লাবণ্য_আলোয় #পর্ব_৫

0
276

#লাবণ্য_আলোয়
#পর্ব_৫

অফিসে আজ মোটামুটি কর্মহীন একটা দিন পার করেছি। হাতে কাজ ছিল; কিন্তু মাথার ভেতর সেই একই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আমাকে প্রায় পাগল বানিয়ে ফেলেছে সারাটাক্ষণ। ছোটো খালার কাছ থেকে ঘটনা না জানা পর্যন্ত মনের এই অস্থিরতা কিছুতেই কমবে না। বসকে, শরীর খারাপ লাগার কথা বলে, অফিস থেকে একটু আগে বেরিয়ে খালার বাসায় চলে আসলাম ।
খালার বাসায় ঢুকতেই খালা অস্থির হয়ে উঠল কী খাব না খাব এইসব নিয়ে।
খালার হাতটা ধরে বললাম, “খালা প্লিজ আর টেনশনে রেখো না। লাবণ্য’র বাবার সম্পর্কে অনেক খারাপ ধারণা আসছে মনের ভেতর। আমি আর এই লোড নিতে পারছি না। তুমি আমাকে সবকিছু বলো খালা।”
“কী জানতে চাস বল? তার আগে শান্ত হয়ে বস তো এখানে।”
খালার মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করলাম, “কার বিয়ে ভেঙেছিল, খালা? মা’র?”
“হুম, তোর মা’র।”
“লাবণ্য’র বাবা’র সাথে?”
এক পলক আমার দিকে চেয়ে থেকে খালা বলল, “হুম।”
হায় অদৃষ্ট, এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম আমি!
“বিয়ে ভাঙল কেন?
“ছিল অনেক ঘটনা।”
“তাঁদের মধ্যে কোনো রিলেশন ছিল?”
না, কোনো রিলেশন ছিল না।”
“তাহলে? পারিবারিকভাবে বিয়েটা হচ্ছিল?”
“হুম। আমরা তখন খুলনায় থাকতাম। ছোটন ভাই’রা ছিল আমাদের প্রতিবেশী; কিন্তু ওদের বাসায় আমাদের তেমন যাওয়া-আসা ছিল না। ছোটন ভাই তখন ঢাকা থাকত। ঢাকা কলেজে এম. এ পড়ত বোধহয়। আপা তখন মাত্র এইচএসসি দিয়েছে। একদিন দুপুরবেলা ছোটন ভাইয়ের মা, আমাদের বাসায় এসে হাজির। বলা নেই, কওয়া নেই, একেবারে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব! আম্মা যতই বলেন যে এত ছোটো মেয়ের আমি বিয়ে দেবো না, খালাম্মা, মা’র কোনো কথার পাত্তাই দেন না। যখন-তখন চলে আসেন বাসায়। আম্মা কোনোভাবেই বুঝাতে পারেন না ওনাকে। আম্মা শেষে বললেন, আপনার ছেলেও তো ছোটো। পড়ালেখাই শেষ করেনি। সংসার চালাবে কী করে? খালাম্মার একই কথা, তার খুব শখ এখনই ছেলের বিয়ে দেবেন। টাকাপয়সার তো আর কোনো টেনশন নেই। তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা আছে। ওনার হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য আম্মা বললেন, আপা আপনি মেয়ের বাপের সাথে কথা বলেন। আম্মা ভেবেছিলেন এরপর হয়তো তিনি ক্ষান্ত দেবেন; কিন্তু হলো ঠিক এর উলটো। তিনি একেবারে আয়োজন করে এসে আব্বাকে ধরে বসলেন। তাঁর এক কথা, আপাকে তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। এই মেয়ে তিনি তার বাড়িতে নেবেনই। বিয়ের পরে আপার লেখাপড়ার কোনো ক্ষতি হবে না। ওনার এইরকমভাবে বারবার অনুনয়-বিনয় করার ফলে আব্বাও শেষ পর্যন্ত আর না করতে পারলেন না। মহিলার সত্যি খুব শখ ছিল ছেলের বিয়ে দেয়ার। ওনার ইচ্ছার কারণেই বেশ ঘটা করে এনগেজমেন্ট হয়ে গেল আপা আর ছোটন ভাইয়ের। এনগেজমেন্টের দিনেই আমরা ছোটন ভাইকে ভালোভাবে দেখেছিলাম। আপার বর হিসেবে আমার খুব পছন্দ হয়েছিল ওকে। শুধু আমার না, বাড়ির সবারই ওকে পছন্দ হয়েছিল। ছোটন ভাই অনেক বছর ঢাকায় থাকার কারণে তাকে আমরা সবসময় দেখতামও না। আগে হয়তো দেখেছি দু’একবার তবে সেভাবে খেয়াল করিনি। যে সময়ের কথা বলছি তখন আমি ক্লাস সেভেন এ পড়ি আর রোমেল পড়ে ক্লাস সিক্সে। আপা আর ছোটন ভাইয়ের এনগেজমেন্ট হয়ে গেল। ডিসেম্বরের দশ তারিখে আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার পর ওদের বিয়ের ডেট ঠিক হলো।”
“মা’র মতামত কেউ জানতে চায়নি?”
