লুকোচুরি,পর্বঃ২
খাদিজা আরুশি আরু
৩
জাবেদের মাথা এখনো কাজ করছে না, জেলখানার বদ্ধ ঘরে তার দম বন্ধ লাগছে। সাত বছর আগে থানা পুলিশের ঝামেলার ভয়ে এক মধ্যরাতে দেশ ছেড়েছিলো সে, আজ এতোগুলো বছর পর দেশে ফিরে সেই একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে জানলে সে কখনোই দেশে ফিরতো না। তার বিরুদ্ধে ধর্ষনের চেষ্টা করার জন্য মামলা করা হয়েছে, মামলা করেছে তারই খুব কাছের একজন মানুষ। জাকিয়া, নামটা তো তার কাছেরই, বিজনেস ডিল করতে যেদিন জাকিয়ার অফিসে গেলো প্রথম দেখায়ই মনে ধরেছিলো তাকে। মনে হয়েছিলো খুবই সরল একটা মেয়ে সে, তার ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতে বিশেষ দেরী করবে না। কিন্তু তাকে ভুল প্রমান করে বর্তমানে দিব্যি মিডিয়া ফেইস করছে মেয়েটা! প্রথম দেখায় যখন জাকিয়াকে মনে ধরলো তারপরের দিনগুলো ছিলো স্বপ্নের মতো। সংসার করতে করতে যখন মনে বিতৃষ্ণা চলে এসেছিলো তখন জাকিয়াকে বসন্তের দখিনা হাওয়া মনে হয়েছিলো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে জাকিয়া ছিলো কেবলই একটা ঝড়ো হাওয়া, জাবেদই তাকে বসন্ত বাতাস ভেবে পথভ্রষ্ট হয়েছিলো!
পূর্বে অনেক খারাপ রেকর্ড থাকলেও বিয়ের পর এই প্রথম কোনো অন্য নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলো জাবেদ। নিজের স্ত্রীর পর প্রথমবার কাউকে মনেপ্রানে নিজের করে চেয়েছিলো সে। কিন্তু সেই ক্ষণিকের ভালোবাসা তার জীবনে কাল রূপে এলো। বর্তমানে সে একজন ধর্ষক, তার পরিবার তাকে ত্যাগ করেছে, তার স্ত্রী ইতোমধ্যে ডিভোর্সের আবেদন করে দিয়েছে। জাবেদের স্ত্রী মনিকা এমনিতে শান্তশিষ্ট হলেও অন্যায় একদম সহ্য করতে পারে না। সেই স্ত্রী যে জাবেদকে ছেড়ে কথা বলবে না তা আগে মাথায় আসে নি কেনো জাবেদের! ভাবতে গিয়েই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠে তার। একটা মেয়ের আগমন কতো দ্রুত তার জীবনটাকে তছনচ করে দিলো, কি অদ্ভুত! জাবেদ তো কখনো এতো বোকা ছিলো না, তবে জাকিয়ার মোহে বোকা বনে গেলো কি করে!
