লুকোচুরি,পর্বঃ৬
খাদিজা আরুশি আরু
আদালত থেকে বের হয়েই সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো সেলিনাকে… সাংবাদিকদের মধ্য থেকে একজন প্রশ্ন করলো,
-“আজকের শুনানির পর কেইসের আপডেট কি? একজন এসআই এর স্ত্রী যদি নিজের ঘরে নিরাপদে না থাকতে পারে তবে সাধারন মানুষের নিরাপত্তা কোথায়?”
সেলিনা তার দাম্ভিক হাসিটা ঠোঁটের কোনে ফুটিয়ে তুলে গমগম স্বরে বললো,
-“কেইসের চুড়ান্ত ফলাফল না আসা পর্যন্ত আমরা মিডিয়ার সামনে কোনো প্রকার অভ্যন্তরীন খবর প্রকাশ করতে পারছি না বলে দুঃখিত। আমি শুধু এটুকুই বলবো, আমি ভিকটিমকে ন্যায় পাইয়ে দেবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।”
দ্রুত সাংবাদিকদের ভিড়টা পার হয়ে গাড়ীতে উঠলো সেলিনা, লুকিং গ্লাসের দিকে চোখ পড়তেই দেখলো মৃন্ময় একটু দূরে গাড়ির পেছনদিকটায় দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। সেলিনার এতোক্ষণকার আত্মবিশ্বাস হঠাৎ হাওয়া মিলিয়ে গেলো, মৃন্ময়ের চোখের দীপ্তি ওর চোখে বিঁধছে! ইশ, মানুষ আরো কয়েকবছর আগে কেনো এই সফলতা পেলো না? যদি পেতো তবে তো তার সঙ্গে সেলিনার… আর ভাবে না সেলিনা। একটা আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে যায়। কথায় আছে, মানুষ যা চায় তা পায় না আর যা পায় তা চায় না। সেলিনা আজ নিজের জীবন দিয়ে সে সত্য উপলব্ধি করলো। সাঁ করে গাড়িটা একটানে আদালতের বাহিরে নিয়ে যেতে লাগলো সেলিনা, সঙ্গে পেছনে ফেলে গেলো হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা সেই প্রথম প্রেম মৃন্ময় কে…
সাংবাদিকরা যখন সেলিনার গাড়ীর পিছু নিতে ব্যস্ত তখন তন্ময় খুব সাবধানে জাকিয়াকে গাড়ীতে তুলে দিলো। ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ী স্টার্ট দিতে দিতে বললো,
-“জাবেদকে দেখে তোমার ভয় করে নি জাকিয়া?”
জাকিয়া শান্তস্বরে জবাব দিলো,
-“না, ঘৃণা হচ্ছিলো।”
তন্ময় চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“আজকাল আমার সঙ্গে এতো মেপে মেপে কথা বলো কেনো জাকিয়া? আমি কি তোমার শত্রু?”
-“আপনি আমার স্বামী। মানুষের জীবনে এমন অনেক কথা থাকে যা আমরা চাইলেও সামনের মানুষটাকে বলতে পারি না, অথচ দূরের একজন মানুষ যাকে আমরা ঠিকমতো চিনিই না তাকে অনায়াসে বলে ফেলি। কি অদ্ভুত তাই না?”
-“কি বলতে চাইছো জাকিয়া? আমি বুঝতে পারছি না।”
-“জরুরি নয় যে আমার সব কথা আপনাকে বুঝতে হবে। একটা অনুরোধ করবো, রাখবেন?”
-“রাখবো।”
মুচকি হাসে জাকিয়া, বলে,
-“না শুনেই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন? যদি পরে রাখতে না পারেন তখন?”
