#রৌদ্র_কুয়াশা,পর্ব ৪১,৪২
Suvhan Årag(ছদ্মনাম)
পর্ব ৪১
মাহির ভেজা চোখ নিয়ে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে ইলার সামনে।ইলা কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে গেছে।বিশ্বাসের দেওয়াল ভাঙার চেয়ে বড় কষ্ট যে আর কিছুই না।
-আপনি এভাবে কেন খেললেন আমার জীবন নিয়ে?মাইশার জীবন নষ্ট করলেন।তার বাচ্চার ও।
-বাচ্চা!
মাহির যেন বড়সড় শক খেলো।ঘোলাটে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে মাহিরের কাছে।মাইশা যে ইলাকে কি পরিমাণ ভুল বুঝিয়েছে বুঝতে বাকি নেই মাহিরের।
-হ্যাঁ বাচ্চা।আপনি একটা ঠক,বিশ্বাসঘাতক।
-ইলা আমি মানছি তোমার থেকে লুকিয়েছে।হ্যাঁ এটা সত্য যে মাইশা আমার স্ত্রী।কিন্তু ,,,।
-বাহ মাহির!আমার তো নিজের প্রতি ঘৃনা হচ্ছে।কত বড় অভাগা আমি।না পেলাম পরিবার পরিজনের ভালো বাসা না পেলাম অন্য কারো।আপনাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম আরে আপনি যে বড় ধোঁকা দিলেন এর থেকে মরে যাওয়া ভালো ছিল আমার জন্য।
-ইলা প্লিজ।আমার কথা শোনো। তুমি এসব বলোনা।
-আমি আর এক মুহূর্ত ও আপনার সাথে থাকতে চাইনা।যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব আমি।কোনো ধোকাবাজ এর ঘরে আর না।
ইলা বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মাহির পথ আগলে দাড়ায়।
-ইলা।আমি ভুল করেছি।অন্যায় করেছি। তুমি চাইলে আমি কখনো আসব না তোমার সামনে। কিন্তু তুমি এ বাড়ি ছেড়ে যেওনা। তোমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই ইলা। তুমি যেওনা।
-যাওয়ার জায়গা নেই জানতেন যখন কিভাবে পারলেন এতো বড় ধোঁকা দিতে?আপনার বুক কাপলো না?আপনার জন্য আজ কিছু না করেই আমার শুনতে হচ্ছে আমি কারোর সংসার ভেঙেছি!ছিহ।যেটা কল্পনা করতেও ঘেন্না লাগে আমার।আপনি কতোটা নিচে নামিয়ে দিলেন আমাকে।হ্যা আমি একজন বার ড্যান্সার ছিলাম।নিজের পেট চালানোর জন্য এই পেশায় ছিলাম। তাই বলে কি আমি মানুষ না!এইভাবে খেললেন আপনি আমার সাথে?আমি নিজেও অনেকবার ভেবেছি আমার মতো একটা মেয়েকে এরকম একটা ধনী পরিবারের ছেলে কেন বিয়ে করলো?কেন নিজের সবকিছু ছাড়লো?আজ বুঝেছি।আপনি গাছের ও খেতে চেয়েছিলেন আর তলার ও কুড়াতে চেয়েছিলেন।আপনি শুধু বিশ্বাসঘাতক ই না একজন চরিত্র হীন পুরুষ।আমার তো নিজের ই ঘৃনা হচ্ছে আপনাকে নিয়ে গর্ব করতাম আমি।মহাপুরুষ ভাবতাম আমি।আপনি একটা চরিত্রহীন কাপুরুষ শুনেছেন মি,মাহির আশহাব। আপনার নাম বলতে ঘেন্না লাগছে আমার। আমার জীবনটা তো এমনিতেই শেষ হয়েছিল শুধু পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়াটা বাকি ছিল।আজ সেটাও আপনি পূরণ করে দিলেন।কি চেয়েছিলাম আমি?একটা ছোট সংসার।আর আপনি কি দিলেন?বলুন।
মাহিরের শার্টের কলার খামচে ধরেছে ইলা।পৃথিবীতে একটা মেয়ের কাছে প্রথম আপনজন হয় তার পরিবার।যখন পরিবার মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন স্বামী শব্দটার কাছেই সে আশ্রয় খোজে।কিন্তু সেই শব্দ টাই যখন বিশ্বাস টাকে ভেঙে ফেলে তখন মৃত্যু টাকেই বেশি আপন মনে হয় মেয়েটার।
