লবঙ্গ_লতিকা,পর্ব ১১,১২

0
1095

#লবঙ্গ_লতিকা,পর্ব ১১,১২
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১১

তমা উঠোনের গাছের সাথে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর বেসুরো গলায় বলছে,” ডিজে ওয়ালা বাবু মেরা গানা বাজা দো। ডিজে ওয়ালা বাবু মেরা গানা বাজা দো। গানা বাজা দো।”

সাদ চৌকাঠ মাড়িয়ে উঠোনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো। তমার বেসুরো গলার গান শুনে তমার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তমা নিজের পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ফিরে তাকালো। সাদ ভ্রু কুঁচকে তমাকে বললো,” এই গান শিখলে কোথা থেকে? ”

তমা নিজের চুলে হাত বুলিয়ে উত্তর দিলো,” আপনার সঙ্গে বিয়ের দিন বক্সে গানটা বেজেছিলো। তখন শুনেছি।”

সাদ মাথা নাড়িয়ে বললো, ” হুম এসব গান মনে থাকে। কিন্তু, পড়ার কথা মনে থাকে না। পড়ার কোনো খবর নেই। আছে শুধু গান আর আচারের খবর!”

তমা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। সাদের উপর ক্ষেপে গিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল। সাদ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মতোই দাঁড়িয়ে থাকলো। তমা ক্ষিপ্ত কন্ঠে সাদকে বললো,” ভালো হচ্ছে না কিন্তু! আর আচার মানে কীসের আচার?”

সাদ গাছ থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে বললো,” ছাঁদে তখন যে চুরি করে আচার খেলে। আমি দেখিনি বুঝি? সবাইকে বলে দেবো কিন্তু। ”

তমা আমতা আমতা করে বললো,”কী বলবেন শুনি?”

সাদ নির্লিপ্ত গলায় উত্তর দিলো, “এই যে তুমি চুরি করে আচার খেয়েছো। আচার চোর!”

তমা রেগে গিয়ে হাসফাস করতে করতে সাদের দিকে তাকালো। সাদ নিজের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। তমা কী করছে না করছে সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই।

“হরেক মাল দশ! হরেক মাল পাঁচ! ”

বাইরে ফেরিওয়ালার কন্ঠস্বর শুনে তমা এক ছুটে বাইরে বেড়িয়ে গেল। সাদ তমার এহেন কান্ড দেখে চমকে উঠলো। তমার পিছু পিছু সাদও নিজেও ছুট লাগালো।

তমা ফেরিওয়ালার ফেরির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফেরিওয়ালা কাঁচের চুড়ি,টিপ, নেইলপালিশ, আলতা এসব বিক্রি করছে। সাদ উদভ্রান্তের ন্যায় তমার দিকে ফিরে তাকালো। তমা গভীর মনোযোগ দিয়ে ফেরিওয়ালার ফেরি থেকে জিনিসপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। এক মুঠো চুরি নিজের হাতে পরে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখলো তমা।
সাদ ফেরিওয়ালাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো চুরির দাম কত? ফেরিওয়ালা সাদকে প্রত্যুত্তরে বললো,”২০ টাকা”

সাদ চুরির দাম মিটিয়ে তমার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তমা আরও কী কী যেন খুঁটিয়ে নাটিয়ে দেখছে। সাদ একটা আলতার বোতল হাতে নিলো। তমা হেসে সাদকে বললো,”ছেলে হয়ে আলতা পরবেন না কি?”

সাদ তমার হাতে আলতার বোতলটা দিয়ে বললো,” তোমার জন্য নিয়েছিলাম। পরলে পরবে আর না পরলে অন্য কাউকে দিয়ে দিয়ো।”

তমা অবাক হয়ে সাদের দিকে তাকালো। বজ্জা/ত ছেলেটা আস্তে আস্তে ভালো হয়ে যাচ্ছে!

