শখের_সাদা_শাড়ি,14,15

0
721

#শখের_সাদা_শাড়ি,14,15
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
১৪.

উর্মির ফোন পরে আছে। মেঘনা কে দৌড়ে জাপটে ধরলো উর্মি। মেয়েটা হঠাৎ ই তীব্র আর্তনাদ করে উঠেছিল। ব্যথায় কাতরে উঠছে। দু চোখের ধার বেয়ে নেমে যাচ্ছে গরম জলের স্রোত। মেঘনার চোখ দুটো ক্লান্তি তে বুঝে এলো বোধহয়। আর তার পর ই সব অন্ধকার হয়ে এলো। হাত টা এখনো পেটে চেপে রাখা। যেন বাচ্চা টি কে পরম আদরে জড়িয়ে রেখেছে এক মা।

তিন টা দিন কম নয়। উর্মি কে পাওয়া যাচ্ছে না ফোনে। সৌমেন অসুস্থ থাকা তে আজকাল অফিসে ও যেতে পারছে না। তাই মাহফুজ সাহেব ই যান। তার কাছে খবর এসেছে উর্মি কোনো ইনফর্ম করা ছাড়াই তিন দিন অফিস কামাই দিয়েছে। তিনি ফোন করলেন অথচ ফোন অফ বলছে। উর্মির বাসায় যাবে বলে স্থির করলেন তিনি। ছেলে কে বললে ছেলে ও চিন্তিত হলো। সচরাচর উর্মি এমন করে না। আর সৌমেন তো নিজ চোখে দেখেছে কাজের প্রতি উর্মির কি ভালোবাসা। মাহফুজ সাহেব ঠিকানা অনুযায়ী উপস্থিত হলেন। চার তলা বাড়ি টা দেখে ভ্রু কুচকালেন। কোন তলা তে থাকে উর্মি?

মেঘনার মাথায় হাত বুলাচ্ছে উর্মি। গত তিন দিনে কি ঝড় গিয়েছে ওর উপর দিয়ে সেটা আল্লাহ ব্যতীত আর কারো জানার কথা না। সত্যি বলতে আপা কে পাগলের মতো ভালোবাসে। আর তার অনাগত সন্তান কে নিজ সন্তানের মতো। এতো টা ভালোবাসে যে অন্তু যদি সেটা দেখতে পেতো তাহলে নিশ্চয়ই হিংসে করতো। উর্মি দেহ বাকিয়ে বসে আছে। তখনি তুলি এসে বলল মাহফুজ স্যারের কথা। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে উর্মি উঠে এলো। বুঝতে পারলো গত তিন দিনে অনুপস্থিত হওয়ার জন্য কোনো ইনফর্ম করা হয় নি। ফোন টা ভেঙে গেছে। আর নাম্বার গুলো অন্য কোথাও তোলা নেই। এমন কি কার্ড টা কোথায় আছে সেটা ও খেয়াল নেই। উর্মি প্রথমেই গেল না। আগে চুলোয় গরম পানি বসালো তারপর সেটা তে চিনি দুধ আর কফি পাউডার দিয়ে মোটামুটি একটা কফি বানিয়ে নিলো। মাহফুজ সাহেব চার পাশে চোখ বুলাচ্ছিলেন। বাড়ি টা মুটামুটি পুরনো। রঙ উঠে গেছে দেয়াল গুলো তে। তবু ও ঘর গুলো পরিপাটি গুছানো। ঠিক যেমন প্রাচুর্যতা নেই ঠিক তেমনি নেই অভাব। সালাম দিয়ে বসলো উর্মি। প্রথমেই নিজের জন্য সাফাই না গেয়ে বলল
” সৌমেন স্যার কেমন আছেন স্যার? ”

” ভালো। তবে এখনো উইক। ঝিমুনি আসে সারাক্ষণ। ”

” ঠান্ডা লেগে আছে এখনো? ”

” হ্যাঁ। সেটা তো জন্মব্যধি। ছেলেটা আমার শ্বাস নিয়ে কতো কষ্ট ই না করলো জীবনে তবে মাঝে সুস্থ ই ছিল। হঠাৎ করেই আবার কি যে হলো। ”
একটু থামলেন ভদ্রলোক। কফি টা হাতে তুলে নিয়ে আবার বলল‍েন–
” বুঝলে সৌমেন নাকি টেস্ট করিয়েছে। অথচ কোনো রোগ ধরা পরে নি। ভাবছি বিদেশ পাঠাবো। ”