-ইলা।আমার কথা টাও তো শুনো।
-আপনি তো একটা মিথ্যাবাদী।কি কথা শুনব আপনার?বানিয়ে অনেক মিথ্যায় বলতে পারেন আপনি।আর কিছু শোনার নেই আমার।আপনি জানেন ভালো বাসা শব্দ টা আমার কাছে কি?অনেক বড় কিছু।আপনি আমার সেই অনুভূতি টাকে ধ্বংস করে দিয়েছেন আজ।আপনার সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই মাহির আশহাব।আর আপনি আমার পরিবারের জন্য কোনো কিছু করবেন না।না আমি করব।সারাটা জীবন শুধু অন্যের কথাই ভেবে গেলাম।আর দিনশেষে স্বার্থ পর খেতাব পেলাম।আর আজ একটা বর পুরস্কার ধোকা।
ইলা মাহিরকে ছেড়ে দিল।কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়লো।মাহির সরে গেল ইলার সামনে থেকে।
-ভালো থেকো পানিজল।আমি অন্যায় করেছি।আমি শাস্তি পাব।তুমি এখানেই থাকবে।আমি কখনো তোমাকে জ্বালাতে আসব না।অন্যায় একটা তুমিও করেছো আমার সাথে।কিছু কথা দিয়েছিলে।একবার শুনতে।শুনলে না।আর শুনলেই বা কি আমি আজ তোমার কাছে একজন মিথ্যাবাদী।আজ কোনো সত্যি তোমাকে এই মিথ্যার দেওয়ালের ওপারের কিছুটা বোঝাতে পারবে না।ভালো থেকো।বড্ড বেশি অন্যায় করেছি তোমার সাথে।অনেক বেশি।আমিও না আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিলাম।ভালো থেকো।আর পরিবার তোমার পরিবারের দায়িত্ব তোমার দায়িত্ব আমার ই থাকবে।তুমি চাইলেও আমি সেটা ফেলব না।আর কেঁদো না প্লিজ।তোমার চোখের প্রতিটি পানির ফোটা আমার কাছে মূল্যবান।ঝড়তে দেখলে কষ্ট হয়।আল্লাহ হাফেজ।
মাহির শেষ বারের মতো ইলাকে দেখে নিল মন ভরে।খোলা চুলে ফ্লোরে বসে কাঁদছে ইলা।এই শীতেও ঘেমে গেছে সে।কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামের সাথে লেপ্টে আছে সামনের ছোট ছোট চুলগুলো।নাক লাল হয়ে গেছে।চোখ মুখ ও লাল হয়ে গেছে।মাহির চোখ বুলিয়ে নিল তার মায়াবতীর ওপর।পেছনে ফিরে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।আর পিছনে ফিরলো না।
১১৪
-তুই কি ভেবেছিস?তোর মতো অমানুষ এমনি এমনি পার পেয়ে যাবে?সাইন কর।নয়তো জেলের ভেতর আজীবন পচে মরবি তুই।
আরিয়ান নিবিড়ের গলা চেপে ধরে সোফার সাথে লাগিয়ে নিবিড়কে শুইয়ে ফেলেছে।আরিয়ানের চোখ মুখ পুরো হিংস্র পশুর মতো হয়ে গেছে।পারলে নিবিড়কে গিলেই খাবে সে।
-ইন্সপেক্টর আপনি ছেড়ে দিন ওকে।ও সাইন করবে।
-করলে ছাড়ব।নয়তো না।আপনার ছেলে এতদিন ধরে আপনার সামনে আপনার পুত্রবধূর ওপর অত্যাচার করেছে আর আপনি তার একটুও প্রতিবাদ করেননি।
-আমি নিজের মতো চেষ্টা করেছি।কি করব বলুন।এই পাগলটাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব?সন্তান আমার।আমি কিভাবে ফেলে দেব বলুন।
নিবিড়ের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সে।ইসমাত বেগমের চোখে পানি দেখে আরিয়ান ছেড়ে দিল নিবিড়কে।নিবিড় উঠে বসে কাশতে লাগলো।
