#শখের_সাদা_শাড়ি_২,পর্ব-০১,০২
লেখা : ফাতেমা তুজ
#সূচনা_পর্ব
নিজের পাগল স্বামীর জন্য বাসর ঘরে অপেক্ষা করছে উর্মি। অথচ ছেলেটার আসার নাম ই নেই। ক্ষণিক পূর্বেই স্বীয় ভালোবাসার বিসর্জন দিয়ে সৌমেন কে বিয়ে করেছে সে। যখন দেখলো বিয়ের আসরে নিজের ভালোবাসার মানুষ টি এসেছে তখন মনে হয়েছে এই পৃথিবী টা ওর জন্য কেবল জাহান্নাম। তবে সময়ের স্রোত ওকে মনে করিয়ে দিয়েছে সৌমেন এর জন্যেই সাগরিকা আজ বেঁচে আছে। অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। তাছাড়া সৌজন্য ভাই কে ও জেল থেকে বেল করানো হয়েছে। সব মিলিয়ে উর্মির মাথার বোঝা মুক্ত তবে মনের বোঝা বেড়েছে। নিজের ভালোবাসা কে বিধ্বস্ত হতে দেখে উর্মির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। সমীর এর চোখে থাকা অদৃশ্য জল উর্মির হৃদয় কে করেছে এক সাগর সম ব্যথীত। হায়রে ভালোবাসা!
কপাট রাগ নিয়ে ব্যলকনি তে এসে দাঁড়ায় উর্মি। অর্ধবৃত্তাকার চাঁদ আজ অপূর্ব ভাবে আকাশের বুকে মিশে আছে। চোখ নড়াতে পারে না মেয়েটি। বুকের ভেতর টা আগুন এর উত্তপ্ত শিখায় ঝলসে আসে। তবু মুখ থেকে টু শব্দ নামে না। চোখে মুখে হঠাৎ শীতলতা লেপ্টে আসে। এই বিয়ে টা কে কোনো বিয়ে বলা যায় কি আদৌ? তাছাড়া সৌমেন অসুস্থ। উর্মি কে নিজের গার্লফ্রেন্ড এর সাথে গুলিয়ে ফেলেছে। সে জন্যেই না উর্মির জন্য অস্থির হয়ে উঠে। সব কিছু বাদ দিয়ে হলে ও উর্মি কে মাইশা বলে সম্মোধন করে চলেছে সৌমেন। যখন সে সুস্থ হবে তখন নিশ্চয়ই এই বিয়ে টাকে মুক্ত করে দিবে। উর্মি বুক ভরে শ্বাস নেয়। বিয়ে টা কেবল এক অসুস্থ মানুষ কে সুস্থ করার দায়বদ্ধতা। একজন মানুষ হিসেবে উর্মি পাশে দাড়িয়েছে সৌমেন এর। এর বাইরে কিছুই নেই। উর্মি তো কেবল একটি মানুষ কে ভালোবাসে। যে মানুষ টি কে আজ দহন দিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা তিন ছেড়েছে। উর্মির ভেতরে যন্ত্রণা হয়। চট করে ফোন করে সমীর কে। কি আশ্চর্য এই গভীর রাত্রি তে ও এক সেকেন্ডেই কল রিসিভ হয়। অথচ গত কয়েক টা দিনে ঘন্টার পর ঘন্টা সমীর কে কল করেছে। কোনো রেসপন্স আসে নি। উর্মির কান্না আসে। শরীরে এখনো জড়ানো বিয়ের লাল রঙের বেনারসি। জীবন টা বুঝি সত্যিই রঙিন হয়েছে? যদি রঙিন হয়েই থাকে তবে ওর অন্তরে কেন এতো ব্যথা!
