রৌদ্র_কুয়াশা,পর্ব ৪৫,৪৬

0
3039

#রৌদ্র_কুয়াশা,পর্ব ৪৫,৪৬
Suvhan Årag(ছদ্মনাম)
পর্ব ৪৫

১১৮

মুখের ওপর একের পর গরম বাতাসের ছোঁয়া অনুভব হচ্ছে ইলার।এখন তো শীত পড়েছে।তাহলে গরম হাওয়া কোথ থেকে এলো?ভাবতে ভাবতে চোখ খুললো ইলা।সাথে সাথে মুখে প্রশান্তির হাসি।মাহির উবু হয়ে ইলার খুব কাছে এসে ইলাকে দেখছে।

-গুড মর্নিং সোনা বউ।
-গুড মর্নিং পচা বর।
-গুড নুন বললে ভালো হতো।
-কেন?
-বারোটা পাচ বাজে।
-কিহ!

ইলা মাহিরকে সরিয়ে লাফ মেরে উঠে বসলো।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আসলেই তাই।

-আপনি আমাকে ডাকেননি কেন?
-ইচ্ছে করেই ডাকিনি সোনা।তোমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর মশাই দশটা বাজলে অফিস যান।তিনি তোমাকে এখানে দেখলে যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে।আর আমি চাইনা বাবা তোমাকে কোন খারাপ কথা বলুক।তাই আমি উঠে বাবার সাথে ব্রেকফাস্ট করেছি।
-উহ।এটা শ্বশুর না বাঘ।
-বাঘ বলতেই পারো।
-তবুও বেশি দেরী হয়ে গেল।সব দোষ আপনার।
-আমি কি করলাম?কাল দুজনেই তো আড়াইটার ও পরে ঘুমিয়েছি।
-ওহ আপনি ঘুমিয়েছেন?মিথ্যুক কোথাকার।সব সময় আমাকে জ্বালান আপনি।ঠিক মতো ঘুমোতে ও দেননা।

ইলার কথা শুনে মাহির মুখে দুষ্টু হাসি দিয়ে ইলার গালে চুমু দিল।

-আবার!
-ফ্রেশ হয়ে নেও।বাবার সামনে কোনমতে খাওয়ার নাটক করেছি।তোমার সাথে খাব বলে।খুব খিদে পেয়েছে।
-আমি কি পড়ব?এখানে তো কোন জামা কাপড় নেই আমার।
– আমার শার্ট প্যান্ট জ্যান্ত আছে।
-মাহির।
– আরে রাগছো কেন?সব ব্যবস্থা করেছি।তোমার সাইজ বুঝে দুটো জামা আনিয়েছি। আজ চলে যাব ।এই খানে থাকতে ইচ্ছে করেনা আমার।যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।
-যাচ্ছি।

ইলা আলমারি থেকে একটা ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।মাহির বিছানা টা গুছিয়ে ফেললো।

এর মধ্যে ঘরে আফরিনের আগমন।

-ভাইজান।

আফরিনের গলা শুনে মাহির উঠে দাড়ালো।

-হ্যা বল।
-ভাইজান মাইশা ম্যাডাম এসেছে।
-কিহ!ও এখানে কেন?
-আপনার এক্সিডেন্ট এর খবর শুনে দেখতে এসেছে তাই তো বলছে।কি করব?দাদিমা বললেন আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করতে।

মাহির চিন্তায় পড়ে গেল।এই মাইশা নামটা শুনলেই ঘেন্না হয় তার।মাইশা নাম টা তার জীবনের আরেক কাল।মাহিরের ভাবনার মধ্যে ইলা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো।

-আফরিন,তুমি বলো ওনাকে আসতে।

ইলার কথা শুনে চমকে গেল মাহির।

-কি বলছো তুমি?তুমি জানো এখানে এসে নির্ঘাত কোন কাহিনী করবে।
-মাহির।আমাকে বলতে দিন। আফরিন তুমি ডেকে নিয়ে এসো।ও যেন ভুলেও না জানে আমি এখানে আছি।ঠিকাছে?

ইলার কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে বেরিয়ে গেল আফরিন।মাহির ইলার কাছে এগিয়ে গেল।

-পাগল হয়েছো তুমি?কালকে সব বলেছি তোমাকে।কেন এমন করছো?
-মাহির আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন তো।আমার সতীন সাহেবা শ্রদ্ধাভাজন বড় বোন আসছেন আপনাকে দেখতে।আমি কি না করতে পারি?আপনি যান তো গিয়ে শুয়ে পড়ুন।আর কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যান আমি এই ঘরে আছি।

মাহির ভেবেই পারছেনা ইলার মাথায় কি চলছে।কিন্তু সে এইটুকু নিশ্চিত ইলার দুষ্টু হাসি তাকে অন্য কিছুর ইঙ্গিত করছে।

কিছুক্ষণ পর।

মাহির বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে।মাইশা দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো।দৌড়ে গিয়ে মাহির কে জড়িয়ে ধরলো।এপাশে বেলকনি থেকে উঁকি দিয়ে এসব দেখে ইলার গা জ্বলছে।মাইশাকে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার।মাহির এক ঝটকায় মাইশাকে সরিয়ে দিল।

-এই মেয়ে তোমার লজ্জা নেই?তোমাকে বলেছি না আমার স্ত্রী আছে।লজ্জা করেনা পর পুরুষের সাথে ঢলাঢলি করতে।কেন এসেছো এখানে?