-আপনি ওনাকে পানি দিন।
-জি।
ইসমাত বেগম রান্না ঘরে ছুটে গেলেন।একটু পর পানির গ্লাস এনে নিবিড়ের হাতে দিলেন।দম নিয়ে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে ফেললো নিবিড়। এখনো হাপাচ্ছে সে।
-কি ভেবেছিস?তোকে খুঁজে পাব না?তোর কত বড় সাহস রাস্তাঘাটে মেয়েদের সাথে অসভ্যতামি করতে আসিস।কি ভেবেছিস তোকে পাব না?ঠিক ই তোর ঠিকানা খুঁজে দেখ তোর বাড়িতে এসেছি আমি।লজ্জা নেই।মেয়েদের সাথে অশ্লীলতা।
-ও আমার স্ত্রী।
-রাখ তোর স্ত্রী।স্ত্রীর কি ভাবে খেয়াল রাখতে হয় জানিস?খুব তো স্ত্রী করছিস।এতদিন তোর বউ কোথায় ছিল খোঁজ নিয়েছিস?তার আগে এটা বল কেন তোর বউ তোর জন্য রাত এর বেলায় বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে। বল?আবার স্ত্রী শেখাতে আসছিস।তোর এই কথা আর থাকবে না।নে সাইন কর ডিভোর্স পেপারে।
-করব না।
-তাহলে চল তোকে জেলের ভাত খাওয়ানোর ই ব্যবস্থা করি।
ইসমাত বেগম ছুটে এসে নিবিড়ের গালে কষে একটা থাপ্পড় মারলেন।
-আম্মাজান।
-কেন ঐ মেয়েটার জীবন নষ্ট করার জন্য আবার উঠে পড়ে লেগেছোও তুমি?লজ্জা নেই তোমার।কি দিতে পেরেছো ওকে কষ্ট ছাড়া।মেয়েটাকে মুক্তি দেও।ও বাচুক তোমার মতো জানোয়ারের থেকে।
-আম্মাজান!
-আজ যদি তুমি এখানে সাইন না করো নিবিড় আমি চিরদিনের মতো চলে যাব যেখানে ইচ্ছা।তোমার সাথে এক মুহূর্ত ও থাকব না।তোমার জন্য শুধু মানুষের কাছে ছোট হয়েছি আজ অবধি।অপমানিত হয়েছে।অনুটার কাছেও অপরাধী হয়ে আছি।আমিই তো ওকে এনেছিলাম।তখন তো বুঝতে পারিনি তুমি এতো বড় জানোয়ার হবে।আমি চলে যাব আজ যদি তুমি সাইন না করো।আর অনুকে তো তুমি ভালোবাসো না তাহলে কেন এমন করছো?ওর প্রতি শোধ তুলবে বলে?
-আম্মাজান আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না আম্মাজান।আমি সত্যি অনুকে ভালো বাসি।
নিবিড়ের মুখে ভালোবাসার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আরিয়ান বললো,
-ও তাই বুঝি।কিন্তু অনু আপনাকে ভালোবাসে না।ও একটু ভালো থাকতে চায়।ভালোবাসলে এখানে সই করে মেয়েটাকে মুক্তি দিন।
নিবিড় কিছুক্ষণ ভেবে আরিয়ানের হাত থেকে কাগজ কলম নিয়ে সাইন করে দিল।আরিয়ান কাগজ টা নিয়ে উঠে দাড়ালো।
-ভালো হয়েছে ভালোই ভালোই কাজটা করেছেন।যদি সত্যি কখনো ভালো বেসে থাকেন তবে আর কখনো ওর সামনে যাবেন না।আর এর পর ওর আশে পাশে দেখলে আপনার কি অবস্থা করব কল্পনা ও করতে পারবেন না। আসি।
ইসমাত বেগম গিয়ে আরিয়ানকে দরজা অবধি এগিয়ে দিল।নিবিড় কটমট চোখে তাকিয়ে আছে আরিয়ানের যাওয়ার দিকে।
-অনু প্রিয়া ভালোই নাগর জুটিয়েছো।তোমাকে তো আমি দেখে নেব।
১১৫
ভোরের আলো ফুটেছে।ইলা এখনো সেই ফ্লোরেই বসে আছে।কাল সারা রাত দু চোখের পাতা এক করেনি এসে।
এর মধ্যে ই বাইরে গাড়ির হর্ন এর আওয়াজ। ইলা উঠে দাড়ালো।
-এতো সকালে কে এলো।
এর মধ্যে ই কলিংবেল বেজে উঠলো।ইলা চোখ মুছে গায়ের কাপড় ঠিক করে গিয়ে দরজা খুললো।
-দাদিমা আপনি?
