রয়েছ_হৃদয়ে #৮ম_পার্ট

0
676

#রয়েছ_হৃদয়ে
#৮ম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
আমি ছেলেটার সাথে খুব ভাব ধরে রইলাম। সত্যি বলি? ওর দরদ আমার ভালো লাগে, খুব…ভীষণ! তাই তো অমন রাগ দেখানোর ভাব করি….আসলে তো আহামরি রাগি না।

মুখ যখন অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখেছি, রোহান-পাঁজি-ফাজিলটা আমার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, “রাগলে তোমায় জুছি লাগে, জুছিরানী লাগে। এদিক তাকাও মেয়েটা?”
আমি তাকালাম, চোখেমুখে একরাশ বিতৃষ্ণা। রোহান আমার সামনে একটা শুভ্র বনফুল ধরলো। এই চমৎকার ফুলটা এর আগে আমি দেখিনি! কি দারুন দেখতে, কি মিষ্টি ঘ্রান! এই রাতে অচিন জায়গায় কই পেল ফুলটা?
আমি বুঝিনি, নিজের অজান্তে ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসির রেখা ফুটে উঠল। রাগ-ধাপ ভুলে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“কই পেলে? কি সুন্দর দেখতে, অসম্ভব মিষ্টি সুঘ্রাণ!”
বাস তখন চলছে, কৃত্রিম লাইটের আলোয় রোহানের পরিতৃপ্ত মুখখানা কিন্তু আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। ওর চোখে কিসের যেন সার্থকতা! খুব আগ্রহ নিয়ে বলল,
“ভালো লেগেছে, জুছি? ফুলটা দেখ? ঠিক যেন তুমি! এই যে মিষ্টি, দারুন, চমৎকার মায়াভরা বনফুল….এটা ঠিক তুমি!”

আচ্ছা বলুন তো? এমন সুন্দর, এমন সুখ সুখ কথা এই ছেলেটা ছাড়া আর কে বলতে পারে? পারে আর কেউ? কই…আমি তো শুনিনি এমন সুখকর কথা আর কারো মুখে!

রোহান আমার চুলের একপাশে লাগানো একটা ক্লিপ খুলে সেখানে ক্লিপটা দিয়ে ফুলটা আটকে দিল। যেন কিছুতেই পরে না যায়! কত যত্ন ওর প্রতিটা কাজে!
তার কাজ শেষ হলে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার রাগ কমেছে, জুছি?”
আমি মিথ্যা বললাম, “উঁহু!”
রোহান শব্দ করে হেসে দিল। কপাল থেকে ছোটছোট চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল,
“একটুও না?”
আমি পুনরায় বললাম, “উঁহু।”
রোহান সকালে যেই কথাটা বলেছিল, সেই কথাটা আবার বলল।
“তোমায় একটা কথা বলতে এখনও খুব ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু আমি বলবো না।”
বলেই সে নিজের সিটে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল। আমি একটু তাকিয়ে জানালায় মুখ রাখলাম, মৃদু বাতাসে জিরজির করে উড়তে থাকা কানের কাছের নিদারুন মায়ার বনফুলটা একটু ছুঁলাম, তারপর কি কি যেন ভাবনায় এলো! এই ভাবনায় আষ্টেপৃষ্ঠে কেউ কি ছিল, খুব গোপনে? আমি জানি না! তবে জানার সাধ যে জাগে!
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম কখন যেন! ঘুম ভাঙলো বাসের ঝাঁকুনিতে। ঘড়ি দেখলাম, বারোটা চল্লিশ। বাস নিশ্চুপ। পাশে তাকালাম, দেখলাম ছেলেটার ঘুমন্ত মুখ। হাত দুটো ভাজ করে বুকের উপর, কাধটা একটু বাঁকানো। অগোছালো চুলগুলো ভ্রু ছুঁইছুঁই, নাকের কাছের তিলটা বাসের আলোয় স্পষ্ট।
আমি ডাকলাম,
“রোহান?”
রোহান প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিল, “হু?”
আমি ভীষণ বিস্মিত হলাম। এক ডাকে শুনলো কেমন করে? আমি বললাম,
“সজাগ তুমি?”
এবার কোনো সাড়া এলো না। আমার কেন যেন হাসি পেল। ইশশ….ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সাড়া দেয়! পাগল!
খুব আস্তে করে বললাম, “তুমি একটা মায়া রোহান!”
“আর তুমি মায়াবতী! আমার সকল মায়ার কেন্দ্রবিন্দু, যাকে কেন্দ্র করে আমি ঘুরি!” উত্তর এলো ওর কাছ থেকে!

আমি চমকে উঠলাম! ও সব শুনতে পেল? কথাগুলো বলছিল চোখ বন্ধ করে, কিন্তু বলেই স্নিগ্ধ চোখ জোড়া মেললো, হালকা হাসলোও বোধহয়!