-“প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ক্ষতিপূরণ দেবো তবে…”
-“মন ভাঙলে তার শব্দ শোনা যায় না জানেন তো? তেমনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না এসআই সাহেব।”
তন্ময় কিছু বলে না, নিরবে হাসে। জাকিয়াই আবার বলে,
-“আপনার ওয়ালেটে মিথিলার ছবির পাশে আমার একটা ছবি রাখবেন? আমি তো আপনার স্ত্রী…”
কথাটা বলেই যেনো কোনো অপরাধ করেছে এমনভাবে মাথাটা নুইয়ে ফেলে জাকিয়া। তন্ময় গাড়ী চালাতে চালাতেই নিজের ওয়ালেটটা জাকিয়ার হাতে দেয়। ওয়ালেট খুলে জাকিয়া দেখে মিথিলার ছবির জায়গায় ওর আর তন্ময়ের বিয়ের একটা ছবি মিনিমাইজ করে রাখা, মিথিলার চিঠিটাও কোথাও নেই… অবাক হয়ে জাকিয়া প্রশ্ন করে,
-“মিথিলাকে আপনি আমার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তন্ময়। মানুষটা নেই বলে তাকে করা প্রতিশ্রুতির কোনো মূল্য থাকবে না? আপনার জীবনে আমি এলাম বলে তার সব স্মৃতি মুছে দেবেন…”
তন্ময় একটা ফ্রেম এগিয়ে দেয় জাকিয়ার দিকে। বলে,
-“কাগজের চিঠি, ভাজে ভাজে ছিঁড়ে যাচ্ছিলো যে… আমি তো মিথিলাকে হারাতে চাই না, তাই বাঁধাই করে নিলাম। আমি যদি এটা আমার স্ট্যাডি রুমে ঝুলিয়ে রাখি তুমি কি খুব রাগ করবে?”
-“আমি রাগ করবো না।”
-“কেমন হয়েছে বাঁধাই করা?”
-“সুন্দর, কিন্তু ছবিটা…”
-“জাকিয়া, মাটির ভিটে লেপা দেখেছো কখনো? মানুষ নতুন মাটি দিয়ে ভিটে লেপে কিন্তু তাতে কিন্তু পুরোনো মাটিটা সরে যায় না। সে তার জায়গায় অটল হয়ে অবস্থান করে। মিথিলার ছবিটা আগের জায়গায়ই আছে কেবল তার উপর নতুন একটা ছবি স্থান পেয়েছে। ঠিক যেমন পুরোনো মাটির ঘর লেপার সময় নতুন মাটির প্রলেপ পড়ে তেমন…”
জাকিয়া দেখলো তাদের ছবির নিচে মিথিলার ছবি রাখা। মুচকি হাসলো সে, এতোক্ষণ মনের মধ্যে যে অপরাধবোধ জেগে উঠেছিলো তা হঠাৎ মিলিয়ে গেলো। সিগন্যালের ওপাড়ে মনিকাকে ফুটপাত ঘেষে হেঁটে যেতে দেখে জাকিয়া বললো,
-“আমাকে এখানে নামিয়ে দেবেন তন্ময়?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জাকিয়ার দিকে তাকায় তন্ময়। জাকিয়া হাতার ইশারায় মনিকাকে দেখিয়ে বলে,
-“ওনার মনটা ভালো নেই মনে হচ্ছে। একটু কথা বলতাম আরকি… আপনার সামনে তো কথা বলতে ইতস্তত করবে।”
-“তাহলে সিগন্যাল ক্রস করে তারপর রাখি?”
-“যদি হারিয়ে ফেলি? নেমে যাই আমি? আপনি সরাসরি থানায় যান…”
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায় তন্ময়। গাড়ী থেকে নেমে সিগন্যাল পার হয়ে দ্রুত পায়ে মনিকার কাছে যায় জাকিয়া। দূর থেকে তন্ময় তাকিয়ে দেখে তার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে… তন্ময় ভাবে, এই মেয়েটার সঙ্গে ঘটনাচক্রে দেখা না হলে হয়তো আজ সে এতোটা মনখুলে কথা বলতে পারতো না, মিথিলার স্মৃতি বুকে করে প্রতিনিয়ত ধুঁকে ধুঁকে মরতো… আজ জাকিয়ার চোখে তার জন্য যে ভালোবাসা দৃশ্যত হয়েছে পূর্ব তা কখনো দৃষ্টিগোচর হয় নি কেনো ভেবে পায় না তন্ময়। সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে, তন্ময় গাড়ী স্টার্ট দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলে, “আমার জীবনে তুমি না এলে আমি হয়তো আজও অতীতের স্মৃতিঘেরা দুঃখসাগরে ভেসে ভেসে বেড়াতাম, আমাকে দুঃখসাগর থেকে টেনে তুলে সুখসাগরে সাঁতরে বেড়ানোর সুযোগ করে দেয়া একমাত্র লাইফ সাপোর্ট তুমি জাকিয়া…”
৯
গাড়ীটা রাস্তার একপাশে পার্ক করে রমনার ভেতরে প্রবেশ করলো সেলিনা। হাঁটতে হাঁটতে একটা বেঞ্চে বসে পড়লো… রমনা লেকের পানির দিকে তাকিয়ে আক্ষেপের হাসি হাসলো। সে তার জীবনে বড্ড বেশিই সুখী, তবুও আজ মনে হচ্ছে কোথাও কিছু একটা নেই… সুন্দর করে কাটা ঘাসগুলোর দিকে তাকিয়ে অতীতের স্মৃতিতে আকণ্ঠ ডুব দেয় সেলিনা।
এমনই গোধুলি রাঙা দুপুরের তপ্ত রোদে একটুখানি ছায়ার আশায় সেলিনা, মৃন্ময় আর রাশেদ রমনায় এসে বসেছিলো সেদিন… অবশ্য প্রায়ই আসতো ওরা এখানে, কিন্তু সেদিনটা ছিলো ওদের শেষ দেখা। তিনজনই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। হঠাৎ রাশেদ সেলিনার হাত নিজের হাতে নিয়ে বললো,
-“সেলিনা, তোর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। আন্টি আংকেলের কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু তোকে জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছেন না ওনারা। তাই আমিই সাহসটা দেখালাম। বিয়ে করবি আমায়?”