-চলো চলো ভেতরে চলো।কি ঠান্ডা গো বাইরে।
ইলা পাশ কেটে দাড়ালো।আদিবা বেগমের সাথে সাথে আফরিন ও ভিতরে ঢুকলো।সকাল সকাল আদিবা বেগমের আগমন টা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে ইলা। দরজা লাগিয়ে ইলাও ভিতরে চলে গেল।আদিবা বেগম ততক্ষণে সোফায় বসে জিড়িয়ে নিচ্ছেন।
-এটা কি করলে তুমি নাতবউ।আমার প্রিন্স তোমার জন্য কষ্ট পেলো কেন?তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি।
-আমিও তো অনেক কিছু আশা করিনি দাদিমা।আপনার প্রিন্স বলে আপনার কাছে হয়তো নালিশ করেছে।আমার তো সেই নালিশ করার মতো ও কেউ নেই।
চলবে————
#রৌদ্র_কুয়াশা
Suvhan Årag(ছদ্মনাম)
পর্ব ৪২
নিজেকে আর সংযত করতে পারলো না ইলা।আদিবা বেগমের সামনে কেঁদেই দিল।
-আপনার নাতনি একটা ঠকবাজ,বিশ্বাস ঘাতক।আপনি তার হয়ে ওকালতি করতে এসেছেন নাকি আমাকে বের করে দিতে।এমনিতেও এই বাড়িতে থাকার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।আমি পথে পথে ঘুরব তাও ভালো এরকম লোকের বাড়িতে থাকব না।অসম্ভব।
আদিবা বেগম ইলার মাথায় হাত রাখলেন।
-কিরে প্রিন্সেস তুই সারা রাত ঘুমাস নি বুঝি। দেখ তো এরকম কেউ করে।অসুস্থ হয়ে পড়বি তো।তখন আমার প্রিন্স কে কে দেখবে?
-তাকে দেখার জন্য তো তার স্ত্রী মাইশা আছেই।
-মাইশা!
ইলার কথা শুনে হেসেই দিলেন আদিবা বেগম।পান খেয়ে তার ঠোট দুটো লাল হয়ে গেছে।দাঁত গুলো ও সব হলদেটে হয়ে আছে।অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে।ইলা বোকা বনে যাচ্ছে বুড়ির কান্ডে।একে তো এই সকাল সকাল হুইল চেয়ারে করে বাড়ি অবধি এলেন।এখন মাইশার কথা শুনে তিনি হাসছেন।
-আপনি হাসছেন কেন দাদিমা?আমি কি কোনো কৌতুক বলেছি?
-তুই তো কৌতুকের থেকে মারাত্মক কথা শোনালিরে প্রিন্সেস।মাইশা রাখবে মাহিরের খেয়াল।ঐ ডাইনি টা!
-ডাইনি!
-শোন আমি এখানে কোনো ওকালতি করতে আসিনি।তোকে একটা গল্প শোনাতে এসেছি।মাহিরকে অনেক গল্প শুনিয়েছি।তোকে শোনানো হয়নি।ভাবলাম বুড়ি মানুষ কই মরে যাই তার আগে তোকে একটু শুনিয়ে যাই।
-কিসের গল্প দাদিমা?
-এক অভাগা রাজপুত্রের।রাজপুত্র বুঝিস তো?
-বুঝি।
-তাহলে শোন।
আদিবা বেগম বলতে শুরু করলেন,
-একটা ছোট্ট রাজ্য ছিল।রাজ্যে অনেক গরীব মানুষ ছিল।তার মধ্যে ছিল একজন দর্জি আর তার একমাত্র মেয়ে।মেয়েটির বয়স তখন খুব অল্প।হুট করে রাজ্যের রাজকুমারের নজরে কিভাবে যেন পড়ে যায় সে।সে নিজেও জানতো না।সে তো কানামাছি খেলছিল তার বন্ধুদের সাথে।রাজকুমার জিদ ধরলো সেই মেয়েকেই সে বিয়ে করবে।সে প্রস্তাব পাঠালো।গরীব দর্জি তো ভেবে কুল পায়না।রাজার ঘরে দর্জির মেয়ের বিয়ে!এতো অসম্ভব যাকে বলে।কিন্তু রাজপুত্র নারাজ।তার মা বাবা তাকে এতো মেয়ে দেখালো তবুও তার মন ভরলো না।সে ঐ একজনকেই বিয়ে করবে।অবশেষে সে বিয়ে করেই ছাড়লো সেই দর্জির মেয়েকে।জানিস সেই দর্জির মেয়েটা কে ছিল?
