রয়েছ_হৃদয়ে #৪র্থ_পার্ট

0
731

#রয়েছ_হৃদয়ে
#৪র্থ_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
সকলের হয়তো মনে হতে পারে, চিরকুটটা পড়ে আমার খুব রাগ হয়েছে কিংবা আমার কাছে অস্বাভাবিক লেগেছে, রোহানকে বকাঝকা করেছি! না, মোটেও এসব কিছুই হয়নি। বরং খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিলাম পুরো বিষয়টা। এর কারণ- এমন ও প্রায়শই বলে। ওই যে বলি, পাগল! তাই অতো আমলে নেই না কোনো কথাই! পাগলের কথার ঠিক আছে?
দেখা গেল, রেগেমেগে জিজ্ঞেস করেছি, ‘এসব লেখার মানে কী রোহান? এই চিরকুট কেন দিয়েছ? কী কথা এসব, হুম?’
রোহান হয়তো হেসে বলত, ‘কই কী কথা? এসব তো জাস্ট এমনি বললাম! গিফট দিলে কিছু বলতে হয়, তাই বলেছি….বলার জন্য বলা আর কি…হা হা হা! রাগ করছ কেন? রাগ করা মতো কিছু কী বলেছি? তোমার লাবন্যের সুনাম করেছি, সুনাম করলে কেউ রাগ করে? সুনাম করলে খুশি হতে হয়, বোকা মেয়ে!’
ইনফেক্ট আই ওয়াজ ড্যাম শিওর ওকে যদি জিজ্ঞেস করতাম, ও-এই কথাই বলতো!

তখন পুরো বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে নেয়ার আরো একটা কারণ ছিল- ও যতই অগোছালো, ছন্নছাড়া, আউল-বাউল হোক না কেন; খুব চমৎকার ভাবে গুছিয়ে কথা বলার দারুন একটা গুন ওর মাঝে ছিল। কথা দিয়ে যেই কাউকে কাবু করে ফেলার অসীম ক্ষমতা ছেলেটার!
তাই তো সেদিন অতো ভাবিনি, আমলে নেইনি! চিরকুট আর শাড়িটা অনাদরে রেখে দিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট ঘুম দিয়েছিলাম। পরদিন রোজকারকার মতো ভার্সিটি গিয়েছিলাম। রোহানের সাথে দেখা হলো, কথা হলো, সাথে তার উদ্ভট কর্মকান্ড তো ছিলই! অসব বাধ্যতামূলক। শাড়ি, চিরকুট এসবের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম!

কিন্তু এখন এসে মনে হয়, ইশশ…যদি সেদিন একটু সিরিয়াস হয়ে ভাবতাম চিরকুটটা নিয়ে! যদি জিজ্ঞেস করতাম! তবে হয়তো আরো একটু আগে থেকে টান-টা অনুভব করতে পারতাম ওর প্রতি! এখন খুব জানতে লোভ হয়, সত্যিই কী বলতো ও? আমার ধারনানুযায়ী কথাগুলো বলতো, নাকি অন্যকিছু?

শ্রাবণ মাস তখন। চিরিচিরি বৃষ্টি পড়ে সমস্ত দিনব্যাপী। আকাশের দিকে তাকানো দায়; ধূসর-কালো-মেঘলা আকাশ! থেমে থেমে কাঁদছে যেন! আমি খানিক বিরক্ত হলাম। যতক্ষণ রুমে থাকি ততক্ষণ বৃষ্টিকে ভালো লাগে, ঘর থেকে বের হলেই অসহ্য বিরক্তি চেপে বসে মনে! মুমূর্ষু প্রকৃতি, ভেজা পথঘাট; হাঁটা মুশকিল!
হোস্টেল থেকে বের হতেই রোহানকে দেখলাম। চিরিচিরি বৃষ্টির ছোঁয়ায় আধ ভেজা চুল, আধ ভেজা শার্ট! খয়েরি শার্ট হালকা ভিজে, ছোপছোপ কালচে খয়েরী রং ধারন করেছে। কপালের কিনার বেয়ে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ছে। আমায় দেখতে পেয়ে সে তার ভুবন ভুলানো হাসিটা দিল, কাছে এসে বলল, “সুন্দর সকাল, জুছি!”
আমি বললাম, “মোটেও সুন্দর সকাল না, অসুন্দর বিরক্তি মাখানো সকাল। তুমি ভিজছো কেন?”
রোহান বলল, “মিষ্টি লাগে।”
আমি বললাম, “এই প্যাঁকপ্যাঁকে পথঘাট, অন্ধকারাবৃত নিভু নিভু প্রকৃতি, চোখমুখ ছুঁয়ে বেরানো বিরক্তি মাখানো বৃষ্টি তোমার মিষ্টি লাগে?”
“খুব!”
“পাগল!”
“পাগলী!”
আমি হাসলাম, রোহান হাসলো। আধভেজা চড়ুইপাখি হয়ে দুজন ক্যাম্পাস গেলাম।
দুটো ক্লাস শেষে রোহান এলো আমার ভবনে। আমি ক্লাস শেষে বেড়িয়ে দেখলাম চোখমুখ অলরেডি লাল হয়ে আছে। বিষন্ন দেখাচ্ছিল খুব। রোহানের ঠান্ডার সমস্যা ছিল। আমি তা জানতাম। বললাম, “নিষেধ করেছিলাম ভিজতে, শোনোনি। এখন বোঝ মজা! কেয়ারলেস একটা!”
রোহান অপরাধী হাসলো। ছেলেটা অন্যায় কিংবা ভুল কিছু করে শেষে এমন একটা মুখ করে যে, আর কারো রাগ করার সাধ্য নাই!
রোহান কাঁচুমাচু করে বলল, “কিচ্ছু হবে না জুছি। বেশি খারাপ লাগছে না কিন্তু। তুমি ক্লাস করবা আর? আমি চলে যাই তাহলে? ক্লাস করতে ইচ্ছে করছে না আজ আর।”
আবার মায়া! আমি বললাম, “যাও। মেডিসিন নিও। হেলাখেলা করবা না মোটেও। অসুখ বাধালে তোমার সাথে আমার আর কথা নাই। বারন তো শোনোনি খুব!”
ও ছোট্ট করে বলল, “আচ্ছা!”
তারপর চলে গেল।
অসুস্থতা কী মানুষকে ইনোসেন্ট বানিয়ে দেয়?

