শখের_সাদা_শাড়ি,20,21 last

0
1295

#শখের_সাদা_শাড়ি,20,21 last
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
২০.
সৌমেন এর পাগলামি বেড়েছে। সে কাউ কেই নিতে পারছে না। উর্মি এসেছিল কিছু ফাইল চেইক করাতে। তবে তাকে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হলো। মাইশা কে উর্মির সাথে গুলিয়ে ফেলেছে সৌমেন। সে জন্য সমস্ত রাগ ঝারছে ওর উপর। উর্মির চোখ দিয়ে পানি নেমে এলো। সৌমেন এর বকা গুলো কেন যেন ওকে দুঃখ দিচ্ছে। শুধু উর্মিই নয় আশে পাশের আরও কিছু মেয়ে কে মাইশা ভাবছে সে। আর তখনি তাদের উপর এট্রার্ক কিংবা বকা চালাচ্ছে অবিরতভাবে। মাহফুজ সাহেব যেন এবার পাগল ই হয়ে যাবেন। ছেলের সাথে সাথে ছেলের মায়ের ও পাগলামি শুরু। লতিফা বেগম সেই যে কান্না শুরু করেছেন আর থামার নাম ই নেই। উর্মি কেমন ভীত চোখ দিয়ে সব টা দেখছে। আচানাক পেছন থেকে জাপটে ধরে সৌমেন সে যে কি ভয়ংকর এক রূপ। সাথে তীক্ষ্ম কিছু চিৎকার
” বলেছিলাম আমায় ছেড়ে না যেতে, কেন চলে গেলে তুমি। কেন আমায় ছেড়ে যাচ্ছো। আই লাভ ইউ মাইশা আই লাভ ইউ। আমি আর কখনো বকা দিবো না, সত্যি আর বকবো না তোমাকে। আর কখনো কাজ নিয়ে টু শব্দ অব্দি করবো না। প্লিজ ব্যাক। ”

কথা শেষ করতে পারে নি সৌমেন। তার পূর্বেই মাথা চেপে ধরে আবার ছুট লাগায় এদিক থেকে সেদিক। মাহফুজ সাহেব এক চুল ও নড়লেন না নিজের স্থান থেকে। তবে এক বুক কষ্ট নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। উর্মি ঢকঢক করে পানি খেল। হাঁপিয়ে উঠেছে মেয়েটি। সৌমেন করছে ছুটোছুটি। উর্মি ব্যগ্র হয়ে বলল
” স্যার সৌমেন স্যার এর ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন। ”

” ট্রিটমেন্ট তো চলছেই উর্মি। বাট আমার ছেলেটা সুস্থ হচ্ছে না। ”

” কি বলবো আমি বুঝতে পারছি না। ”

” আমার সৌমেন এর ভাগ্য টাই খারাপ। জানি না কোন পাপের সাজা পাচ্ছে আমার সন্তান। ”

ভদ্রলোক গুমোট কান্নায় ভেঙে পরলেন। উর্মির ও ভীষণ কান্না পাচ্ছে। হঠাৎ ই কাচ ভাঙার শব্দ শোনা গেল। হতচকিয়ে উঠলো উর্মি সহ সকলেই। মাহফুজ সাহেব ছুটে গেলেন ছেলের রুমে। গিয়ে দেখলেন লাল তরলের বন্যা বয়ে গেছে। সৌমেন এর পা থেকে ঝরছে সেই তরল। তিনি ছুটে এলেন তবে সৌমেন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। উর্মি গেলে উর্মি কে ও ধাক্কা দেয়। তবে সামলে নেয় উর্মি। একটু পর সৌমেন পুরো পুরি চেতনা হারিয়ে ফেলে। মাহফুজ সাহেব মেঝে তে বসেই অশ্রু ঝরাচ্ছিলেন। উর্মির চিৎকারে ধরমরিয়ে উঠেন। ছেলে কে বুকে জড়িয় ধরেন ” আমার সন্তান। বাবা কি হলো তোর। ”

” সৌমেন স্যার কে হসপিটালে নিতে হবে স্যার। অতিরিক্ত ব্লিডিং হচ্ছে। ”