আদিবা বেগমের প্রশ্ন শুনে ইলা উওর দিল,
-না দাদিমা।
-আরে পাগলি ওটা আমি ছিলাম।আর রাজপুত্র ছিল তোর দাদা শ্বশুর।বড্ড ভালোবাসতো জানিস।তো এবার শোন পরের কথা।
আদিবা বেগম আবার বলতে শুরু করলেন,
-সবকিছুই ভালো যাচ্ছিল।দর্জির মেয়ে কখনো বুঝতেই পারেনি এতো সুখ তার কপালে ছিল।একদিন সেই মেয়েটার কোল আলো করে এলো ছোট্ট আরেকঁ টা রাজপুত্র।খুশি আর খুশি।কিন্ত হঠাৎ করে সব এলো মেলো হয়ে গেল।রাজা রাণি একই বছরে কয়েক মাসের ব্যবধানে মারা গেলেন।রাজপুত্রের ঘাড়ে তখন বিশাল দায়িত্ব।একে তো স্ত্রী সন্তান আরেক দিকে পুরো রাজ্য।এর মধ্যে হুট করে রাজপুত্র ও চলে গেলেন।মেয়েটি তখন একা হয়ে গেল।চারদিকের সব সুখ যে মুহূর্তেই এভাবে দুঃখে ভরে যাব সে বুঝতেই পারেনি।এদিকে গরিবের মেয়ে ধন সম্পদের কিছুই সে ঠিকমতো বুঝে না।এক শ্রেনীর অতি কাছের আত্নীয় তখন জুটলো।মেয়েটিকে রাজরানী থেকে একদম সেই দর্জির মেয়েতেই এনে দাঁড় করালো।কোলে তার ছেলে।শুরু হলো মেয়েটির নতুন যুদ্ধ।ছেলেকে বড় করতে হবে।সংগ্রাম করতে শুরু করলো মেয়েটি।একদিন তার ছেলেও বড় হয়ে গেল।নিজের মেধা পরিশ্রম দিয়ে সে ব্যবসা শুরু করতে লাগলো।ক্রমশ ই সফলতা আর সফলতা।দর্জির মেয়ের দুঃখ যেন এবার ঘুচলো। তার ছেলেকে সে মানুষের মতো মানুষ করেছে এটা ভেবেই যেন নিজেকে গর্বিত মা মনে হতো তার।কিন্ত সেখানেও ভুল ছিল সে।একদিন নিজের পছন্দ মতো একটা গরীব ঘরের মেয়ে দেখে ছেলের বিয়ে দিল সে।তখনি যেন নিজের ছেলের আসল রূপ আসতে আসতে তার সামনে প্রকাশ হতে লাগলো।গরিবের প্রতি ঘৃনা আর অর্থের নেশা তাকে অন্ধ করে রেখেছিল।নিজের স্ত্রীকে ঘৃনা করতো সে।নির্যাতন করতো।পশুর মতো আচরণ করতো।একদিন তাদের ঘর আলো করে আরেকটা ছোট্ট রাজপুত্রের জন্ম হয়।তার দাদী তার নাম রাখে প্রিন্স।প্রিন্স বড় হতে লাগলো।আর তার মা বাবার ঝামেলা বাড়তেই লাগলো।তার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মা চুপ থাকতো সব সময়। এর মধ্যে একদিন সবচেয়ে বাজে দুর্ঘটনা ঘটে গেল।প্রিন্সের বাবা তখন অর্থের নেশা না অন্য কিছুর নেশাতেও মত্ত হয়ে গেছিল।নিজের চরিত্র টা ও সে নষ্ট করে ফেলেছিল।সেদিন সে বাধ্য করে প্রিন্সের মাকে বাড়ি ছাড়া হতে।প্রিন্স কেও আটকে রাখে তার কাছে।সেদিন প্রিন্সের দাদী ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায়।কদিন আগেই একটা ছোট্ট এক্সিডেন্ট এ নিজের হেঁটে চলার ক্ষমতা হারান তিনি। হুইল চেয়ারে আবদ্ধ হয়ে যান।নিজের ছেলের পা পর্যন্ত ধরতে শুধু বাদ ছিল।তবুও সে নিষ্ঠুর ছেলের মন গলাতে পারেনি।সেদিন মা থাকতেও প্রিন্স মা হারা হয়ে যায়।আজ ও সে জানেনা তার মা কোথায়।
আদিবা বেগম চুপ হয়ে গেলেন।ইলা কেন যেন চোখের কোনায় পানি চলে এসেছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আদিবা বেগম বললেন,
– প্রিন্সের ঐ বজ্জাত বাপটা কে জানিস?
