লুকোচুরি,পর্বঃ৭ শেষ
খাদিজা আরুশি আরু
১০
মনিকার গা ঘেষে হাঁটছিলো জাকিয়া, অন্যমনষ্ক থাকায় প্রথমে খেয়াল করে নি মনিকা। খেয়াল করতেই থমকে দাঁড়ালো, তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-“পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ বস্তু কি বলুন তো? ভালোবাসা? আমার এতোদিন এটাই মনে হতো জানেন? তবে আপনাকে দেখার পর মনে হলো যদি তা’ই হবে তবে আপনি এতো সহজে কি করে পেয়ে গেলেন!”
জাকিয়া কিছুই বললো না, কেবল ঘনঘন চোখের পলক ফেললো। মনিকা নিজেই আবার বললো,
-“বেশ রোদ পড়েছে বুঝলেন? চলুন কোথাও একটা বসি। নিউ মার্কেটের ভেতরে বেশ কয়েকটা খাবার দোকান আছে। ফিরে যাবার আগে আমার স্বামীর মনের মানুষকে একটা ট্রিট দিয়ে গেলে মন্দ হয় না বলুন…”
কথাটা বলে হাঁটতে শুরু করলো মনিকা, জাকিয়াও তার পিছু পিছু এগোতে লাগলো। ওভারব্রিজে ওঠার সময় জাকিয়ার ওড়নার কোনা ব্রীজের ভাঙ্গা সিঁড়িতে আটকে গেলো, মনিকা তা ছোটাতে ব্যস্ত হলো। ওড়নার কোনাটা হাতে ধরা অবস্থায় মুচকি হেসে বললো,
-“রাস্তা থাকা সত্ত্বেও মানুষ চলাচলের জন্য ব্রিজ কেনো বানায় জানেন? যেনো মানুষ নিরাপদভাবে চলাচল করতে পারে। বৈবাহিক সম্পর্কটাও এমন জানেন? সেখানে মন থেকে মনের যাতায়াতের জন্য কেবল রাস্তা হলে চলে না। নিরাপদ ব্রিজ গড়তে হয়। আপনি আপনার স্বামীর সঙ্গে সে ব্রিজ গড়তে পেরেছেন বলেই আপনি এতো সুখী আর আমি সে ব্রিজটা গড়তে পারিনি বলে আজ একাকি, একা! জানেন, আমার সব আছে। টাকা, বাড়ি, গাড়ী, সব… কিন্তু দিনশেষে আমি যখন রাতে ঘুমোতে যাই তখন দু’চোখে শান্তির ঘুম নামে না। বড্ড বেশি একা লাগে। আজ যখন জাবেদ আপনাকে ভালোবাসে বলে ভেঙ্গে পড়ছিলো তখন আমি ওর দিক থেকে আপনার দিকে অগ্রসর হওয়া সেই অদৃশ্য ব্রিজটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। এতোগুলো বছর আমরা একত্রে ছিলাম অথচ আমি ওকে আমার জন্য এতোটা কাতর হতে কখনো দেখি নি, আমাদের মাঝের দুরত্বটাকে বিলীন করতে একটা ব্রিজ গড়তে পারি নি।”
জাকিয়া ইতস্তত করে বললো,
-“আমি সত্যিই দুঃখিত মিস মনিকা। আমার জন্য আপনি কষ্ট পাচ্ছেন। তবে আমার বিশ্বাস, এবার আপনার জীবনে যা ঘটবে তার সব ভালো হবে। বিগত বছরগুলোতে আপনি একটা মিথ্যে সম্পর্কের জালে জড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু বর্তমানে আপনি মুক্ত, স্বাধীন। এখনো দেরী হয় নি, আপনি চাইলেই নতুন করে শুরু করতে পারেন।”
পেছন থেকে এক মহিলা রাগান্বিত স্বরে চেঁচিয়ে বললো, “সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কিসের কথা? জলদি যান…” মহিলার তাড়ায় জাকিয়া আর মনিকা দুজনই দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওভারব্রিজে উঠে গেলো। মনিকা অপ্রস্তুত হেসে বললো,
-“ইস, মানুষের কতো তাড়া… দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ নেই।”
জাকিয়া মুচকি হাসলো, বললো,
-“আসলে এ জায়গাটাই এমন, আপনি অনেক বছর পর দেশে এলেন তো তাই অপ্রস্তুত হচ্ছেন।”
-“আপনি বুঝি প্রায়ই আসেন?”