” ভালো ভেবেছেন স্যার। আগে থেকেই চিকিৎসা করা উচিত। ”

” হুম। তা উর্মি তোমার কি অবস্থা? তিন দিন ধরে খোঁজ খবর নেই। ”

উর্মি নিশ্বাস নিলো। লম্বা এক নিশ্বাস। আর তারপর ই বললো সে রাত্রি তে মেঘনার হঠাৎ ব্যথা উঠে যাওয়ার কথা টা। মাঝে শুধু বাদ দিলো শশুড় বাড়ি তে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনার কথা। উর্মির গলা টা নুইয়ে আসে বার বার। মাহফুজ সাহেব আশ্বস্ত করে আর ও দুদিন ছুটি কাটাতে বললেন। তবে উর্মি জানালো সে কাল থেকেই অফিস যাবে। এমনি তেই কোম্পানির অবস্থা ভালো যাচ্ছে না।

সিম কার্ড টা নতুন ফোনে লোড করতেই সমীর এর কল এলো। নাম্বার টা একে বারে মুখস্ত না থাকলে ও চিনতে অসুবিধা হলো না মোটে ও। সময় না নিয়েই রিসিভ করলো উর্মি।
” হ্যালো, হ্যালো উর্মি। তোমার নাম্বার বন্ধ কেন বলে। অফিস ও যাও নি গত তিন দিন। কি হয়েছে সব ঠিক ঠাক তো। তুমি ঠিক আছো তো। ”

” শান্ত হও সমীর। আমি ঠিক আছি। ”

” হ্যাঁ ঠিক আছো বুঝলাম। তবে ফোন কেন অফ? ”

” ফোন টা ভেঙে গেছে। নতুন ফোন কিনে নিয়ে আসলাম আজ। ”

” ও আচ্ছা। খুব টেনশনে ছিলাম। ”

” আচ্ছা শোনো রাখছি এখন। অফিসে আছি। ”

চেয়ারে বসলো সমীর। হাতে পাসপোর্ট আর প্লেনের টিকেট। গত তিন দিনের টিকেট পাচ্ছিলো না কোনো মতেই। আজ কের টাই পেয়েছে সেটা ও অনেক কষ্টের পর। যাওয়ার আগে আবার উর্মি কে কল করেছিল যদি কোনো খোঁজ আসে। একটু করে হাসলো সমীর। তবে সেদিনের বলা ভালোবাসি শব্দ টা শুনতে পায় নি উর্মি। শখ করে বলা মূল্যবান শব্দ গুলো মূল্যহীন ই ঠেকলো। হঠাৎ ই জোরালো শব্দ এলো কানে। আকাশের পানে দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেল মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে প্লেন টা।

নাক ফুলিয়ে বসে আছে সৌমেন। প্রচন্ড রাগে কেঁপে উঠলো সে। একটু দূর থেকে চোখের পানি ফেললো মাইশা। কল্লোল টার জন্য বার বার বকা খাচ্ছে সে। এমনি তেই মাথা ঠিক নেই সৌমেন স্যারের। তার উপর বার বার কল্লোল এর জন্য কাজ কর্মে ভুল করে বসছে। স্যরি বলে বেরিয়ে গেল সে। সৌমেন দূর্বল শরীর টা কে সতেজ রাখার চেষ্টা করছে। বাবা কে জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে বাড়ি তে। এটা তার বিজনেস। সে চায় বাবার টাকা কে না স্পর্শ করে একটা ভালো পজিশন দিতে। অবশ্য পেরেছিল ও বটে। তবে আচানাক আচানাক কি যেন হয় আর সুন্দর গড়ে উঠা পরিকল্পনা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এদিকে শরীর এর যে হাল। উর্মি নক করতে ভয় পায়। একটু আগেই দেখেছে মাইশা ম্যাম চোখ মুছে বের হলো। নিশ্চয়ই স্যার রেগে আছেন। এদিকে উর্মি ও যে খুব ভালো কাজ করে যাচ্ছে তেমন না। অসাধারণ কিছুই হচ্ছে না। এর ফলে কোম্পানির অবস্থা আর ও নিচু হতে শুরু হয়েছে। উর্মি শ্বাস নিলো। এতে অনেক টা স্বস্তি এলো। তারপর নক করলো। শীতল কন্ঠ টা অনুমতি দিতেই প্রবেশ করলো উর্মি। সালাম দিয়ে বলল–
” গুড ইভিনিং স্যার। ”