সেদিন মাঝরাতে ও আমায় ফোন দিল। সরাসরি কথা বলা, দেখা সাক্ষাৎ ছাড়া ফোনে কিন্তু আমাদের খুব একটা কথা হতো না। যে কারণে মাঝরাতে ওর কল দেখে একটু অবাক-ই হয়েছিলাম। কাতর কন্ঠে বলল, “জুছি, আজ এত শীত কেন? বৃষ্টি মজা, কিন্তু শীত তত মজা না। শীত লাগছে ভীষণ। আজ বেশি শী..শীত, না?”
আমি ঘুমে কাতর হয়ে বললাম, “অদ্ভুত রোহান! এই প্রশ্ন করতে মাঝরাতে ফোন করেছ?”
আমি ভুলে গিয়েছিলাম তার যে জ্বর জ্বর ভাব ছিল। কিন্তু আমার প্রশ্নের প্রতিত্তুরে রোহানের আর কোনো কথা ভেসে আসলো না। আমি এত ডাকলাম, তার কোনো সারাশব্দ নাই। ফোন কেটে বেশ কয়েকবার ফোন দিলাম, নো রেসপন্স! ভাবলাম, বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে! কিন্তু মহাশয় যে জ্বরে কাবু হয়ে ছিলেন তা তখনও বুঝিনি। এরপর দিন ক্যাম্পাসে এলো না। মাহিরা ওর বাসার কাছেই থাকে। ও জানালো, রোহানের জ্বর এসেছে। আমি এক প্রকার রাগ আর ক্ষোভ থেকে বললাম, ‘বেশ হয়েছে, ঠিক হয়েছে, খুশি হয়েছি! বারবার নিষেধ করেছি, ভিজো না, ভিজো না! কিন্তু সে-কি কারো বারন শোনে? বৃষ্টি নাকি খুব মিষ্টি!’

আমার হম্বিতম্বি দেখে মাহিরা মিটিমিটি হাসলো। আমি বললাম, “হাসিস ক্যান? ফাজিল!”
ও বলল, “সত্যি করে বল তো, তোর রাগ হচ্ছে, না মায়া হচ্ছে?”
আমি ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম, “মায়া!”
মাহিরার সে কি হাসি! তার আগের হাসি এবার দ্বিগুণ হলো। হাসি যেন তার থামেই না! আশ্চর্য! এত হাসার মতো কি বলেছি?

একটু একটু টেনশন যে হচ্ছিল না, তা কিন্তু নয়। ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে, বিকেল নাগাদ রোহানের নাম্বার থেকে ফোন এলো। আমি প্রিপারেশন নিলাম, খুব বকবো। কিন্তু রিসিভ করতেই ভেসে এলো একটা অপরিপক্ব কন্ঠস্বর। ফিসফিয়ে বলল, “হ্যালো আপু? আমি রায়হান জুনিয়র। আর ভাইয়া রোহান সিনিয়র। ভাইয়া ঘুমাচ্ছে তাই লুকিয়ে তোমায় কল দিলাম। রাগ করোনি তো? হ্যালো আপু, শুনতে পাচ্ছো?”