মাইশা মাহিরের সামনে বসে কেঁদেই দিল।

-মাহির কেন এভাবে দূরে ঠেলে দিচ্ছো?আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি মাহির।আমাকে এই শেষবারের মতো ক্ষমা করে দেও।মাহির আমি জানি অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে।

মাইশা চোখ মুছে আবার বলতে শুরু করলো,

-এতোটা কেয়ারলেস কেন তুমি?কিভাবে মাথায় ব্যথা পেয়েছো?একটু ঠিক করে ড্রাইভ করতে পারোনা?তুমি জানো এই খবর শোনার পর আমার কি অবস্থা হয়েছিল।কতোটা ব্যথা পেয়েছো তুমি!
-মাইশা এর থেকে অনেক বেশি ব্যথা একদিন তুমি দিয়েছিলে।মাইশা এক্সিডেন্ট এর ব্যথা কিছুই না।সবচেয়ে বড় ব্যথা হলো বিশ্বাস ঘাতকতার ব্যথা, প্রতারণার ব্যথা যেগুলো তুমি আমাকে দিয়েছিলে।এখন এই সামান্য ব্যথাতে আমার কিছুই হবে না।এই সামান্য ব্যথার মারাত্মক উপশম আমার কাছে আছে।আমার প্রেয়সীর ওষ্ঠের উষ্ণ স্পর্শ।

প্রেয়সী কথাটা শুনে মাইশার চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো।

-মাহির আমি তো জানি আমি তোমার কাছে এলে তোমার সব কিছু ঠিক হয়ে যায়।আচ্ছা তোমার সেই বউ কোথায়?শুনলাম ঐ মেয়েটার জন্য না কি তোমার এই অবস্থা?
-নিজে আমার ঘর ভেঙে এখন আবার জিজ্ঞাসা করছো!
-মাহির আমি তো পরীক্ষা করছিলাম।আরে তুমি মানুষ চেনোনি।ঐ দুটাকার বার ড্যান্সার সে কি তোমার যোগ্য?তোমাকে অবিশ্বাস করে সে।তুমি না বলেছিলে তোমার বউ তোমাকে খুব বিশ্বাস করে।দেখলে তো নমুনা। এরা টাকা ছাড়া কিছু চেনেনা।
-মাইশা এত কিছু কেন করলে?আমি তো তোমার জীবনে বাধা হয়ে দাড়াই নি।কেন আমার সংসার টা ভাঙলে?
-মাহির আমি তোমাকে ভালোবাসি।আমিই তোমার স্ত্রী।আর ঐ মেয়েটা তোমার যোগ্য না মাহির।আর তুমি শুধু আমার।

ইলা এবার আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না।মাইশা কথা বলছে আর মাহিরের দিকে ঢলাঢলে পড়ছে।ইলার পুরো গায়ে আগুন ধরে যাচ্ছে। ইলা বেলকনি থেকে বেরিয়ে গিয়ে মাইশা র চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করালো।ঘটনা এতো দ্রুত ঘটলো মাহির ও চমকে গেল।

-আআআআ,,কে?
-দাদিমা ঠিক বলেছে তুই আসলেই ডাইনি।শয়তান মেয়ে কোথাকার।ইবলিসের খালাতো বোন।আমার বরের কাছে এসে বসে আছিস।

ইলা মাইশাকে ঘুরিয়ে গালে কষে থাপ্পড় দিল।ইলাকে দেখে অবাক হয়ে গেল মাইশা।

-তুমি এখানে কি করছো?আগের দিন তো তোমাকে সব বললাম আমি।
-হ্যাঁ বলেছিস তো।সব মিথ্যা বলেছিস।নির্লজ্জ চরিত্রহীন মেয়ে একটা।আর কি দু টাকার বার ড্যান্সার করছিস বার বার।পেটের দায়ে নাচ করেছি।টাকা দিয়ে সংসার চালিয়েছি।পর পুরুষের সাথে ঢলাঢলি করিনি।আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলিস তুই?তোর মতো জঘন্য মেয়ে না আমি।বিয়ের আগে বাচ্চা এবরশন করাস,এত ভালো একটা মানুষ কে স্বামী হিসেবে পেয়ে তাকে ঠকাস।আবার আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলিস তুই?আমি গরিব হতে পারি ,নাচ করে পেট চালাতে পারি কিন্তু তোর মতো লম্পট না।মানুষের দারে দারে ঘুরেছি চাকরির জন্য।একটা কাজের জন্য।উল্টা সবাই মেয়ে দেখে রাত কাটানোর অফার দেয়।উপায় না পেয়ে এই পেশা বেছে নেই।বুঝেছিস?আর তুই কি মনে করেছিস তোর জন্য এতো সহজে আমার স্বামীকে অবিশ্বাস করব আমি?
-ইলা তুমি ভুল করছো।আমি প্রেগন্যানসি রিপোর্ট ও দেখিয়েছি।মাহির সব ভুল বোঝাচ্ছে তোমাকে।
-রাখ তোর প্রেগন্যানসি রিপোর্ট।হয় তোর ঐ রিপোর্ট মিথ্যা না হয় কোন সো কলড বয়ফ্রেন্ড এর সাথে নোংরামির ফল তাই দেখ।তুই আমার সংসার ভাঙবি।এত সহজ?