“শোন আজকে তোরা যত স্বাধীন হয়েছিস, স্বাধীনতার সুযোগও নিয়ে ফেলিস যখন-তখন, এই যে লাবণ্য হুট করে বিয়ে করল, আবার ইচ্ছে হল তো একাই শ্বশুরবাড়ি চলে আসলো, আটাশ-ত্রিশ বছর আগের অবস্থা তো এমন ছিল না। আর আমরা থাকতম মফস্বল শহরে। সেখানে এইচএসসি পেরোনো একটা মেয়ের বিয়ে হওয়া খুবই স্বাভাবিক বিষয় ছিল। তারপরও আব্বা বারবার তোর মা’কে বলেছিল, তুই যদি বিয়ে করতে না চাস তো বল, আমি ওদের না করে দেই।”
“মা না করেননি?”
“না, আপা একবারও না করেনি। ওরও বোধহয় ছোটন ভাইকে ভালো লেগেছিল। তার এতে সায় ছিল বলেই তোর নানা-নানি বিষয়টা এগিয়েছিল।”
“দুই ফ্যামিলির সবাই রাজি ছিল, তাহলে ঝামেলা লাগল কোথায়?”
“হুম, সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। এনগেজমেন্টের পর ছোটন ভাইয়ের মা সবসময় বাসায় আসতেন। আর যখনই আসতেন, বাড়ির সবার জন্য এত্তো এত্তো গিফট নিয়ে আসতেন। কিছু মানুষ থাকে না, যে অন্যকে দিয়ে শান্তি পায়, উনি হচ্ছেন সেই ধরনের। এনগেজমেন্ট এর পরপর ছোটন ভাই ঢাকায় চলে গেল। আবার যখন ফিরল, তখন বোধহয় অক্টোবরের শেষের দিক। সে এসেই ফোন দিয়ে আপাকে দেখা করতে বলল। এদিকে এনগেজমেন্ট হয়েছে ঠিক আছে; কিন্তু বাইরে গিয়ে দেখা করার পারমিশন পাওয়া যাবে না, এটা আপা জানত; কিন্তু ছোটন ভাই প্রতিদিন ফোন করে ঐ একই কথা বলে- একটু আসো, অল্প সময়ের জন্য হলেও আসো।
ছোটন ভাই বারবার দেখা করতে চাচ্ছে বলে আপার মনটাও বোধহয় ছটফট করতে লাগল। ঐ বয়সে এমন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। আপার বান্ধবী ছিল মিলি আপা। মিলি আপার বাসায় যাওয়ার কথা বলে দুবোন মিলে বের হলাম একদিন। শহরের বড় রাস্তার মোড়ে তখন নতুন চাইনিজ রেস্তোরাঁ খুলেছে। ওখানে গিয়ে বসলাম আমরা। জানিস শুভ্র, সেই প্রথম আমরা চায়নিজ রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলাম, চাইনিজ খাবার খেয়েছিলাম।”
“তারপর কী হলো খালা?”