-“আসলে আমার স্বামী আর আমি টুকটাক জিনিসপত্র কিনতে প্রতিমাসেই আসি।”
-“দুজনে একত্রে সংসারের বাজার করতেও অনেক আনন্দ তাই না?”
জাকিয়া মিষ্টি হেসে বলে,
-“সংসারটাতো দুজনের, তবে ভারটা একজনের উপর দেই কি করে বলুন? সব দায়িত্ব যদি একজনের উপর পড়ে তবে তো সংসারটা তার কাছে বোঝা মনে হবে। স্বভাবত মানুষ একই বোঝা বেশিদিন বইতে চায় না, পালাই পালাই করে। তাইতো সব দায়িত্ব দুজনে ভাগ করে নিয়ে পরস্পরের পালানোর সুযোগটা চিরতরে শেষ করে দিচ্ছি…”
মনিকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-” আপনার সঙ্গে আমার আগে দেখা হলো না কেনো বলুন তো? তবে তো আমিও জাবেদের পালানোর সুযোগটা শেষ করে দিতাম। আমাদের মধ্যকার ব্রিজটাকে শক্ত হাতে যত্ন করে গড়ে তুলতাম…”
-“কিছু ব্রিজ হয়তো কখনো না গড়ে উঠাই উত্তম! অতীত ভুলে যান। জীবন সুন্দর, সেখানে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার নিকষ কালো ছায়া পড়তে না দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। বর্তমানে বাঁচুন, ভবিষ্যত নিয়ে ভাবুন…”
মনিকা বিড়বিড় করে বললো,
-“আমি তো বুদ্ধিমান হতে চাই নি, এই আমি তো বোকাই ভালো…”
১১
আদালতের পরবর্তী সুনানির দিন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ৯ নম্বর ধারায় জাবেদকে আদালত সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও পঞ্চাশ হাজার টাকার অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত করেছে।
ডিভোর্সের যাবতীয় কাজ শেষ করে মনিকা ইউএসএ ফিরে গেছে, সে আর কখনো এদেশে ফিরতে চায় না। ফিরে যাবার আগে জাকিয়া আর তন্ময়ের সঙ্গে দেখা করতে ওদের ফ্লাটে এসেছিলো মনিকা। তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,
-“পৃথিবীর সব পুরুষ যদি আপনার মতো হতো তবে হয়তো কোনো মেয়েকে মিসেস থেকে মিস হতে হতো না।”
তন্ময় মুচকি হেসে বলেছিলো,
-“পৃথিবীর সব মেয়ে যদি জাকিয়ার মতো ভালোবাসায় বাঁধতে জানতো তবে এতো সংসার ভাঙতো না। আমার হাতে কিছুই নেই, সবটা আমার ঘরণীরই হাতে…”
মনিকা আর কিছু বলতে পারে নি, কেবল তার আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিলো!
মামলার রায় আসার এক মাস পর জাকিয়া গিয়েছিলো জাবেদের সঙ্গে দেখা করতে, জাকিয়াকে দেখে জাবেদ শান্তস্বরে প্রশ্ন করেছিলো,
-“তুমি কি জানো, তন্ময় তোমাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছে?”
জাকিয়া মুচকি হেসে বলেছিলো,
-“এস.আই. সাহেব এমন একজন মানুষ যে নিজেকে উজাড় করে অপর পক্ষের মানুষকে ভালোবাসতে জানে। মানুষকে ব্যবহার করা তোমার কাজ, আমার স্বামীর নয়।”
জাবেদ চেঁচিয়ে বলেছিলো,
-“তুমি আমাকে তন্ময়ের কথায় ফাঁসাও নি? মিথ্যে বলে লাভ নেই জাকিয়া… আমি জানি, তুমি যা করেছে মিথিলার ঘটনার প্রতিশোধ নিতে করেছো এবং তন্ময়ের কথাতেই করেছো। বলো আমি যা বলছি সব মিথ্যে…”
জাকিয়া মুচকি হেসে বলেছিলো,
-“তোমার আর মিথিলার ঘটনাটা আমাদের বিয়ের আগেই তন্ময় আমাকে বলেছিলো, আমি একসময় সবটা ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু একদিন হঠাৎ তোমার ফেইজবুক আইডিটা আমার নিউজফিডে চলে আসে, হয়তো সে দিনটাই তোমার জীবনের সবচেয়ে বাজে দিন ছিলো।”
-“মানে?”
