শখের_সাদা_শাড়ি_২,০৩,০৪

0
476

#শখের_সাদা_শাড়ি_২,০৩,০৪
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
৩.

সাগরিকার শরীর টা ভালো না থাকাতে খাবার খেয়েই চলে এলো মেঘনা রা। অন্তু আবার বাদরামো শুরু করেছে। তবে সেই মেয়ের সাথে কোনো ঝামেলা নয়। সমস্যা হচ্ছে পিংকির কাজিন রাতুল কে নিয়ে। ক্লাস ফাইফে পরে রাতুল। অন্তুর স্কুলেই। একটু ভীতু প্রকৃতির। আর সেই ছেলে কে বাঘে পেয়ে যা তা কান্ড করে যাচ্ছে অন্তু। বাচ্চা বয়সেই বাদরামো! ভাবা যায় এসব। সে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত জোৎস্না। ছেলেটা বুঝি মানুষ হলো না!
এক টা গাড়ি তে গাদাগাদি করে বসেছে পাঁচ জন। সামনে বসেছে সৌজন্য আর পেছনে বড় ভাবি, বড় ভাইয়া, অন্তু আর মেঘনা। মেঘনার কোলে আবার শুয়ে আছে সাগরিকা। ভ্যাঁপসা গরমে যা তা অবস্থা। সৌজন্য এক মনে সিগারেট টানছিল। একদম ভেঙে গুড়িয়ে গেছে ছেলেটা। সিগারেটের ধোঁয়ায় সাগরিকার অস্বস্তি হচ্ছে। বিষয় টা খেয়াল হতেই সৌজন্য আধ খাওয়া ফিল্টার টা ফেলে দিলো। পেছন ফিরে বলল ” আগে বলবি না ওর সমস্যা হচ্ছে। আমি তো ভুলেই গেছি আমাদের সাথে এখন নতুন সদস্য আছে। ”

” আমি ও বুঝতে পারি নি। ”

” দে ওকে আমার কোলে। ”

সাগরিকা কে কোলে নিলো সৌজন্য। মুখ থেকে সিগারেট এর গন্ধ আসছে।
” অন্তু বাবা চকলেট বা গাম হবে? ”

অবিলম্বে একটি গাম বাড়িয়ে দিলো অন্তু। প্যাকেট খুলে গাম চিবুতে শুরু করেছে সৌজন্য। বাতাস নেই একদম। তবু বুদ্ধি করে জানালা খুলে দিলো। এতে কিছু টা গরম কম লাগছে। টিস্যু দিয়ে বার বার কপাল মুছতে হচ্ছে না। যদি ও রাত্রী অনেক টা তবে সেসব পরোয়া করলো না ওরা। ড্রাইভার কিছু টা আতঙ্কিত। তবে বাচ্চা টার অবস্থা দেখে ঘাপটি মেরে রইলো। সাগরিকার মুখের দিকে চেয়ে বুকের ভেতর শূন্যতা অনুভব হয় খুব। এই তো গত বছর তুলি কে বলেছিল একটা বাচ্চা নেওয়ার কথা। তুলি বলেছিল ” তুমি এতো তাড়াহুড়ো করছো কেন? আর সময় কি ফুরিয়ে গেল নাকি! আমরা আগে সেভিংস করি। তারপর একটা বাবু নিবো।”

তুলির কথায় তখন তাল মিলিয়েছিল সৌজন্য। ভেবেছিল তুলি রাইট। আগে সেভিংস করে নিলে ভবিষ্যতে বাবু কে কষ্ট করতে হবে না। চাকরির বাজারে যা অবস্থা! তবে সেসব ছিল কেবল দুঃস্বপ্ন। অদ্ভুত হাসলো সৌজন্য। এক রাশ ঘৃনা হলো নিজের প্রতি। কেন এখনো সেই মানুষ টার কথা ভাবে যাকে নিয়ে ভেবে কেবল দুঃখ পেতে হয়।