উর্মি ঝটপট এক টা কাপড় এনে সৌমেন এর পা বেঁধে ফেলে। তবে র’ক্তের থামার নাম ই নেই। একদম ভেঙে পরেন বাড়ির কঠোর ব্যক্তি মাহফুজ সাহেব। উর্মি কল করে অনুজ কে। ছেলেটা শহর থেকে অনেক টা দূরে। সে জানায় এখনি আসছে আর উর্মি যেন সৌমেন কে হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। উর্মি সেটাই করে। হসপিটালে নিয়ে আসা হয় সৌমেন কে। ডাক্তার সাহেব জানান রক্ত নিয়ে আসতে। ব্লাড ব্যাংক এর কাছে আসে উর্মি। হাত পা শীতল হওয়ার জোগাড়।
” উর্মি দাড়াও। ”

রক্ত নিয়ে যাচ্ছিল উর্মি। ঠিক তখনি নয়ন এর কন্ঠে থেমে যায়। পেছন ঘুরে দেখে নয়ন এর সাথে তুলি ও আছে। চোয়াল ভারী হয় মেয়েটির।
” কি প্রয়োজন? ”

” টাকার। ”

” কিসের টাকা হা? ”

রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠে উর্মি। তুলি এক দলা হেসে বলে ” আমার দেন মোহর এর টাকা। কোর্ট কিন্তু রায় দিতে বাধ্য। কবে টাকা দিবে তোমার ভাই। ”

” নষ্টা মেয়ে মানুষ। বাঁধলো না ননদের স্বামীর সাথে পরকীয়া করতে। ”

” সাবধানে কথা বলো উর্মি। ”

” কিসের সাবধানে হা। অসভ্য একটা। ”

উর্মির গায়ে হাত তুলতে যায় তুলি। নয়ন বাঁধা দেয়।
” কি করছো জান! শুধু শুধু নিজের হাত নোংরা? এর থেকে ভালো একটু রস মিশিয়ে শোধ নেই। ”

গা দুলিয়ে হাসলো তুলি। ঘৃনা হচ্ছিল উর্মির। সে যেতে চাইতেই নয়ন হাত তালি বাজালো। বিস্ফোরণ নিয়ে ঘুরে তাকায় উর্মি। নয়ন খুব যত্ন নিয়ে আগায় গুনে গুনে নয় পা
” রাইট নাও আমি এখন আগের অবস্থান থেকে নয় পা এগিয়ে। এটাই বিষয়। তুলি আর আমি নয় বছর ধরে প্রেমে হাবুডুবু খাই। সৌজন্যের সাথে তো সবে পাঁচ ছয় বছর এর পরিচয়। বিবাহিত জীবনের চার বছর। হা বিবাহিত কেন বলছি এটা তো ছিল কেবল নাটক। ”

না বুঝার মতো করে তাকিয়ে আছে উর্মি। নয়ন একটু হাসলো। তুলির শরীরে হাত রেখে বলল ” আমাদের জীবন টা রঙিন ছিল কী বলো। ”

” ছিলো না এখনো রঙিন আছে। অলোয়েজ ই রঙিন থাকবে বেবি। ”

” এসব ফাউ কথা বলা শোনা কোনো টাই আমি জরুরি মনে করছি না। আমি এসব জানতে চাই না। ”

ওদের কে উপেক্ষা করে চলে আসে উর্মি। এই নষ্টালজিক মানুষদের সাথে আর কোনো কথাই নয়। ছুটে আসে এক প্রকার। ব্লাড দেওয়ার সাথে সাথে অনুজ এর দেখা মিলে। ছেলেটা এমন চিন্তিত!
” সৌমেন এর কি অবস্থা? ”

” জানি না। ”

” স্টুপিট এর মতো কথা বলো না উর্মি। ডাক্তার কি বললেন। ”

” এখনো বের হয় নি। ”

বিরক্তি ফুটে অনুজ এর কপালে। সে চট জলদি এগিয়ে আসে। মাহফুজ সাহেব এর পাশে বসে।
” ভাববেন না আঙ্কেল। সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

” কিচ্ছু ঠিক হবে না। ”

” আপনি বল হারিয়ে ফেলেছেন। একটু ধীর চিত্তে বসুন। ”

উর্মি এদিক টা আসার সময় হঠাৎ ই মনে পরলো আসার পথে বাবুর জন্য বেবি ফুড নেওয়ার কথা। ঘড়িতে অনেক টা টাইম চলে গেছে। উর্মি কোনো মতে বেরিয়ে এলো। এতো সব চিন্তা আর মাথায় যাচ্ছে না।
.