বাড়ি ফিরেই তমা আলতার বোতল নিয়ে বসলো। হাতে,পায়ে আলতা দিয়ে লাল টুকটুকে করে ফেললো। তমাকে আলতা দিতে দেখে নাদিয়া দৌড়ে এসে তমার পাশে বসলো। আঙুল দিয়ে আলতার বোতলের দিকে ইশারা করে বললো,” এটা কী?”

তমা পায়ে আলতা মাখতে মাখতে বললো,”এটা আলতা। তুমি দেবে?”

নাদিয়া ওপর নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মিচের মতামত জানান দিলো। তমা নাদিয়ার ছোট্ট ছোট্ট পায়েও আলতা পরিয়ে দিলো।

আলতা পায়ে তমা বাড়ির এদিক ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। সাদের ছোট চাচী হেরা তো আঙুর বালা আর অনিতার সামনে বলেই ফেললো,” তমা মেয়েটা মাত্রাধিক চঞ্চল! বাড়ির এদিক ওদিক ছুটোছুটি করেই বেড়াচ্ছে! ”

আঙুর বালা হেরাকে ধমক দিয়ে বললো, “বউ মানুষ ঘুরবো ফিরবো খাইবো। ছোট মানুষ! ওর থেইক্যা আর এত কী আশা করো?”

অনিতা আঙুর বালাকে শান্ত করে বললো,” আহা হেরা, এমন ভাবে বলছিস কেন? তমা তো নিজের মতোই আছে। কাউকে বিরক্ত করতে দেখেছিস? বাড়ির বাইরেও তো যাচ্ছে না। নিজের মতোই নিজে ব্যস্ত। ওকে নিয়ে এত ঘামাস না তুই।”

হেরা আর কিছু বললো না। বলেও লাভ নেই। আঙুর বালা কারো কথাই কানে তোলেন না। হেরা সেই স্থান হতে দ্রুত প্রস্থান করলো।

দুপুরে সবাই একত্রে খাবার খেতে বসেছে।তমাও সবার সঙ্গে খেতে বসেছে। অনিতার সবার সামনে তমাকে বললেন,”তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।বলবো বলবো করে ভাবছিলাম। খেয়ালই থাকে না!”

তমা নিচু গলায় জবাব দিলো,” জি, বলুন”

অনিতা ব্যস্ত গলায় বললো,” কালকে সকালে তোমাদের বাড়ি থেকে তোমার বই খাতা সব নিয়ে আসবে। এখানেই পড়াশোনা করবে। দরকার পরলে সাদও তোমাকে টুকটাক সাহায্য করবে। এতদিন অনেক দিয়েছো ফাঁকি। কিন্তু আর না। পড়াশোনা করলেই জীবনে বড় হতে পারবে।”

তমা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, “এ্যা! আমি তো বিয়ে করলাম পড়াশোনা করবো না বলে। এখন আবার পড়তে হবে কেন? এত পড়াশোনা করতে হবে কেন? একদিন তো মরেই যাবো।”

সাদ বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,” এত আচার খেতে হবে কেন? একদিন তো মরেই যাবে!”

তমা অগ্নি দৃষ্টিতে সাদের দিকে তাকালো। আসলেই ছেলেটা বেশি কথা বলে! অনিতা হালকা নিশ্বাস ফেলে বললো, ” এতকিছু আমি জানি না। কাল থেকে আবার পড়াশোনা শুরু করবে। বিয়ে হয়েছে বলে পড়াশোনা বন্ধ করার ভাবনা মাথায় ভুলেও এনো না।”

তমা খাবার টেবিলে মুখ বাঁকিয়ে বসে রইলো। ছাতার মাথা! ভালো লাগে না কিছু!

খাওয়া শেষ করে তমা হাত মুখ ধুয়েমুছে আঙুর বালার ঘরে গেল। আঙুর বালা তমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ” এই ছে/ড়ি এদিকে আয় তো।”

তমা টলমলে পায়ে এগিয়ে গেল। আঙুর বালা তমাকে সামনে থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলো। চিন্তিত গলায় তমাকে বললো,” এই চুড়ি, আলতা এসব তোরে কে দিসে?”

