লুকোচুরি,পর্বঃ৩
খাদিজা আরুশি আরু
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মনিকা বললো,
-“তাহলে আমি এবার ওর সঙ্গে দেখা করতে যাই?”
তন্ময় ইশারায় কুঞ্জকে বললো মনিকাকে নিয়ে যেতে। মনিকা যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকালো তারপর তন্ময়ের টেবিলের কাছে দুই কদম এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-“আমি কি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি স্যার?”
তন্ময় বিস্মিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মনিকার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনি জাকিয়ার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন কেনো?”
-“আসলে আমি ইউ.এস.এ এর একটা নিউজ পোট্রালে কাজ করি। ওখানে ওনাকে নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখতে চাই… পৃথিবীতে ফিজিক্যাল হ্যারাসমোন্ট ব্যাপারটা কম বেশি সব দেশেই আছে কিন্তু আপনার স্ত্রীর মতো এর আগে কখনো কোনো ভিকটিম এতোটা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করে নি। আপনার স্ত্রী ইউনিক… এ জাতীয় ঘটনার উপর একটা আর্টিকেল লেখার ইচ্ছে আমার বরাবরই ছিলো, তবে তখন কে জানতো যে আমার স্বামীই আমাকে সে সুযোগ করে দেবে! আমি কি দেখা করতে পারবো ওনার সঙ্গে?”
-“আপনি যাবার সময় কুঞ্জর কাছ থেকে আমার বাসার ঠিকানাটা নিয়ে যাবেন।”
মনিকা কিছুক্ষণ থেমে তন্ময়কে ডাকলো,
-“স্যার…”
চকিতেই মনিকার দিকে তাকালো তন্ময়, মেয়েটার দৃষ্টি স্থির, গলার স্বর কতো শান্ত। কে বলবে এর জীবনে এতো উথাল পাথাল চলছে!
-“বলুন”
-“এতো সহজে আসামী পক্ষকে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিয়ে দিলেন! যদি আপনার স্ত্রীর ক্ষতি করি?”
প্রশস্ত হাসে তন্ময়, টেবিলের ওপরের পেপার ওয়েটটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,
-“পারবেন না… বাড়ির চারপাশে পুলিশের পাহারা আছে। আমার স্ত্রী বলে নয়, একজন ভিকটিম বলে জাকিয়াকে পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া আপনি থানা থেকে ঠিকানা নিয়ে যাচ্ছেন, ওর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ কিছু ঘটলে প্রাইম সাসপেক্ট হিসবে কিন্তু আপনাকেই গ্রেফতার করা হবে। আমার মনে হয় না, কোনো ক্রিমিনাল এতো কাঁচা কাজ করে… এম আই রাইট মিসেস মনিকা?”
প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না মনিকা, কেবল মুচকি হাসে।
৬
জাবেদের শুকনো মুখটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনিকা, কেনো যেনো আজ এ মুখটা দেখে একটুও মায়া হচ্ছে না তার। বরং ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিতে মন চাইছে… আগে তো কখনো এমন হয় নি, অথচ একটা ঘটনা কতো সহজে তাদের মাঝে দেয়াল তুলে দিলো! আচ্ছা, সম্পর্ক কি এতোটাই ঠুনকো!
দীর্ঘ নিরবতার পর জাবেদ বললো,
-“আমাকে দেখে মায়া হচ্ছে না মনিকা?”
-“একজন ধর্ষকের প্রতি মায়া দেখানো মানে ভিকটিমকে অবজ্ঞা করা, আমাকে এতোটা অবিবেচক মনে করো?”
-“আমি কিন্তু জাকিয়াকে ধর্ষন করি নি…”
-“চেষ্টা করেছো, হয়তো সুযোগ পেলে মিথিলার মতো জাকিয়াকেও…”
মিথিলার নামটা শুনে কিছুটা অবাক হয় জাবেদ, জিজ্ঞেস করে,
-“মিথিলার কথা তোমাকে কে বললো? তুমি ব্যাপারটা কি করে জানলে?”