কয়েক টা শ্বাসের শব্দ শোনে উর্মি। সমীর এর যন্ত্রণা গুলো যেন চোখে ভাসে। ঠোঁট কামড়ে কান্না থামায়।
” এতো রাতে জেগে আছো কেন? ”
শীতল কন্ঠ সমীরের। অবাক হয় উর্মি। ছেলেটার এমন স্তব্ধতা ওকে বাধ্য করে চিন্তিত হতে। সমীর এবার কঠোর কন্ঠে শুধায় ” এতো রাতে জেগে আছো কেন? বলেছি না বারো টা আগে ঘুমিয়ে পরবে। কথা শোনো না কেন। ”
” সমীর আমি ”
কথা হারিয়ে যায় উর্মির। কি বলবে বুঝে উঠে না। সহজ করে সমীর। মৃদু কন্ঠে বলে
” রাত হয়েছে অনেক। ঘুমিয়ে পরো। ”
” ঘুম আসছে না। ”
” চেষ্টা করো আসবে। ”
” উহু। ”
” বাচ্চাদের মতো করে না উর্মি। দূর্ঘটনা হবেই জীবনে। তাই বলে শরীর কে কষ্ট দিবে? ”
” আমার ভালো লাগছে না সমীর। আমি ম’রে যাবো। সত্যিই ম’রে যাবো এবার। ”
কথার মাঝে ডুকরে উঠে উর্মি। সমীর কঠোর হয়। তার নিজের ও খুব কষ্ট হচ্ছে তবে সেটা বুঝতে দেওয়া চলবে না। সামনে অনেক টা জার্নি। উর্মি কে ভেঙে পরলে চলবে না। তাছাড়া উর্মির কান্না,ফোলা চোখ সমীর কে ও ভেঙে দেয়। সেই জন্যেই সমীর কল রেখে দেয়। ব্যস্ত হয়ে যায় উর্মি। ওর কেবলি মনে হয় সমীর ওকে ভুল বুঝেছে। ছেলেটা বোধহয় ওকে প্রতারক ই ভাবে। চটপট ম্যাসেজ লিখে
” আমি তোমাকে ভালোবাসি সমীর। এই বাজে পরিস্থিতি কেন কীভাবে হলো আমি জানি না। তবে আমি তোমাকে ছাড়া এক সেকেন্ড ও থাকতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমার সর্বাঙ্গে বি’ষ ঢুকে পরেছে। প্লিজ সমীর আমাকে বাঁচাও। আমি ম’রে যাচ্ছি। মস্তিষ্ক আর মনের যুদ্ধে আমি হেরে যাচ্ছি। পারছি না আর। ”
পলক হীন ভাবে ফোনের স্ক্রিনে তাকানো সমীর। মেয়েটি তবে এই ভুল সম্পর্ক টা কে বদলাতে চাচ্ছে। খুশি তে চোখে জল নেমে আসে। ছেলেটা চট করে কল করে বসে। আবার কেঁটে দেয়। ফোন করলে উর্মি নিশ্চয়ই কাঁদবে। আর সে কান্না ওর সহ্য হবে না। তাঁর থেকে বরং উর্মি কে ম্যাসেজ করা যাক। তাই সে লিখে পাঠায়
” কাল কে দেখা করতে পারবে? ”
সারা রাত চোখের পাতা বুজে নি উর্মি। আর না কেউ এসেছে ঘরে। ফুলে সজ্জিত ঘরে এখনো কাঁচা ফুলের সুবাসে ম ম করছে। বাসর ঘরের কোনো খামতি নেই শুধু খামতি আছে দুটো মানুষের ভালোবাসার। এসব ভেবে উর্মির মন তিক্ত হয়ে উঠে। সাথে সাথে একটা স্বস্তির স্থান ও তৈরি হয় এটা ভেবে যে সৌমেন আসে নি ঘরে। উর্মি আশাবাদী সৌমেন নিশ্চয়ই কোনো বাজে আচারণ করবে না। তাছাড়া সৌমেন এর মস্তিষ্ক এখন শিশু সুলভ আচারণে মেতে আছে। সেই হিসেবে কিছু হওয়ার চান্স ও নেই। বাহিরে বের হওয়ার পূর্বে গোসল করে আসে উর্মি। নিচে নেমে দেখতে পায় ঘরোয়া আয়োজন চলছে। এসব দেখে উর্মির মন খারাপ হয়। তবে সে বিয়ের পূর্বেই মাহফুজ সাহেব এর সাথে একটি চুক্তি করেছে। সেটা হচ্ছে সৌমেন সুস্থ হলেই উর্মি এই দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। মাহফুজ সাহেব প্রথমে রাজি না হলে ও পরে রাজি হয়ে যান। তবে শর্ত ছিল এমন যে কথা টা সৌমেন এর মা বা অন্য কেউ যেন না জানে। উর্মি অবশ্য এ বিষয়ে কিছু বলে নি। সিড়ি দিয়ে নামতে দেখে এগিয়ে এলেন সৌমেন এর মা লতিফা বেগম। উর্মি সালাম জানালো। লতিফা বেগম পরম আদরে জড়িয়ে ধরলো উর্মি কে।