তমা চুল আঙুল দিয়ে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বললো,” যাঁর ইচ্ছে করেছে সে দিয়েছে। তোমাকে এত কথা বলবো কেন বুড়ি?”

আঙুর বালা নিজের হাতে থাকা লাঠি ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,” বুজছি! আমার নাতী দিসে এডি।”

তমা ব্যাঙ্গাত্বক কন্ঠে বললো, “বুঝতেই যখন পেরেছো তখন আবার জিজ্ঞেস কেন করো? না কি হিংসে হয়? আমার তো দেওয়ার মতো মানুষ আছে। তোমারটা তো তাও নেই! একেবারে পটল তুলেছে।”

আঙুর বালা নিজের হাতে থাকা লাঠিটা তমার দিকে তাক করে বললো,”তুই দেখসোস? আমারডা আমারে কত ভালোবাসতো। সারাদিন আমারে চোখে হারাইতো!”

তমা মুখ টিপে হেসে বললো, “ছাই বাসতো ছাই! সেই তো একা রেখে চলেই গেল।”

আঙুর বালা এবার খুব ক্ষেপে গেল। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,” ওই ছে/ড়ি আমারে যদি তোর দাদা ভালোই না বাসতো। তাইলে তোর শশুর তোর চাচা শশুর এডি পয়দা হইসে কইত্তে? বাইচ্চা থাকলে দেখতি তোর আরও কত চাচা শশুর আর ফুপু শাশুড়ী থাকতো!”

চলবে….

#লবঙ্গ_লতিকা
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১২

তমা ঘুম থেকে ওঠা মাত্রই অনিতা তমাকে বই আনতে পাঠিয়েছেন। তমা যেতে চায়নি। অনিতা বহুকষ্টে তমাকে ঠেলেঠুলে বই আনতে পাঠিয়েছেন।

তমা বই নিয়ে ফিরে আসতেই সব বই আঙুর বালার ঘরে রেখে দিতে বললো অনিতা। তমা বইগুলো নিয়ে আঙুর বালার ঘরের এক পাশে রেখে দিলো। সাদ হঠাৎ নিজের ফোন নিয়ে দৌড়ে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে অনিতাকে বললো,” আম্মু! কিছুদিন পর থেকে না কি আমাদের টেস্ট পরীক্ষা শুরু। এখন কী হবে? আমাকে আমার ক্লাসমেট ফোন করো জানালো।”

অনিতা আতংকে আঁতকে উঠলেন। সাথে সাথে নিজের স্বামী মহসীন খানকে ঘর থেকে ডেকে আনলেন। মহসীন সবটা শুনে সিদ্ধান্ত নিলেন কালই নিজ গৃহে ফিরে যাবেন। ছেলের পড়াশোনা নিয়ে তিনি বেশ সিরিয়াস। পড়াশোনার প্রতি তিল পরিমাণ অবহেলাও তিনি সহ্য করতে পারেন না।

আঙুর বালা সবটা শুনে রাগে ফেটে চৌচির! মহসীন খানের সঙ্গে বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে আঙুর বালার। তমাকে কত শখ করে সাদের বউ করে এনেছেন আঙুর বালা। তমাকে না কি এখানেই রেখে যাবে মহসীন। তমাকে শহরে নিয়ে গেলে মা কি সাদ সংসারের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়ে ফেলবে। পড়াশোনার আরো ক্ষতি হবে এতে। আঙুর বালা এসব শুনে নিজ ছেলের ওপর বেশ ক্ষিপ্ত।

সাদের চলে যাওয়ার কথা শুনে সবার মন খারাপ হলেও তমা বেশ খুশি। তাঁর শত্রুপক্ষ কাল বাড়ি থেকে বিদায় হবে। আহা কী শান্তি! কেউ আর তমার পিছু লাগতে আসবে না।

