লুকোচুরি,পর্বঃ১
খাদিজা আরুশি আরু
১
“এস.আই. পত্নী জাকিয়াকে ধর্ষণের চেষ্টা, ঘটনাস্থলে ধর্ষণকারী গ্রেফতার” পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার হেডলাইনটার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এস.আই. তন্ময়, ঠোঁটের কোনে তার মৃদু হাসির ছটা, কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকানো। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে তার হাসিটা চোখে পড়বে না, বরং তাকে গম্ভীরই মনে হবে। ছোট সেন্টার টেবিলটার অপর পাশে বসে চায়ের কাপে অনবরত চামচ ঘুরাচ্ছে জাকিয়া। কুঞ্জর আগমনে তাদের দুজনেরই ঘোর কাটলো, তন্ময় কুঞ্জর দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
-“কিছু বলতে চাও কুঞ্জ?”
কুঞ্জ ইতস্তত করে বললো,
-“স্যার, ম্যামকে গতরাতে যে লোকটা ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সে আপনার ক্লাসমেট ছিলো অর্থ্যাৎ পূর্বপরিচিত। তার বয়ান অনুযায়ী সে নির্দোষ, তাকে ফাসানো হচ্ছে…।”
তন্ময় শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে বললো,
-“তাকে ঘটনাস্থলে হাতেনাতে ধরা হয়েছে, জাকিয়া তার বিরুদ্ধে বয়ান দিয়েছে। তাছাড়া, জাকিয়ার বাহুতে তার নখের আঁচড় পাওয়া গিয়েছে, তদন্তের পর সকল প্রমান তার বিরুদ্ধে। এছাড়া জাকিয়ার বাহুতে যে নখের আঁচড় পাওয়া গিয়েছে তার এবং অপরাধীর ডিএনএ ফরেনসিক টেস্টে ম্যাচ করেছে। এরপরও তুমি তাকে করুণার চোখে দেখতে চাইছো কুঞ্জ? জাকিয়ার দিকে তাকাও, মুখটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছে মেয়েটার। গতকাল থেকে কিছু খাওয়াতে পারি নি, তারপরও বলবে ওই জানোয়ারটাকে ছেড়ে দেয়া উচিত? একজন ধর্ষক কোনোকালে আমার ক্লাসমেট ছিলো বলে স্বজনপ্রীতি দেখাতে বলছো?”
তন্ময়ের গলার স্বর চড়ে গেছে, কেমন গা ছমছমে গলার স্বর! কুঞ্জ অপরাধীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর ক্ষীণস্বরে বললো,
-“সরি স্যার, আসলে লোকটা জিজ্ঞাসাবাদের সময় এমনভাবে বললো…”
-“কেইস ক্লোজড কুঞ্জ, আসামীকে কোর্টে তোলার ব্যবস্থা করো। দোষ করার আগে তার ভাবা উচিত ছিলো, এখন ভেবে কি হবে!”
-“জ্বী স্যার।”
কুঞ্জ বেরিয়ে যেতেই জাকিয়া উৎসুক দৃষ্টিতে তন্ময়ের দিকে তাকালো, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরও তন্ময়কে চুপ থাকতে দেখে জাকিয়া নিজেই জিজ্ঞেস করলো,
-“কিছু বলবেন না?”
-“এসব ঘটার ছিলো না জাকিয়া, তোমাকে আমি অনেক আগেই চাকরি ছেড়ে দিতে বলেছিলাম। ওই জানোয়ারটা শাস্তি পেলেও তুমি তো সমাজের চক্ষুশূল হয়ে গেলে। এখন কিছু মানুষ তোমাকে দয়া দেখাবে, আবার কিছু মানুষ তোমারই দোষ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। সমাজের মানুষের আঙ্গুল খুব সহজেই মেয়েদের দিকে ওঠে বুঝলে? এ ঘটনার পর তোমাকে প্রতিনিয়ত ধৈর্য্যের পরিক্ষা দিতে হবে প্রিয়।”
-“আমার ধৈর্য্য সম্বন্ধে আপনার বিন্দুমাত্র ধারনা নেই, এমনটাই তো বলেছিলাম কয়েক বছর আগে পুলিশ স্টেশনে… মনে নেই আপনার?”
