রয়েছ_হৃদয়ে #৫ম_পার্ট

0
764

#রয়েছ_হৃদয়ে
#৫ম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

ফার্স্ট ইয়ার এবং সেকেন্ড ইয়ারে আমাদের সম্পর্ক এজ ইউজুয়াল নরমাল ফ্রেন্ডশিপের মতোই যাচ্ছিল কিন্তু থার্ড ইয়ারে এসে লক্ষ্য করলাম, আমার খুব সামান্য কিংবা অসামান্য; যেকোনো বিষয় নিয়ে রোহান খুব বেশি ডেসপ্যারেট হয়ে যেত। প্রথম প্রথম কিন্তু এতটা করতো না। কিন্তু যত দিন গড়াচ্ছিল ওর এই বিষয়গুলো ততো আমার চোখে বাধতে লাগল।
কোনো কারণে আমি একটু চুপচাপ কিংবা মনমরা থাকলে রোহান কেমন অস্থির হয়ে যেত। আমাকে হাসার চেষ্টা করতো। কি ভীষণ মজার এবং ইন্টারেস্টিং কথা বলতো, নিমিষে মন ভালো হয়ে যেত! ওর মতো মজার কেউ নাই আর। ওর মতো অমন করে মাতিয়ে রাখতে পারে না, পারবে না কেউ!
আমার অসুস্থতা আমার চাইতেও বেশি তাকে কাবু করে ফেলতো! অস্থির হয়ে বলত, “জুছি? বেশি খারাপ লাগছে? মেডিসিন নিয়েছ? দেখি এদিকে আসো! আজ ক্যাম্পাসে এসেছ কেন? জুছি? একটু কেয়ারফুল হও তো!নিজেকে নিয়ে তুমি এত বেখেয়াল কেন, হু?”

আমি হেসে ফেলতাম। আমি তাকে যে ভাবে বলি সে তা কপি করে বলছে! কি ফাজিল!

ক্লাস শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে শিমুল তলায় এসে বসতাম। ক্লান্তিতে কখন যে চোখ লেগে আসতো! ঘুম ভেঙে, চোখ না মেলেই অনুভব করতাম কারো কাঁধে আমার মাথা! প্রথম প্রথম খুব চমকে যেতাম। একটা সময় এসে অভ্যেস হয়ে গেল। আমি কিছু হয়নি টাইপ ভাব নিয়ে সরে বসতেই রোহান কেমন কেমন হেসে বলত,
“উঃ তুমি কত্ত ঘুমাও জুছি! এবার একটু কাঁধ টিপে দাও! কাঁধটা ব্যাথা করছে…দাও তো টিপে।” বলেই হেসে ফেলত।

সবচাইতে বিস্মিত হবার মতো বিষয় ছিল-
কেউ আমাকে কোনো রকম টিজ করলে কিংবা করার চেষ্টা করলে পরদিন খবর পেতাম সে হসপিটাল ভর্তি! আমি খুবই আশ্চর্যান্বিত হতাম। আমি প্রথমে আন্দাজও করতে পারিনি, কাজগুলা রোহান করে! ইভেন ওকে আমিই আগ্রহ নিয়ে বলতাম,
“এমন কে করছে, বলো তো? যে-ই আমাকে কোনো না কোনো ভাবে ভালো-মন্দ কিছু বলছে; তারই ক্ষতি হচ্ছে! আশ্চর্য! ইজ ইট ম্যাজিক, রোহান?”
রোহান একটু হেলে এসে, হেয়ালি করে বলত,
“হুহ, ম্যাজিক! খুব মিষ্টি পরিদের সাথে একটা করে জীন থাকে; যে অলওয়েজ সেই পরিটাকে প্রটেক্ট করে, আল্লাহ্‌ পাওয়ার দিয়ে দেয়! তুমি তো মিষ্টি পরি। প্রটেক্ট করার জন্য জিন নিশ্চয়ই আছে! তোমায় কেউ কিছু বলতে পারবে না, জুছিরানী!”
বলেই চমৎকার হাসতো।

ওর এই কথাটা সেদিন অন্যসব কথার মতো হেয়ালি হিসেবে উড়িয়ে দিলেও, এই কথার রহস্য টের পেলাম সেদিন; যেদিন ও আমার সামনেই সিনক্রিয়েট করলো!

এত মারলো, এত মারলো, এত মারলো ছেলেটাকে! মারতে মারতে নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের করে ফেললো, ওর নিজের হাত কেটেও রক্ত বেড়িয়ে গেল! আমি এত বুঝালাম, আমাকে শুনলোই না! যেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে! ওর সেই দানবীয় রূপ দেখে আমি নিজেই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কেমন নিষ্ঠুর আচরণ ছেলেটার!
শুধু আমাকে একটু টিজ করেছে বলে?

