রয়েছ_হৃদয়ে #দ্বিতীয়_পার্ট

0
932

#রয়েছ_হৃদয়ে
#দ্বিতীয়_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
আমি কলেজ যাই, হোস্টেলে ফিরি। রোহানের সাথে কতটা সময় কেটে যায়, টের পাই না। ওর সাথে আমার সম্পর্কটা ঠিক কেমন তা নিয়েও ভাবি না। ভাবতে হয়নি বলেই ভাবিনি। দিন যায়, দিন আসে; সম্পর্কের বাঁধন শক্তপোক্ত গাঢ় হয়। তবে তা বুঝি না।

আজীবন ঘরকুনো, বন্ধু-বিমুখ এই আমার বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব হয়ে গেল ক্যাম্পাসে। এর শুরুটা অবশ্যই রোহান করেছে।
কিন্তু সবাইকে আমি রোহানের সাথে মিলাতে পারি না। ওর মতন অমন পাগল আর কে হবে? ও একটু আলাদা; একরোখা, অগোছালো এবং নিজেকে নিয়ে মারাক্তক উদাসিন!
আমি বলি, “নিজের প্রতি একটু সচেতন হও রোহান। নিজেকে নিয়ে নিজের ফিউচার নিয়ে সিরিয়াস থাকা ছেলে-মেয়েরা লাইফে অনেক সাকসেস পায়। তুমি জাস্ট একটু সিরিয়সনেস আনো নিজের প্রতি। প্লিজ, বি ম্যাচিউর।”
রোহান কিছুক্ষণ আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে যেন আমার ভেতর থেকে ‘বিশ্ব জয়’ করা টাইপ কিছু আবিষ্কার করে ফেলবে এক্ষুনি! আমি বিরক্ত হয়ে বলি,
“কী? কী দেখ?”
রোহান খুব সিরিয়াস, বিজ্ঞ টাইপ ভাব করে বলে,
“ইশশ…জুছি? তুমি এত দ্রুত বুড়ি হয়ে গেলা! হায় আল্লাহ্‌! এখন আমার কী হবে? মেয়েটা এমন বুড়িদের মতো কথা কেন বলে আল্লাহ্‌!”
বলেই কিটকিট করে হাসে।
প্রায় প্রত্যেকবার এমন করে। যতবার ভালো একটা কথা বলি ততবার সে হেসে-টেসে একেবারে উড়িয়ে দিবে, আমাকে বুড়ি বানিয়ে দিবে! আমার মুখ চুপসে যায়, করুন মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। এছাড়া আমার আর কিছুই করার নাই।
তার মতে, “জীবনকে নিয়ে খুব বেশি সিরিয়াস হতে হয় না। জীবন হচ্ছে ‘মোহমায়ায় আকৃষ্ট হয়ে থাকা পুষ্পের সুমিষ্ট ঘ্রান!’ যতক্ষণ এই পুষ্পের ঘ্রান থাকবে, ঠিক ততক্ষণ সেই ঘ্রান প্রাণ ভরে গ্রহন করতে হবে। প্রয়োজনে পুষ্প পল্লবের আশেপাশে লেগে থাকা মায়াগুলোতে ডুবে মরে যেতে হবে! তবুও জীবন নিয়ে আহামরি সিরিয়াস হয়ে জীবনকে বিস্বাদ, জটিল করে ফেলা যাবে না।”
ও যখন থেমে থেমে এই সুন্দর কথাগুলে বলে, আমি মোহিত হই, মুগ্ধ হই, একটুখানি ভালোবেসে ফেলি। এরপর? এরপর আর কিচ্ছু বলতেই পারি না। হার মেনে নেই ওর কাছে। ওরে বুঝানোর সাধ্য যে আমার কোনো কালেই ছিল না। নিজের খামখেয়ালি পনায় আবিষ্ট হয়ে থাকা ছেলেটাকে কে বুঝাতে পারে? কেউ না, কেউ-ই না।

শুধু নিজের ডিপার্টমেন্ট না, পুরো ক্যাম্পাস শুদ্ধ সবার সাথে তার মারাত্মক ভাব। আমি কোনোমতেই ভেবে পাই না, একটা মানুষ ঠিক কতটা মিশুক স্বভাবের হলে এত ইজিলি যেকোনো মানুষকে কাবু করে ফেলতে পারে?

যাদের যাদের ও অপছন্দ করত তাদের একটা করে বিদঘুটে নামকরণ করত। বিশেষ করে নিজের ডিপার্টমেন্ট এর লেকচারার দের প্রতি তার তমুল বিদ্বেষ। কারণ তাকে বেশ কয়েকবার বদমাইশির জন্য ক্লাস থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, বকাঝকা করেছে বহুবার।
ইশশ…তখন মুখখানা যা করে না! মোটামুটি পুরো ক্যাম্পাসের ক্রেজ…আর সে কিনা এমন মুখো…হা হা! আমার এত মজা লাগে! সারাক্ষণ আমায় কথার মারপ্যাঁচে ফেলে। কিন্তু এই বেলায় তেমন কিছু করতে পারে না।
ওর ফ্রেন্ড গুলো যখন টিটকারি মারে তখন রেগেমেগে কিল ঘুষি মারে তাদের। হুমকিধামকি দিয়ে বলে, এক মাঘে শীত যায় না। আমারও সময় আসবে, হুহ!

ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আমি লাইব্রেরীতে এসে পড়ি। আমার যখন ক্লাস থাকত না, রোহানের ক্লাস থাকলেও ও ক্লাস করত না। আমি বলতাম,
“ক্লাস কেন ফাঁকি দাও রোহান?”
রোহান হাই তুলতে তুলতে বলত, “এগুলো আমার দুই মিনিটের পড়া। জাস্ট পরিক্ষার আগের রাতে পড়ব, খেল খতম…হাহ-হাহ!”
বলেই উদ্ভট হাসতো।
আমি বিতৃষ্ণা নিয়ে বলতাম,
“ভালো স্টুডেন্টরা কখনো ক্লাস ফাঁকি দেয় না।”
রোহান ফাও যুক্তি দিয়ে বুঝাতো,
“নো, নেভার…ইউ আর অ্যাবসোলুটলি রং জুছি! ভালো স্টুডেন্টদের কখনোই সারাদিন নাকেমুখে বই গুঁজে বসে থাকতে হয় না। ইশশ…ইউর বেড লাক, আমার মতো ব্রিলিয়েন্ট হতে পারলা না, তাইতো এমন বই গুলিয়ে খেয়ে ফেলো! আহারে!”
আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালে বলত,
“তোমাকে বলি নাই, ট্রাস্টি মি। ইয়ে মানে ভুলে বলে ফেলেছি!”
একটু থেমে বলতো, “আচ্ছা আমায় একটু এই পড়াটা বুঝি দাও তো?”
কী জ্বালা…কেমন ফাজিল! ওর অন্য ডিপার্টমেন্ট এর পড়া আমি বুঝাবো কী করে? আমায় প্যাঁচে ফেলতে এমন করতো। মাথায় শয়তানি বুদ্ধিতে ভরপুর। ঠোঁট উল্টে, হাসি চেপে বলতো, “ইশশ! পার না বললেই হয়! উমম..এত পড়ে তবে কী লাভ, যদি এই সিম্পল পড়া বোঝাতে না পার?”
বলেই সে তার চমৎকার হাসিটা দিত। ছোট ধূসর চোখ দুটো তখন আরো একটুখানি ছোট হয়ে যেত। গালের খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো রোদের আলোয় চিকচিক করত। আর ও হাসলেই আমার রাগ কমে যেত! অদ্ভুত না?

ওর এই সুন্দর চোখ এবং চমৎকার হাসির জন্যই ক্যাম্পাসের অনেক মেয়েদের কৌতুহলের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। কিন্তু কেউ খুব একটা মুখ ফুটে কথা বলার সাহস পেতো না। ওকে কেন কেউ কেউ এত ভয় পেতো তা তখনও আমার ধারনাতে ছিল না।

ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরিক্ষার আগে আগে বেশ ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা ঘটলো!
আমি আমার ক্লাস শেষ করে সবে বের হয়েছি। রোহান আমায় দেখতে পেয়ে দূর থেকে ডাকলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে সাদা টিশার্ট এর উপর একটা চেকপ্রিন্টের শার্ট পরা ছিল। চুল মোটেও গোছালো ছিল না, কপালের উপর অস্থির বিচরণ। আনডিসিপ্লিন্ড কৃষ্ণ-বালক!
ও আমায় দেখতে পেয়ে হাতের ইশারায় ডাকলো। আমি আগানোর সুযোগ অব্দি পেলাম না, তার আগেই কোত্থেকে একটা মেয়ে ছুটে এসে, পুরো ক্যাম্পাস ভর্তি মানুষের সামনে ওকে জরিয়ে ধরলো। রোহান পরে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিল। মেয়েটা অনবরত কিছু একটা বলে যাচ্ছে। ভয়ানক অস্থির দেখাচ্ছিল মেয়েটাকে। ছোট একটা মেয়ে। এই বড়জোড় সতেরো-আঠারো বছর!