ইলা মাইশা কে ধরে আরো কয়েকটা থাপ্পড় দিল।ইলা বেশি খেপে গেছে।মাইশা ও নিজেকে ছাড়াতে পারছে না।অগত্যা মাহির উঠে ইলাকে ছাড়লো মাইশার থেকে।

-ইলা ছাড়ো তো।এই মেয়েকে চেনোনা তুমি।উল্টা অন্য কিছু করে বসাবে।
-রাখুন আপনার অন্য কিছু।একে পুলিশে দেব আমি।শয়তান একটা।লজ্জা করেনা তোর।তোকে পারলে কেটে কুচিকুচি করে আমি দশটা বাঘকে খাওয়াতাম।তাও মনে হয় তারা আমাকে বদদোয়া দিত।তুই এতোটাই খারাপ তুই বদহজম হতিস ওদের পেটে।

মাইশা রাগে লাল হয়ে যাচ্ছে।

-তোকে আমি ছাড়ব না ইলা।

মাহির এবার নিজে গিয়ে মাইশার গালে থাপ্পড় বসালো।মাইশা গালে হাত দিয়ে হা করে তাকিয়ে আছে মাহিরের দিকে।

-মাহির!তুমি আমাকে মারলে!
-আরো কয়েক বছর আগে এই মারটা দিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া উচিত ছিল আমার।আমার স্ত্রীর দিকে আর চোখ তুলে তাকাও শুধু তোমাকে তোমার পুরো পরিবার কে জেলের ভাত খাইয়ে পথে বসিয়ে ছাড়ব আমি।তোমার সব কুকর্মের প্রমাণ আমার কাছে আছে।বেশি বাড়াবাড়ি করতে আসবে না।এরপর আর কখনো আমার জীবনের যদি তুমি নাক গলাতে আসো না মাইশা তোমার নাক কতো ইঞ্চি লম্বা সেটা কেটে মাপ দিয়ে দেখাব তোমাকে।মাহির আশহাব এখন আর সেই আগের মাহির আশহাব নেই।এখন আমি আমার ইলার জন্য যে কোন সীমা অতিক্রম করতে পারি।তোমাকে মেরে ফেলতেও হাত কাপবে না আমার।আর শুনেছি তোমার বাবা নাকি তোমাকে ত্যাজ্য করতে চেয়েছেন।তুমি এতক্ষণ এখানে যা করেছো সব কিছু রেকর্ড করেছি আমি।এটা তোমার বাবার কাছে পাঠিয়ে দিলেই দেখবে কি হাল হয় তোমার।আফসোস তোমার মা বাবার জন্য।তোমার জন্য ওনাদের মান সম্মান কিছুই থাকলো না।একমাত্র মেয়ে হয়ে তুমি কখনো তাদের জন্য কিছুই করলেনা।
-মাহির তো বললোই।আমার কথাও শুনে রাখো মাইশা।এখনো সময় আছে ভালো হও।আরো আগে যদি নিজেকে শোধরাতে আজ মাহিরের পাশে আমি না সেই তুমি থাকতে।নিজের দোষে অনেক কিছু হারিয়েছো তুমি।সময় আছে ভালো হও।পরের ঘরে আগুন লাগাতে এসো না নিজেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।

মাইশা আর কিছু বললো না।মাহির আর ইলার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে চলে গেল।মাইশা যেতেই মাহির শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইলাকে।

-আসলেই ইলা তুমি একপিস। তুমি লাখে একটা।এতো দুষ্টু কি করে হও তুমি?
-ও আপনাকে মারব এখন।ছাড়ুন বলছি।
– আমি কি করেছি?
– আহা।মাইশাকে পেয়ে নিজেও কম ঢলাঢলি করেননি। লুচ্চু কোথাকার।আপনার খবর আছে আজ।
-ছিহ! কি বলো কি তুমি?আমি তোমার দিকে ছাড়া আর কারোর দিকে তাকাইনা।
-তাকালে চোখ তুলে আমি গুলি খেলব বলে দিলাম।

১১৯

সময় অতি দ্রুত চলে যায়।সময় নামক ঘড়িটা কখনো এক মুহূর্তের জন্য থামেনা।

আড়াই মাস কেটে গেছে।

আলফাজ সাহেবের পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া।জীবনে এই প্রথম তিনি নিজেও ভেঙে পড়েছেন।এক সপ্তাহ হলো আদিবা বেগম দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন।

মাহির খুব ভেঙে পড়েছিল।ইলাও।সেদিনের ঘটনার পর থেকে আদিবা বেগমের মুখের ওপর আর কথা বলতে পারেননি আলফাজ সাহেব।ইলাকে ও বাড়িতে থাকার অনুমতি দিতে বাধ্য হন।বেশ ভালোই কাটছিল ইলা-মাহিরের সংসার জীবন।আদিবা বেগমের সাথে বেশ খাতির জমেছিল ইলার।মাহিরের পর আদিবা বেগম সবচেয়ে কাছের হয়ে গেছিলেন ইলার জন্য।ওনার মৃত্যু ইলার কাছে একটা বড় শক ছিল।

কিন্তু শোকের মাঝেও অন্য একটা খুশির হাওয়া বয়ে এলো ইলা-মাহিরের জীবনে।নামকরা বিজনেসম্যান আলফাজ সাহেবের মা মারা গেছেন।পুরো শহর জুড়ে খবরটা ছড়িয়ে পরে।ইসমাত বেগম সেদিন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি। আদিবা বেগমের থেকে তিনি মায়ের ভালোবাসা পেয়েছেন তাকে শেষবারের মতো দেখতে তিনিও ছুটে যান বহু বছর পর তার চেনা ঠিকানায়।