ছেলেটাকে প্রচন্ড মারলো এবং শেষে নিজেই হসপিটাল নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে ওর দুজন ফ্রেন্ডকে কল করে ডেকে পাঠাল। ওরা আসার পর বলল,
“জুছিরানীকে একটু ওর হোস্টেলে পৌছে দিয়ে আয়, সাবধানে।”
খুব একটা মানুষের আনাগোনা সেখানে ছিল না, কিন্তু যারা ছিল তারা কেউই এগিয়ে আসলো না। কী অদ্ভুত মানুষ! আমি সেদিন মনে মনে ঠিক করেছিলাম, রোহানের মতো অমন বখাটে ছেলেটার সাথে আমি আর কখনোই কথা বলবো না। কক্ষনো না!
কেমন করে মারলো, ইশশ!

এত কান্না পেয়েছিলো সেদিন আমার; ভয়ে, নাকি অস্বস্তিতে ঠিক বুঝিনি!
সেদিন রাতে প্রচন্ড জ্বর চলে এসেছিল আমার। বারবার চোখে ভেসে উঠছিল রোহানের সেই হিংস্র রূপ! আমার এত হেইট আসলো ওর প্রতি!

এরপর টানা তিন দিন ক্যাম্পাস গেলাম না। সব রকমের সোশ্যাল সাইট থেকে ব্লক করলাম ওকে।
রুমমেটরা এসে বারংবার বলতে লাগলো, রোহান আমার সাথে একবার কথা বলতে চায়! শোনামাত্র ভয়ানক বিরক্তিতে মাথা ধরে গিয়েছিল।
আমি না যাওয়ার ফলে, চিরকুট লিখে পাঠাল। আমি খুলেও দেখিনি! কুটকুট করে ছিড়ে রুমমেটদের দিয়ে পুনরায় ফেরত পাঠালাম।
প্রিয়দের প্রতি রাগ এবং অভিমানের প্রখরতা বুঝি এমনই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়!

নেহাৎ মেয়েদের হোস্টেল। নচেৎ হোস্টেলের ভেতরেও চলে আসারও প্রবল সম্ভাবনা ছিল! ভাগ্যিস….
বারবার মনে হতো, এই ছেলেকে বন্ধু ভেবে খুব বড়ো ভুল করেছি! প্রায় তিন বছর একটা বখাটেকে প্রিয় একজন ভেবে এসেছি? ছিঃ! আর নয়! আর কিছুতে ওর সাথে আমি কথা বলবো না! এমন ডাকাত, এমন ভয়ংকর বখাটে!

ঠিক তিনদিন বাদে আমি ক্যাম্পাস গেলাম। আমি আড়চোখে কেবল পর্যবেক্ষণ করছিলাম, রোহান কোথাও আছে কি-না! তাকে কোথাও না দেখতে পেয়ে মনে মনে খুব খুশিও হয়েছিলাম। কিন্তু আমার খুশির গুঁড়ে বালি! মিনিট পাঁচেক বাদে অনুভব করলাম; আমার পাশে কেউ হাঁটছে। পাশ ফিরে তাকাতেই রোহানকে দেখতে পেলাম। ওর এই একটা স্বভাব…ফট করে কোত্থেকে এসে, নিশ্চুপ আমার পাশে হাঁটবে! আমি দ্রুত পা চালালে- ও আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি কিছু না বলে, খুব কঠোর হয়ে তাকালাম। রোহান অস্থির হয়ে বলল,
“কেমন আছো জুছি? তুমি কী আমার উপর খুব রেগে আছো? কেন? আচ্ছা কিচ্ছু বলতে হবে না। যে-কারণেই রেগে থাক না কেন, আই এম স্যরি!”
আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম। রোহান কি বুঝলো কে জানে! সে চোখ নামিয়ে মিনমিনে সুরে বলল,
“আমার কী দোষ? ওরা অমন বললে, আমার খুব রাগ হয়! তোমায় কেউ কিছু কেন বলবে? হোয়াই? এত সাহস!”
আমি মনের তেজ যত সম্ভব মুখে ফুটানো যায়, ফুটিয়ে বললাম,
“তুমি একটা সাইকো রোহান! তোমার ইমিডিয়েটলি মেন্টাল ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন। অমন করে কেউ কাউকে মারে? ওরা আমায় ভালো খারাপ যাই বলেছে, ইট’স টোটালি ম্যাটার অব মাইন! তোমার কী?”
রোহান শুধু বলল,
“আমার অনেক কিছু, অনেক কিছু, অনেক-অনেক কিছু! যাও, ক্লাসে যাও!”
বলে ও উল্টো দিকে চলে গেল। সে কি অধিকারবোধ তার! ওর এই এত রাগ, এত তেজ…এই ঘটনার আগে ওর মাঝে আমি কখনো দেখিনি। এই তিন বছরেও না!
ও চঞ্চল, উদ্ভট, পাগল, ছন্নছাড়া, একরোখা জানতাম; কিন্তু এমন ডানপিটে কখনো ভাবিনি, দেখিনি!