বাড়ি তে পৌছেই উর্মি কে কল করে পৌছানোর খবর জানালো মেঘনা। বেশ ঘেমেছে আজ। সাগরিকা কে বেডে রেখে হালকা করে গা মুছিয়ে দিল। বাচ্চা টার সবে মাত্র সার্জারি হয়েছে। তবে ডাক্তার বলেছেন বাচ্চার বয়স কম হওয়াতে বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে সার্জারি করা হয়েছে। এতে করে কাঁটা ছেড়া করতে হয় নি। এতে অবশ্য ভালোই হলো। মেঘনা জামা বদলে এলো। মাথা টা ও ভিজিয়েছে কিছু। শরীরের নোংরা জলে একদম ই বাজে অবস্থা। সাগরিকার উপর পাতলা চাদর টেনে দিয়ে জানালার কোনে বসেছে সবে। অন্তু এসে হাজির। হাতে মিষ্টির বাটি। একটু অবাক হলো মেঘনা। সৌমেন দের বাসা থেকে মিষ্টি দিয়েছে বলে মনে পরলো না। কি সব হাবিজাবি দিয়েছে যেন। তাই তেমন ঘাটলো ও না। অন্তু কে বলল ” বাবুর খেয়াল রাখ আমি একটু চা বানিয়ে আনি। ”

” ঠিক আছে। ”

” তুই খাবি? ”

” না। ”

” কোথাও যাস না আবার। ”

” আমি এখানেই আছি ফুপি। তুমি যাও তো। ”

অন্তুর দিক থেকে চোখ সরিয়ে কিচেনে এলো। আদা চা করলো সে। মাথা টা ধরেছে বেশ। চা শেষ করে বসার ঘরে আসতেই চোখ পরলো আলিদ এর উপর। শুভ্র সাদা পাঞ্জাবী পরে। মুখ টা কেমন গোমড়া। চোখাচোখি হতেই চোখ সরালো মেঘনা। ভদ্রতার খাতিরে দাঁড়িয়ে রইলো।
” তুই এসেছিস? এই দেখ কখন থেকে এসে বসে আছে ছেলেটা। সাথে আবার এক গাদা জিনিস পত্র এনেছে। পাগল ছেলে। অথচ তোকে ডাকতে দিচ্ছে না। তোরা বরং বোস আমি চা নিয়ে আসি। ”

নীরবে সম্মতি জানায় মেঘনা। জোৎস্না চলে যায়। আলিদ এর নাক বরাবর বসে। আলিদ মুখ খুলে
” শুনলাম উর্মির বিয়ে হয়ে গেল। ”

” হ্যাঁ। এই তো হলো। ”

” কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? সমীর নামের এক ছেলের সাথে উর্মির সম্পর্ক ছিল তাই তো? ”

” হুম। ”

” তবে এটা ”

” ভাগ্য। ”

” আমি এটা মানতে পারছি না মেঘনা। কেন যেন খচখচ করছে বুক টা। ”

কথা বদলাতে মেঘনা বলল ” আপনার থাইল্যান্ড ট্যুর কেমন হলো? ”

” ভালো। তবে এখন দেখছি না গেলেই ভালো হতো। ”

” কেন? ”

” জানি না। শুধুই মনে হলো। ”

” ওও। ”

” আচ্ছা শোনো বাবুর জন্য একটা জিনিস এনেছি। প্লিজ না করবে না। ”

বলতে না বলতে পকেট থেকে একটা চকচকে পাথর সহ গোল্ড এর চেইন বের করে আলিদ। দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে মেঘনা।
” এসবের কী দরকার ছিলো? ”

” বাবু কে কিছুই তো দেই নি তাই এনেছি। প্লিজ এটা রাখবে। আমি তো তোমার জন্য কিছু দিচ্ছি না। ”