বিচ্ছুটার প্রথমে বলা আমি ‘রায়হান জুনিয়র’ শুনেই খুব হাসি পাচ্ছিল। রায়হানের কথা রোহান আমাকে আগেই বলেছিল। ক্লাস এইটে পড়ে তখন সে। কথা শুনে মনে হচ্ছিল, ঠিক রোহানের মতোই বাঁদর সেও! আমি বললাম,
“জ্বি শুনতে পাচ্ছি মিস্টার রায়হান জুনিয়র! কেমন আছেন আপনি?”
রায়হান বলল, “আমি সুপার ফাইন, আপুই! কিন্তু ভাইয়াটা সিক! শোনো আপু? তোমাকে আমি একটা সিক্রেট কথা বলবো বুঝেছো?”
আমি হাসি আটকে বললাম, “নিশ্চয়ই বলবে মিস্টার জুনিয়র। কখন বলবে? এখন? বলো? শুনছি!”
ওপাশে কি হলো কে জানে! রায়হান ব্যস্তগতিতে আগের মতোই ফিসফিয়ে বলল, “এই এই আপু….ভাইয়া জেগে গিয়েছে। তোমায় আমি পরে বলবো কথাটা। এখন রাখছি। আর শোনো? তোমায় যে আমি কল করেছি, এটা কিন্তু ভুলেও বলবা না ভাইয়াকে। বললে আমি খুব রাগ করবো। সিক্রেট কথাটাও আর বলবো না কিন্তু। ওকে…রাখছি, বায়!”
বলেই লাইন কেটে দিল। সেইম টু সেইম রোহান! আমি খুব হাসলাম। এত বিচ্ছু!

তিনদিন পর রোহান ক্যাম্পাস এলো। মুখখানা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার। আমি কথা-টথা কিছু বললাম না। কথা তো দূর…দেখেও দেখিনি টাইপ ভাব ধরে বসে রইলাম। মাহিরা থাকলে নিশ্চয়ই হেসে খুন হতো।
ওই সপ্তাহ টানা বৃষ্টি ছিল। সেদিনও বৃষ্টি। টাপুরটুপুর বৃষ্টি পড়ছে। লাইব্রেরীতে চলে গেলাম আমি। আমার পিছুপিছু রোহানও এলো। আমি মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম, “এখানে তোমার কি কাজ?”
রোহান বলল, “অনেক কাজ।”
আমি বললাম, “দূরে-টূরে সরে কাজ করো। আমায় জ্বালাবে না।”
রোহানের চোখেমুখে হঠাৎ-ই যেন খুশির ঝিলিক খেলে গেলো। একগাল হেসে বলল, “এই, জুছি? একটা টুর দেয়া যায়…কি বলো?”
আমি বললাম, “তোমার সাথে টুর? ইম্পসিবল! যাও তো…জ্বালাবে না। বারবার বলছি শুনছো না কেন?”
ওর হঠাৎ কি হলো কে জানে! উঠে চলে গেল। সদ্য জ্বর থেকে ওঠা, নিজের প্রতি কেয়ারলেস ছেলেটা, লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে, ঐ চিরিচিরি বৃষ্টি মাথায় হনহনিয়ে নিজের ভবনের দিকে চলে গেল। পেছনে ফিরে একবার তাকালোও না! তাকালে দেখতে পেতো – একটা মেয়ে কেমন করে তার অভিমান উপভোগ করছে! ইশ রে! এই ছেলেটা কেমন যেন! মেয়েদের মতো লজ্জা পায়, আবার অভিমানও করে! ইন্টারেস্টিং না?
কিন্তু সে তার অভিমান ধরে রাখতে পারে না। তাইতো ক্লাস শেষে হোস্টেলে ফেরার পথে সে ছাতা মাথা আমার পাশে এসে হাঁটতে লাগলো। সদা-হাস্যজ্জ্বল মুখখানাতে হাসি নাই, মুখ মলিন। কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটারপর আমিই জিজ্ঞেস করলাম, “চুপ যে?”
রোহান গমগমে স্বরে বলল, “কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রাগ করেছি একজনের উপর।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কার উপর?”
তার ঝটপট সোজা উত্তর, “তোমার উপর!”
আমি খিলখিল করে হেসে ফেললাম। রোহান বলল, “একদমই হাসবে না।”
আমার হাসি কি থামে? আরো বেড়ে যায়! হাসতে হাসতে তাল সামলাতে না পেরে- পিছলা খেয়ে- ধুপ করে গেলাম পরে! রোহান একটু ধরল, ধরে আর রাখতে পারল কই? পরে গিয়েও হাসি আমার থামে না। ছাতা মাথায় রোহান আমার সামনে বসে দারুন করে বলে, “আবার হাসে! পাগলী মেয়ে!”…………….

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here