” গুড ইভিনিং উর্মি। বসো। ”

” এখন আপনি কেমন আছেন স্যার? ”

” ভালো। তবে তোমরা সবাই ভালো থাকতে দিচ্ছো না আমায়। ”

” জী স্যার? ”

” এই যে অসাধারণতা পাচ্ছি না। প্রায় সয় ভুল ভাল কাজ হচ্ছে। এতে লস না হোক তবে বেনিফিট তো আসছে না। আর টাইম ওয়েস্ট তো হচ্ছেই। সে দিক থেকে বলতে গেলে ক্ষতিই হচ্ছে। ”

” দুঃখিত স্যার। তবে আমরা সবাই চেষ্টা করবো নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে। ”

” সেটাই দেখার অপেক্ষা। কফি খাবে? ”

” ওকে। ”

বেল প্রেস করে সৌমেন কফি আনতে পাঠালো। ততক্ষণে আর ও কিছু কথা হলো দুজনার। সৌমেন জানালো বাবা খুব চাপ দিচ্ছে ফরেন কান্ট্রি তে গিয়ে চেকাপ করার জন্য। আর সে নিজে ও এখন সেটাই চাচ্ছে। এদিক টা একটু গুছিয়ে তারপর ই যাবে বলে মনস্থির।

বাসায় ফিরতে একটু লেট ই হলো। রাত তখন সাড়ে দশটা। উর্মি ঝটপট ছাতা গুটালো। যা বৃষ্টি হচ্ছে না বাহিরে। দাঁড়িয়ে থাকাই মুশকিল। ঘরের সামনে গিয়ে বুঝতে পারলো নতুন কেউ এসেছে। আর জুতোর মাপ দেখে অনেক টাই নিশ্চিত হলো মানুষ টি কে হতে পারে। স্বাভাবিক ভাবেই ভেতরে এলো। ড্রয়িং রুমে কেউ নেই।
যা বুঝার বুঝলো উর্মি। ব্যাগ পত্র ড্রয়িং রুমে রেখেই আগে ফ্রেস হলো। তারপর জামা বদলে আপার রুমে গেল। নয়ন মেঘনার পা ধরে বসে আসে। উর্মি কে দেখে নয়ন নড়লো না এক চুল। মেঘনা দ্রুত সরে আসার চেষ্টা করলো। ইশারায় স্থির থাকতে বলল উর্মি।
” কেমন আছেন নয়ন ভাই? ”

” উর্মি। বোন মাফ করো আমায়। ”

” কিসের জন্য? ”

” তোমার আপার খেয়াল না রাখার জন্য। প্লিজ মাফ করো। ”

” মাফ তাকে করা যায় যে ভুল করে আর আপনি তো করেছেন অন্যায়। স্যরি নয়ন ভাই আমি আপনাকে মাফ করতে পারলাম না। আর না আপনার সৃষ্টিকর্তা আপনাকে মাফ করবে। কেন জানেন? কারণ আপনি আপনার স্ত্রীর গর্ভে থাকা নিজ সন্তান কে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছেন। ”

” মিথ্যে– ”

” থামেন নয়ন ভাই। আপনি নিজের হয়ে সাফাই গাইতে পারেন তবে ছবি কখনো মিথ্যে বলবে না। ”

ছবির কথা শুনে বসা থেকে উঠে পরলো নয়ন। উর্মি তাচ্ছিল্য করে তাকালো। এতো সময় চুপ থাকলে ও এবার মেঘনা মেজাজ হারালো। চিৎকার করে উঠলো।
” কু’ ত্তার বা”চ্চা তুই আমার সন্তানের দিকে নজর দিয়েছিস। আমার ফুলের মতো বাচ্চা যে কি না এই পৃথিবীর আলো দেখতে পেল না এখনো। ”

” মেঘনা কি বলছো এসব! আমি কেন আমার সন্তান এর ক্ষতি করবো। তোমাদের ভুল হচ্ছে। ”