হু হা করলো না মেঘনা। তবে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। জোৎস্না চা নিয়ে এসেছে। আলিদ বললো বসতে তবে জোৎস্না বসলো না। অজুহাত দেখিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে বললো আলিদ কে থেকে যেতে। আলিদের থাকার ইচ্ছে নেই। তবু ও একবার তাকালো মেঘনার পানে। কোনো রেসপন্স দেখলো না। তাই একে বারেই না করে দিলো। জোৎস্নার এতো জোড়াজোড়ি তে ও থাকলো না ছেলেটার। চলে গেল খানিক বাদেই। মেঘনা দরজায় দাড়িয়ে আছে। চোখ দুটো জ্বালা করছে। যেন এখনি ফেঁটে জল গড়াবে। পুরনো ঘা আবার নাড়া দিয়েছে। তবে যার সাথে দীর্ঘদিনের সংসার তাকে ভুলে যাওয়া অতো সহজ?
.
সমীর চলে গেছে অনেকক্ষণ। যাওয়ার আগে একবার বলে ও যায় নি। সেই নিয়ে জমায়েত হয়েছে আরেক অভিমান। রাগ হচ্ছে খুব,সাথে দুঃখ ফ্রি। উর্মি সমস্ত রাগ নামাচ্ছে পায়ের উপর। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পা অথচ সে দিকে তোয়াক্কা নেই একটু ও। জানালা খোলা থাকাতে সমীরণ আসছে খুব। একটু একটু করে স্পর্শ করে যাচ্ছে উর্মির শরীর। হঠাৎ ই শরীরে কাটা দিয়ে উঠে। উর্মির মনে হয় সৌমেন যদি কিছু করার চেষ্টা করে। ভেবে কুল পায় না মেয়েটি। অন্তরে যন্ত্রণা লেপ্টে বিষের মতো অনুভূতি দেয়। সব মিলিয়ে নিজেকে যন্ত্র কিংবা সামগ্রী মনে হয়। সময় কেঁটে যায়। তখন মধ্যরাত্রী। উর্মি বসে আছে চুপচাপ। আচানাক দরজায় খটখট আওয়াজ। ভরকে যায় মেয়েটি। শরীরের বল নেই যেন। তবু ও সাহস জুগিয়ে আসে দরজা বরাবর। প্রথমে কোনো শব্দ না শুনতে পেলে ও কিয়ৎক্ষণ যেতেই বাহির থেকে সমীর এর কাজিন দের কন্ঠ। উর্মি হতাশ হয়। নিজেকে ঠিক করে দ্বার খুলে দেয়। প্রথমেই চোখ যায় সৌমেন এর নিকট। ছেলে টাকে লাল পাঞ্জাবী তে অতিরিক্ত সুন্দর লাগছে। প্রশস্ত বুক টা যে কোনো নারীর হৃদয় কে স্তব্ধ করে দিতে পারে। উর্মি চোখ নামায়। অস্বস্তি হচ্ছে। সৌমেন হাসে। কাজিন রা লেপ্টে যায় গল্পে। উর্মি সরে দাড়ায় এক কোনে। হঠাৎ ই বিধু বলে ” ভাবি দূরে কেন? সামনে আসো। ভাইয়ার কাছে এসে বসো।”

” ঠিক আছি ভাইয়া। তোমরা গল্প করো। ”

” সেকি কথা। আরে ভাবি আসো তো। ”

উর্মি কে বসতে হয়। সৌমেন এর আচারণ খুব ই স্বাভাবিক। উর্মি একটু লক্ষ্য করে বুঝতে পারে ছেলেটা হুটহাট আবার কেমন বাচ্চামো করে। উর্মি ব্যথীত হয়। সেদিন বড় ভুল করেছিল কি না মেয়েটি।

বিয়ের কিছু দিন আগের ঘটনা। মাইশা সর্বদা চুলে উঁচু করে ঝুটি বাধে। আর উর্মি বিনুনী বা খোলা চুল। সেদিন বাইরে ছিল প্রচন্ড গরম। বাহির থেকে এসে উর্মি যেন প্রাণ হারায়। উপায় না পেয়ে উঁচু করে ঝুটি বাধে। মাইশা চলে যাওয়ার পর সমস্ত দায়িত্ব আসে উর্মির ঘাড়ে। আর উর্মি কে দেওয়া হয় মাইশার মতো পোষাক। আর সে দিন টাই উর্মির জন্য কাল হয়ে যায়। সৌমেন এর কিছু সাইন এর প্রয়োজন থাকাতে সৌমেন কে অফিসে নিয়ে আসা হয়েছিল। পেছন থেকে উর্মি কে দেখে মাইশা ভেবে নেয়। যখন মুখ টা দেখে তখন নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে থাকে। সময় যেতেই মাথা চেপে ধরে। আর তারপর পর উর্মি কে মাইশা ভেবে বসে। সেদিন এর পর থেকে উর্মির জীবন টা পুরো বদল হয়ে গেল। উর্মি শিউরে উঠে। দ্রুত সামলে নেয় নিজেকে।
” ভাবি কাঁদছো কেন? ”