আমাদের মধ্যে সরাসরি কোনো কমিটমেন্ট হয়তো ছিল না, তবে অদৃশ্য কোনো এক কমিটমেন্ট বোধহয় ছিল। নয়তো, ওর কোনো কথা, কাজ অস্বাবিক কেন লাগেনি?

বাসে কারো তেমন অসুবিধে না হলেও সাদিয়া আর শম্পার হয়েছিল। কুয়াকাটা পৌঁছানোর আগে আগে ওরা দুবার বমি করলো। বাস জার্নি ওদের অপছন্দের, মাথা ঘুরায়, বমি পায়, ক্লান্ত হয়ে যায়। যদিও আমারও অপছন্দের জার্নি তবে বমি পায় না।

আমরা কুয়াকাটা পৌঁছালাম একটা পঞ্চাশে।
ইফাজ আগে থেকে রিসোর্ট বুক করে রেখেছিল স্থানীয় এক ছেলের মাধ্যমে তাই মাঝরাত হওয়াতেও খুব একটা অসুবিধায় পড়তে হয়নি। শম্পা আমায় ধরে নামলো, ওর মুখের দিকে তাকানো যায় না, খুবই ক্লান্ত, বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। বাকিরা আগে আগে চলে গেল। আমি সাদিয়া, শম্পা, রোহান আর ইফাজ পেছনে পরে রইলাম।
সাদিয়ার সাথে ইফাজের বন্ধুত্ব বেশি। ওরা স্কুল ফ্রেন্ড ছিল। সাদিয়া বাস থেকে নামতে নামতে বলল,
“ইফু? আমি বোধহয় মারা যাইতেছি!”
ইফাজ ধমক দিয়ে বলল,
“সারা রাস্তা আমারে জ্বালিয়ে মেরে এখন বলিস, তুই মরছিস? চটকোনা খাবি নাকি হাঁটবি?”
সাদিয়া কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলল, “ইট্টু জ্বালাইছি বইলা এমনে খোঁটা দেস? তুই কি খারাপ রে!”
রোহান তার স্বভাব সুলভ টিটকারি মেরে বলল, “আসলে খারাপ। তোর উচিত ছিল ইফুর শরীরে বমি করে দেয়া। আহ-হারে ভুল করে ফেললি! এখন কি আবার ব্যাক যাবি? তাইলে ভুলটা সংশোধন করে নিতে পারতি।”
ইফাজ রোহানের বাহুতে মেরে বলল,
“শালা তুই বন্ধু নামে হারামি! এই মাথাখারাপ ‘চাদিয়া-বিস্কুটদিয়া’র লগে তাল দেস!”
সবাই হাসিতে ফেটে পড়লে সাদিয়া মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলল, “ধুর…আমি যাইতামই না!”
ইফাজ আরেক দফা ক্ষেপাতে বলল,
“আরে আর কান্দিস না, তোরে কুয়াকাটার পানি দিয়াই চা বানাইয়া- চা’দিয়া বিস্কুট খাওয়ামুনে….হা হা হা।”
সাদিয়া আমায় নালিশ করার মতো করে বলল, “দেখলি? ওয় আমারে আবার চাদিয়া কইছে!”
আমি ইফাজকে বকা দেয়ার ভান করে বললাম, “ইফাজ স্টপ!”
ইফাজ মুখ বাঁকিয়ে বলল, “ঠাকুর ঘরে কেরে-আমি কলা খাই নাই টাইপ অবস্থা! ওরে চাদিয়া বিস্কুট খাওয়ামু কইলাম আর ওয়….! এরলাইগাই কয় মাথাখারাপ মানুষদের ভালো কথাও কইতে নাই।”
আমি বহু কষ্টে হাসি আটকে রাখলাম। সাদিয়া তো ক্ষেপেটেপে অবস্থা খারাপ। সে ট্যুর-ফ্যুর সব ক্যান্সেলের ঘোষনা দিয়ে বসে ছিল, রোহান কিভাবে যেন বুদ্ধিমানের মতো সব ম্যানেজ করে ফেললো। ছেলেগুলো যেমন ফাজিল তেমন চালাকও। মেয়ে পটানোতে তাদের জুরি মেলা ভার!

রিসোর্টে পৌঁছে যে যার রুমে গিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচল। টানা এতখানি জার্নি এর আগে কেউ করেনি। রুমে এসে আমি আগে ফ্রেশ হলাম। ফ্রেশ হতে গিয়ে আয়নায় মলিন হয়ে যাওয়া মায়া জড়ানো বনফুলটা দেখলাম। ফেলে দেইনি ফুলটা। খুলে রেখে দিলাম। আমি কখনো কিছু ফেলে দিতে পারি না, খালি খালি লাগে। বস্তুটা মূল্যবান কিংবা অমূল্যবান যা-ই হোক না কেন। সেখানে এই সুন্দর ‘স্মৃতি’- ‘হ্যাঁ আমি একে স্মৃতিই আখ্যা দিলাম’- একে ফেলি কি করে?