” আমার ছেলের জন্য যা করলে সেটার জন্য সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তোমার কাছে। বসো তুমি আমি নাস্তা দিচ্ছি। ”
” না আন্টি আমি এখন নাস্তা করবো না। ”
” ওমা কেন? ”
” একটু বের হবো। ”
” বের হবে। ”
লতিফা বেগমের মুখ টা কেমন কালো আঁধারে নেমে এলো। মাহফুজ সাহেব সোফা তে বসা ছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে বললেন ” কোথায় যাবে উর্মি? ”
” একটা ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করতে। ”
” ঠিক আছে। গাড়ি নিয়ে যেও। ”
” না না স্যার প্রবলেম হবে না আমার। ”
” ওমা স্যার কেন বলছো? বাবা বলে ডাকো। ”
লতিফা বেগম এর কথায় একটু চমকালো উর্মি। ওর ভয়ার্ত মুখ দেখে মাহফুজ সাহেব বললেন ” সমস্যা নেই। সময়ের সাথে সাথে হয়ে যাবে। ”
” আমি তাহলে যাচ্ছি আন্টি। ”
” ঠিক আছে মা। যাও, আর একটু দ্রুত ফিরো। দুপুরে তো তোমার বাসা থেকে লোকজন আসবে। ”
” জী। ”
বাহিরে বের হয়ে স্বস্তির দম ফেলে উর্মি। এতো টা হাঁফসাঁফ লাগছিল ওর। জীবনে প্রথম বারের মতো নাটক চালাতে হচ্ছে ওকে। উর্মি ভেবে পায় না কি হতে চলেছে। ওর মন শুধু বলে যা হচ্ছে তা ঠিক না।
সমীর কে দেখে বোঝার উপায় নেই ছেলে টা মনের দিক থেকে একদম ই ভেঙে গেছে। কতো টা সহজ সরল দেখাচ্ছে ওকে। পোষাকের সৌন্দর্য্যের কোনো খামতি নেই। চেহারায় রয়েছে সামন্য মলিনতা তবে সেটা বুঝতে হলে প্রয়োজন এক জোড়া গভীর চোখ। শীতল চোখে তাকানো উর্মি হঠাৎ ই ভীষণ লজ্জিত অনুভব করে। মেয়েটির আড়ষ্টতা লক্ষ্য করে সমীর। তাই কাছে এসে দাঁড়ায়। আলতো করে হাসে।
” কি হলো এমন লাল টুকটুকে হচ্ছো কেন? ”
লাল টুকটুকে কথা টা শুনে উর্মির রাগ হয়। কেন হয় জানা নেই। সমীর আবার হেসে উঠে। দুজনের মাঝে একটু দূরত্ব সৃজন হয়েছে বই কি। কেমন যেন অদৃশ্য দেয়ালে আটকে আছে। দুজনেই চুপচাপ। মনে হয় বিচ্ছিন্নতার কতো বছর পর আবার দুজনের দেখা। অথচ এই তো কাল রাতে কথা হলো। কাল সন্ধ্যা তেই হয়েছে দর্শন। তবু কেমন যেন একটা অনুভূতি কাজ করছে। উর্মি কথা খুঁজে পায় না। সমীর মৌনতা ভাঙে
” না খেয়ে চলে এসেছো? ”
” তুমি বুঝলে কি করে? ”
” আমি বুঝবো না তো কে বুঝবে? ”
“ধ্যত বলো না কি করে বুঝলে। ”
” এমনিই বুঝে গেছি। ”
” মিথ্যে। ”
” ভালোবাসার জোড়ে বুঝেছি ম্যাডাম। ”
হেসে ফেলে উর্মি। সমীর এর গায়ে আলতো করে চাপড় মেরে বলে ” পাগল তুমি। ”
দুজনেই হাসে কিয়ৎক্ষণ। পর মুহূর্তেই কেমন করে যেন দমে যায়। উর্মির কান্না পায় ভীষণ। ছলছল নয়ন দেখে সমীর দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দেয়।
” আমি ও নাস্তা করি নি। চলো, আগে নাস্তা করে নেই। ”
উর্মি নিরবে হাঁটে। আগে দুজনে হাতে হাত রেখে চললে ও আজ দুজনের মাঝে এক হাত সমান দূরত্ব। উর্মি কষ্ট অনুভব করে তবে সমীর মুখ টা হাসি হাসি করে রাখে। অভিমান হচ্ছে উর্মির। ছেলেটা কেন বুঝে না ওর মন?