মেঘনার মেয়ের নাম সাগরিকা। অনেক কষ্ট করে এই নাম টা খুঁজে বের করেছে সমীর। প্রথমত সে চেয়েছিল বাচ্চা টার নামের সাথে নিজের নাম টা জড়িয়ে দিতে। তবে সেটা মিলাতে পারছিল না। এখানে আবার উর্মি আর মেঘনার নাম থাকা ও জরুরী। অবেশেষ সাগরিকা নাম টি বের করেছে সে। তার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে মিলিয়ে উর্মি আর মেঘনার মিশ্রনে মোটামুটি মিল করে রাখলো নাম টি। সবাই বেশ পছন্দ করেছে। উর্মি বেবি ফুড নিয়ে এসে দেখলো সৌজন্য সব খাবার আগেই এনে রেখেছে।
” ভাইয়া টাকা পেলে কোথায়? ”

” সামনেই একটা কাজ পেয়েছিলাম। নর্মাল কাজ। হাজার টাকার কিছু বেশি দিয়েছিল। সেটা দিয়েই সাগরিকার জন্য খাবার নিয়ে আসলাম।”

” ওও আচ্ছা। ”

হাজার টাকার কিছু নোট বের করে সৌজন্য কে দিলো উর্মি। আলতো হেসে সৌজন্য বলল
” কি দিনকাল এলো। ভাই তার বোনদের খাওয়া বে সেটা না করে বোন ভাই কে খাওয়াচ্ছে। ”

” এসব কথা বলিও না প্লিজ। ”

” কষ্ট হয় রে বোন। ”

” রাখো সেসব কথা। এখন টাকা টা রাখো, তোমার ও হাত খরচ লাগবে। ”

” লাগে না আমার। ”

” আমি জানি সেটা। তবু ও। ”

” রেখে দে তোর কাছে। প্রয়োজন হলে নিবো। ”

উর্মি জানে টাকা টা নিবে না তার ভাই। এক রাশ হতাশার শ্বাস ফেলে ফ্রেস হয়ে আসে। বড় ভাবী খাবার দিয়ে যায়। অন্তু আগে থেকেই খাচ্ছিল।
” এক্সাম কবে? ”

” সামনের মাসে। ”

” ওও ঠিক আছে। বেতন বাকি আছে তাই না? ”

” হ্যাঁ ছোট ফুপি। ”

” বলতে পারবি কত মাসের? ”

” চার মাসের টা। সাথে কিছু এক্সাম না দেওয়ার কারনে জরিমানা ও হয়েছে। ”

” কত টাকা হয়েছে সব মিলিয়ে। ”

” ম্যাম বলেছে সাড়ে ছয় হাজার টাকা। ”

” ওও। ”

নীরবে খেয়ে চলে এলো উর্মি। বড় ভাইয়া যে এখন বেতন হীনভাবে বসে আছে সেটা জানে উর্মি। এতো বড় ফ্যামিলি চালানো কোনো ছেলের পক্ষে ও চারটি কথা নয় সেখানে ও মেয়ে হয়ে কতো টা চিন্তিত!

মেঘনা মাথার কাছ টায় বালিশ রেখে বলল
” তুই আর সৌমেন স্যার এর বাসায় যাস নে। ”

” কেন রে আপা। ”

” আমার মনে হচ্ছে তোর কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে। ”

” কিছুই হবে না। এই টুকু চোট দেখেই তুই কি সব ভাবিস বল তো। ”

” এইটুকু এটা?”