” তুই আর লুকাতে পারবি না জা”নোয়ার। তিক্ত রাতের আঁধারে সোহাগ দেখিয়ে দিনের আলো তে আমায় অন্ধ করে রেখেছিলি তুই। তোর মা আমাকে দিয়ে এতো কাজ করিয়েছেন তবু আমি চুপ ছিলাম। তুই তো রাতে এসে ঠিক ই আমার যত্ন নিতি। এসব ভেবে আমি মুখ বুজে ছিলাম। সেদিন যে বাথরুমে পরে গিয়েছিলাম সেগুলো সব ছিল তোর প্ল্যান যাতে আমি আমার সন্তান কে হারিয়ে ফেলি আর তুই অতি সহজেই ডিভোর্স দিতে পারিস আর ঐ নতুন মেয়ে টা কে বিয়ে করতে পারিস। নোংরা মেয়ে টা কে। কি যেন নাম। খুব পয়সা তাই না। তোর মিথ্যের দরদে জানি না আমার সন্তান টা কেমন আছে। তবে এই কথা মাথায় রাখ তোর ডিভোর্স পাবি না তুই। আমি যতো দূর যাওয়া লাগে যাবো। আর আমার সন্তান ও এই পৃথিবীর আলো দেখবে। ”

কথা বলতে বলতে মেঘনা বেডের উপর বসে পরলো। উচ্চস্বরে কথা বল‍াতে পেটে খুব ব্যথা করছে। উর্মি নয়ন এর নিকট এসে দাঁড়ালো। শুধু বলল ” আমার আপা কি দোষ করেছিলো নয়ন ভাই? সে দেখতে খারাপ নাকি আপনাকে শারীরিক ভাবে খুশি করতে পারে নি। বলেন কি দোষ আমার আপার। বড় শখ করে আব্বা বিয়ে দিয়েছিল। আমার আপার পেছনে তখন পুলিশ সুপার এর ছেলে আলিদ ভাই ঘুরঘুর করছে। আপনার থেকে দেখতে হাজার গুন সুন্দর। আপার বান্ধবীরা জানেন কি বলেছিল বিয়ের দিন। বলেছিল মেঘনা তুই কাকে বিয়ে করছিস? এই ছেলের থেকে আলিদ ভাই কতো সুন্দর। পয়সা ও তো কম না। আর তুই কি না এই সাদা মাটা সাধারণ জব করা এক ছেলে কে বিয়ে করিস। আপা সেদিন খুব হেসেছিল আর বলেছিল শখ করে বিয়ে করছি রে, এই টুকু বুঝেছি এই ছেলে আর যাই হোক আমায় কাঁদাবে না। আমার আপার শখের বিয়ে টা কেন এমন হলো নয়ন ভাই? বলেন কেন আমার আপার কপাল টা এভাবে পুরলো। কি দোষ ঐ ফুটফুটে বাচ্চা টার। সে কেন পাচ্ছে বাবার অবহেলা। শুধুই টাকা!”

চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

#শখের_সাদা_শাড়ি
১৫.
সমীর সব থেকে বড় ধাক্কা টা খেল অনুষ্ঠানের ফাইনাল রাউন্ডে। নিজের বাবা কে জাজ হিসেবে দেখে একে বারেই ভরকে গেল। কয়েক সেকেন্ড একদম ই পলক ফেললো না। আর তারপর ই চোয়াল শক্ত করে উঠে এলো। ভদ্র লোকের নাম সওলাত খান। বর্তমান ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বড় এক নাম। বেশ ভালো ডিজাইন করতে পারেন। আর সেই গুন টাই পেয়েছে ছেলে সমীর খান। তবে দুজনের মাঝের দূরত্ব যে সব দুমড়ে মুচড়ে দিলো। এর আগের বার ন্যাশনাল পর্যায়ে অনলাইন অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন ভদ্রলোক। শুধু সেই কারনে জিতে যাওয়া রাউন্ড টা ফেলে আসে সমীর। সবাই খুব বুঝিয়েছিলো তবে সে নারাজ। এতে নিজ ক্যারিয়ারের ক্ষতি করে ফেললো সমীর।এই নিয়ে কখনোই আপসোস করে নি। ভদ্রলোকের ছায়া টা যেখানে থাকবে সমীর ঠিক তার বিপরীতে অবস্থান করবে। সমীর এর নাম ডাকা হলো। তার করা ডিজাইন গুলো অলরেডি মনিটরে দেখানো হচ্ছে। শুধু ব্রিফিং দিবে। সমীর এর নাম টা শুনে সওলাত খান বেশ চমকালেন। আগের বারের ঘটনা টা তিনি জানতেন না। প্রধান অতিথি হিসেবে স্বীয় দায়িত্ব পালন শুরু করেছিলেন কেবল। তবে এবার যে একে বারে বিচারকের আসরে। সমীর আসছে না দেখে সওলাত খান বার বার তাকাচ্ছেন। ছেলের মুখ টা দেখা হয় না আজ কতো গুলো বছর। সত্যি বলতে তিনি সন্তান দের ভালোবাসেন। মাঝের করা এক ভুলের জন্য সন্তান রা আলাদা হয়ে গেলো। কি করার ছিলো ওনার? দ্বিতীয় স্ত্রী তথা কাননবালার পেটে যে ভুলক্রমে ওনার সন্তান এসেছিলো। অনাকাঙ্ক্ষিত সেই ভুলের জন্য বিয়ে টা করে নিতে হলো তাড়াহুড়ো করে। বড্ড ভুল ছিলো সেসব। নিজ স্ত্রী কে খুব একটা ভালোবাসতেন না তিনি। পরনারী তে আসক্ত হয়ে অবৈধ সন্তানের জন্ম দিলেন। আর নিজের বৈধ সন্তান দের হারিয়ে ফেললেন। বুকের ভেতর টা ছ্যত করে উঠে। পাশ থেকে একজন বিচারক বললেন ” সওলাত সাহেব দেখেন এই ছেলের কাজ গুলো। কি নিখুত ডিজাইন। যতো গুলো ডিজাইন এসেছে সব থেকে বেস্ট। ”

ছলছল নয়নে হাসার চেষ্টা করলেন তিনি। চোখের জল টুকু বহু কষ্টে আটকে রেখে দিলেন। ছেলেকে দেখার জন্য মনের ভেতর ঝড় বইতে শুরু করলো। অধৈর্য হয়ে কয়েক বার সিট থেকে উঠার চেষ্টা ও করলেন। অতঃপর সমীর এর দেখা মিলে। ছিমছিমে শরীরের লম্বা দেহের ছেলে। চেহারা ভালো খারাপ না। তবে সব থেকে সুন্দর হচ্ছে চিকন কপাল টা। এমন সুন্দর কপাল যে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। লম্বা চুল গুলো যখন কপালে এসে আছড়ে পরে তখন মনে হয় এই পৃথিবীর সব থেকে সুদর্শন পুরুষ সমীর। মনে মনে চাপা গর্ব করলেন তিনি। এই গুনী ছেলে টার যে তাঁর সেটা ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে। সমীর খুব স্বাভাবিক ভাবেই মঞ্চে এলো। মাইক তুলে দেওয়া হলো।
” থ্যাংকস টু অল। যারা আমাকে এমন সুন্দর, বিশেষ আয়োজনে অংশ হতে নির্বাচিত করেছিলেন। আমি দীর্ঘ এক মাস যাবত কাজ করে আজ ফাইনাল রাউন্ডে মাইক হাতে উপস্থিত। বিজয় হয়তো বা খুব নিকটে। যেহেতু ফাইনাল সেহেতু বিজয়ী না হলে ও আমরা সবাই এক একজন রানার্সআপ এটা সিউর। মোট কথা হেরে যাওয়ার কোনো চান্স নেই। সে যাই হোক, আমি হয়তো সকল কে এমন এক সংবাদ দিতে চাই এর ফলে মিডিয়া কিংবা ভিউয়ার্স সকলেই তিক্ত মতামত পোষন করবেন। এই ভিন্ন ভিন্ন মতামত গ্রহণে আমি দ্বিধান্বিত না। আমি জানি আমাকে ফেস করতে হবে অনেক কিছু তবু আমি সেটা বলবো। আর ইটস ফাইনাল। ”