ইলা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো এবার।ইলা বলার আগেই আদিবা বেগম বললেন,
-আলফাজ।তোর ঐ বজ্জাত শ্বশুর।ভিলেন চিনিস সিনেমাতে হয়।আগে কতো বই দেখেছি।ও তোরা তো আবার বই বুঝিস না।আমরা সিনেমা কে বই বলতাম আগে।ওখানে দেখতাম এরকম শয়তান মার্কা লোক।এখন দেখ নিজেই দেখছি সামনে।নিজের পেটে ধরেছি ভাবতেই ঘেন্না ধরে।ও তোকে বাকিটা বলি।শোন।
আদিবা বেগম আবার বলতে শুরু করলেন,
-প্রিন্স টা অনেক অসহায় ছিল রে।একমাত্র তার দাদিমাই ছিল দিনশেষে তার আশ্রয়স্থল।তার বাবাও তাকে দূরছাই করতো।নিজের কাজ নিয়ে পড়ে থাকতো।কখনো ভাবতো না তার ও একটা ছেলে আছে।তার প্রয়োজন বাবার আদর।কারণে বিনা কারণে প্রিন্সটা সব সময় বকা খেত তার বাবার কাছে।মানুষ বলে মেয়েরা জন্ম হয়ে ই যেন খাঁচার মধ্যে থাকে।তাদের সবকিছুতে বাধা।প্রিন্স এর কপাল টা ছেলে হয়েও এমন ছিল না।তার নিজের ইচ্ছের কোনো মূল্যই ছিলনা।তার বাবার কথা অনুযায়ী একটা চকলেট খাওয়া বল কি গোসল সব তার কথামতো।সে না বললে প্রিন্স খেতেও পারবে না। ঐ নিষ্ঠুর টা এতো অত্যাচার করতো প্রিন্সের ওপর।তবুও প্রিন্স দাদিমার কাছে সব বলতো।একমাত্র দাদিমাই ছিল তার কাছের বন্ধু।স্কুল কলেজ কারোর সাথে মিশতেও পারতো না সে।স্কুল ছুটি তো তাকে বাড়ি চলে আসতে হবে সাথে সাথেই।দশ মিনিট এদিক ওদিক হলে ওর সেই ভিলেন বাবা ওর রাতের খাওয়াটাই বন্ধ করে দিত।দেখতে দেখতে প্রিন্স অনার্স এ ভর্তি হলো।এবার কিছুটা সে মুক্তির স্বাদ পেতে লাগলো।একটাই কারণ অনার্স এর ক্লাস একেক সময় এ হয়।একেকদিন।হুট করে ক্লাস বন্ধ ও ঘোষনা হয়।তবুও কড়া নিয়মেই তাকে থাকতে হতো।এর মধ্যে ঘটলো আরেক কান্ড।ভিলেন বাবার বিজনেস এর একটা প্রজেক্ট এ সমস্যা হয়।তিনি পাগলের মতো হয়ে যান।তার কোটি টাকার লস হয়ে যাবে ভেবে।প্রিন্স যাই হোক বাবাকে খুব ভালোবাসতো।সে নিজেই ঐটুক বয়সে দায়িত্ব নেয় প্রজেক্ট টার।আর সফল হয় সে।ঐ দিন প্রথম ভিলেন বাবা প্রিন্সকে তার পছন্দ মতো কিছু উপহার দেন।একটা কালো রঙের মটর সাইকেল ।প্রিন্সের অনেক দিনের শখ ছিল।সেখানেও শর্ত থাকে।সে নিজের ইচ্ছে মতো চলাফেরা করতে পারবে একটু আধটু তবে তাকে তার বাবার সাথে বিজনেস এ যোগ দিতে হবে।স্বার্থ পর ভিলেন বাবা এখানেও নিজের স্বার্থ দেখেন।নিজের একটু মুক্ত হওয়ার সুযোগ প্রিন্স সায় দেয় তার বাবার সিদ্ধান্তে।শুরু হয় প্রিন্সের আরেক জীবন।বাবার সাথে বিজনেস এ বসা পড়াশোনা ভালোই চলছিল সব।প্রিন্সের জন্য তার বাবার লাভ হতেই থাকে শুধু।এর মধ্যে একদিন বিকেল বেলা।