-“তোমার আইডিতে ফিমেল ক্লায়েন্টদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ছবিগুলো আমার চোখে কাটার মতো বিঁধছিলো, মনে হচ্ছিলো এতো বছরেও তোমার চরিত্র বদলায় নি। তারপর তোমার স্ত্রী মনিকার আইডি খুঁজে বের করি আমি, তার আইডিতে তোমাকে নিয়ে পোস্ট দেখে আমি আমার অতীত যেনো চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। হাসিবকে আমার অন্ধ বিশ্বাস করা এবং ওর আমাকে প্রতিনিয়ত ঠকানো যেনো তোমার আর মনিকার সম্পর্কে স্পষ্ট ছিলো। আমি মনস্থির করলাম, তোমাকে তোমার জালেই ফাঁসাবো, মনিকার মতো ভালো মেয়েকে এই মিথ্যা সম্পর্ক থেকে বের করে আনবো।”
-“আমার জাল!”
-“হ্যাঁ, তোমার জাল। তোমার দুর্বলতা মেয়েমানুষ, যেই আমি মেইল করলাম সেই তুমি দেশে ফিরতে রাজি হয়ে গেলে! ভাবলেও না, তোমাকে কেউ ফাঁসাতে পারে… আমাকে দেখেই গলে গেলে? আমার স্বামী কে জানতেও চাইলে না! এতো অস্থিরতা তোমার?”
জাবেদ কিছু বলে নি, কেবল মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার নিজের ভুলেই সে জাকিয়ার পাতা ফাঁদে পড়ে গেছে। আগামী বছরগুলোতে এ বদ্ধ কারাগারেই তার বসবার করতে হবে। মনিকাকে সে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করেছে, অর্থের জন্য, প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য… হয়তো তারই শাস্তি পাচ্ছে। জাবেদকে নিরব থাকতে দেখে জাকিয়াই বলেছিলো,
-“মনে আছে, মিথিলা যখন তোমার বিরুদ্ধে কেইস করেছিলো তখন তুমি এবং তোমার পরিবার ওর নামে কুৎসা রটিয়েছিলে। বড়লোকের ছেলেকে বিয়ে করতে চায় বলে নাকি মিথিলা তোমার নামে মিথ্যে অপবাদ এনেছে। তুমি মিথিলার পরিবারকে বলেছিলে, “আইন যা দেখে তা’ই বিশ্বাস করে।” তখন প্রযুক্তি এতো উন্নত ছিলো না, ডিএনএ রিপোর্ট বের করা যায় নি। তাছাড়া মিথিলাও একা পড়ে গিয়েছিলো… আমিও তোমার দেখানো পথেই চলেছি জাবেদ, মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছি যে তুমি দোষী এবং আমি ভিকটিম… সত্যি বলেছিলে তুমি, আইন তা’ই বিশ্বাস করে যা তাকে দেখানো হয়… আশা করবো জেল থেকে তুমি নিজেকে শুধরেই বের হবে।”
জাকিয়া চলে আসতে নিলে জাবেদ জিজ্ঞেস করে,
-“আমার সব শেষ জাকিয়া। কিন্তু সত্যিটা আমি জানতে চাই, আমাকে ফাঁসাতে তোমায় কে সাহায্য করেছে? তোমার ফ্লাটের চাবি আমার কাছে ছিলো, তবে পুলিশ সে চাবিতে আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেলো না কেনো?”