ইষৎ হাসলো উর্মি। মনে মনে সে ও বেশ ভরকে আছে। তবে উপরে উপরে শক্ত রইলো। আবরণে ঢেকে রাখা শরীর টা কে এগিয়ে নিয়ে সমীর কে কল করলো। আজ সমীর কে বেশ ব্যস্ত শোনালো। উর্মি নিচু কন্ঠে শুধালো
” তুমি কি ব্যস্ত আছো সমীর? ”

” না জাস্ট একটু প্রবলেম এ আর কি। ”

” সেকি! ”

” ব্যস্ত হইয়ো না। আমি ঠিক আছি। ঐ দিকে কি অবস্থা? ”

” সব ঠিক ই আছে। ডাক্তার বাবু আর আপা কে কিছু টেস্ট করাতে দিয়েছেন। ”

” সাগরিকার ঠান্ডা কমেছে? ”

” উহু। সেটা নিয়েই ভাবাছি। ”

” ভালো করে চেকাপ করাও। ”

” হুম। ”

” আর শোনো। ”

” হ্যাঁ। ”

” নিজের যত্ন নিও। তুমি সব কিছু সামাল দিতে গিয়ে নিজের অযত্ন করে যাচ্ছো। সব কিছুর সাথে সাথে নিজেকে ও তো গুরুত্ব দিতে হবে তাই না। আর একদম বলবে না যত্ন নিচ্ছো নিজের। আমি জানি সব টা। যদি কাছাকাছি থাকতাম ধরে বেঁধে নিয়ে আসতাম। একদম ফাকিবাজি না ওকে। ফিরে এসে আমার উর্মি কে বউ করে নিবো। বুঝেছো মেয়ে আমার শখের বউ। ”

কলমে ~ ফাতেমা তুজ
চলবে….

#শখের_সাদা_শাড়ি [ সমাপ্তি পাতা ]
২১.
ডুকরে কেঁদে উঠে উর্মি। সমস্ত টা এলোমেলো লাগছে। মেয়েটির তুলতুলে গালে জলের স্রোত নেমেছে। শরীরে জড়িয়ে রাখা দামী লাল বেনারসি। গা ভর্তি করা দামী সব অর্নামেন্টস। মেকাপে লেপ্টে আছে মুখমন্ডল। তবে জলের কারনে সব ছিন্নভিন্ন। উর্মির কান্না গুলো কেউ শুনতে পায় না। লুকিয়ে কাঁদে মেয়েটি। মাঝে কেঁটে গেছে ছয় টা দিন। এই ছয় দিনে এতো পরিবর্তন এসেছে জীবনে যা হয়তো উর্মির মন টাকেই কুচি কুচি করে ফেললো। সাগরিকার রিপোর্ট এসেছে। বাচ্চা মেয়েটির ব্রেনে প্রবলেম দেখা দিয়েছে। অতি দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন। আর সে জন্য প্রয়োজন কোটি টাকা। উর্মি যেন সব কিছু হারিয়ে বসে। এদিকে ডাক্তার বলেছেন সপ্তাহ খানেক এর মধ্যে চিকিৎসা না করালে বাচ্চা টি হয়তো বা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হয়ে যাবে। অন্য দিকে সৌজন্য কে পুলিশে ধরে নিয়েছে। তুলি আর নয়ন মিলে ছেলেটা কে এমন ভাবে ফাসিয়ে দিয়েছে যে এর থেকে নিস্তার পাওয়া হলো দুষ্কর। পুলিশের নিকট টাকা ছাড়া কোনো কিছুর ই মূল্য নেই। আজ সকালেই উর্মি জানতে পেরেছে নয়নের বোন নিতু ছিল সৌজন্যের জুনিয়র। আর নিতু সৌজন্য কে পছন্দ করতো। তবে সৌজন্য নাকোচ করায় মেয়েটা আত্ম ‘ হ ‘ত্যা করে। সেই জন্য ই নয়ন আর তুলি মিলে সৌজন্যের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। উর্মির মাথার উপর ছাদ নেই যেন। সমীর এর ও পাত্তা নেই। সেদিন যে বললো নিজের খেয়াল রেখো এর পর আর কথা হয় নি। ফোন বন্ধ। উর্মি দিশেহারা। সৌমেন আবার উর্মি কে মাইশা ভেবে রেখেছে। দিন রাত উর্মির সাথে চিপকে যাচ্ছে। উর্মি চলে আসলেই ভাঙচুর করে আর নিজর উপর আঘাত করে। এসব সামলে ও শেষ রক্ষা হলো না। সেদিন সৌমেন নিজের হাতে ছুড়ি চালিয়েছে। ভাগ্যিস শিরা কাঁটে নি। তবে মাহফুজ সাহেব ছেলের মঙ্গলের জন্য উর্মির হাত চেয়েছিল। তবে উর্মি সরাসরি না বলেছে। এতে করে লোকটা উর্মির পা অব্দি ধরেছে! তবে উর্মি যে সমীর কে ভালোবাসে। উর্মি সেদিন ই চাকরি ছেড়ে চলে আসে। বাসায় এসে জানতে পারে সাগরিকার কথা। এর পর থেকে উর্মির মাথা খারাপ। বাচ্চা টি কে জড়িয়ে ছিলো সারা রাত। মেঘনা তো পাথর বনে গেছে। কি বলবে সে জানে না। উর্মির এই করুণ পরিস্থিতি তেই ডিল করেন মাহফুজ সাহেব। উর্মি বার বার সমীর এর নিকট কল করে তবে ছেলেটার ফোন বন্ধ বলে। উর্মি দরজা লাগিয়ে দিলো। আবার নাম্বার ডায়াল করলো তবে কোনো প্রকার আশা এলো না। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হলো। উর্মি চোখ মুছলো। মেঘনা কে দেখে আবারো কেঁদে উঠলো।
” আপা ”