-“কেউ বলতে চায় নি, জোর করে কথা বের করতে হয়েছে।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে জাবেদ বললো,
-“তুমি কিন্তু চাইলে আমাকে এখান থেকে বের করে নিতে পারো, ঘটনাটাকে ধামাচাপা দিতে পারো। তোমার বাবার বাড়ির সে ক্ষমতা আছে।”
মুচকি হাসে মনিকা, বলে,
-“যেমনটা সাত বছর আগে মিথিলাকে রেপ করার পর আমার বাবা তোমাকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলো সেভাবে তাই না? আমি যে তোমাকে বাঁচাতে চাই না জাবেদ… নিজের স্বামীকে বাঁচানো সহজ কিন্তু একজন ধর্ষককে বাঁচানো বড্ড কঠিন। আমি নিজের চোখে ছোট হয়ে যাবো যে…”
একটু থামে মনিকা, হ্যান্ড ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে দু’চুমুক পানি পান করে, তারপর বলে,
-“জানো, যখন বাবার কাছে প্রথম তোমার সম্পর্কে শুনলাম তখন আমি বিয়ের জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না। আমার অন্য পরিকল্পনা ছিলো। আমি বদ্ধপরিকর ছিলাম যে আমি বিয়ে করবো না। আমার না বলা স্বত্তেও বাবা তোমার ছবি আর বায়োডাটা মেইল করলো। দেখবো না, দেখবো না করেও আমি দেখলাম। আর সেই দেখাতেই আমার সর্বনাশ হলো! আমি যেদিন তোমাকে বিয়ে করেছিলাম সেদিনই মরে গিয়েছিলাম জানো? তাইতো আজ তোমার কৃতকর্ম দেখে আমার একটুও অবাক লাগছে না। সাত বছর আগে যে চেহারাটা দেখে পাগল হয়ে বিয়ে করেছিলাম আজ সে চেহারাটার দিকে তাকাতে মনও চাইছে না। ভাগ্য এতো নির্মম কেনো?”
-“আই এম সরি মনিকা।”
-“তুমি শাস্তি পাবে জাবেদ, তুমি শাস্তি পাবে… আজ অবধি তোমাকে আমি কেবল দিয়ে গেছি, আজ একটা জিনিস চাইবো। দিবে?”
-“কি?”
-“উকিল ডির্ভোস পেপার নিয়ে তোমার কাছে আসলে সাইন করে দিবে প্লিজ?”
-“তুমি প্রথমবার আমার কাছে কিছু চাইলে, দিবো না বলছো? একটা সাইনই তো, দিলাম না হয়…”
-“তোমার সঙ্গে দেখা করার কোনো ইচ্ছে ছিলো না জানো? তবুও এলাম, কারন সঙ্গী তোমাকে পুরোপুরি ভুলতে পারার জন্যও একবার ধর্ষক তোমার মুখোমুখি হওয়া খুব বেশি জরুরি ছিলো যে… আমাদের আর কখনো দেখা হবে না জাবেদ, গুড বাই।”
মনিকা দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেলো, জাবেদ মেঝের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
-“ভালো থেকো মনিকা, ভালো থেকো। পারলে এই প্রতারক আমিকে ভুলে যেও… তোমার আগামীর পথচলা শুভ হোক!”
৭
দরজার সামনে মনিকাকে দেখে একটুও অবাক হলো না জাকিয়া, দরজা থেকে সরে মুচকি হেসে বললো,
-“ভেতরে আসুন।”
বসার ঘরের সোফার দিকে হাতে ইশারা করে জাকিয়া আবার বললো,
-“বসুন। কি খাবেন বলুন, চা না কফি? আসলে ফ্লাক্সে করা আছে, আনতে দু’সেকেন্ড লাগবে। পাটিসাপ্টা খাবেন? অফিস থেকে ফিরেই বানালাম, আসলে আমার বরের পাটিসাপ্টা বেশ পছন্দ। দেই আপনাকে দু’টো?”
মুচকি হাসে মনিকা, যেনো সে জাকিয়ার বহু আকাঙ্ক্ষীত অতিথি! সোফায় বসে বলে,
-“আমি কিছু খেতে আসি নি যে ম্যাডাম, আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতে এসেছি। আমার আবার বড্ড তাড়া, বুঝলেন? যতো দ্রুত সম্ভব জাবেদের সঙ্গে ডিভোর্সের ফরমালিটি শেষ করে ওই দেশে ফিরতে হবে।”
জাকিয়া মনিকার কোনো কথা শুনে না, রান্নাঘরের দিকে দৌঁড় দেয়। কয়েক মিনিটের মাথায় ট্রে তে করে পাটিসাপ্টা পিঠা, নানা রকম বিস্কুট, চানাচুর সাজিয়ে ফিরে আসে। ট্রে সেন্টার টেবিলে রেখে মনিকার পাশে বসে সে, মনিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এতো দ্রুত দেশ ছাড়তে চাইছেন কেনো বলুন তো? আমাদের দেশটা কিন্তু মন্দ নয়… হ্যাঁ, একটু অপরাধ, দূষণ এসব আছে কিন্তু এগুলোকে ইগনোর করলে দেখবেন দেশ আর দেশের মানুষ উভয়কেই ভালো লাগবে।”
-“আপনি ভীষণ সুন্দর, জাকিয়া।”
ফিক করে হাসে জাকিয়া, হাসি থামিয়ে বলে,
-“আপনার থেকে কম, আপনাকে দেখলে কোনো অংশে নায়িকাদের থেকে কম মনে হয় না কিন্তু।”
-“নায়িকাদের দেখে মানুষ আনন্দ পায় ঠিকই কিন্তু সহজে কেউ তাদের ঘরে তুলতে চায় না জানেন তো? তারা দৃষ্টির খোরাক হতে পারে, মনের না… তাইতো আমার বর আমার সঙ্গে এতো বছর ঘর করেও অল্প কয়দিনে আপনার বশে চলে গেলো!”
