লুকোচুরি,পর্বঃ৫
খাদিজা আরুশি আরু
সেলিনা ফরেনসিক রিপোর্টটা পেশকার এর কাছে জমা দিলো। সেলিনা কুঞ্জকে আবার জিজ্ঞেস করলো,
-“মিস জাকিয়ার ঘরে কি কোনো ফোন পাওয়া গিয়েছিলো? মি. জাবেদ যে ফোনটার কথা বলছে…”
-“না, একটা ফোন পাওয়া গিয়েছে তবে তা জাকিয়া ম্যামের ফ্লাটে নয়, মি. জাবেদের অফিসের ব্যাগে।”
মুচকি হাসে সেলিনা, বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“পয়েন্ট টু বি নোটেট ইওর অনার। মি. জাবেদ নিজের অফিস ব্যাগ এ এক্সট্রা ফোন নিয়ে ঘুরছিলেন এবং বর্তমানে দাবী করছেন ফোনটা আমার ক্লায়েন্ট মিস জাকিয়ার কাছে ছিলো এবং উক্ত ফোনে তাদের প্রেমালাপ হতো…”
কথাটা বলে সেলিনা একটা খাম এগিয়ে দেয় বিচারকের পেশকার এর হাতে… তারপর বলে,
-“মি. জাবেদের মেডিক্যাল রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, উনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। হাইপারটেনশন, ডিপ্রেশন, ইনসোমনিয়া এ জাতীয় সমস্যাগুলোতে উনি দীর্ঘদিন ভুগছিলেন। ট্রিটমেন্ট চলছিলো ওনার… ঘটনাটা পানির মতো স্পষ্ট ইওর অনার। মি. জাবেদ যখন প্রথমবার আমার ক্লায়েন্টকে দেখেন তখনই উনি জাকিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হন। তারপর নিজেই দু’টো ফোনে মেসেজে কথা বলে…”
মৃন্ময় বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়, নিভু নিভু স্বরে বলে,
-“অবজেকশন ইওর অনার, আমার ক্লায়েন্ট অসুস্থ হতে পারে তাই বলে সে নিজে এতো বড় গল্প সাজাবে! এটাও কি বিশ্বাসযোগ্য?”
সেলিনা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে, শান্তস্বরে বলে,
-“আমাকে আমার বক্তব্য শেষ করতে দেয়া হোক, আমার প্রতিপক্ষ বন্ধু নিজের ক্লায়েন্টকে বাঁচাতে বেকার কথা বাড়িয়ে আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করছেন।”
বিচারক বললেন,
-“অবজেকশন ওবাররুট, ইউ মে প্রসিড মিসেস. সেলিনা।”
-“ধন্যবাদ। ইওর অনার, খেয়াল করলেই দেখা যায়, মি. জাবেদ নিজে স্বীকার করেছেন যে, আমার ক্লায়েন্টের সঙ্গে তার সরাসরি ফোনালাপ হয় নি। তাদের ম্যাসেজের মাধ্যমে কথা হতো এবং ওনার উপহার দেয়া ফোনের মাধ্যমে কথা হতো। অথচ ফোনটা ওনার অফিস ব্যাগেই ছিলো! পুরো ঘটনার সত্যতা যাচাই এর জন্য আমি আমার ক্লায়েন্ট মিসেস জাকিয়াকে ডিফেন্স বক্সে ডাকার অনুমতি চাচ্ছি।”
বিচারক বললেন,
-“অনুমতি দেয়া হলো।”
জাকিয়া ডিফেন্স বক্সে এসে দাঁড়ানোর পর জাবেদের সঙ্গে তার চোখাচোখি হলো, সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিলো জাকিয়া। সেলিনা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“মিস জাকিয়া, মি. জাবেদ কি আপনাকে কোনো ফোন উপহার দিয়েছিলো?”
