাকে।আমার ভালোবাসা আমাকে ভালোবাসেছিল।ভালোবাসি বউ।
৯৬
৬ মাস পর
চলবে————–