জাকিয়া যেনো চুপসে গেলো, তার এতোক্ষণের উৎসাহ শূন্যোর কৌটায় গিয়ে পৌঁছালো। মিনমিন করে বললো,
-“থাক না সেসব কথা।”
-“আপনার বরটা ভালো বুঝলেন, আজ সকালেই দেখা হলো। আমার দিকে ঠিকঠাক তাকালোও না, যেনো তাকালে আপনাকে ঠকানো হবে!”
-“ও অমনই…”
-“তাহলে আপনি এমন কেনো?”
জাকিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেমন?”
-“এই যে, আপনার এক বরে চলে না! আমার বরকে কি করে বশ করলেন বলুন তো?”
-“আপনি আমাকে অপমান করছেন কিন্তু… আমি আপনাকে ভালো ভেবেছিলাম।”
-“নিজের বরকে রেখে একটা বাইরের মেয়েকে আমি সাপোর্ট করবো বলে আপনি ভাবলেন কি করে? আমি নিশ্চিত আপনিই আমার বরকে ভুলিয়ে নিজের ঘরে এনেছিলেন, কিন্তু যখন দেখলেন বর এসে গেছে তখন গল্প বানালেন? এম আই রাইট মিস জাকিয়া?”
জাকিয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, কর্কশ স্বরে বললো,
-“আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। আপনি নিজে একজন মেয়ে হয়ে আমাকে এসব বলছেন!”
শব্দ করে হাসলো মনিকা, জাকিয়ার হাত টেনে নিজের পাশে বসিয়ে বললো,
-“আপনাকে কেমন ভড়কে দিলাম বলুন তো? আপনার বরকে একদম ভয় পাইয়ে দিলাম তাই না?”
-“মানে?”
-“টিভি স্ট্যান্ডের পাশের ফুলদানীটার ফুলগুলোর মাঝে যে ক্যামেরাটা আছে তা একটু লুকিয়ে দিতে বলবেন আপনার বরকে, কথা বলার সময় বারবার চোখে পড়ছে। ফুলদানীর গায়ে যে লিসেনিং বাগটা ওটারও জায়গা পরিবর্তন করা দরকার বুঝলেন? কথা বলার সময় কেউ হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে যেমন অনুভূতি হয় বর্তমানে আমার তেমন অনুভূতি হচ্ছে বুঝলেন?”
-“দুঃখিত, আমি আসলে এসবের ব্যাপারে জানতাম না।”
মনিকা হেসে বলে,
-“মিথ্যে বলছেন কেনো জাকিয়া? আপনি সব জানতেন। এমনকি আমি আসবো বলে আজ আপনি অফিস থেকে দ্রুত ফিরে নাস্তা বানিয়েছেন। আর আমার আসার খবরটা আপনাকে এস.আই. সাহেব দিয়েছে। কি, ঠিক বলছি তো?”
জাকিয়া ইতস্তত করে উত্তর দেয়,
-“জ্বী।”
-“এতো ইতস্তত করবার কিছু নেই, যা ঘটেছে তা ঘটার ছিলো বলেই ঘটেছে। এসব নিয়ে যতো ভাববো ততোই খারাপ লাগবে, আমার আবার মন খারাপ করে রাখতে ভালো লাগে না। আজ তাহলে উঠি?”
-“আপনি তো কিছুই মুখে দিলেন না…”
-“আসলে খিদে নেই, একটা কাজ করুন আমাকে রেসিপিটা হোয়াটসএ্যাপ করে দিন। আমি জানি আমার নাম্বারটা আপনার কাছে আছে…”
-“আমার বরের কাছে আছে।”
-“আপনার আর আপনার বরের জিনিস কি আলাদা জাকিয়া?”
কিছুই বলে না জাকিয়া, কেবল অপলক মনিকার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনিকাই আবার বলে,
-“আপনার সঙ্গে প্রথম এবং শেষ দেখাটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে জাকিয়া। স্টেটস এ ফিরে গিয়ে আপনাকে নিয়ে আমি নিশ্চিত একটা আর্টিকেল লিখবো দেখবেন…”
-“আপনি সত্যিই আপনার বরকে ডিভোর্স দেবেন?”
-“একজন ধর্ষকের সঙ্গে আর সংসার করতে মন চাইছে না যে…”
চলবে…