প্রিন্স কলেজ থেকে ফিরছে।তার বাইকটা খারাপ হয়ে যায়।সে আশে পাশে খুঁজতে থাকে কোনো গ্যারেজ আছে কিনা। হঠাৎ তার সামনে পড়ে একটা ছোট প্রিন্সেস।দুপাশে বিনুনি করে মুখে ললিপপ দিয়ে স্কুল ব্যাগ কাঁধে সে ফিরছিল প্রাইভেট থেকে।ব্যস।আরেক ঘটনা।প্রিন্সের বাইক ঠিক তো হলো সে বাড়িও ফিরলো কিন্তু তার মনটা সে সেখানেই ছেড়ে আসলো যেখানে সেই প্রিন্সেস এর সাথে তার দেখা হয়।এবার শুরু হয় আরেক টা পথ চলা প্রিন্সের।প্রতিদিন সে সেই প্রিন্সেস এর পেছনে ছুটতে থাকে।তাকে ফলো করে।চিরকুট পাঠায়।আর সব গল্প দাদিমাকে বাড়ি এসে শোনায়। ও আরেকঁ টা কথা তো বলাই হয়নি জানিস প্রিন্স কালো রঙ খুব পছন্দ করতো।তার কাছে ছোট থেকেই মনে হতো তার জীবন টা এমন কালো।প্রিন্সেস এর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে রোজ দাদিমা কে সে বলতো একদিন তার প্রিন্সেসকে সে তার রাজ্যে উঠিয়ে আনবে।সেদিন তার এই কালো রঙ টা সব মুছে যাবে রঙিন হয়ে যাবে সব।কিন্তু ঐ যে বললাম অভাগা রাজপুত্রের গল্প।প্রিন্স এর কপাল টা ই খারাপ ছিল।তার বাবার হঠাৎ মনে হয় তার ছেলেই তাকে দেশের টপ বিজনেস ম্যান হতে সাহায্য করবে।তার অভিজ্ঞতা আরো বাড়ানোর জন্য তিনি প্রিন্স কে দেশের বাইরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।প্রিন্স খুব কেদেছিল। সে বার বার বলতো দাদিমা, আমার প্রিন্সেস কে ছাড়া আমি কি ভাবে থাকব। আমি যদি ওকে না পাই। অসহায় দাদিমা এখানে ও অসহায়। তিন বছর পর প্রিন্স দেশে ফিরলো।দাদিমার কোলে এসে সে আগেই বললো এবার সে তার প্রিন্সেস কে তার কাছে নিয়ে আসবে।নিয়তি এবার ও তার সাধ দিলোনা।তার ভিলেন বাবা আরেক নামকরা বিজনেসম্যান এর মেয়ের সাথে তার বিয়ে দিলেন।ছেলের মতামত জানার প্রয়োজন করলেন না।শুরু হলো প্রিন্সের জীবনের আরেক অধ্যায়।প্রিন্স প্রিন্সেসকে ভুলে গিয়ে তার স্ত্রীকে নিয়েই থাকতে চেয়েছিল।সেখানেও তার কপাল পোড়া।তার স্ত্রী বিয়ের আগেই দুবার এবরশন করিয়েছে।বাসর রাতে সে প্রিন্সকে সে গল্প শোনায়।প্রিন্স তবুও মেনে নিয়েছিল।সে তাকে ভালোবেসে তাকে পথে আনবে।কিন্তু ঐ ডাইনি তো সেটা হতে দিল না। সে তার পুরানো প্রেমিক এর সাথে সম্পর্ক রেখেই চলেছিল।এর মধ্যে হঠাৎ করে প্রিন্স এর একটা সমস্যা ধরা পড়ে।সে কোনোদিন বাবা হতে পারবেনা।ব্যস এই সুযোগটাই যথেষ্ট ছিল তার স্ত্রীর জন্য।এই সুযোগ নিয়ে তার স্ত্রী তাকে ডিভোর্স দেয়।তার স্ত্রী আরো আগেই কাজটা করতো।কিন্তু ডাইনি টা খারাপ হলে কি হবে তার বাবা মা এ মন ছিল না।