৪
জাকিয়ার অফিসের এমডি রাশেদুল হাসান ও তার স্ত্রী সেলিনা হাসান এসেছে জাকিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। জাকিয়া বেশ যত্ন করে তাদের জন্য চা বানাচ্ছে, তন্ময় সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চায়ের ট্রে হাতে রান্নাঘর থেকে জাকিয়াকে বেরিয়ে আসতে দেখে তন্ময় এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“ট্রে টা আমার কাছে দাও। তুমি বরং ওনাদের সঙ্গে বসে কথা বলো। সব ঠিক হয়ে যাবে, মন খারাপ করবে না একদম।”
জাকিয়া চায়ের ট্রে তন্ময়ের হাতে দিলো না, নিজেই এগিয়ে গিয়ে রাশেদ আর সেলিনাকে চা নাস্তা দিলো। সেলিনা হাতের ইশারায় জাকিয়াকে নিজের পাশে বসতে বললো, জাকিয়া এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলো। সেলিনা মুচকি হেসে বললো,
-“রাশেদের কাছে তোমার কাজের প্রশংসা বরাবরই শুনেছি, এখন তোমাকে নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেখে মনে হলো তোমার সঙ্গে একটু দেখা করি। আচ্ছা জাকিয়া, এতো সাহস কি করে পেলে বলো তো? আমি নিজেও হয়তো তোমার জায়গায় থাকলে এতোটা সাহস দেখাতে পারতাম না।”
জাকিয়া সেলিনার একটা হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বললো,
-“ম্যাম, আমার ভীষণ কাছের একজনকে একসময় ধর্ষণের স্বীকার হতে হয়েছিলো, সে মানসিকভাবে দুর্বল ছিলো বলে আত্মহত্যা করেছিলো। অবশ্য সে দুর্বল ছিলো, কথাটা ভুল। আমাদের সমাজ তাকে দুর্বল করে দিয়েছিলো। কেইস করতে গিয়ে সে নানা কটু কথার সম্মুখীন হয়েছিলো। বর্তমানে তবুও কিছৃ ব্যাপারে সহযোগিতা পাওয়া যায় পুলিশ আর মিডিয়া থেকে। আপনিই বলুন না ম্যাম, আমি যদি মিডিয়া ফেইস না করতাম তাহলে কি মিডিয়ায় খবরটা ছড়াতো না? নিশ্চয়ই ছড়াতো। মিডিয়া মনগড়া একটা খবর ফলাও করে প্রকাশ করতো। কিন্তু আমি আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা সবার সামনে নিজে থেকে এনেছি, এতে মানুষ আসল সত্যিটা জানতে পেরেছে। আমাকে সাপোর্ট করতে পেরেছে। মানুষের সাপোর্ট পেয়েছি বলেই তো আজ অপরাধী জেলে আছে, তার জামিন হয় নি। আজ যদি আমিও মুখ বুজে সব সহ্য করতাম তবে তো আমাকেও একসময় আত্মহত্যা করতে হতো তাই না ম্যাম?”
সেলিনা মুচকি হেসে বললো,
-“আমি পেশায় একজন উকিল, আমি তোমার হয়ে কেইসটা লড়তে চাই। আমি চাই তুমি তোমার ওই আত্মীয়ের মতো হেরে না যাও, আত্মহত্যার পথ বেছে না নাও। একজন নারী হিসেবে আমি চাই তুমি মাথা উঁচু করে আর পাঁচটা মেয়ের মতোই এ সমাজে ঘুরে বেড়াও।”
-“ম্যাম, আমার হাজবেন্ড আমাকে ওই ঘটনার পর অফিসে যেতে দেয় নি। আমি কি অফিসে যেতে পারি? আপনি কি ওনাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন?”
তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে সেলিনা বললো,
-“মি. তন্ময়, আমার মতে একা বাসায় থাকার চেয়ে অফিসে ব্যস্ত সময় কাটানো জাকিয়ার জন্য বেশি উপযুক্ত হবে। বাসায় একা থাকলেই ঘটনাগুলো তার মন ও মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলবে, আপনি কি বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি?”
-“জ্বী।”
-“তাছাড়া রাশেদ তো আছে, আমার বিশ্বাস জাকিয়ার সঙ্গে যা খারাপ ঘটার ঘটে গেছে। এরপর যা হবে ভালো হবে। ও সাহসী মেয়ে, ঠিক নিজেকে সামলে নেবে।”
-“জ্বী।”
-“তাহলে কাল থেকে জাকিয়া অফিসে যাচ্ছে তাই তো?”
-“জ্বী।”
-“আপনার কিছু বলার নেই মি. তন্ময়?”
এতোক্ষণে তন্ময় সেলিনার দিকে তাকালো, ইতস্তত করে বললো,
-“আমি চাই জাকিয়া সুখী হোক, একটা স্বাভাবিক জীবনযাপন করুক। ইন ফেক্ট ওকে আমি বিয়ে করেছি দুজনে একটু ভালো থাকার জন্য। এসব ঝামেলায় ওকে মানায় না।”
-“এসব ঝামেলায় কাউকেই মানায় না মি.তন্ময়। তবুও তো ঝামেলা পিছু ছাড়ে না তাই না?”