” তুই কেন এভাবে নিজেকে বিসর্জন দিচ্ছিস উর্মি? ”

” সাগরিকার অপারেশন। ”

” কিছু হবে না আম‍াদের মেয়ের। তুই প্লিজ এমন টা করিস না। এখনো সময় আছে। ”

” সমীর কে পাচ্ছি না তো আপা। কি করবো আমি? ”

” এতো ভেবে কিছু হবে না উর্মি। তুই এই বিয়ে ভেঙে দে। এতো টা কেন করবি তুই।”

” কি বলছিস কি আপা! সাগরিকা আমার ও মেয়ে। ”

মেঘনা এবার সশব্দে কেঁদে উঠলো ” কেন সব সময় আমাদের জন্য তোকে বিপদে পরতে হবে বল তো। তোর জীবন নেই না! কেন এতো ভাবিস বোন। নিজের জীবন টা এভাবে কেন ভাসাচ্ছিস। তুই তো পারবি না সমীর কে ছেড়ে থাকতে। ”

” আমার কপালে যা আছে তাই হবে রে আপা। সাগরিকার কাছে যা তুই। কাল রাতে ও ঘুমাতে পারে নি। মাথায় খুব যন্ত্রণা করে মনে হচ্ছে। ”

” বোন প্লিজ একবার ভাব। ”

” ভেবেছি। তুই যা এখন। আমি একটু একা থাকতে চাই। ”

মেঘনা চলে যায়। যাওয়ার পূর্বে আবার ও একি কথা বলে যায়। দুমন দুআশা নিয়ে বিপাকে পরে উর্মি। মেয়েটার মস্তিষ্কের ভেতর যন্ত্রণা। সৌমেন কে বিয়ে করলে সাগরিকার অপারেশন আর সৌজন্যের বেল করিয়ে দিবেন মাহফুজ সাহেব। তবে সমীর এর কি হবে?
ছেলেটার মুখ টা চিন্তা করতেই উর্মির হৃদয় টা দহন হতে শুরু করেছে। এতো বেশি খারাপ লাগলো যে মুখে উড়না গুজে কাঁদতে লাগলো। তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। যদি ফোন আসে সমীর এর।

এয়ারপোর্ট এ এসে সমীর বলল
” বাবা তোমার ফোন টা দাও তো একটা কল করবো। ”