রোহান চলে যাওয়ার পর আমি ক্লাসে চলে গেলাম। কিন্তু ক্লাসে তো আমার মন নাই। ক্লাসমেটদের কাছেই জানতে পারলাম, রোহানকে কলেজ থেকে ওয়ার্নিং দেয়া হয়েছে। অমন একটা কান্ড করলো, এরপরও যে ওকে কলেজ রেখেছে সেটাই অনেক!

এরপরের সাতদিন রোহানের সাথে আমি তো কথা বলিইনি, সেও বলেনি। ওর এই…ঠিক এই দিকটাই অনেক ব্যতিক্রম! ও কখনোই আমার সাথে বাড়াবাড়ি করতো না। অনুরোধ করতো কিন্তু জোড় করতো না। আর এই কারণেই ওর উপর বেশিদিন রেগে থাকতে পারতাম না। বিশেষ করে ওর কাজকর্মগুলোর জন্যই আমার অদ্ভুত মায়া লাগতো! শুধু দূর থেকে কেমন করে তাকিয়ে থাকতো! ওর ওই ধূসর চোখ, স্বচ্ছ চাহনি; কেমন যেন লাগতো! মাঝে-মধ্যে আমার কাছ ঘেঁষে হাঁটতো, কিন্তু কোনো রা’শব্দ করতো না, এইটুকু কথাও কিন্তু সে বলতো না! কেমন অদ্ভুত, কেমন পাগল ছেলে!

সাতদিন পর আমি আর পারলাম না। আমার পাশ ঘেঁষে যখন নিরবে হাঁটছিল, আমি থেমে জিজ্ঞেস করলাম,
“কী সমস্যা, রোহান?”
আমার ঐ-ঐটুকু কথাতেই রোহানের সকল নিরবতার বাঁধ ভেঙে গেল। সামনে এসে বলল,
“অনেক সমস্যা! অনেক অনেক বেশি সমস্যা। আই মিস ইউ। আই মিস ইউ আ লট। তোমার সাথে কথা না বলে আর থাকতে পারছি না। মেজাজ খারাপ হচ্ছে, খুব রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে ওই ছেলেটাকে আবার…! সত্যি খুব রাগ হচ্ছে জুছি। প্লিজ মাফ করে দাও। কসম, আর কাউকে মারবো না। যদি বেশি….”
“যদি বেশি কী?”
“কিছুনা! প্লিজ? প্লিজ মাফ কর। ওরা অমন বলেছে বলেই তো…..তোমায় নিয়ে কেউ কিছু বললে আমার সহ্য হয়না জুছি! অসহ্যকর রাগ লাগে!”
বলতে বলতেই এমন ভাব, যেন এই এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে! ইশশ! কেমন মেয়েলি! যার অত রাগ, অমন তেজ; সে আবার এমন করতে পারে?
আমার কেমন মায়া হলো। সেদিন, ঠিক সেদিনই টের পেলাম, ওর প্রতি আমার অনেক মায়া, অনেক টান। কবে জন্মালো, কে জানে!

এরপর আবার সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। ওর ফাইজলামি, বদমাইশি কমাকমির কোন নাম গন্ধ নেই! বরং বাড়ছিল যেন!
এই যে ও এত উদ্ভট, উদাসিন, বেখেয়ালি? ওকে নিয়ে আমার এতো অভিযোগ! এই এতকিছুর শেষেও আমার প্রতি ওর কোনোই অভিযোগ নেই। আমার সব কিছুই ওর কাছে পারফেক্ট!

নিজেকে নিয়ে খুব উদাসিন ছেলেটা; আমায় নিয়ে প্রচন্ড যত্নাশীল, সতর্কবান, দায়িত্ববান তেজি পুরুষ! তার এমন দ্বিমুখী স্বভাব কেন, কী কারণে; এর উত্তর তখনও ভাবার কিংবা জানার ইচ্ছেটুকু জাগেনি মনে! আমার কেবল মনে হতো, ‘আমি, রোহান, আমাদের সম্পর্ক আজীবন, অনন্তকাল এমনই চলতে থাকবে! রোহান অমন পাগল থাকবে, আমি ওকে খুব বকে যাব, একটু একটু ভালোবাসবো, মায়া করবো, স্নেহ করবো। সম্পর্কে বন্ধন গাঢ় থেকে ভয়ানক গাঢ় হবে কিন্তু সেই সম্পর্কের কোনো নাম থাকবে না! সব সম্পর্কের নাম হতে হয়, কে বলেছে?’…..

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here