-“সবই মনে আছে আমার জাকিয়া, তবে তোমার সঙ্গে এমন কিছু ঘটতে পারে তা জানা থাকলে কখনোই আমি তোমাকে চাকরিটা কন্টিনিউ করতে দিতাম না। শুরুর দিকে আমাকে অন্তত জানাতে পারতে সবটা, আমি হয়তো হেল্প করতে পারতাম। শুরুর দিকে আমি সবটা জানলে কখনোই জল এতোদূর গড়াতে দিতাম না।”
-“অতীতের জন্য মানুষ বর্তমানের বলি চড়ায় না এস.আই. সাহেব। আপনাকে জানালে কখনোই আপনি আমাকে চাকরিটা কন্টিনিউ করে এই রিস্কটা নিতে দিতেন না। যাই হোক সেসব বাদ দিন… তা কি শাস্তি হবে লোকটার, ফাঁসি নাকি যাবজ্জীবন?”
-“তা আমার জানা নেই, আমার কাজ আসামীকে গ্রেফতার করে তাকে কোর্টে চালান করা। কি শাস্তি হবে না ঠিক করবে আদালত। তবে আমার জানামতে শাস্তি তো হবেই…”
-“আমার হাতে থাকলে সে যা করেছে তার জন্য আমি তাকে খুন করতাম।”
-“খুন করা গেলে আরও সাত বছর আগেই সে আমার হাতে খুন হতো জাকিয়া।”
কথাটা বলেই উঠে ভেতরে চলে গেলো তন্ময়। জাকিয়া নিজের চা রেখে উঠে এসে তন্ময়ের ফেলে রাখা চা টা বেশ আয়েশ করে খেলো। আপনমনে বললো, “এস.আই. সাহেব, আপনার প্রশান্তির জন্য এই জাকিয়া সারা গায়ে কাঁদা মাখাতেও রাজি, এ আর তেমন কি”!
২
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে সাংবাদিকরা এসে জড় হয়েছে থানার সামনে, যেখানে একজন এস.আই. এর স্ত্রী’ই নিরাপদ নয় সেখানে সাধারণ মানুষ কতোটা নিরাপদ তা নিয়ে মানুষের মাঝে চাপা গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে। তন্ময় যতোই চেষ্টা করুক খবরটা কোনোভাবেই দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। জাকিয়াকে ঘর থেকে বের হতে মানা করা স্বত্তেও সে বের হয়েছে, প্রেসের সামনে মুখ খুলেছে। ব্যাপারটা নিয়ে তন্ময় জাকিয়ার উপর বেশ ক্ষুব্ধ, তবে মুখে কিছুই বলে নি সে। তন্ময় শান্ত প্রকৃতির মানুষ, তাড়াহুড়া করতে গিয়ে সবকিছু নষ্ট করতে চায় না সে। এতোসব ভাবনার মাঝে একবার জাবেদের সঙ্গে দেখা করার কথা ভুললো না তন্ময়, তন্ময়কে দেখে জাবেদ হাতজোড় করে বললো,
-“তন্ময়, আমাকে ক্ষমা করে দে। এভাবে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমার সংসারটা ভেঙে দিস না, আমি আমার স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসি।”
-“আমিও আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি জাবেদ, তোর জন্য আমার স্ত্রীকে প্রতিনিয়ত মিডিয়ার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তাদের কুরুচিপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে…”
-“আমার কোনো দোষ নেই বিশ্বাস কর, আমাকে তো তোর স্ত্রী নিজের দিকে…”