জাকিয়া মুচকি হেসে বলেছিলো,
-“কিছু প্রশ্নের উত্তর অজানা থাকাই ভালো জাবেদ। যেমন নিজের জন্য তেমনি অন্যদের জন্যও…”
থানা থেকে বের হবার পর কুঞ্জর সঙ্গে দেখা হয় জাকিয়ার, কুঞ্জ এগিয়ে এসে বলে,
-“এবার সব ভুলে স্যারের সঙ্গে সংসার করুন তো ম্যাডাম, স্যার আমার বড্ড ভালো মানুষ।”
-“আপনার স্যারকে এতোটা ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ কুঞ্জ।”
মাথা চুলকে মুচকি হাসে কুঞ্জ। জাকিয়া আবার বলে,
-“আপনার স্যারের কাছে আপনার জন্য একদিন রান্না করে পাঠাবো, আমার পক্ষ থেকে একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর জন্য ছোট্ট ট্রিট।”
-“এসবের প্রয়োজন নেই ম্যাডাম, স্যার ভালো থাকলেই আমি খুশি। আমার বিশ্বাস আপনি স্যারকে ভালো রাখতে পারবেন।”
-“আমার ট্যাক্সি চলে এসেছে, আমি তাহলে আজ আসি…”
-“সাবধানে যাবেন ম্যাডাম।”
কথাটা বলেই জাকিয়ার জন্য ট্যাক্সির দরজা খুলে দেয় কুঞ্জ। ট্যাক্সিতে উঠে বসতেই জাকিয়ার মনে পড়ে কেইস চলাকালীন অফিসের এক লাঞ্চ ব্রেকের কথা। সেদিন জাকিয়া লাঞ্চ করতে যায় নি, অফিসের বেশিরভাগ মানুষ লাঞ্চ ব্রেকে বাহিরে। হঠাৎ কুঞ্জ এসে হাজির হয় অফিসে, কুঞ্জকে দেখে প্রথম প্রথম অবাক হলেও জাকিয়া নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছিলো। একটা কফিশপে মুখোমুখি বসে ছিলো দুজনে দীর্ঘক্ষণ। কুঞ্জ নিজের পকেট থেকে একটা চাবি বের করে বলেছিলো,
-“আপনাদের ফ্লাটের চাবি ম্যাডাম, আমি জানি মি. জাবেদ মিথ্যে বলছে না। তবে এটাও জানি যে স্যার বিশ্বাস করেন, আপনি সত্যি বলছেন।”
দরদর করে ঘামছিলো জাকিয়া, কুঞ্জ মুচকি হেসে বলেছিলো,
-“আমাকে সবটা খুলে বলতে পারেন ম্যাডাম। সবটা শোনার পর যদি মনে হয় যে, আপনার উদ্দেশ্য ভালো তবে কথা দিচ্ছি যা কেউ দেখে নি, যা কেউ জানে না তা কেউ কখনোই জানবে না।”
জাকিয়া ঘটনার বিস্তারিত বলে কুঞ্জকে, সবটা শোনার পর কুঞ্জ বলেছিলো,
-“অনেক বছর পার হয়ে গেলেও একজন অপরাধী সবসময় অপরাধীই… আপনি যে পথ অবলম্বন করেছেন তা খুব বেশি রিস্কি এবং হয়তো অসংগতও। তবুও আপনার উদ্দেশ্যটা সৎ। তাই আমি আপনাকে সাহায্য করবো ম্যাডাম।”
জাকিয়া ক্ষীণ স্বরে বলেছিলো,
-“আপনার স্যার জানলে…”
কুঞ্জ জাকিয়াকে আশ্বস্ত করে বলেছিলো,
-“চিন্তা করবেন না ম্যাডাম, স্যার কখনোই জানবেন না। আপনি যা করেছেন তা স্যারের মনে মিথিলা ম্যামকে সাহায্য করতে না পারার যে অপরাধবোধ তা চিরতরে নিঃশেষ করার জন্য করেছেন। আশা করবো, স্যার এরপরে আপনার সঙ্গে সুখে ভবিষ্যত জীবনটা কাটাতে পারবেন।”
-“চাবিটা কি আপনার স্যার দেখেছে?”
-“না, আমি চাবিটা থেকে মি. জাবেদ এর ফিঙ্গারপ্রিন্ট মুছে দিয়েছি, এখন এতে আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট লাগবে। কারন চাবিটা আপনার আর তাছাড়া ফরেনসিক টেস্ট এর পর আমাকে রিপোর্ট সাবমিট করতে হবে।”
জাকিয়া মুচকি হেসে চাবিটা হাতে নিয়ে বলেছিলো,
-“ধন্যবাদ।”
তার প্রত্যুত্তরে কুঞ্জ কিছু বলে নি, কেবল মুচকি হেসেছিলো। জাকিয়া মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখেছিলো সে হাসি, যে হাসিতে একজন সহকর্মীর প্রতি অগাধ স্নেহ ফুটে ওঠে… কে বলে রক্তের সম্পর্ক ছাড়া ভালোবাসা হয় না? পৃথিবীতে এমন অনেক সম্পর্কই আছে যা রক্তের সম্পর্কের ধার ধারে না, কোনো নিয়ম মানে না, ধর্ম, বর্ণ, বয়সের বাধা মানে না। সে সম্পর্কগুলো পবিত্র হয়, বিশেষ হয়, সুন্দর হয়, সাধারণ বাক্যে অসাধারণ হয়…
১২
দরজার সামনের নেমপ্লেটটায় রাশেদুল হাসান নামটা চকচক করছে। পাশে ব্রাকেটে লেখা এম.ডি.। জাকিয়া দরজায় দুই বার নক করে মাথাটা দরজার ফাঁকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“মে আই কাম ইন স্যার?”