-“জ্বী, তা তো নিশ্চয়ই।”
-“এতো ভাববেন না মি.তন্ময়। সব ঠিক হয়ে যাবে, আপনি কেবল জাকিয়াকে সাপোর্ট দিন।”
-“আমি সবসময়ই ওর পাশে আছি।”
রাশেদ এতোক্ষণ চুপচাপ সেলিনা আর তন্ময়ের কথা শুনছিলো, ওদের কথা শেষ হতেই বললো,
-“আপনার বউয়ের অনেক সাহস বুঝলেন তো এস.আই. সাহেব? নতু্বা জাবেদের মতো ধুরন্ধর লোকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়! আপনি সত্যিই ভাগ্যবান!”
তন্ময় সেলিনার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
-“আপনিও।”
৫
তন্ময়ের সামনে জড়সড় হয়ে বসে আছে একটা অল্পবয়সী মেয়ে, নাম মনিকা। তন্ময়ের দিকে একটু পর পর চোখ তুলে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সে। কয়েকবার চোখাচোখিও হয়েছিলো তাদের। নিরবতা ভেঙে তন্ময় জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান মিসেস জাবেদ?”
-“মনিকা”
ছোট করো জবাব দেয় মনিকা, দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছে ছিলো না তার। জাবেদের জোরাজুরিতে কয়েকমাসের জন্য দেশে এসেছিলো সে। দেশে এসে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে হারাতে হচ্ছে… এ মুহূর্তে তার বদ্ধ ঘরে কান্নারত অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও তন্ময় কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছে না, সে চায় মনিকার যা বলার সে নিজে থেকেই বলুক…
-“আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা করা যাবে?”
মুচকি হাসে তন্ময়, বাঙালী নারীরা যতোই আধুনিক হয়ে যাক আজও স্বামীর নাম মুখে নিতে ইতস্তত করে! সামনে বসা মেয়েটাও হয়তো তাদেরই দলের, অথচ কিছুদিন পরই তার সঙ্গে তার স্বামীর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটবে!
-“জ্বী দেখা করা যাবে।”
-“আমি আসলে ওর সঙ্গে ডিভোর্স নিয়ে কথা বলতে এসেছি। আমি দ্রুত কাজটা সম্পন্ন করে দেশ ছাড়তে চাচ্ছি, এ দেশে আমার দমবন্ধ লাগছে।”
-“আমি আপনার কাছে এক্সপ্লেনেশন চাই নি মিসেস মনিকা…”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মনিকা বললো,
-“একটা প্রশ্ন করবো?”
-“জ্বী করুন।”
-“আমি কি দেখতে অসুন্দর?”
-“এভাবে বলছেন কেনো? যা ঘটেছে তাতে আপনার দোষ নেই…”
-“কাজটা করার আগে ওর একবারও আমার কথা মনে পড়লো না? আমাদের এতো বছরের সংসারের কথা মনে পড়লো না? ও সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম, ওর সঙ্গে থাকলে আমি কখনো মা হতে পারবো না, এ কথাটা জানার পরও আমি তো কখনো অন্য পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হই নি… তবে ও কেনো?”
-“আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি… দেখুন, যা ঘটে গেছে তা তো আমরা বদলাতে পারবো না তাই না?”
-“আপনি আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন না… যার সঙ্গে ঘটনা ঘটে কেবল সে কষ্টটা বুঝে, অন্য কেউ তার কষ্টটা আন্দাজ করতে পারে তবে অনুভব নয়।”
তন্ময় ইতস্তত করে বললো,
-“হয়তো…”
-“আরেকটা প্রশ্ন করি?”
-“জ্বী।”
-“ডিভোর্স হবার পর একজন নারীকে কি সম্বোধন করা হয়? মিস নাকি মিসেস?”
-“আমার জানামতে মিস…”
-“কি অদ্ভুত তাই না? মিস থেকে মিসেস হবার পথটা আনন্দের আর মিসেস থেকে মিস হবার পথটা কতোই না বেদনার…”
তন্ময় এবার ঠিকভাবে লক্ষ্য করলো মনিকাকে, মেয়েটা শান্ত হলেও কথাবার্তায় বেশ ধার আছে… চোখের কোনে জল টলমল করছে, আবার ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্যের হাসি! এ যেনো ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের মানবিক রূপ! কি ভীষণ অদ্ভুত মানব জীবন…
চলবে…