সওলাত খান ছেলে কে ফোন এগিয়ে দেয়। সমীর দ্রুত ফোন তুলে নেয় হাতে। উর্মির নাম্বারে বার কয়েক কল দেয় তবে কল রিসিভ হয় না। নিজের উপর রাগ হয় সমীর এর। সওলাত খান ছেলের কাধে হাত রেখে বললেন
” আসো, লেট হয়ে যাচ্ছে। ”

” হুম বাবা। ”

ফোন সুইচ অফ করার পূর্বে লাগাতার কল করে সমীর। অথচ রিসিভ হয় না। সমীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্লেনে উঠে বসে।এয়ারহোস্টেস ওয়াইন অফার করতেই ছ্যত করে তুলে নেয় সেটা। খানিক টা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন সওলাত খান। ছেলের এতো টা বিরক্তি আর চিন্তিত অশান্ত মুখ আগে কখনো দেখেন নি।
” হোয়াট হ্যাপেন মাই বয়? ”

” নাথিং বাবা। জাস্ট ভালো লাগছে না। ”

” ফোন নিয়ে চিন্তিত? তোমায় তো বললাম ফোন কিনে নাও। তুমিই তো সময় নিতে চাইলে না। ”

মৌন রইলো সমীর। মাথা টা নিচু করে হাত কচলাতে লাগলো। শরীর কাঁপছে থর থর করে। বুক টা কেমন অশান্ত। কত দিন হলো উর্মির সাথে যোগাযোগ নেই। এমন জায়গায় ছিল যেখানে নেটওয়ার্ক নেই। আর আজ যখন নেটওয়ার্ক সীমার মধ্যে এলো ঠিক তখনি ফোন টা চুরি হয়ে গেল। কেন যে এমন হচ্ছে।

ব্যলকনি থেকে ঘরে আসে উর্মি। চারপাশ টায় গানের উচ্চস্বর ভাসে। সেসবের জন্য কান যেন তালা লেগে আছে। উর্মি ঘরে এসে ফোন টা হাতে তুলেছে মাত্র ঠিক তখনি ঘরে ঢুকে যায় আশে পাশের সব মানুষ। সবাই বলাবলি করছে বর এসে গেছে। আর উর্মি কে এখনি নিয়ে যেতে হবে। সকলের জোড়াজোড়ি তে উর্মি ফোন টা অন ও করতে পারলো না। সবাই এক প্রকার টেনে নিয়ে গেল ওকে।

দেহে প্রাণ না থাকলে চোখ মুখ যেমন দেখায় উর্মি কে ও ঠিক তেমনি দেখাচ্ছে। উর্মি অশান্ত ভেতরে। সামনে তাকিয়েই চোখে পরে সৌজন্য। ভাই কে দেখে না কেঁদে পারে না মেয়েটা। ছুটে এসে দু হাতে জড়িয়ে ধরে। সৌজন্য হতবাক! তার এই দুদিনের বোন টা এতো বড় হয়ে গেল। সে আজ বিয়ের পিরিতে?
” পাকামো করতে বলেছে কে উর্মি? ”

” তুমি ঠিক আছো তো ভাইয়া। আমি জানি ওরা খুব খারাপ। মেরেছে খুব? ”

কথার ফাকে ফাকে সৌজন্যের গাল হাত ছুঁইয়ে দিচ্ছিলো উর্মি। মাহফুজ সাহেব নিকটে এলেন। উর্মি তখনো তার ভাই কে দেখতে ব্যস্ত। মাঝে সাগরিকার শরীর টা খারাপ করায় তাকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। মাহফুজ সাহেব আলাদা হলেন উর্মি কে নিয়ে
” আমি কিন্তু কথা রেখেছি উর্মি। তুমি এখন তোমার কথা রাখবে। ”

” জী স্যার। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।”

জবাব দিলেন না মাহফুজ সাহেব। উর্মির চোখে মুখে খুশি। তার ভাই কে আর কেউ আঘাত করবে না। যন্ত্রণায় কাতরাতে হবে না ছোট্ট শরীর সাগরিকা কে। এর থেকে খুশির আর কিইই বা হতে পারে?