সেদিন আদিবা বেগমের মুখ কাউকে দেখতে দেওয়া হয়নি তার নিজের কাছের আত্নীয় স্বজন ছাড়া।মুখ দেখার জন্য হলেও ইসমাত বেগম নিজের পরিচয় দিতে বাধ্য হন।দাদির খাটিয়ার পাশে বসা ছিল মাহির।এক মূহুর্তের জন্যও সে সরেনি সেখান থেকে।সেদিন ইসমাত বেগম মাহিরকে না চিনলে ও শত কষ্টের মাঝেও ভেজা চোখে নিজের মাকে ঠিক চিনেছিল মাহির।নিয়তির অদ্ভুত খেলা।শোকের ছায়ার মধ্যে মাহির এতো বছর পর তার মায়ের দেখা পেল।আলফাজ সাহেবের জন্য আদিবা বেগমকে শেষবারের মতো এক পলক দেখেই সেখান থেকে বিদায় নেন ইসমাত বেগম।নয়তো এর কম দিনে আলফাজ সাহেব তাকে দেখলে অপমান করতেও দ্বিধা বোধ করতেন না।ইসমাত বেগম মাহিরকে ও এক পলক দেখার জন্য এদিক ওদিক ঘুরেছিলেন।কিন্তু এতো মানুষের ভীড়ে সেটা তিনি পারেননি।এমনকি মাহিরের সামনে থেকেই যে তিনি আদিবা বেগমকে দেখে এসেছেন নিজেও জানেননা।

এই নিয়ে কয়েকবার কলিংবেলের আওয়াজ।ইসমাত বেগম ঘড়ির দিকে তাকালেন।আটটা বাজে।

-এতো রাতে কে আসলো?নিবিড় তো অফিস থেকে ফিরেছে।এখন এখানে কে আসবে?

ইসমাত বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে সদর দরজা খুললেন।

-জি বলুন।

দরজার ওপাশে একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।পাশে বোরখা পরিহিত একটা মেয়ে।অন্ধকারে ঠিক মতো চিনতে পারলেন না ইসমাত বেগম।

-ভেতরে আসতে দেবেন না?
-আপনারা?
-আমি ইলা।ইনি আমার স্বামী।আপনার সাথে একটা দরকার ছিল।
-ওহ।কিন্তু আমি তো চিনলাম না আপনাদের?
-ভেতরে চলুন।সব বলি।
-জি আসুন।

ইসমাত বেগম মাহির ইলাকে ভেতরে বসতে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন। ইলা সোফায় বসে নিকাবটা খুলে ফেললো।ইসমাত বেগম ইলার দিকে এগিয়ে আসতেই মাহির এগিয়ে গিয়ে ইসমাত বেগমের সামনে দাড়ালো।ইসমাত বেগম মাহির কে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলেন।মাহির ইসমাত বেগমের সামনে দাড়িয়ে আছে।তার ভেজা চোখ দুটো ইসমাত বেগমের চোখ এড়ালো না।তিনি বুঝতেই পারছেন না ছেলেটা কেন কাঁদছে।সে একনজরে ইসমাত বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে।ইসমাত বেগম খেয়াল করলেন দরজার বাইরেও মাহির একনজরে ইসমাত বেগমকে দেখছিল।এখনো।বেশ অস্বস্তি বোধ হচ্ছে তার।মাহিরের মুখের দিকে বার বার তাকিয়ে দেখছেন তিনি।নিজের মুখের সাথে অনেক মিল পাচ্ছেন।ইসমাত বেগমের অস্বস্তি আরো বাড়তে লাগলো।

এক পর্যায়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেই ফেললেন,

-কে তুমি বাবা?
-দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা?

মাহিরের এমন জবাব শুনে ইসমাত বেগমের বুকটা ধক করে উঠলো।তার বার বার মনে হচ্ছে সে তার খুব কাছের কেউ।চেহারায় নিজের মুখের ছাপ ও খুঁজে পাচ্ছেন তিনি।ইসমাত বেগমের চোখটা হঠাৎ করেই ঝাপসা হয়ে এলো।

কাঁপা কাঁপা কন্ঠে তিনি বললেন,

-সত্যি করে বলো বাবা কে তুমি?
-মাহির।মাহির আশহাব।আমার দাদিমা আদিবা বেগমের প্রিন্স।

চলবে————

#রৌদ্র_কুয়াশা
Suvhan Årag(ছদ্মনাম)
পর্ব ৪৬

মাহিরের কথা শুনে বুক ধক করে উঠলো ইসমাত বেগমের।চোখ থেকে ঝরণার ধারা প্রবাহিত হতে লাগলো।ইসমাত বেগম কাপা কাপা হাতে মাহিরের দুই বাহু ধরলেন।গায়ে হাত বুলালেন।মুখে হাত দিতে গেলে মাহির মাথা নিচু করলো।ইসমাত বেগম মাহিরের মুখে হাত বুলাচ্ছেন।কত বছর নিজের সন্তানকে তিনি দেখছেন।আজ তার অনুভূতি টা তিনিই ব্যখা করতে পারবেন না।

কাঁপা কাঁপা কন্ঠে তিনি বললেন,

-আমমার মাহির!সত্যি বলছো তুমি।
-কেন মা?একটু ও কি কাছের বলে মনে হয়না?

ইসমাত বেগম মাহিরকে জড়িয়ে ধরলেন।মাহির ও পরম যত্নে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।দুজনের চোখেই আজ খুশির ঝর্ণা।সোফায় বসে ইলাও কেঁদে ফেলেছে মা-ছেলের এই দৃশ্য দেখে।

-আমার মাহির।কত বড় হয়ে গেছিস তুই।আমি অভাগী মা তোকে চিনতেও পারলাম না।এতটাই অভাগী আমি।
-মা তুমি কেদোনা।তুমি জানো সেই কবে থেকে খুঁজেছি তোমাকে?তুমি কেন আমাকে ফেলে চলে গেছিলে?কেন তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাওনি?