দুজনে নাস্তা করে। এই সময় টা তে অনেক টা সহজ হয়ে উঠে পরিস্থিতি। আইসক্রিম, ফুচকা, নৌকায় চড়া কোনো টাই বাদ দেয় না ওরা। ঘড়ির কাঁটা কখন যে তিন পেরিয়ে যায় খেয়াল ই হয় না। যখন মনে পরে তখন সাড়ে তিন টে বাজে। উর্মি মন খারাপ নিয়ে বলে
” যেতে হচ্ছে এখন। ”
” ঠিক আছে। আমি পৌছে দেই? ”
” উহু। ”
” রিক্সা ঠিক করে দেই? ”
” আচ্ছা। ”
হাঁটতে হাঁটতে মেইন রোডে আসে ওরা। রিক্সা দেখা যাচ্ছে না। বেশ অনেক টা সময় পর রিক্সা পায়। যাওয়ার পূর্বে উর্মি তাকিয়ে থাকে। সমীর ও একি ভাবে তাকানো। চোখ দুটো ছলছল করে। প্রতি বার যাওয়ার আগে উর্মির কপালে চুমু খেত সমীর। কতো বার ঠোঁট স্পর্শ করাতো গালে সেটা ধারণার অতীত। অথচ আজ যোজন যোজন দূরত্ব মেপে চলতে হয়। জীবন টা কে অর্থহীন মনে হওয়া স্বাভাবিক। সমীর এর নিকটে এসে উর্মি বলে
” সব টা তো জানলেই তুমি। আমি কেবল পরিস্থিতির স্বীকার। সাগরিকার অপারেশন এর জন্য এতো গুলো টাকা প্রয়োজন ছিল। সৌমেন স্যার কে বিয়ে না করলে সাগরিকা কে বাঁচাতে পারতাম না। কি করতাম বলো। ”
” দুঃখ পেও না উর্মি। ”
” আমি জানি না কি করে এমন টা হলো। আর কেন বড় স্যার এমন করলেন। ”
আলতো করে হাসে সমীর। উর্মির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ” সৌমেন ভাই সুস্থ হলেই আমাদের ভালোবাসা আবার ফিরে পাব। আঙ্কেল নিজের ছেলের জন্য এমন একটা কাজ করেছে। এতে ওনাকে ও দোষ দেওয়া চলে না। তাছাড়া তুমি নিজেকে ও দোষ দিবে না। আমি যদি তোমার সাথে কথা বলতে পারতাম তাহলে এমন একটা পরিস্থিতি আসতোই নাহ। দোষ টা আমার উর্মি। আমার জন্য তোমাকে কষ্ট করতে হচ্ছে। তবে আই প্রমিস আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকবো সর্বদা। ”
চলবে……….
#শখের_সাদা_শাড়ি_২
২.
বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। খানিক টা ভয় নিয়েই শশুর বাড়ি তে পা ফেললো উর্মি। আশে পাশে মানুষের ভীড় পরিলক্ষিত হলো। কেমন যেন সংকোচ কাজ করছে। হাজার হোক,সবাই তো জানে উর্মি এ বাড়ির বউ। আর এটা সত্য ও বটে। লুকিয়ে যেতে নিয়ে ও ধরা পরে গেল উর্মি। পাশ থেকে একজন মহিলা বললেন ” ঐ যে সৌমেন এর বউ। ”
কথা টা অদ্ভুত শোনালো। উর্মির কেমন অস্বস্তি হতে শুরু করেছে। তবে বউ শব্দ টা কেমন যেন সুখ অনুভূতি দেয়। উর্মি মাথা নিচু করে আরেক পা আগানোর পূর্বেই মহিলা আবার বললেন ” বউ মা পালাও কেন? এদিকে আসো তো। ”
কাছে এসে সালাম জানালো উর্মি। তিনি জানালেন সৌমেন এর ছোট খালামনি সে। দীর্ঘ সময় জুড়ে ওনারা অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত। কিছু দিন আগেই এসেছেন। ভদ্র মহিলা বেশ ভালোই গল্প জুড়ে দিয়েছেন। লতিফা বেগম ড্রয়িং রুমে এসে উর্মির নিকট হয়ে বসলেন। লেট করার জন্য উর্মি কিছু বলবে ওমন সময় তিনি বললেন
” ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও উর্মি। তুমি তো কথাই শুনতে চাও না। কি দরকার ছিল অতো দূরে গিয়ে ঔষধ কিনে নিয়ে আসার। কাউ কে পাঠিয়ে দিলেই তো হলো। ”
” আন্টি আমি। ”
উর্মির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে লতিফা বললেন ” জানি তো তুমি টেনশন করো, যে অন্য কেউ যদি ঠিক মতো ঔষধ না নিয়ে আসে। তাই বলে নিজে এতো ধকল নেওয়া টা ঠিক হলো কি? ”
ঝটকা খেল উর্মি। আবার কিছু বলতে যেতেই উর্মি কে এক প্রকার জোড় করে ঘরে পাঠানো হলো। কিছু সময় পর সে নিজে ও উপস্থিত হলেন। উর্মি কেমন ভরকে গেছে। কি হলো বুঝতেই পারলো না। দম ফেললেন লতিফা বেগম। উর্মির কাছে এসে নিচু কন্ঠে বললেন
” লুবনা আমার বোন হলে ও মানুষ হিসেবে খুব ভালো না। ওর মেয়ে আমার সৌমেন কে পছন্দ করে তবে সৌমেন বা আমরা কেউ ওর মেয়ে কে পছন্দ করি না। এমন নয় যে দেখতে ভালো না, সমস্যা হচ্ছে ওর মেয়ে টা নেশা পানি তে ডুবে থাকে। আর টাকা পয়সার জন্য ও একটা লোভ কাজ করে। ভালোবাসা টা নিছক ই লোক দেখানো।”
” ও আচ্ছা। ”
উর্মি তেমন আগ্রহ দেখালো না। লতিফা নিজ থেকেই জানালেন লায়লা সৌমেন কে নিজের প্রতি আসক্ত করার চেষ্টা করবে। যেহেতু সৌমেন অসুস্থ সেহেতু অনেক ভুল কর্ম করে ফেলতে পারে। উর্মি স্থির নয়নে শুনলো কথা। তবে আগ্রহ পাচ্ছে না একটু ও। তবু এক সময় নিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল ” আমি স্যারের খেয়াল রাখবো। ”
” এখনো স্যার? ”
” অভ্যাস তো তাই। ”
” সে নয় ঠিক আছে। তবে মা আমার ছেলে টা খুব ভালো জানো তো। ওকে আগলে রেখো। ”
লতিফা কেঁদে দিলেন। উর্মি সান্ত্বনা দিতে পারছে না। বুক টা খচখচ করছে। কি বলে সান্ত্বনা দিবে? যেখানে বিয়ে টা কেবল দায়িত্ব। যেখানে নেই স্বামী স্ত্রী আচারণ কিংবা ভালোবাসা।