প্লেন ল্যান্ড করতেই সমীর এর শরীর টা কেঁপে উঠলো। হাওয়া কেমন গম্ভীর লাগে। যেন নিস্তব্ধ হতে শুরু করেছে এই পৃথিবী। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই চোখে পরে শৌখিন আর প্রবীণ কে। দুজন কেই চিন্তিত ঠেকে। সমীর কে দেখে ওরা ছুটে আসে। হাপানোর মতো সময় ও নেই যেন।
” কি রে? তোরা এখানে! ”

” সময় নেই। তুই আগে চল। ”

” কি এমন হয়েছে? ”

” আরে চল না ভাই। প্লিজ প্রশ্ন করিস না।”

” কিন্তু বাবা। ”

” আঙ্কেল এর সাথে পরে যোগাযোগ করিস। এখন চল ভাই। না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ”

সমীর কে টেনে বসালো দুজন। শৌখিন এর মুখ টা পাথর সম্য। আর প্রবীণ এর চেহারা উদাস।
” কি হয়েছে এবার তো বল। ”

প্রবীণ আর শৌখিন একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে তারপর ই শৌখিন বলে ” তোকে এতো বার কল করেছি। কিন্তু ফোন বন্ধ বলে। তারপর আঙ্কেল এর ম্যানেজার এর সাথে বহু কষ্টে কথা বলে জানতে পারলাম দেশে ফিরছিস আজ। প্লেনে তাই ফোন সুইচ অফ।”

” হ্যাঁ। ফোন টা চুরি হয়ে গেল। কিন্তু কি হয়েছে কি তাতে? ”

” উর্মির বিয়ে।”

” ও আচ্ছা। ”

আনমনেই উত্তর করে সমীর। শৌখিন আর প্রবীণ হা হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড পর কথা মিলায় সমীর। তার পর পর ই অনুভব হয় পায়ের তলায় মাটি নেই। ধীরে ধীরে শরীর কেঁপে উঠে। একবার মনে হয় এরা মজা করছে আবার মনে হয় এটা স্বপ্ন। অদ্ভুত ভাবে নিজেকে পাগল পাগল অনুভব হয়। শৌখিন জানায় সৌমেন এর সাথে বিয়ে হচ্ছে উর্মির। ঝড়ের গতিতে শৌখিন এর ফোন নিয়ে উর্মির নাম্বারে কল করে। কিন্তু ফোন টা রিসিভ হয় না। সমীর কে পাগল পাগল দেখায়। প্রবীণ আলগা হাতে সান্ত্বনা দেয়।
” দোস্ত এটা কি করছে উর্মি? আমি কেম্নে বাঁচবো ওকে ছাড়া। আমাদের বিয়ের কথা ছিলো। ”

সমীর এর চোখ ভিজে যায়। মাথা টা খোলসা ঠেকে। এক হাতে লাগাতার উর্মির নাম্বারে কল করে।

বাচ্চাদের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে উর্মির ঘরে এসে লুকায় অন্তু। খাটের পেছনে লুকাতেই চোখ পরে ফোন টায়। রিং হচ্ছে। মেঝে থেকে তুলে ফোন। রিসিভ করবে কি না এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কল কেঁটে যায়। আবার কল আসে। অন্তু এবার চটজলদি রিসিভ করে।
” হ্যালো উর্মি, আমার কথা শুনতে পাচ্ছো তুমি? আমি সমীর বলছি। কি হলো কথা বলো না ক্যান। ”

” সমীর আঙ্কেল। ”

” অন্তু! অন্তু উর্মি কে ফোন দাও বাবা। দ্রুত ফোন দাও ফুপি কে। ”

” ফুপি কে তো নিয়ে গেছে।”

” নিয়ে গেছে কোথায় নিয়ে গেছে? ”

” বিয়ে করাতে। ”

” ওও শীট! অন্তু এখনি যাও, গিয়ে বলো সমীর আঙ্কেল ফোন করেছে। মিস যেন না হয় বাবা। প্লিজ। ”

” ওকে আঙ্কেল আমি এখনি যাচ্ছি। ”