ইসমাত বেগম মাহিরকে ছেড়ে মাহিরের গালে মুখে অজস্র চুমু খেলেন।

-আল্লাহর কাছে শুকরিয়ার শেষ নেই।কত অপেক্ষা করেছি কত কেদেছি তার দরবারে।একবার তোকে চোখের দেখা দেখব বলে।আমাকে ক্ষমা করে দে বাবা।সমাজ বড় নিষ্ঠুর।তুমি মা হয়ে জন্ম দেবে,প্রসব ব্যথা ভোগ করবে,নয় মাস গর্ভধারণ করবে অথচ সন্তান বড় হলে বাবার অধিকার খাটিয়ে তুমি মা হয়ে হারাবে সন্তানের অধিকার।বাবা আমি নিরুপায় ছিলাম।না আইন না সমাজ কেউ সেদিন আমার কথা শুনেনি।না শুনতো।না তারা দেখেছে আমার কষ্ট টা।আজ ও প্রতিটা রাতে তোর জন্য কাদি আমি।তোকে দেখার জন্য ছটফট করতে থাকি।দেখ নিয়তি আজ কোথায় দাঁড় করিয়েছে আমাকে নিজের ছেলে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অথচ তাকে চিনতেও পারলাম না।আমি মা হয়েও হতে পারিনি মা।তোকে মায়ের ভালোবাসাটাও দিতে পারিনি।

ইসমাত বেগমের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিল মাহির।

-মা আমি জানি সেদিন ও তুমি নির্দোষ ছিলে,নিরুপায় ছিলে।আজ ও।আর আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেব না।এবার ঐ আলফাজ সাহেব ও কিছু করতে পারবে না।আমার মাকে আমি নিয়ে যাব।

মাহির আবার ইসমাত বেগমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন।

হঠাৎ করেই কেউ এসে মাহিরকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ইসমাত বেগমের থেকে।এতোটাই জোরে যে মাহির ছিটকে গিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো।ঘটনাটা এতোই দ্রুত ঘটলো ইসমাত বেগম ও অবাক হয়ে গেলেন।নিবিড় ইসমাত বেগমকে জড়িয়ে ধরলো।

-আম্মাজান এই ছেলের সাহস হয় কি করে আমার আম্মাজান কে জড়িয়ে ধরে?আম্মাজান আপনি একে কিছু বলেননি?এতো বড় সাহস।

ইসমাত বেগম নিবিড়কে সরিয়ে দিয়ে মাহিরের কাছে ছুটে গেলেন।ইলা আর তিনি মিলে মাহিরকে উঠিয়ে সোফায় বসালো।টি টেবিলের কোনায় লেগে মাহিরের কপালের পাশে কেটেই গেছে।

-মাহির।লাগেনি তো বাবা?আমি এক্ষুণি ওষুধ আনছি।

ইসমাত বেগম ঘরের দিকে পা বাড়ানোর আগেই নিবিড় পথ আটকে দাড়ালো।

-কোথায় যাচ্ছেন আম্মাজান?ঐ লোকটার জন্য আপনি কেন ওষুধ আনবেন?কোথাও যাবেন না আপনি।আপনি বসুন আমি ওদের কে এক্ষুণি বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছি।
-চুপ কর নিবিড়।কি ঐ ছেলে ঐ ছেলে করছো?ও আমার ছেলে।আমার নিজের সন্তান মাহির।তোমার বড় ভাই।বুঝেছো।সরো এখান থেকে।
-না।কেউ না ও।আপনি শুধু আমার আম্মাজান।আমার একার।কেউ না ও।ওকে মেরেই ফেলব আমি।আমার আম্মাজানের ওপর ভাগ বসাতে এসেছে।

নিবিড় ইসমাত বেগমকে ছেড়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর থেকে ফল কাটা ছুড়ি হাতে নিয়ে তেড়ে গেল মাহিরের দিকে।

-আমার আম্মাজান কে জড়িয়ে ধরা।তোকে মেরেই ফেলব,,,,,।

নিবিড়ের পথ আটকে দাড়িয়ে ইসমাত বেগম নিবিড়ের হাত থেকে ছুরিটা ফেলে দিয়ে নিবিড়ের গালে কষে থাপ্পড় মারলেন।

-আর একটা কথাও বলবে না তুমি।আমার মাহিরের দিকে এক পা এগুলে তোমার খবর আছে নিবিড়।পাগলামির সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো তুমি। যাও নিজের ঘরে যাও।আমার সামনে আসবে না তুমি।যাও বলছি।যাও এখান থেকে।তোমার আম্মাজানের আদেশ। যাও বলছি।

নিবিড়ের চোখ ছলছল করে উঠলো,সাথে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠলো ভেতরে।মাহিরের জন্য ইসমাত বেগম তার গায়ে হাত তুললেন মেনে নিতে পারছেনা সে।এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল সে।ইসমাত বেগম নিজের ঘরে গেলেন।স্যাভলন তুলো এনে নিজের হাতে মাহিরের ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে দিলেন।

-খুব ব্যথা করছে না তোর?
-মা।ঐ ছেলেটা কে?আপনাকে মা বলছিল কেন?আপনি কি আবার বিয়ে,,,,,।
-না না।কি বলছিস তুই?ও আমার নিজের সন্তান নয় মাহির।
-তাহলে।
-সব বলছি তোকে।

ইসমাত বেগম তার আর নিবিড়ের সম্পর্কের সবকিছু খুলে বললেন মাহির কে।

-ও তো অসুস্থ মানুষ মা।
-জানি।কি করব বল?ওকে ফেলতে পারব না আমি।জন্ম থেকে ওকে নিজের ছেলে হিসেবেই মানুষ করেছি।কিন্তু পাগলটা সব সময় পাগলামি করে।
-তুমি ওকে কেন ফেলবে মা?আমি তো বলছিনা তুমি ওকে ফেলো।কিন্ত তোমাকে আর এখানে রাখব না আমি।আর না।তুমি আমার সাথে থাকবে।

ইসমাত বেগমের চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।

-আমি ও তোকে আর হারাতে চাইনা সোনা।
কিন্তু নিবিড়?