সেদিন সেলিনা কিছু বলতে পারে নি, কেবল মৃন্ময়ের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকাই ছিলো যেনো তার একমাত্র কর্ম। বাবা-মা তাকে অনেক আগে থেকেই বিয়ে দিতে চাইছিলো, কিন্তু তার ইচ্ছে নেই বলে বাসার কেউ আর জোর করে নি। ভেবেছিলো রাশেদের ক্ষেত্রেও না বলা সহজ হবে, কিন্তু বাসায় পৌঁছাবার পর দেখলো ব্যাপারটা খুব বেশিই জটিল রূপ ধারন করেছে। একসময় পারিবারিক চাপে বিয়েতে মত দিতে বাধ্য হয় সেলিনা, সেদিন মৃন্ময়কে ফোন দিয়ে বলে,
-“রাশেদের বাবার অনেক টাকা বুঝলে তো মৃন্ময়? আমি ভালো থাকবো, আমার সংসার দেখে বাবা-মা নিশ্চিন্তে থাকবে।”
কথাটা বলার সময় সেলিনা ভেবেছিলো মৃন্ময় বলবে, “তুমি আমার কাছে চলে এসো, আমরা ঠিক সুখে থাকবো।” কিন্তু কিছুই বলে নি মৃন্ময়, কেবল ফোনটা কেটে দিয়েছিলো। তারপর আর ওই নাম্বারটা কোনোদিন খোলা পায় নি সেলিনা, আর দেখাও হয় নি কখনো। হয়তো ইচ্ছে করেই সেলিনার সামনে আসে নি মৃন্ময়। বিয়ে হলো, সংসার হলো, ভুলেই তো গিয়েছিলো মৃন্ময়কে… আজ হঠাৎ এতো বছর পর কিসের আশায় সেলিনার সামনে এলো সে? আচ্ছা, সেলিনা-রাশেদ কি সত্যিই সুখে আছে? আইন বিভাগে পড়ে বাবার ব্যবসা সামলাচ্ছে রাশেদ… টাকার অভাব নেই, কিন্তু কোথাও কি নিজের পছন্দের পেশা বেছে নেয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবার আক্ষেপ নেই? সেলিনা নিজের পছন্দের পেশা পেয়েছে, তাকে ভালোবাসে এমন বর পেয়েছে, বড় ঘর পেয়েছে, তবুও কেনো একটা চঞ্চল হাসি তাকে বড় বেশি টানে? মৃন্ময় কোর্ট রুমে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, “রাশেদের কিসের অভাব?” সেলিনা প্রশ্নটা এড়িয়ে গেছে, কারন সে জানে রাশেদের যে অভাব তা তারই জন্য… সেলিনা বিড়বিড় করে বলে, “রাশেদের একটা বাচ্চার অভাব। আমি কখনো মা হতে পারবো না মৃন্ময়, রাশেদ কোনোদিন বাবা ডাক শুনতে পারবে না কেবল আমার জন্য… তোমার একাকিত্ব, রাশেদের বাবা না হতে পারা, সবকিছুর জন্য আমি দায়ী, কেবলই আমি!”
চলবে…