“মোট চারদিন দেখা হয়েছিল আপার সাথে ছোটন ভাইয়ের, আর চারদিনই আমি ছিলাম ওর সাথে। আপার সাথে ছোটন ভাই যখন কথা বলত, মনে হত যেন ওরা কতোদিনের চেনা। ছোটন ভাই অনেক কথা বলত আর আমরা দুই বোন শুধু শুনতাম আর মিটিমিটি হাসতাম। ছোটন ভাই যখন আপাকে বলত, বিয়ের পর ঢাকায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেবে, তখন আমার ভীষণ মন খারাপ হত। আমি তো শেষে চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম, ভাইয়া আমি তো আপাকে ছাড়া থাকতেই পারি না। আমি কী কোনোভাবে ঢাকা যেতে পারি না?”
“তুমি বলেছিলে এই কথা?”
“হুম, বলেছি তো। ছোটন ভাই হেসে বলেছিল, ঠিক আছে, তোমাকেও সাথে নিয়ে যাব। স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো। এরমধ্যে কী হলো, জানিস? চার নাম্বার দিনে আমরা ধরা খেলাম। সেদিন তাবাসসুম আপাদের বাড়ির নাম করে বের হয়েছি। তাবাসসুম আপা হলো তোর মা’র আরেক বন্ধু। তো ঘুরেফিরে রেস্তোরাঁয় খাওয়া শেষে ছোটন ভাই, আমাদের বাড়ির কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমার হাতে শপিং ব্যাগ। ছোটন ভাই আপার জন্য খুব সুন্দর একটা শাড়ি এনেছে। দু’বোন মিলে বাসায় ঢুকেই আম্মা’র জেরার মুখে পড়লাম সেদিন। আম্মা খুব সুন্দর করে হেসে বললেন, এতক্ষণ তাবাসসুমদের বাড়িতেই ছিলি তোরা? আপা ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে। ওর মুখ দিয়ে মিথ্যে বের হয় না। এদিকে সত্য বলার সাহসও নেই। আমি পরিস্থিতি সামাল দিতে অনর্গল মিথ্যা বলে যাচ্ছি, হ্যাঁ আম্মা ওখানেই তো ছিলাম। খালাম্মা কোনোভাবেই ছাড়লেন না আমাদের। জোর করে খাইয়ে দিলেন। আম্মা জিজ্ঞেস করল, দুপুরে ওখানেই খেয়েছিস তো? বললাম, তো আবার কোথায় খাব! জবাব শুনে আম্মা বলল, তাই তো, কোথায় খাবি আর। তাবাসসুমকে নিয়ে আসতি সাথে করে। অনেকদিন হলো মেয়েটা আসে না। আমি বললাম, বলেছিলাম তো আসতে, তাবাসসুম আপা বলল এই সপ্তাহেই আসবে। আচ্ছা। তোর হাতে কী রে ওটা?
ব্যাগটা শেষ পর্যন্ত আম্মার চোখে পড়েই গেল। অবলিলায় বলে দিলাম, এটা তাবাসসুম আপার শাড়ি। আপার শাড়ি পরা ভালো ছবি নেই তো, তাই এনেছি। তাবাসসুম আপা বলেছে ক্যামেরার রিল কিনে রাখতে। পরশু এসে আপাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেবে, তারপর ছবি তোলা হবে। পরশু কেন, আজই তোল না। যা লিলি স্টুডিও থেকে একটা রিল নিয়ে আয়।
তাবাসসুম আপা তো নেই । শাড়ি পরাবে কে? সাজাবে কে? কে বলেছে নেই? আমি এখনই জাদু করে তাবাসসুমকে এখানে আনতে পারব, দেখবি?
আপা তো আগে থেকেই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, এবার আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মা কিছু জেনে যায়নি তো? কেউ এসে কী মা’র কাছে কিছু লাগিয়েছে, আমাদের নামে? আমাকে চুপ থাকতে দেখে মা বললেন, জাদু দেখবি না দীপ্তি? আমি বোকার মতো হেসে মা’র দিকে তাকিয়ে আছি। মা আমার দিকে কটমটে চোখে তাকিয়ে বললেন, এই তাবাসসুম এদিকে আয় তো।
তাবাসসুম আপা আমাদের রুম থেকে বেরিয়ে এল! আমরা দুবোন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম!