রোহান হতবিহ্বল চোখে একবার আমার দিকে চাইলো, তারপর মেয়েটাকে কিছু বলতে লাগলো। দূরে থাকার ফলে ওদের কথোপকথন কিছুই শুনতে পেলাম না। ইভেন কি হচ্ছে তাই ঠাহর করতে পারছিলাম না। তবে মেয়েটার এহেন কান্ডে অবাক হয়েছি বেশ। সাহস আছে বলতেই হবে। নচেৎ এমন ক্যাম্পাস ভর্তি মানুষ…
রোহান যত ছাড়াতে চাচ্ছে, মেয়েটা তত আঁকড়ে ধরছে। আশেপাশের কিছু ছেলেমেয়ে গসিপ করছে। কেউ কেউ ভিডিও করছে।
মেয়েটা রিকোয়েস্ট করে কিছু বলছে, বলতে বলতে সে কেঁদে ফেলছে। রোহান আরো একবার আমার দিকে তাকালো তারপর পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যই হোক বা যে কারণেই হোক, রোহান মেয়েটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে ক্যাম্পাসের বাহিরে চলে গেল।

এ নিয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথোপকথনে মজে উঠল। আমি চলে এলাম হোস্টেলে। রাতে ফেইসবুকে ঢুকতেই দেখতে পেলাম নানান ক্যাপশনে রোহান আর সেই মেয়েটার ভিডিও! এক প্রকার ভাইরাল।

শম্পা আমার ক্লাসমেট, রুমমেট, ফ্রেন্ড। ও খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“মেয়েটা কে রে তারিন? তুই চিনিস?”
সিম্পল একটা প্রশ্ন। আমি ত্যাক্ত-বিরক্ত হওয়ার মতো ভাব করে বলি,
“আমি চিনব কী করে? আমার কী চেনার কথা?”
“রোহান তো তোর গুড ফ্রেন্ড। তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
আমি আরো একটু বিরক্তি, রাগ মাখিয়ে বললাম,
“তোর ধারনা, আমি ওর যাবতীয় খোঁজ নিয়ে বসে আছি? আমার কোনো কাজ নাই আর?”
শম্পা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলে,
“রেগে যাচ্ছিস কেন? শুধু জানতে চাইলাম! সবাই খুব গসিপ করছে তাই…”

প্রতিত্তুরে আমি আর কিছু বললাম না। বইপত্র গুছিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। কেমন যেন একটা খচখচ নিয়ে রাতে ঘুমালাম। আমার খারাপ লাগছিল- তা নয়, তবে একটু অদ্ভুত লাগছিল। কেন লাগছিল তা বলতে পারবো না।

সকাল সকাল ক্যাম্পাসে চলে গেলাম। রোজ হোস্টেল থেকে বের হলেই রোহানের দেখা পাই, সেদিন পেলাম না। ক্যাম্পাসে গিয়েও কোথাও দেখিনি। সেদিন সারাদিন রোহানকে দেখলাম না। ইভেন খুঁজিওনি। অদ্ভুতভাবে কোনো কিছু নিয়েই আমার খুব বেশি ইন্টারেস্ট কখনোই কাজ করে না!

এরপরের দিন বিকেলে সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে গিয়ে বসলাম একা একা। রোহান কিভাবে জানল আমি ওখানে আছি, তা এক বিস্ময়! ফট করে আমার ঠিক পাশে এসে বসলো।
আমি বোধহয় চমকে ছিলাম। চুলে গুঁজে রাখা কৃষ্ণচূড়া ফুলটা চুল থেকে খুলে পড়ে গেল। রোহান মৃদু হাসলো। তারপর পড়ে যাওয়া ফুলটা নিজে নিয়ে পুনরায় চুলে গেঁথে দিল। খানিক মিহি স্বরে বলল,”ফুলগুলো বোধহয় তোমার জন্যই ঝড়ে পড়ে জুছি! কৃষ্ণকলি লাগে তোমায়!”
আমি বললাম,”কখন এলে।”
“এখনই।”
“ও!”
এরপর আমি চুপ করে রইলাম। প্রকৃতির ছোয়া অঙ্গে জড়ালাম!
নিরবতা ভেঙে রোহান নিজেই বলল,
“মেয়েটা জেরিন। তুমি চিনবে না অবশ্য। আমরা এক স্কুলে পড়তাম। আমি যখন ক্লাস নাইনে ও তখন সেভেনে এসে ভর্তি হলো আমাদের স্কুলে। প্রথম দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিল। তারপর…!”
আমি ছোট্ট করে বললাম,
“ও আচ্ছা।”
রোহান হালকা কেশে বলল,
“ইয়ে মানে, ছোট বেলায় খুব পুংটা ছিলাম তো তাই আর কি….বাট এসব কিন্তু সেই স্কুল লাইফেই ক্লোজ্ড হয়ে গিয়েছিল। কই থেকে যে হঠাৎ মেয়েটা…!”
আমার কি যে হাসি পেল! কিন্তু হাসা বারন। হাসি নিয়ন্ত্রন করে গাম্ভীর্য বিরাজমান রেখে বললাম,
“তুমি এখনো পুংটাই আছো রোহান।”
রোহানের সদা-হাস্যজ্জ্বল মুখখানায় পুনরায় হাসির বিস্তর রেখা ফুটে উঠল। খুব সুন্দর করে বলল, “তোমার তাই মনে হয়?”
আমি বললাম,”হু!”

(চলবে)……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here