তাদের জন্য সম্পর্ক টা এতদিন টিকেছিল ।এবার তারাও আর মেয়েকে আটকাতে পারল না।ডিভোর্স এর ব্যবস্থা চলছে এর মধ্যে হুট করে প্রিন্স আবার দেখা পায় সেই প্রিন্সেস এর।সে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সে চলে যাওয়ার পর তার প্রিন্সেস টার জীবনে অনেক বাজে কিছু ঘটে গেছে ।ব্যস সে সিদ্ধান্ত নেয় সে তার প্রিন্সেস কেও ভালো রাখবে আর নিজেও ভালো থাকবে।ডাইনিটার সাথে ডিভোর্স এর পর প্রিন্স তার প্রিন্সেস কে বিয়ে করে।নিয়ে যায় তাকে তার নিজের রাজ্যে।সবই ঠিক ছিল।কিন্তু সেই ডাইনি স্ত্রী টা আবার ফিরে আসলো প্রিন্সের জীবনে।কারণ ততদিনে সে নিজের পাপের ফল পেয়েছিল।সে বুঝেছিল প্রিন্স তাকে নিয়ে ভালোই থাকতে চেয়েছিল।তার বাবা হওয়া না হওয়া টা তখন আর তার কাছে মূল ছিলনা।সে তখন ফিরতে চায় প্রিন্সের কাছে।প্রিন্স তাকে মনে করিয়ে দেয় সব শেষ।তার অস্তিত্ব শুধু তার প্রিন্সেস কে নিয়ে।এখানে প্রিন্স একটা ভুল করেছিল।সে প্রিন্সেস কে এতোটাই ভালোবাসতো তাকে এতোটাই হারানোর ভয় করতো নিজের অতীত সে লুকিয়েছিল তার থেকে।আর এই সুযোগটাই নিল সে ডাইনিটা।সব শেষ করে দিল।প্রিন্স একা হয়ে গেল।আবার ফিরে গেল দাদিমার কোলে।কেঁদে কেঁদে শুধু এটাই বললো,দাদিমা সুখ ও ভালোবাসা শব্দ দুটো আমার জন্য নিষিদ্ধ।
আদিবা বেগম চুপ করে গেলেন।ইলার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে।ইলা কম্পিত কন্ঠে বললো,
-দাদিমা।
-বল।
-প্রিন্স টা কে?সেটা তো বললেন না।
-অভাগাদের নাম জানতে নেই।ভালো থাকিস তুই।
আফরিন দাঁড়িয়ে ছিল।তাকে জোরে তাড়া দিলেন আদিবা বেগম,
-ঐ ছেড়ি। কি দেখছিস?চল বাড়ি চল।
আদিবা বেগম নিজের হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দরজার কাছে চলে গেলেন।আফরিন পিছু পিছু গেল।ইলা দৌড়ে গেল দরজার কাছে।
-দাদিমা বলুন না প্রিন্স টা কে?
-আরে গল্প বলা শেষ।গেলুম রে।ভালো থাক।
আদিবা বেগম একদন্ড অপেক্ষা করলো না।আফরিন কে নিয়ে চলে গেলেন।
ইলা দরজা লাগিয়ে দিল।ভেতরে এসে হাত পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে রইলো।তার কি করা উচিত?ইলা বুঝতে পারছে না।
সকাল গড়িয়ে দুপুর।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।কলিংবেলের আওয়াজ।ইলা উঠে দাড়ালো।দরজার দিকে এগিয়ে গেল।দরজা খুলে দেখে বাইরে ইশতিয়াক দাঁড়ানো।
ইলাকে দেখেই ইশতিয়াক বলে উঠলো,
-ভাবীজান, আপনার কাছে কি দশ মিনিট সময় হবে আমার ভাইজান কে শেষ বারের মতো আপনার মুখটা দেখানোর?
চলবে————