সেদিন আম্মা কাছে এসে আমার কানটা ধরে এমন মলা দিয়েছিলেন যে মনে হয়েছিল কানটা বুঝি ছিঁড়ে আম্মার হাতেই চলে এসেছে। কানটা কয়েকদিন টনটনে ব্যথা হয়েছিল। এরপর থেকে মিথ্যে বলতে গেলেই, আম্মার সেই কান মলার কথা মনে পড়ত সবসময়।
আম্মা সেদিন আপাকে বকাঝকা করেননি, শুধু বলেছিলেন, তোর আব্বা শুনলে কষ্ট পাবে, এমন কাজ না হয় না-ই করলি। ছোটো জায়গায় থাকি, লোকজন সবাই সবাইকে চেনে এখানে। কেউ না কেউ তো দেখেছে তোদের । আর কিছু মানুষের কাজই হল, মানুষের নামে খারাপ কথা ছড়ানো। তারা তিলকে তাল বানিয়ে ছাড়ে। এভাবে আর দেখা করতে যাস না মা। আর ক’টা দিনই তো আছে। বিয়ের পর যত খুশি ঘুরে বেড়াস, তখন কারও বলায় কিচ্ছু যাবে-আসবে না।
আপা খুব লজ্জা পেয়েছিল সেদিন। জানিস শুভ্র, তোর মা কিন্তু আব্বা-আম্মার কথা শুনত খুব। তারপর আপা, ছোটন ভাইয়ের সাথে আর একদিনও দেখা করেনি।”
“সবই তো ঠিক ছিল, তাহলে বিয়ে ভাঙল কেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
“ছোটন ভাই খুব অবুঝের মতো করত, জানিস। দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে থাকত। আপা যখন কোনোভাবেই রাজি হল না বাইরে গিয়ে দেখা করতে, তখন প্রতিদিন শেষ বিকেলে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে একবার হেঁটে যেত। সেই সময়টায় আপাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে। আপাও দাঁড়িয়ে থাকত ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ ছোটন ভাইকে দেখা যায়। আমি যদিও বুঝতাম না এত আকুল হয়ে চেয়ে থাকার কী আছে, তবে একটা জিনিস বেশ বুঝতে পারতাম, দুজনের জন্য দুজনের মনে ভালোবাসা দিন দিন বাড়ছিল। ওহো, একটা মজার কথা তো তোকে বলাই হয়নি। রেস্তোরাঁয় আমরা যে ক’দিন গিয়েছিলাম, প্রতিদিনই ছোটন ভাইয়ের গল্পের পরিমান বাড়তেই থাকত। কত গল্প, ঢাকার বাড়িটা কীভাবে সাজাবে, কোথায় বেড়াতে যাবে সেইসব নিয়ে কত তার পরিকল্পনা! পরিকল্পনা ডালপালা মেলতে মেলতে বাচ্চা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। ছোটন ভাই একদিন হুট করে বলল, লাবণ্য তোমার কী ছেলে পছন্দ, না মেয়ে? আপা তো লজ্জায় রাঙা হয়ে, খাওয়া বন্ধ করে মাথা নীচু করে বসে আছে। ছোটন ভাই বোধহয় বুঝতে পারল যে আমার সামনে এমন কথা বলা উচিত হয়নি। বোকার মতো একটা হাসি দিয়ে বলেছিল, না মানে, আমার তো মেয়ে খুব পছন্দ আর আমি মনে মনে একটা নামও ঠিক করে ফেলেছি। আমার মেয়ের নাম রাখব, অনন্যা প্রিয়দর্শিনী হাসান। তুমি লাবণ্য আর মেয়ে অনন্যা। আরে যা, তোকে কী বলতে কী সব বলছি দেখ! আমারও না মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।”
“সমস্যা নেই খালা, তুমি বলো। আমি এখন বড়ো হয়ে গেছি।”
“সেদিন আপা কপট রাগ দেখিয়ে বলেছিল, আমি কিন্তু এক্ষুনি চলে যাব এইসব কথা বললে। ছোটন ভাই হো হো করে হেসে উঠে বলেছিল, আচ্ছা আর বলব না, একেবারে মেয়ে হলে নাম রেখে, ঐ নামে ডাকব, ঠিক আছে। লাবণ্য’র নামটা খেয়াল করেছিস তুই? নামটা কিন্তু ঠিকই রেখেছে শুধু অনন্যার জায়গায় লাবণ্য বসিয়ে দিয়েছে।”
“বিয়ে যদি ভাঙলই তাহলে আমার মা’র নামে ওনার মেয়ের নাম রাখবেন কেন?”