রাত আটটার দিকে উর্মি লাগাতার ফোন করে জানতে পারলো কাছাকাছি এসে পরেছে সবাই।
সৌজন্য ভাইয়ের বেল টা হলেও কিছু কিছু ফর্মালিটিস এখনো বাকি। সেটার জন্য ই থানায় গিয়েছিল সৌজন্য। তাই দুপুরে না এসে রাতে আসছে সবাই। উর্মি উবু হয়ে বেডের উপর গা এলিয়ে দিলো। সমীর এর কথা ভীষণ মনে পরছে। তবে কল করার মতো সাহস হচ্ছে না। কেন যেন একটা দ্বিধা এসে আগলে নিচ্ছে। মাথা ও ব্যথা করছে তাই চোখ দুটো বন্ধ করে রইলো কিছুক্ষণ। খানিক সময় যেতেই কাচ ভাঙার শব্দ কানে এলো। ফট করে উঠে পরে উর্মি। উড়না টেনে নিয়ে ছুট লাগায় এক প্রকার। নিচ থেকে আসছে শব্দ। দোতলার করিডোর দিয়ে নামার সময় চোখে পরে সৌমেন কে। তার ই সামনে দাড়ানো দারুণ সুন্দর এক মেয়ে। পরনে শার্ট প্যান্ট। উর্মি চিন্তা করে না মেয়ে টি কে। তবে বুঝতে পারে সৌমেন এর রাগের কারন এই মেয়েটিই। উর্মি নিচে নামতে নামতে অনেকেই এসে গেছে। সার্ভেন্ট রা কাছে আগানোর সাহস পাচ্ছে না। উর্মি চোখ দিয়ে ইশারা করে সৌমেন কে থামাতে। কাচের শো পিস গুলো মাটি তে গড়াগড়ি খায়। ঐ মেয়ে টি বলে ” হোয়াট হ্যাপেন সৌমেন? তুমি কেন এমন করছো। ”
সৌমেন কথা বলছে না শুধু মাত্র ভেঙে চলেছে। সার্ভেন্ট রা কাছে এলে ধমকে দিচ্ছে। উর্মি নিজে যায় এবার
” স্যার থামুন। প্লিজ থামুন আপনি। ”
সৌমেন এর হাতে থাকা ফ্লাওয়ার ভাস টা কেড়ে নেয় উর্মি। টেবিলের উপর রেখে এক হাতে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করে।
” আপনি শান্ত হোন। রেগে যাচ্ছেন কেনো? দেখুন আমার দিকে। ”
তাকায় না সৌমেন। রাগে চোয়াল শক্ত।
হঠাৎ ই উর্মির পায়ে বিধে যায় কাচের টুকরো। ব্যথায় ককিয়ে উঠে মেয়েটি। তৎক্ষণাৎ সৌমেন এর ঘোর কাঁটে। সে ব্যস্ত হয়ে যায় ” মাইশা! দেখি দেখি কত টা কেঁটেছে। কি যে করো না তুমি। ”
কথার মাঝ পথেই উর্মির পায়ে হাত দেয় সৌমেন। উর্মি দূরে সরে যেতে চাইলে ও আবার আটকে ধরে। অস্বস্তি তে ভরে যায় উর্মির শরীর। সৌমেন খুব যত্ন নিয়ে কাচ সরায়। তখনি সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে সমীর। উর্মির সাথে চোখাচোখি হয়। উর্মি কেমন অসহায় নিয়ে তাকায়। তবে সমীর একদম ই স্থির। ব্যথিত নয়নের দৃষ্টি লুকিয়ে কাছে আসে। উর্মির পা থেকে ঝরে লাল তরল। সৌমেন চেচিয়ে উঠে ” এই কেউ ব্যান্ডেজ নিয়ে আসো। আর মলম ও সাথে। ”
একজন সার্ভেন্ট ছুটে যায়। সৌমেন এর দৃষ্টি কেমন কঠোর হয়ে আসে। সমীর চুপ করে দেখছে বিষয় টা। হঠাৎ করেই আবার রেগে যায় সৌমেন। আচারণ হয়ে যায় বাচ্চা দের মতো। উর্মির রক্তে ভেসে যাওয়া পা ফেলে চলে যায় গার্ডেনে। উর্মি ব্যথায় মরে যাচ্ছে প্রায়। সার্ভেন্ট ব্যান্ডেজ এনে দিলে সমীর এসে বসে পাশে। ধীর হস্তে ব্যান্ডেজ করে দেয়। উর্মি চোখ খিচে আছে। ব্যথা টা পায়ে না বরং ব্যথা টা বুকে।
” চোখ খোলো। ব্যান্ডেজ হয়ে গেছে। ”
” হুম। ”
” কোন বিষয় নিয়ে রেগে গিয়েছিল সৌমেন ভাই? ”