তমা খুশিতে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে গুন গুন করে গান গাইতে শুরু করলো। কিন্তু এই খুশির স্থায়ীত্ব ছিল খুব স্বল্প। সন্ধ্যা হতেই অনিতা তমাকে পড়তে বসিয়ে দিলেন। তমা মুখ ভার করে পড়ার টেবিলে বসলো।

মহসীন রাতে একটা নতুন মোবাইল ফোন নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। টাচস্ক্রীনের মোবাইল ফোন। ফোনটা তিনি তমার জন্য এনেছেন। ওনারা যেহেতু থাকবেন না। তাই তমার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফোনটা কিনে নিয়ে এসেছেন।

তমার হাতে মহসিন খান ফোনটা দিতেই। তমা নেড়েচেড়ে দেখতে শুরু করলো। উল্টে পাল্টে ফোনটা কিছুক্ষন নাড়াচাড়া করেই রেখে দিলো তমা। শফিক ভাইয়ের হাতেও এরকম ফোন ছিল। মাঝেমধ্যে ওটা দিয়ে তমা শফিককে গান শুনতে দেখতো। কানের মধ্যে একটা মেশিন লাগিয়ে ফোনের সাথে জয়েন্ট করেই গান শুনতে হয়।

সকাল হতেই সাদ,অনিতা এবং মহসীন গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। আঙুর বালার বেশ মন খারাপ। ছেলে,নাতী, বউমা সব আজ চলে গেল। বাড়িটা আবার ফাঁকা হয়ে যাবে। মহসীন খান বলেছেন সাদের পরীক্ষা শেষ হলেই আবার এসে ঘুরে যাবেন। তমা তো আজ বেশ খুশি। শান্তি মতো থাকা যাবে একটু।

তমা যতটা শান্তির কথা ভেবেছিল। বাস্তবে তাঁর বিপরীত ঘটলো। মানুষ থাকা সত্ত্বেও পুরো বাড়িটা কেন যেন খুব ফাঁকা ফাঁকা। তমা আলতো পায়ে সাদের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। নাহ! সাদ নেই!

শুন্য ঘর দেখে তমার বুকটা কেন যেন খালি খালি লাগলো। সব আছে তবে কিছুই নেই! তমা ক্রন্দনরত দৃষ্টিতে সাদের ঘরের এদিক ওদিক চোখ ফিরিয়ে দেখলো। ঘরে সবই বিদ্যমান। তবে, সেই নিদিষ্ট মানুষটা ব্যাতীত।
তমা দৌড়ে এক ছুটে আঙুর বালার খাটে গিয়ে আছরে পরলো। শব্দ করে কাঁদতে শুরু করলো। আঙুর বালা কিছু বুঝতে না পেরে তমাকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেন তমার কী হয়েছে? কিন্তু, তমা নিরুত্তর।

বিছানার এক প্রান্তে শুয়ে নিরবে চোখের জল ফেলতে ব্যস্ত তমা। আঙুর বালার তখন সবে মাত্র চোখটা লেগে এসেছে। কারো ফুঁপানোর আওয়াজ শুনে চমকে উঠলেন আঙুর বালা। পাশ ফিরে তাকালেন। পাশে তমা বালিশে মুখ গুঁজে রয়েছে। আঙুর বালা তমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। অচিরেই তমাকে বুকে টেনে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করলেন। আদুরে ভঙ্গিতে বললেন,”এমনে তো আমার নাতী থাকলে কাইজ্জা(ঝগড়া) করস। এহন তো নাই তুই কান্দোস ক্যা আবার?”

তমা প্রতুত্তরে কিছু বললো না। তমার কান্নার আওয়াজ আরো প্রগাঢ় হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। আঙুর বালা তমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”কান্দিস না আর তুই। কালকে আমার ফোনডা দিয়া ওর লগে কথা কইস। আমি কাউরে কিছু কমু না।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here