এর মধ্যে ইলা বলে বসলো,

-আপনিই তো ওনাকে বললেন মাহির ওর বড় ভাই।তাহলে মাহির মাকে নিয়ে যাবে ছোট ভাইকে রাখবে না সেটা তো হয়না।

ইলার কথা শুনে মাহির মুচকি হেসে ইসমাত বেগমকে ইলা আর তার মাঝে বসালেন।

-মা।ও ইলা।তোমার পুত্র বধু।

ইলা ইসমাত বেগম কে সালাম করতে গেলেই আটকে দিলেন তিনি।

-মাশাল্লাহ।কি অভাগী আমি।আমার ছেলের বিয়েটাও নিজে সামনে দাড়িয়ে দিতে পারলাম না।
-আরে মা কি হয়েছে তাতে?এখন তো দেখছেন আপনি।আমার আর মাহিরের জন্য দোয়া করবেন তাতেই হবে।
-মাহিরের জন্য তো সব সময় দোয়া করি।আজ থেকে না হয় তুমিও তাতে যোগ হবে।

ইলার কপালে চুম্বন করলেন ইসমাত বেগম।ইলা মাহির দুজনকে এক সাথে জড়িয়ে ধরে কাদলেন তিনি।আজ অনেক বড় কিছু পেয়েছেন তিনি।তার খুশি আজ আর দেখে কে।

-তোরা বস।আমি খাবার আনছি।
-না মা।তুমি কষ্ট করতে যেও না।তার চেয়ে আমার পাশে বসো।তাতেই হবে।
-হবে না।এতদিন পর আমার ছেলেকে পেলাম ছেলে বউকে পেলাম খালি মুখে রাখব না আমি।যা রেধেছি তাই খাবি।

একটু পর রান্নাঘর থেকে প্লেটে করে ভাত তরকারি নিয়ে আসলেন ইসমাত বেগম।রুই মাছ ভুনা, ডাল দিয়ে ভাত মেখে দুজনকে খাইয়ে দিলেন তিনি।

-মা তুমি যাবে না?নিবিড়কেও নিয়ে যাব আমি।সে যদি তোমার ছেলে হতে পারে আমারো ভাই।ওই তো এত বছর ধরে তোমাকে দেখেছে।আমি ছেলে হয়েও সেটা পারিনি।
-মাহির।নিবিড়ের কথা তো তোকে বললাম।ও বড্ড জেদী।রাগ করে বসে আছে।ওকে ঠিক করতে হবে।তোরা আজকের মতো বাড়ি যা বাবা।তোদের আজ রাখতে পারব না এখানে।না জানি কি শুরু করবে আবার।
-তোমার ক্ষতি করবে না তো?
-মাহির ও পাগলামি করুক যাই করুম ওর কাছে পুরো দুনিয়া এক দিকে আর আমি অন্য দিকে।ওকে যেদিন বলেছিলাম আমি ওর নিজের মা না।সেদিন ওর কি অবস্থা হয়েছিল আমি জানি।এরপর থেকে আজ অবধি ঐ কথা কখনো বলিনা ওকে।তোরা যা।কাল না হয় আসিস।কাল যাব তোদের সাথে ওকে নিয়ে।
-তোমাকে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না মা।এত বছর পর তোমাকে পেয়েছি।
-আমার ও মন চাইছে না তোকে যেতে দিতে।কি করব বল?আমি নিরুপায়।

মাহির আবার ইসমাত বেগমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই দিল।

– মাহির কাল এসে মাকে নিয়ে যাব।বুঝছি আপনার কষ্ট হচ্ছে।একটা দিন তো।মায়ের আরেক ছেলেকেও তো দেখতে হবে মার।
-হুম।আচ্ছা মা।কাল কিন্তু তৈরী থাকবে।তোমাদের দুজনকেই নিয়ে যাব।
-আচ্ছা।

ইসমাত বেগমের মন চাইছে না মাহিরকে ছাড়তে।তবুও বাধ্য হয়ে তিনি বিদায় দিলেন মাহির আর ইলাকে।

১২০

-অনু।

আরিয়ানের কন্ঠ শুনে উঠে বসলো অনু।পরীক্ষা শেষ হয়েছে তার ।বাড়ি এসেই জব্বর ঘুম দিয়েছে সে।

-অনু।আপনি কি উঠেছেন?
-আসছি।

অনু বিছানা ছেড়ে উঠলো সাবধানে ।পাশে তুলির ছোট্ট বাবু ঘুমিয়ে আছে।অনু মাথার কাপড় ঠিক করে গিয়ে দরজা খুললো।

-আসুন আরিয়ান সাহেব।
-ঘুম ভেঙেছে আপনার ?
-জি।
-হাত মুখ ধুয়ে আসুন।
-না আপনি বলুন কি জন্য ডাকলেন।
-আরে।আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন।আমি বসার ঘরে বসে আছি। আপনি আসুন।
-আচ্ছা।

ফ্রেশ হয়ে অনু বসার ঘরে গেল।আরিয়ান আর তুলি বসে কফি খাচ্ছে।অনুর জন্য ও টেবিলে একটা কাপ রাখা রয়েছে।অনু ও তুলির পাশে গিয়ে বসলো।কফির কাপ হাতে নিল।

-অনু।
-জি।
-আপনাকে আড়াই মাস আগে একটা কথা বলেছিলাম।মনে আছে?