জাকিয়াকে দেখে রাশেদ মুচকি হেসে বললো,
-“মিস জাকিয়া যে, ভেতরে আসুন। কেমন আছেন?”
ভেতরে গিয়ে রাশেদ সাহেবের সামনে খামটা বাড়িয়ে দিয়ে জাকিয়া মুচকি হেসে বললো,
-“আমি ভালো আছি স্যার। স্যার, আজ আমি আপনার কাছে অন্য কাজে এসেছি। আসলে আমি রিজাইন করছি স্যার, হেয়ার ইজ মাই রেজিগনেশন লেটার।”
খামটা হাতে নিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন রাশেদ, জাকিয়া বেরিয়ে যেতে নিলে পিছু ডাকলেন।
-“মিস জাকিয়া…”
জাকিয়া বের হবার জন্য পা বাড়াতে গিয়েও বাড়ালো না, রাশেদ সাহেবের ডাকে ঘুরে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে বললো,
-“মিসেস জাকিয়া স্যার।”
জাকিয়ার কথায় কর্ণপাত না করে রাশেদ জিজ্ঞেস করলো,
-“এতোদিন এতোকিছু ঘটে যাবার পরও আপনি চাকরিটা ছাড়েন নি, আর এখন যখন লোকটা দোষী সাব্যস্ত হলো, তার শাস্তি হলো তখন আপনি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন? কেনো?”
জাকিয়ার ঠোঁটের কোনে লেপ্টে থাকা হাসির রেখা প্রশস্ত হলো, বললো,
-“স্যার, আমি যদি ওই ঘটনাটার পর চাকরি ছেড়ে দিতাম তবে সবাই ধরে নিতো আমি লজ্জায় নিজেকে আড়াল করতে চাইছি। অথচ লজ্জাটা কিন্তু আমার না, লজ্জা যে অপরাধ করেছে তার। তাই আমি নিঃসংকোচে চাকরিটা করে গেছি, মিডিয়ার সামনে গিয়েছি। আর যদি বলেন, চাকরিটা ছাড়ার কথা, তবে সেটা আমি করছি আমার স্বামী আর সংসারের জন্য। আমার স্বামী ব্যস্ত মানুষ, ঘরে ফিরে বউয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখলে সে শান্তি পাবে বলে আমার ধারনা। তাই আমি মন দিয়ে আমার স্বামীর সংসার করতে চাই, অনেক তো করলাম চাকরি এবার না হয় সংসারটা করি?”
রাশেদ মুচকি হেসে বললেন,
-“আপনার আগামী জীবনের জন্য শুভকামনা রইলো মিসেস জাকিয়া।”
-“ধন্যবাদ স্যার, একদিন ম্যামকে নিয়ে আমার বাসায় আসবেন কিন্তু। ম্যামের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ, ম্যামের সাহায্য ছাড়া আমি হয়তো এতো সহজে ন্যায় পেতাম না।”
-“যে নিজেই নিজেকে সাহায্য করতে চায় তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর মানুষের অভাব হয় না, আমরা নিশ্চয়ই একদিন আসবো।”
মুচকি হেসে রাশেদের রুম থেকে বেরিয়ে যায় জাকিয়া। তার হ্যান্ড ব্যাগের ভেতরে উঁকি দিচ্ছি কক্সবাজার যাবার দুটো ফ্লাইট টিকেট… অনেক হয়েছে অপরাধীদের সঙ্গে সংঘর্ষ, এবার নাহয় একান্তে দুটো মানুষের মনের সংঘর্ষ হোক!
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে, রিকশার হুড ফেলে দিলো জাকিয়া… আজ তার মন ভালো, আজ সে আনন্দ বৃষ্টি গায়ে মাখবে। অদ্ভুত, জীবনটাকে হঠাৎ জাকিয়ার এতো রোমাঞ্চকর বোধ হচ্ছে কেন! বৃষ্টি কণা গায়ে মাখতে মাখতে জাকিয়া গুনগুন করে গান ধরে,
“লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প,
তারপর হাতছানি অল্প
চায় চায় উড়তে উড়তে-
মন চায় উড়তে উড়তে…”
“সমাপ্ত”