রাতে দুই-তিন ঘন্টার বেশি আর ঘুম হলো না। খুব ভোর বেলা মাহিরা আর নিশাত এসে ডাকাডাকি শুরু করলো। ফজরের আযান দিচ্ছিল তখন। মাহিরা বলল, “জলদি বের হ দোস্ত, সূর্যদয় মিস করবি, ফ্যাস্ট।”

আমি ঘরকুনো হলেও আকাশ, চাঁদ, সূর্য আমার অতি পছন্দের। ঘুম পাতলা হওয়ায়, উঠতেও খুব একটা কষ্ট হলো না। ঝটপট উঠে পড়লাম। নামাজ পড়ে বেরিয়ে গেলাম। রিসোর্ট থেকে বের হয়ে সবাইকে দেখতে পেলেও রোহানকে দেখলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, “রোহান কই?”
রবিন বলল, “ঘুমায়।”
আমি বললাম, “ঘুমায় মানে? ও ছাড়া যাব নাকি?”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই লাটসাহেব ভাব নিয়ে রোহান এসে উপস্থিত হলো। খুব ঢং করে বলল, “আমি ছাড়া ক্যান যাবা না?”

আমি বিরক্ত হলাম। সমসময় ফাজলামো ভাল্লাগে? যতটুকু বিরক্তির ভাব মুখে ফুটানো যায়…ফুটিয়ে বললাম, “এতই যদি ঘুমাবে, ট্যুরে আসতে চেয়েছিলে কেন? যাও ঘুমাও!”
বলেই উল্টা হাঁটা ধরলে রোহান হাত টেনে ধরলো। আমার দিকে না তাকিয়ে বাকিদের বলল, “দেখছিস না জুছিরানী রেগে যাচ্ছে? দাঁড়িয়ে আছিস কেন সবাই? দ্রুত হাঁট!”
বলেই হাঁটা ধরলো। এরপর পুরোটা পথ আমার হাত ধরেই রইলো! ও এমন কেন?
এমন বলেই কি…..!

ইফাজ এর যেই পরিচিত ছেলেটা ছিল তাকে ও গাইড হিসেবে রাখলো। ছেলেটার নাম শাহিন। শাহিন বলল, “গঙ্গামতির চর আর কাউয়ার চর থেইকা ভালো দেহা যায়। তয় আমি কমু কাউয়ার চর থেইকা দেখতে। ওনতে বেশি ভালো দেহা যায়।”
তাঁর কথানুসারে আমরা কাউয়ার চর গেলাম। সমুদ্রকন্যার উত্তাল স্রোতের শ্রুতিমধুর শব্দ কানে বারি খাচ্ছিল থেমে থেমে। সবাই খুবই উচ্ছ্বসিত তখন। শাহিন বলল, “আর খানিক বাদেই সূর্য উঠবো।”
কথা সত্য। আমরা মুগ্ধ নয়নে দেখতে পেলাম, ক্রমশ অন্ধকার সরে গিয়ে হলুদাভাব ফুটে উঠছে।
উত্তাল স্রোত, স্রোতের গর্জন, সমুদ্রকন্যার অতল থেকে ভেসে ওঠা ওই সুন্দর লাল-কমলা-হলদে অগ্নিশর্মা আর আমাদের বিমোহিত মুগ্ধ নয়ন….ঐ দৃশ্য অবর্ণনীয়!

রোহান কিন্তু তখনও আমার হাত ধরা। ও খুব শীতল কন্ঠে ডাকলো, “জুছি?”
আমি কোনোমতে সাড়া দিলাম, “হুহ?”
প্রকৃতির অমন মনোরোম দৃশ্য থেকে চোখ সরানো কঠিন, মন ফেরানো দায়! স্নিগ্ধতায় সিক্ত বাতাসে মধুর অনুভূতি নিংড়ে পড়ে।
রোহান হাতটা আরো একটু শক্ত করে ধরলো বোধহয়। তারপর কেমন করে যেন বলল,
“এই সমুদ্র, এই স্রোত, এই বাতাস আর তুমি…….
জুছি? এই ভয়ংকর স্বচ্ছ-সুন্দর সকালটার উতলে পরা সকল মুগ্ধতা আমি তোমায় দিলাম। নিবে কি?”
আমি আর প্রকৃতি দেখলাম কই? দেখলাম তো অমন করে কথা বলা যাদুকরী ছেলেটাকে! আমার মন বাঁধা হয়, মায়া-যাদুর কাব্য-কথায়!……(চলবে)

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here