আরিয়ানের কথা শুনে অনুর কপালে চিন্তার ভাজ।তার বুঝতে বাকি নেই কি কথা বোঝাচ্ছে আরিয়ান।

-কি হলো?
-আপনি বলেছিলেন আমার পরীক্ষা শেষ হলে আপনি আমার কাছে বড় কিছু একটা চাইবেন।আপনি আমাকে এত সাহায্য করলেন তার জন্য।
-হুম।ঠিক বলেছেন।অনু আপনি কি প্রস্তুত আছেন সেটা দিতে?

অনু ভয়ে ঢোক গিলে আরিয়ানের দিকে তাকালো।আরিয়ান কি চাইবে তার কাছে সেটাই বুঝে পারছেনা সে।

-কি হলো?
-জি আছি।আমি আপনাকে ওয়াদা করেছিলাম আরিয়ান সাহেব।আপনি যা বলবেন সেটাই করব আমি।
-তাহলে আপনি রাজি?
-কিন্তু কি জিনিস বললেন নাতো?না বললে কিভাবে দেব?
-হুম।বলব।কিন্তু আজ না।আগামীকাল।কাল সন্ধ্যার পর আপনাকে সব বলব।মানসিক প্রস্তুতি বলে একটা ব্যাপার আছে।এজন্য এক দিন সময় দিলাম।
-আচ্ছা।
-আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন?ভয় পাওয়ার মতো কিছু করব না।আর যেন কখনো ভয় না পেতে হয় সেই কাজ করব।

আরিয়ানের কথা শুনে অনু আরেক দফা চমকে গেল।

-যান।কাল বলব।আর উওর তো হ্যা হতেই হবে।না হলে ধরে বেধে হ্যা করাব।
-আপনার ধরে বেঁধে কিছু করতে হবে না আরিয়ান সাহেব।আপনি যা করেছেন আমার জন্য তার জন্য আপনি যা চাইবেন সেটাই শুনব।
-অনু কখনো নীল বেনারসি পড়েছেন?

আরিয়ানের প্রশ্ন শুনে আরো চমকে গেল অনু।বড্ড অদ্ভুত প্রশ্ন করে আরিয়ান।এমন ধরনের প্রশ্নের শিকার সে অনেকবার করেছে অনুকে।

-কি হলো?বলুন?
-না।নিবিড়ের সাথে বিয়ের সময় লাল বেনারসি পড়েছিলাম। আর কখনো বেনারসি পড়িনি।
-পড়লে বেশ ভালো লাগবে আপনাকে।আর বউ সাজলে আরো ভালো লাগবে।

আরিয়ানের কথা শুনে অনু আরো অবাক হচ্ছে।অনু আরিয়ানের দিকে তাকাতেই সে মুচকি হাসি দিল।

-এমনি বললাম।আচ্ছা গুড নাইট।ঘুম পাচ্ছে আমার।
-আচ্ছা।

অনু উঠে ঘরের দিকে চলে গেল।আরিয়ান উঠতে গেলে তুলি আরিয়ানের হাত ধরে বসে।

-তোর আবার কি হলো?
-এতদিনে ভাবি ডাকার লোক পাব।যদিও জুনিয়র।
-এতো উতোলা হসনা।
-মানে?
-অতি এক্সাইটমেন্ট ভালো না।

আরিয়ান রহস্যময় হাসি দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।তুলি নিজের জায়গায় বসে আছে।আরিয়ানের কথার কিছু সে বুঝতে পারলো না।

১২১

সকাল দশটা বাজে।মাহির ইলাকে নিয়ে আজ ইলার মায়ের কাছে এসেছে।উদ্দেশ্য একটাই।মিলা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে।মিলা আবার হাঁটতে পারছে শুনে ইলা আর নিজেকে আটকাতে পারেনি।বোন কে দেখার জন্য ছুটে এসেছে।কিন্তু এসে তারা দুজনে এতো খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে তারা কল্পনা ও করতে পারেনি।

-কি দেখতে এসেছিস তুই?বেশ্যা মেয়ে একটা ।বাড়িটাকে অপবিত্র করে দিলি।টাকা দিয়েছিস বলে এটা ভাবিস না যে তোকে বাহবা দেব।আমার সংসার ভেঙেছিস তুই।এটা তোর পাপের প্রায়শ্চিত্ত বলব।পরের সংসার ভেঙে ভালো থাকবি তুই?কখনো না।আছিস ই তো অন্যের রক্ষিতা হয়ে।

ইলা মাথা নিচু করে বসে আছে।চোখের পানি ফেলছে।মাহির ও চুপ করে আছে।শায়লা বেগম নিজেও চুপ হয়ে আছেন। এই তো কদিন আগে মার্কেটে তার দেখা হয় মজিদ বুড়োর সাথে।বুড়ো সেদিন পায়ে ধরে ক্ষমা চান তার কাছে।ইলা নির্দোষ সেটাও বলেন।কিন্ত মিলা সে তো সেটা গায়ে মাখেনা।মিলা তো অশ্রাব্য ভাষায় যা নয় তাই বলছে ইলাকে।এমনকি ইলার কারণে ঘর অপবিত্র হয়ে যাবে বলে আলিশাকে ঘরে আটকে রেখেছে সে।ইলার সংস্পর্শে এসে সে না ইলার মতো দুশ্চরিত্রা হয়।