“সেটা আমি কী করে বলব?”
“ঠিক আছে। এরপর কী হল, বলো।”
“শোন সবকিছু যখন ঠিকঠাক চলছিল, বিয়ের কেনাকাটাও শেষ, কার্ডও বিলি করা হয়ে গেছে, ঠিক সেই সময়ে ছোটন ভাইয়ের দাদী আসলেন তাঁদের গ্রামের বাড়ি থেকে। আমার এখনও মনে আছে, আপার গায়ে হলুদের আগেরদিন বিকেলবেলায় ছোটন ভাইয়ের দাদী, আমাদের বাসায় এলেন। সাথে ছোটন ভাইয়ের বোন সীমা আপা, ওর ফুপুসহ আরও কারা যেন ছিল। সব মিলে সাত/আটজন মহিলা এসেছিলেন। আমাদের বাড়িতে তখন দূরের আত্মীয়রা চলে এসেছেন বিয়ে উপলক্ষ্যে। ঘর ভরা লোকজন। বিয়ে বাড়ি, বুঝিসই তো। এত তো আর গোছানো থাকে না। আর ওনারাও কোনো খবর না দিয়েই চলে এসেছেন। দাদীর আর তর সইছিল না, নাতবৌ এর মুখ না দেখা অবধি। উনি ঘরে ঢুকেই আপাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে গেলেন। আপা ওনার সামনে এসে দাঁড়াতেই বললেন, তুমি না, আমার নাতবৌকে সামনে আসতে বলো। সীমা আপা বলল, দাদী এটাই তো আমাদের ভাবী। দাও চুড়িগুলো পরিয়ে দাও। এতক্ষণ অস্থির করছিলে সবাইকে, কখন যাব, কখন বৌয়ের হাতে চুড়ি পরাব। কই বের করো চুড়িগুলো। ছোটন ভাইয়ের দাদী আপার মুখের ওপরই বলে দিলেন, এই মেয়ে দেখে পাগল হয়েছে তোর মা! মেয়ে তো কালো। সীমা আপা বলল, কী বলো দাদী এইসব কথা! লাবণ্য আপুর চেহারাটা দেখেছ? কী মায়াময় চেহারা আর এই রঙ কী কালো নাকি?
দাদী আর কথা বাড়ালেন না শুধু বললেন, তাড়াহুড়ায় এসেছি তো, চুড়ি বাসায় রয়ে গেছে। আজ তো দেখে গেলাম, পরে একসময় এসে হাতে পরিয়ে দেবো। যেমন তাড়াহুড়ায় এসেছিলেন ঠিক তেমনই অস্থির হয়ে চলে গেলেন দাদী। আম্মা, চাচী সবাই কত করে ওনাকে বসতে বললেন; কিন্তু কাজ আছে বলে তিনি তখনই বেরিয়ে গেলেন। ঐ অল্প সময়ের মধ্যেই ওনাদের সামনে কয়েকরকম পিঠা আর মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। সেগুলো ওভাবেই পড়ে রইল। ওনারা কিছু ছুঁয়েও দেখেননি। ওনারা যাওয়ার পর আমার চাচী, খালারা সবাই হৈচৈ বাধিয়ে দিল। ঘরে বয়ে এসে মেয়েকে এভাবে অপমান করে যাওয়ার মানে কী? আমরা কী মেয়ে দিতে চেয়েছিলাম? ছেলের মা’ই তো দিনের পর দিন এসে এসে বিরক্ত করে বিয়েতে রাজি করাল। এদিকে আপা তখন কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। দাদীর এমন কঠিন ব্যবহারে, খুব মন খারাপ করেছে বেচারী। আম্মা যখন দেখল এক কথা, দু কথায় কথা বেড়েই চলেছে, তখন সবাইকে অনুরোধ করল, এই বিষয়ে আর কথা না বলতে। কারণ আব্বা জানতে পারলে আরও একটা ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে। আম্মার কথায় সবাই চুপ হয়ে গেল।”
“এরপর কী হলো খালা?”