সওলাদ সাহেব ছেলের কথা টা কে খুব পজেটিভ ভাবে গ্রহণ করলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন ছেলে বুঝি বলবে সওলাত খান আমার বাবা। তিনি একেবারে তৈরি হয়ে রইলেন ছেলে কে বুকে টেনে নেওয়ার জন্য। সমীর কে অলরেডি সাংবাদিক রা প্রশ্ন করা শুরু করেছে। সমীর এক বার ও তাকালো না বাবার দিকে। চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে বলল ” আমি নিজের নাম এই প্রতিযোগিতা থেকে উইথড্রো করতে যাচ্ছি। ”

উর্মির সাথে কথা বলছে সমীর। দুজনের কন্ঠ টাই মলিন। একে অপরের থেকে কি যেন লুকোচ্ছে। সমীরের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই সমীর অন্য কথায় এলো।
” সৌমেন ভাই এর কি খবর গো? শুনলাম বিদেশে আসবেন। ”

” হ্যাঁ মাহফুজ স্যার তেমন টাই বলেছেন। সেদিন সৌমেন স্যার ও বললো। ”

” তাহলে তো ঠিক ই যাবে। ”

” হ্যাঁ। এখন বলো তোমার অনুষ্ঠানের কি হলো। আজ কালের মধ্যেই তো ফাইনাল হওয়ার কথা তাই না? ”

” হুম। খেয়েছো? ”

” অনেক আগেই। আপা কে খাইয়েই খেয়ে নিয়েছি। ”

” ও হ্যাঁ রাত তো অনেক হলো। আপার কি খবর? ”

” ভালো। বেবি টা আজকাল যন্ত্রণা দিচ্ছে। কিক করলেই আপা ককিয়ে উঠে। ”

” ইস কি বলো এটা যন্ত্রণা? এটা তো দারুণ লাগার কথা। বেবি কিক করার ফিল টা ভাবো কেমন লাগে। ”

” হুম হয়েছে মিস্টার। মায়েরাই বুঝেন কেমন লাগে। ”

” কষ্ট হলে ও সুখ তো আছে। আমি তো আমার বেবির প্রতি টা কিক ফিল করতে চাই। ”

” হা। আগে বিয়ে করে একটা বেবি পয়দা তো করো। ”

” করবো তো। খুব দ্রুত করবো। ”

” তাই। তো মেয়ে দেখেছো নাকি? ”

” উম দেখি নি। তবে চাইলে তুমি দেখতে পারো। ”

আনমনেই হাসলো সমীর। এদিকে উর্মি দাঁত চেপে বলল–
” হুম দেখবো তো। ”

” দেখো প্লিজ। মেয়ে টা যেন খুব সুইট হয়। একদম তোমার — ”

” আমার কি? ”

উর্মির উদিগ্ন কন্ঠ। সমীর ফিঁচেল হেসে বলল
” তোমার বিপরীত। তুমি তো একটা ঝাল মেয়ে। আমার সুইট কাউ কে লাগবে। বহু দিনের শখ। ”

কল কেটে দিয়েছে উর্মি। সমীর হেসে আবার কল করলো। ভাবলো এখনি বলে দিবে শখের মেয়েটি উর্মি। তবে দ্বিতীয় বার কল করে সুইচ অফ পেলো ফোন। এতো রাগ করেছে মেয়েটা?

দু দিনের মাথায় দেখা গেল সৌমেন খুব অসুস্থ। মুখ দিয়ে লালার মতো কি যেন বের হয়। এসব দেখে সৌমেন কে ফাইল দিতে আসা ড্রাইভার চিৎকার করে উঠে। দ্রুত পায়ে ছুটে আসে উর্মি সহ সবাই। উর্মি দেখতে পায় সৌমেন কেমন যেন বিহেভ করছে। সবাই ধরে হসপিটালে নিয়ে আসে। যাওয়ার পূর্বে উর্মি মাহফুজ স্যার কে কথা টা জানান। ভদ্রলোক এই কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যান। কারো গলা শুনতে পায় উর্মি। তিনি বলছেন কে ফোন করেছে? সৌমেন?