কথা বলে শেষ করতে পারলো না জাবেদ, তার আগেই তার গালে কষে চড় মারলো তন্ময়। নিজের স্ত্রীর সম্বন্ধে কখনো এরূপ অভিযোগ শুনতে হবে স্বপ্নেও ভাবে নি সে, এতোকিছুর পরও তন্ময়ের দৃঢ় বিশ্বাস তার স্ত্রী কখনো কোনো অন্যায় করতে পারে না। দু’বছরের সংসারে কখনো জাকিয়াকে খারাপ কিছু করতে দেখে নি, নিজেকে যথেষ্ট গুটিয়ে রাখতে জানে সে। সেই মেয়েটা কাউকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করবে এটুকু ভাবা বোকামি…
তন্ময়ের চড় খেয়ে জাবেদ মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলো, এতোক্ষণে মেঝেতে উঠে বসেছে সে, ঠোঁটের কোণে জমা রক্তটা বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মুছে নিয়ে সে বললো,
-“তুই আমাকে ভুল বুঝিস না, আমি জানি আমি একজন খারাপ মানুষ। একসময় অনেক খারাপ কাজ করেছি কিন্তু বিশ্বাস কর, বিয়ের পর আমি কখনো কোনো খারাপ কাজ করি নি। তোর স্ত্রী আমাকে আকৃষ্ট করেছিলো বলেই আমি তার সঙ্গে…”
জাবেদের কোমর বরাবর জোরে লাথি মারলো তন্ময়, জাকিয়া সম্বন্ধে এ জাতীয় কথা হাজার চেষ্টা করেও হজম করতে পারছে না সে। জাবেদ মেঝেতে পড়ে ব্যাথায় কোঁকাচ্ছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই বেরিয়ে এলো তন্ময়। বের হয়ে কুঞ্জকে দেখে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না সে, কুঞ্জ নিজেই বললো,
-“এতোটা অধৈর্য্য হলে চলবে না স্যার, ম্যাম যেভাবে মিডিয়াকে ফেইস করেছে তাতে অনেকটা সাহসের প্রয়োজন হয়, সেখানে আপনি এতোটা ভেঙে পড়লে চলবে? আপনি মাখা ঠান্ডা রাখুন স্যার।”
-“আমি মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছি না কুঞ্জ, জাকিয়াকে নিয়ে যা তা মন্তব্য করা হচ্ছে। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে অনেকেই জাকিয়ার দিকে আঙ্গুল তুলছে, আমার আর সহ্য হচ্ছে না। মেয়েটাকে সুখে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে করেছিলাম আমি…”
-“ম্যাম আপনার সঙ্গে সুখী স্যার, যা ঘটেছে তা কেবলই একটা দুর্ঘটনা। আর আমার বিশ্বাস এ দুর্ঘটনা কখনোই আপনার আর ম্যামের দাম্পত্য জীবনে বাধার সৃষ্টি করবে না।”
-“জাকিয়া একটু অন্যরকম কুঞ্জ, ও হুট করে এতোটা সাহসী হয়ে গেলো কি করে আমি বুঝতে পারছি না।”
-“কিছু কিছু ঘটনা মানুষকে সাহসী বানিয়ে দেয় স্যার, তাছাড়া ম্যাম তো নিজেও একটা সময় একাহাতে নিজের জীবনের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করেছেন। ম্যামকে দুর্বল ভাবাটা ঠিক হবে না…”
কুঞ্জর কথার প্রত্যুত্তরে কিছুই বলে না তন্ময়, চুপচাপ নিজের রুমে ফিরে যায়। তার মাথাটা ধরে এসেছে, জীবনে যখনই সে একটু সুখের খোঁজ পেয়েছে তখনই কোনো না কোনোভাবে তমসাচ্ছন্ন হয়ে গেছে তার সুখের রাজ্য। জাকিয়াকে পাবার পর নিজের জীবনটাকে অন্যরকমভাবে সাজাতে চেয়েছিলো তন্ময়, হঠাৎই যেনো একটা ঝড়ো হাওয়া এসে সব ওলট পালট করে দিলো। কুঞ্জ সবটা যতোটা সহজ মনে করছে আধৌ কি সবটা ততোটা সহজ? তবে তন্ময়ের এতো অস্বস্তি হচ্ছে কেনো!
চলবে..