অন্তু ফোন হাতে ছুট লাগায়। সমীর এ পাশ থেকে হায় হতাশ করছে। তাঁর উর্মি সাথে অন্য কাউ কে কল্পণা করা মোটে ও সম্ভব না। শৌখিন খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিল। তবে হঠাৎ ই রেড সিগন্যাল পরলো। সমীর গাড়ির দরজায় লাথি মারে। সমস্ত সমস্যা এখনি পরতে হলো। এক সেকেন্ড সময় ব্যয় করে না ছেলেটা। এখান থেকে উর্মিদের বাসা হাঁটা পথে দশ মিনিট। ছুটে গেলে কয়েক মিনিট লাগবে।
সিগন্যাল ভেঙে ছুট লাগায় সমীর। পেছন থেকে পুলিশ আসতে থাকে। তবে সেসব দেখার সময় নেই সমীর এর।

বড় বড় মানুষ দের সামনে অন্তু খুব ই ছোট। সবাই কে ঠেলে ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করছে ছেলেটা। তবে সে পারছে না কিছু তেই। তাই ডাকলো ” ফুপি ফুপি, শোনো না আমার কথা। ও ফুপি। ”

এতো ভীরের মাঝে ও অন্তুর কন্ঠ টা কানে এলো উর্মির। বুক টা ছ্যত করে উঠলো। উর্মি মাথা উঁচু করে খুঁজতে লাগলো। এ দিক থেকে কাজি সাহেব বলছেন কবুল বলার জন্য। উর্মি ধ্যানহীন ভাবে তাকানো তবে মুখ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ করছে না। মাহফুজ সাহেব উর্মির কাছে এসে বসেছেন।
” তোমার কথা পূরণ করার সময় এসেছে উর্মি। ”

বুকের ভেতর কেউ যেন কেঁটে লবন লাগিয়ে দিচ্ছে। উর্মি চোখ বন্ধ করলো। সাগরিকার মুখ টা ভেসে আসে। বাচ্চা টি নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাচ্ছে। ওর মুখের একটি কথার জন্য সাগরিকার চিকিৎসা আটকে আছে। সমীর এর মুখ টি শেষ বারের মতো মনে করলো উর্মি। চোখ থেকে নেমে গেল নোনা জলের ফোঁয়ারা। মনে মনে বলল আমি তোমাকে ভালোবাসি সমীর। পারলে আমায় ক্ষমা করো। আর তারপর ই বলে দিলো ‘কবুল।’

চারপাশ থেকে আলহামদুলিল্লাহ্ শোনা গেল। অন্তু সুযোগ পেতেই জোর গলাতে বলল
” ফুপি সমীর আঙ্কেল কল করেছে। ”

মাথা ঘুরিয়ে পরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে উর্মির। সকলে তাকিয়ে গোল চোখে। দরজার ফটকে এসে দাঁড়ানো সমীর। হাত টা কেঁপে উঠলো। উর্মির চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। দু পা এগিয়ে এলো সমীর আবার পিছিয়ে গেল কয়েক পা। হাতে থাকা গোল্ড দিয়ে তৈরি করা ব্যাগ টা পরে গেল মেঝের উপর। বেরিয়ে এলো উর্মির স্বপ্নে দেখা বহু মূল্যবান সেই সাদা শাড়ি। যেই স্বপ্ন টা শেয়ার করেছিল সমীর এর নিকট। শখ করেছিল ওমন শাড়ি পরবে বিয়ে তে। ঠিক তখন থেকে যত্ন করে একটু একটু করে তৈরি করা হয়েছে এই শখের সাদা শাড়ি। শখের জিনিস তৈরি হলো ঠিক তবে শখ টা রইলো না আর। এক অদ্ভুত দেয়াল সৃষ্টি হলো সমীর আর উর্মির মাঝে। উর্মি এগিয়ে আসছে সমীর এর নিকট, খুব কাছাকাছি এসেছে দুজনে তবে কেউ কাউ কে ছুঁতে পারছে না। এ জীবনে বোধহয় আর কোনো শখ ই রইলো না। উর্মি আর সমীর ছটফট করছে। কি করে বাঁচবে জীবনের সব থেকে বড় ব্যর্থতা নিয়ে?

সমাপ্ত

কলমে ~ ফাতেমা তুজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here