হসপিটালের করিডোরে মানুষের ভীড় জমেছে। প্রতি টা স্টাফ ছুটে এসেছেন। সৌমেন স্যারের এমন অসুস্থতা কেউ আশা করে নি। মাহফুজ সাহেব আর ওনার স্ত্রী লতিফা বেগম ছুটে এলেন। ভদ্র মহিলা উন্মাদের মতো কাঁদছেন। ছেলের জন্য যেন শরীরের প্রতি টি রক্ত বিন্দু ত্যাগ করতে প্রস্তুত। উর্মি লতিফা বেগম কে সিটে বসালেন। মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এই তো দুপুরেই উর্মি কে ডেকে বলল উর্মি এবার এর কাজ টা খুব ভালো করেছো। তুমি খুব ভালো কর্মী। ডাক্তার বের হয়ে আসতেই লতিফা বেগম ছুটে গেলেন। থমথমে ডাক্তার কিছু বলতে নারাজ। তবে মাহফুজ সাহেব কে দেখে না বলে আর থাকতে পারলেন না। তিনি শুধু জানালেন সৌমেন এর অবস্থা ভালো নয়। শরীরে বিশেষ ধরনের মেডিসিন দেওয়া হয়েছে। যার ফলে পরিবর্তন এসেছে সৌমেন এর জেনিটিক বৈশিষ্ট্য সহ ব্রেনের। হয়তো বা সৌমেন এর স্মরণ শক্তি আর বুদ্ধিমত্তায় প্রভাব পরবে। ব্যাস এই টুকু শুনেই জ্ঞান হারালেন লতিফা বেগম। মাহফুজ সাহেব ও ভেঙে পরলেন। প্রতি টা মানুষ চুপ চাপ। শুধু উর্মি চিৎকার করে বলল
” আন্টির হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে দ্রুত বেডে নিতে হবে ওনাকে। ”

রাতে সমীর এর নাম্বারে কল করলো উর্মি। পুরো আটা নব্বই টা মিস কল এসেছে। উর্মি রিসিভ করতে পারে নি কারন সৌমেন এর পরিবার নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। সমীর কল রিসিভে সময় নিলো না। ঝটপট বলল–
” সারাদিনে কল রিসিভ করো নি উর্মি। তুমি ঠিক আছো। ”

” চিন্তা করো না আমি ঠিক আছি। তবে সৌমেন স্যার অসুস্থ। ”

” কি হয়েছে? ”

পুরো ঘটনা বর্ননা করলো উর্মি। এতে সমীর ব্যথিত হলো। দুজনের মাঝের সম্পর্ক টা সুন্দর। সৌমেন এর খোঁজ নিতে ফোন করবে বলে ঠিক করলো। এদিক টা সামলে দ্রুত ফিরে আসবে বলে ও স্থির হলো। উর্মির মন টা ভীষণ পানসে ঠেকে। সমীর ও নিশ্চুপ হয়ে রইলো। কিছু সময় গেলে দুজনেই প্রসঙ্গ বদল করলো। এক পর্যায় এসে উর্মি জানতে চাইলো সমীর এর ফাইনাল রাউন্ড এর রেজাল্ট। আজ বাদে কাল তো সত্যি টা জানবেই উর্মি। সে জন্য সমীর বলল
” আমি নিজের নাম উইথ ড্রো করে নিয়েছি উর্মি। ”

” কেন? ”

আজ আর লুকায় নি সমীর। একে একে বর্ননা করলো নিজের বাবার প্রতারণা। মা ভাই কে নিয়ে চলে আসার ঘটনা। সবশেষে উর্মি চুপচাপ। চোখ দুটো ভরে গেছে জলে। অথচ সমীর কতো টা সহজ গলায় বলে যাচ্ছে। সমীর আর ও বলল মা কতো টা ভালোবাসতেন বাবা কে। মাংস কে একদম চিড়ে ফেলে বাঁধাকপি দিয়ে ভাজি করা ছিল বাবার সব থেকে প্রিয়। সেদিন মা শখ করে বাবার জন্য সেই রান্না টাই করেছিলেন। তবে বাবা এসেছিলেন অন্য নারীর হাত ধরে। কেউ সেদিন মুখে তুলে নি খাবার। পরদিন ময়লার গাড়ি করে চলে গিয়েছিল শখের রান্না।কয়েক সপ্তাহ মুখ বুজে ছিলো সমীর। খুব কষ্ট করে জব খুঁজে মা ভাই কে নিয়ে বেরিয়ে আসে। আর এভাবেই শুরু হয়েছিল ওর শখের গল্প।

চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here