-তোকে তো নিজের বোন বলতে লজ্জা করে আমার।ছিহ ।

ইলা আর নিজেকে আটকাতে পারলো না।বসা থেকে উঠে গিয়ে কষে থাপ্পড় বসিয়ে দিল মিলার গালে।মিলা মুখে হাত দিয়ে ক্রোধ নিয়ে তাকিয়ে আছে ইলার দিকে।

-এই থাপ্পড় টা আগে তোকে মারা উচিত ছিল।মা বাবা কখনো সেই কাজটা করেনি।বড় মেয়ে প্রথম সন্তান।এসব বলে বলে সব সময় ছাড় দিয়েছে তোকে।তাই আজ এই অবস্থা তোর।আর কি বললি আমি তোর সংসার ভেঙেছি?তোর সংসার তুই নিজে ভেঙেছিস।
নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড এর প্রেমিক কে নিজের প্রেমে ফাসিয়ে বিয়ে করলি।ঐ মেয়েটার চোখের পানির জন্য তোর এই অবস্থা আজ।সবাই না জানলেও আমি জানি এই কথা।এতোটা স্বার্থপর তুই।আর কি বললি বেশ্যা?

ইলা আরো জোরে চড় মারলো মিলার গালে।

-ভদ্র ভাবে কথা বলবি।বড় বোন বলে তোকে অনেক সম্মান দিয়েছি আমি।তোর জন্য অনেকবার মিথ্যাবাদী হয়েছি।সব সময় নিজে দোষ করতি পরে সব দোষ আমার ঘাড়ে দিয়ে আমাকে খারাপ বানিয়েছিস।আমার ভালো হবে না?শকুনের দোয়ায় গরু মরেনা শুনে রাখ।আমি কখনো জানা মতে কারোর ক্ষতি করিনি।আর তোরা বললেই আমি খারাপ থাকব।মা তাই আমাকে এই অভিশাপ দিয়েছিল।নিজের সন্তানকে।মা হয়েছে বলেই কি অভিশাপ লাগবে আমার।আল্লাহ সব দেখেন।আমি কারোর ক্ষতি করিনি।দেখ আলহামদুলিল্লাহ আজ আমি অনেক সুখে আছি ভালো আছি।তুই তো একটা অকৃতজ্ঞ ।তোর জন্য আজ অবধি কি না করেছি আমি।তোর বাচ্চাটাকেও মানুষ করেছি।আরে আমার বাবার যা জমানো টাকা ছিল তা দিয়ে আমার আর মায়ের দিব্যি চলে যেত খেয়ে পড়ে।তোর চিকিৎসার জন্য বারে নেচে টাকা আয় করেছি ।আজ তুই বলছিস আমি বেশ্যা?তোর মতো অকৃতজ্ঞ বোন যেন আল্লাহ কাউকে না দেয়।

ইলা শায়লা বেগমের সামনে গিয়ে দাড়ালো।

-আমার কি দোষ আছে মা বলতে পারো?এতকিছু করেও আজ অবধি তোমাদের মন পেলাম না।আমার স্বামী এত কিছু করল তবুও কখনো তাকেও সম্মান দেওনি।সব সময় সন্তান হয়েও এক পাক্ষিক বিচার পেয়েছি তোমার থেকে।আজ ও আপু তোমার সামনে এতগুলো বাজে কথা বললো কিছু বললে না তুমি!আমি অপবিত্র!বাহ মা।

ইলা চোখ মুছে ফেললো।মাহিরকে ইশারা করলো উঠতে।

-আজ অনেক খুশি হয়ে এসেছিলাম আমি।আমার বোন সুস্থ হয়ে গেছে।কতদিন পর আপুকে হাঁটতে দেখব।ওকে জড়িয়ে ধরব।আর কি ব্যবহার পেলাম!তোর মতো অধম মানুষ আমি আজ অবধি দেখিনি।এরপর থেকে আমি যা করব শুধু আমার মায়ের জন্য আর আলিশার জন্য করব।আলিশাকে তুই জন্ম দিয়ে মা হতে পারিস আমি ওকে এই অবধি বড় করেছি। তোর জন্য আমি আমার সোনাকে কোন কষ্ট পেতে দেব না।আর মায়ের ওপর অভিযোগ নেই।মায়েরা যে কষ্ট করে জন্ম দেয় তার ঋণ জীবন দিয়েও শোধ করতে পারব না।তবে হ্যাঁ।এটাই শেষ।আর কোন দিন আসব না তোদের সামনে।আল্লাহ্ যেন কখনো তোদের সামনে না নিয়ে আসেন আমাকে।

ইলা বেরিয়ে গেল। মাহির ও পিছু পিছু গেল।ইলা ততক্ষণে গাড়িতে বসে গেছে।

-ইলা তুমি,,,।
-মাহির।এখন আর কষ্ট লাগেনা।অভ্যস্ত হয়ে গেছি।আর কখনো আনবেন না এখানে আমাকে।আল্লাহ আছেন।আর দুনিয়াতে কেউ থাকলে আপনি থাকবেন।আমার কিছু লাগবে না।

ইলা চোখ মুছে মাহিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল।

চলবে——–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here