“আসল ঘটনা শুরু হল তারপর। রাতে ঐ বাড়ি থেকে খবর পাঠালো, কাল গায়ে হলুদ হচ্ছে না, আর বিয়ের তারিখ নিয়ে পরে আলোচনা হবে। আমাদের এখানে তখন হলুদের সমস্ত আয়াজন শেষ হয়ে গিয়েছিল। এই খবর শুনে আমাদের বাড়িটা যেন মরা বাড়ি হয়ে গেল সাথে সাথে। যারা খবর দিতে এসেছিল, তাদের বারবার জিজ্ঞেস করা হলো, তারা কোনো ভুল করছে না তো? শেষে ছোটো চাচা আর মামা ঐ বাড়ি থেকে আসা লোকদের সাথেই রওনা দিল আসল ব্যাপারটা জানতে। এদিকে আব্বা অস্থির হয়ে আছেন। পুরো বাড়ি পায়চারী করছেন আর বিড়বিড় করে কী সব বলছে। মামা আর চাচা ফিরে এসেও সেই কথাই বললেন। আব্বা কাউকে কোনো কথা না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। আব্বার পিছে খালুকে যেতে দেখে আমি দৌড়ে গিয়ে খালুর হাত ধরে বললাম, আমিও যাব খালু। আব্বা সরাসরি ছেলের বাড়িতে হাজির হলেন। ছোটন ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখি, সেখানেও হট্টগোল চলছে। তাদেরও বাড়ি ভরা বিয়ে উপলক্ষ্যে আসা মেহমানে। আব্বা গিয়ে সরাসরি ছোটন ভাইয়ের আম্মা আর আব্বাকে জিজ্ঞেস করলেন, সমস্যা কোথায়? ছোটন ভাইয়ের আম্মা অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছেন, সেটা ওনার চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছিল। তিনি কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলেন। ছোটন ভাইয়ের আব্বাও খুব ইতস্তত করতে লাগলেন। এমন সময় দাদী এসে বসলেন আব্বার সামনে। কোনো ভনিতা না করে সরাসরি বললেন, এই বিয়েটা হচ্ছে না বাবা। তুমি মনে কিছু নিও না। আব্বা ধমকে বললেন, বিয়ে হচ্ছে না মানে! এটা কী ছেলেখেলা নাকি? আমার মেয়ের জীবন কী কোনো খেলার জিনিস? মেয়ে আমার পছন্দ হয়নি। আমার অনেক আদরের নাতি ছোটন। তার বিয়ে আমি যার-তার সাথে হতে দেবো না। আব্বা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, যার তার সাথে মানে! তাহলে এতদিন গিয়ে বিরক্ত করেছেন কেন আমাদের? আমি তো এত ছোটো মেয়ে বিয়ে দিতে চাইনি। আপনাদের জোরাজুরিতে আমি বাধ্য হয়েছি। এখন সব আয়োজন শেষে, লোক জানাজানি হওয়ার পর বলছেন, মেয়ে পছন্দ হয়নি। ফাজলামো পেয়েছেন? আপনার ছেলে, ছেলের বউ, তাঁরা আপনার পছন্দ জানতেন না? ছেলের বিয়ে নিয়ে তাঁরা আপনার সাথে কথা বলেননি? ছোটন ভাইয়ের দাদী বললেন, যা হয়েছে, সবকিছু ভুলে যাও বাবা। আমার মতের বাইরে এই বিয়ে হতে পারবে না। বিয়ের আসর থেকেও কত বিয়ে ভেঙে যায় আর এখানে তো কিছুই হয়নি। আব্বা অবাক হয়ে বললেন, কিছুই হয়নি! আপনি কী বলেন এইসব? এরপর আব্বা, ছোটন ভাইয়ের আব্বাকে বললেন, আপনার আম্মার কথাই যদি শেষ কথা হয়, তাহলে আপনি তাঁকে না জানিয়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত কেন নিলেন?

চলবে

#ফারজানাইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here