-“উনি একদিন হুট করে মিটিং শেষে আমাকে একটা দামী ফোন উপহার দিতে চাইলো, এতো দামী ফোন বহন করার সামর্থ্য আমার নেই। তাছাড়া আমার স্বামীর সঙ্গে আমার যতোই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হোক না কেনো ব্যাপারটাকে কেউই সহজভাবে নিতো না। ভালো জিনিসের লোভ সবারই থাকে, তবুও লোক-লজ্জার ভয়ে আমি উপহারটা প্রত্যাখ্যান করি। এমনকি ওনার সঙ্গে অফিসের বাইরে কখনো আমার কথা হয় নি। যা কথা হয়েছে অফিসের ফোনে, তাও সব অফিসের কথা। উনি কি সব বলছেন, আমার নিজেকে তুচ্ছ মনে হচ্ছে। আমি ওনাকে কখনো কোনো প্রকার ইঙ্গিত দেই নি… ঘটনার দিন আমি আমার স্বামীর জন্য ঘর সাজিয়ে অপেক্ষা করছিলাম, তাকে সারপ্রাইজ দিবো বলে। তাই বেল বাজার সঙ্গে ছুটে গিয়ে দরজা খুলি, কিন্তু ওনাকে দেখে আমি বেশ অবাক হই। ভদ্রতার খাতিরেই ভেতরে এসে বসতে বলি, অন্য সময় হলে ভেতরে আসতে দিতাম না কিন্তু আমার স্বামী সেদিন জলদি ফেরার কথা, তাই সাহস করে ভেতরে আসতে বলি। আসলে কোম্পানীর সঙ্গে তার যে ডিলটা হচ্ছিলো ওটা অনেক বড় একটা ডিল, অনেক টাকার ব্যাপার। আমার দুর্ব্যবহারের জন্য যদি কোম্পানির লস হয়! সে চিন্তা করেই তাকে ভেতরে এসে বসতে বলি। কিন্তু ওই লোকটা ভেতরে ঢুকেই আমার উপর হামলে পড়ে… এখনো ওই ঘটনা মনে পড়লে আমার গা শিউরে উঠে। একটা মানুষ এতোটা নৃসংশ, এতোটা বর্বর কি করে হয়!”
এ পর্যায়ে জাকিয়ার চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। সে কাঁদতে কাঁদতে ডিফেন্স বক্সে বসে পড়লো, একজন মহিলা কন্সটেবল এসে তাকে নিয়ে গেলো। সেলিনা বিচারককে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“আমি মিস জাকিয়ার অফিসের কয়েকজন সহকর্মীকে ডিফেন্স বক্সে ডাকার অনুমতি চাচ্ছি ইওর অনার।”
-“অনুমতি দেয়া হলো।”
পরপর তিনজন সহকমীর বয়ান শোনা হলো, সকলের ভাষ্যমতে জাকিয়ার ব্যবহারে অসংগতিপূর্ণ কিছুই কখনো কারো চোখে পড়ে নি। সে অন্যসব ক্লায়েন্টের মতোই মি. জাবেদকে এটেন্ড করেছে, অভিবাদন জানিয়েছে, তার সঙ্গে হেসে কথা বলেছে। এ ব্যাপারগুলোতে অস্বাভাবিকতা নেই… তবে মি. জাবেদ প্রতিবারই অফিসে আসার পর মিসেস জাকিয়ার কথা জিজ্ঞেস করতো, তার সম্বন্ধে কৌতুহল দেখাতো। এমনকি মিসেস জাকিয়ার বাসার ঠিকানাটা সে কোম্পানী থেকেই সংগ্রহ করেছিলো।
জাকিয়ার সহকর্মীদের বয়ান সংগ্রহের পর সেলিনা বলে,
-“ইওর অনার, দ্য ফ্যাক্ট ইজ ক্রিস্টাল ক্লিয়ার… মি. জাবেদ মানসিকভাবে আনস্টেবল, আর ঠিক সে কারনেই তিনি মিসেস জাকিয়ার সঙ্গে তার করা ঘৃণ্য কাজকে অন্যরকমভাবে অনুভব করছেন। আমি আদালতের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, মি. জাবেদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে তার প্রাপ্য শাস্তি প্রদান করা হোক… দ্যাটস অল ইওর অনার।”
ঘড়িতে ঢং ঢং করে শব্দ হলো। বিচারক আজকের মতো বিচারকার্য স্থগিত করে পরবর্তী তারিখে কেইসের সিদ্ধান্তে আসবেন বলে জানিয়ে দিলেন। মৃন্ময়কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সেলিনা এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“কেমন আছো মৃন্ময়? যখন জানো হেরে যাবে তখন কেইসটা নিলে কেনো? ইটস যাস্ট এ্যা ওপেন ওন্ড শাট কেইস…”
মুচকি হাসে মৃন্ময়, সেলিনার কিছুটা কাছে এগিয়ে এসে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে,
-“সবসময় কি সবাই জেতার জন্য মাঠে নামে সেলি? মাঝে মাঝে কিছু মানুষের সান্নিধ্য অনেক বড় জয়ের তুলনায়ও আনন্দের হয়। আমি এই কেইসটা হাতে না নিলে কখনো কি তোমার মুখোমুখি হবার সুযোগ হতো সেলি?”