” জানি না। ”
” হাত টা ধরো। ঘরে পৌছে দেই। মনে হয় না হাঁটতে পারবে। ”
সমীর এর হাতে ভর করে দাঁড়ালো উর্মি। বহু পূর্বেই নিজের রুমে চলে গেছে লায়লা। সৌমেন যখন উর্মির পায়ে হাত দিয়েছিল তখন খুব রাগ হচ্ছিলো ওর। রাগে দুটো গ্লাস ও ভেঙেছে।
উর্মি কে দাঁড়াতে সাহায্য করলো সমীর। একটু নিচু কন্ঠে সমীর বলল
” অন্য কেউ তোমায় ঘরে দিয়ে আসুক। ”
” কেন? ”
” তুমি এ বাড়ির বউ উর্মি। তুমি এখন না আমার বন্ধু না আমার কলিগ আর না আমার প্রেমিকা। ”
শেষোক্ত কথায় নীরব অভিমান জন্মালো উর্মির মনে। একটা শব্দ ও করলো না সে। চুপচাপ সার্ভেন্ট এর সাথে ঘরে চলে গেল। সমীর এর দেহ টা চলে না যেন। গত দুদিন যেন,সমীর কে পাল্টে দিয়েছে বহুগুন। এই তো বিকেল বেলায় সিয়াম এর উপর খুব চেচামেচি করলো। তারপর মায়ের সাথে ও কথা বললো না। পাছে যদি মা কে কটূ কথা বলে ফেলে সেই ভয়ে।
ডিনারের টেবিলে বসে উর্মি আর সমীর এর আবার চোখাচোখি। কারন টা হচ্ছে সৌমেন এর কাকি বলেছেন আজ নাকি আবার বাসর সাজানো হবে। যেহেতু কাল সৌমেন এর শরীর টা ভালো ছিল না তাছাড়া উর্মি নিজে ও খুব টায়ার্ড ছিল সব মিলিয়ে নিয়মকানুন এর ন ও মানা হয় নি। সমীর মুখের খাবার টুকু খুব কষ্ট করে পেটে নিল। উর্মি আর মেঘনা দুজনের ই মুখ টা চুপসে গেছে। বাকি সবাই ঠিক ঠাক খাচ্ছে। মেঘনা আর খাবার খেতে পারলো না। আধ খাওয়া প্লেট রেখেই চলে এলো। উর্মির ভীষণ কান্না পাচ্ছে। বোনের নিকট আবেগ লুকাতে ব্যর্থ।
” কেঁদে কি হবে। আমি বলেছিলাম তোকে, আমাদের মেয়ের কিছু হবে না। আর ভাই কে ও ছাড়িয়ে নিবো কিন্তু তুই শুনলি না।”
” আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে আপা। তুই দেখলি সমীর এর মুখ টা। ”
” দেখে ও না দেখার মতো করে থাকতে হচ্ছে। ছেলেটা কি করে যে খাবার খাচ্ছে ভাবতেই অবাক হই। ”
” আমার ভালো লাগছে না আপা। বল না কি করবো আমি। ”
চুল গুলো টেনে ধরলো উর্মি। কষ্টে বুকের ভেতর ঝলসে যাচ্ছে। পায়ের শব্দ পেয়ে চুপ হয়ে গেল দুজনেই। লায়লা এসে ভ্রু কুঁচকে হাত ধুয়ে নিলো। যাওয়ার আগে দু বোন কে আড় চোখে দেখলো আবার। উর্মি ঠোঁট কামড়ে তাকালো। শান্তি মতো কান্না করবে সেই সুযোগ টুকু ও নেই। কিছু সময় পর সমীর ও আসলো হাত ধুতে। মেঘনা সুযোগ দিয়ে চলে যেতেই উর্মি কে বলে সমীর
” চোখ মুছো। কান্না করার মতো কিছু হয় নি। এটা স্বাভাবিক একটা বিষয়। ”
” এটা স্বাভাবিক? ”
” হুম। ”
রাগ হলো উর্মির। সমীর এর নীরবতা ওর সহ্য হচ্ছে না। রাগে দুঃখে কেটে যাওয়া পা নিয়েই হনহনিয়ে ছুটতে লাগলো। ব্যান্ডেজ ভেদ করেক্ত মেঝে তে লাল তরলের রেখা নেমেছে উর্মির প্রতি পায়ের ধাপে। সমীর নিচু হয়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করলো সে তরল টা। তারপর ই লাল রঙের সেই তরলের দিকে ঠায় তাকিয়ে রইলো।
চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