সেলিনা কিছুটা অপ্রস্তত ভঙ্গিতে পিছনে সরে যায়, মৃন্ময় তার ঠোঁটের কোণে বিদ্যমান হাসিটাকে ধরে রেখে বলে,
-“আমায় যেমন রেখে গেছিলে তেমনই আছি সেলি, একটুও বদল আসে নি বিশ্বাস করো। অবশ্য বয়সটা একটু বেড়েছে বৈকি… তা, তোমার সংসার কেমন চলছে? রাশেদ তোমায় ভীষণ ভালোবাসে তাই না?”
-“আই এম হ্যাপি উইথ মাই হাজবেন্ড।”
-“সেলি, সবসময় টাকার কাছে ভালোবাসা হেরে যায় কেনো বলো তো? আজ আমার কাছে টাকা আছে, সুনাম আছে, প্রভাব প্রতিপত্তি আছে, অথচ তুমি নেই… কেনো বলোতো?”
-“সব একত্রে আশা করো কি করে মৃন্ময়? সবাই সবকিছু একত্রে পায় না তো…”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মৃন্ময়, আগের মতোই হাসিমুখে বলে,
-“মিথ্যা সান্তনা কেনো দিচ্ছ সেলি? যদি এমনটাই হবে তবে রাশেদ কেনো তোমাকে পেলো?”
চকিতে মৃন্ময়ের হাসি মুখটার দিকে তাকালো সেলিনা, ঠিক যেনো কলেজ জীবনের সেই মৃন্ময়… সেলিনা এক মুহূর্তের জন্য বাকরূদ্ধ হয়ে গেলো, সে তার জীবনের খেই হারিয়ে ফেলছে যেনো! এইতো অতীত ভুলে সুখে সংসার করছিলো সে, আজ হঠাৎ মানুষটার বলা কয়েকটা বাক্য তার ভেতরটাকে এতোটা প্রবলভাবে নাড়িয়ে দেয় কি করে! তবে কি অতীত মনের কোনে ঘাপটি মেরে বসে ছিলো? সুযোগ খুঁজছিলো স্বাধীন বিহঙ্গের মতো রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিচরন করার! মুহূর্তে সেলিনার চোখের সামনে মৃন্ময়ের হাসিমুখটা ঝাপসা হতে থাকে, টলতে টলতে কোর্ট রুম থেকে বের হয়ে যায় সে। কোর্ট রুমের সামনে তন্ময়কে দেখে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয় সে। হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে,
-“ইজ এনিথিং রং মি. তন্ময়?”
-“বাইরে সাংবাদিকদের একটা টিম আপনার আর জাকিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চায়। এখনই তাদের কোনো আপডেট দেয়া কি ঠিক হবে?”
-“কেইসের ফলাফল ইতোমধ্যে আমরা জানি। সুতরাং একটা ছোটখাট ইন্টারভিউ দেয়াই যায়… আমি যাচ্ছি, আপনি জাকিয়াকে নিয়ে আসুন।”
মুচকি হেসে যাবার জন্য সামনে পা বাড়ায় সেলিনা। তন্ময় অবাক দৃষ্টিতে তার যাবার পথে তাকিয়ে থাকে, এই মানুষটাই কিছুক্ষণ আগে অতীতের স্মৃতিরোমন্থন করে আবেগী হয়ে উঠেছিলো অথচ এখন কতোটা নির্ভিক, নিঝঞ্ঝাট! মানুষ ঠিক কতোটা প্রফেশনাল হলে আবেগ অনুভূতির জলাঞ্জলি দিতে পারে তন্ময়ের বুঝে আসে না! একটা গোল পৃথিবী, তাতে নানা প্রকারের অনুভূতির মানুষের বাস! পৃথিবী সত্যিই বড় বিচিত্র!
চলবে…