” কাঁদি না তো, এমনি চোখে কিছু পরেছে হয়তো। তুমি বসো না। ”

” উঁহু তুমি আসো আমার সাথে। ”

উর্মি কে আবার চেপে ধরে বসিয়ে দেয় বুশরা। এদের কথার মাঝে উর্মির অসহায় ভীষণ অনুভব হয়। তাই বলে ” আমি কফি নিয়ে আসি। তোমরা খালি মুখে বসে আছো। ”

” সার্ভেন্ট কে বললেই তো হয়। ”

” সবসময় তো সার্ভেন্ট এর হাতেই কফি খেলে আজ আমি বানাই? ”

” ওয়াও ভাবি। তুমি তো আমাদের ফুললি ট্রিট করছো। কি বলিস বুশরা? ”

” ঠিক বলেছিস ভাইয়া। আমি ও যাবো ভাবি? ”

” না না বুশরা তুমি বসো। আমি নিয়ে আসবো এখনি। ”

সবাই কে ফাঁকি দিয়ে চলে আসে উর্মি। রান্না ঘরে এসে শিউরে উঠে। বাড়ির বড় রা সব ঘুমিয়ে জল। লায়লা কে গেস্ট হাউজে রাখা হয়েছে। কারন ওকে দেখলেই সৌমেন রেগে যাচ্ছে হুটহাট। উর্মি পানি বসায়। চুলো জালিয়ে চেয়ে থাকে অবাক ভঙ্গিতে। পানি ফুটে উঠে। দু চোখের নোনা জল মুছে ফেলে উর্মি। কফি নামিয়ে ট্রে হাতে নিতেই মনে পরে সমীর এর কথা। ছেলেটা একটা ম্যাসেজ বা ফোন কল করে নি অব্দি! দুঃখ হয় সাথে রাগ। উর্মি নানাবিধ চিন্তায় পরে। সমীর নিশ্চয়ই ভাবছে সৌমেন এর সাথে বাসর জমিয়েছে উর্মি।

মাত্র ই বুশরা আর বিধু উঠে গেল। যাওয়ার আগে কত শত গল্প ই না শোনালো উর্মি কে। কোনো টা মনোযোগ দিয়েছে আবার কোনো টায় মনোযোগ দেয় নি। তবে গল্পের প্রধান চরিত্র ই ছিল সৌমেন। ছেলেবেলার সব ঘটনা পরিষ্কার করে দেখালো বুশরা আর বিধু। বিধুর বয়স টা উর্মির থেকে কিছু টা বেশি তবে বুশরা ছোট। অনার্স শেষ বর্ষে পরছে এবার। বুশরার পড়াশোনা নিয়ে যখন কথা হলো তখন উর্মির একটা কথা মনে পরেছে। গত এক মাস যাবত ভার্সিটির কোনো খোঁজ নেই। সেই যে ভর্তি হয়ে এলো আর যাওয়া হয় নি। উর্মি দরজা লাগাতে গিয়ে অনুভব করলো ওর পিঠের খুব নিকটে কেউ দাঁড়িয়ে। চট জলদি ঘুরে তাকালো উর্মি। সৌমেন দাঁড়িয়ে। লম্বা চওড়া মানুষ টার নিকট উর্মি নেহাত ই পিচ্ছি। শুকিয়ে গেল গলা। সৌমেন কি এবার উর্মির উপর অধিকার চাইবে? মস্তিষ্কের ঘাটতি হলে ও শারীরিক ভাবে সুস্থ সৌমেন। একি ঘরে থাকা কালীন নিজেকে কি করে আড়াল করবে উর্মি?

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

#শখের_সাদা_শাড়ি_২
৪.
মৃত মানুষের মতো করে ঘুমিয়ে আছে সৌমেন। ঘুমাবেই না কেন? ক্ষণিক আগেই ঘুমের ঔষধ মিশ্রিত খাবার খাওয়ানো হয়েছে। ঔষধ টা উর্মি নিজ হাতে দিয়েছে। এ ছাড়া অবশ্য কোনো উপায় ছিল না মেয়ে টার নিকটে। নিজেকে আড়াল করার জন্যে সৌমেন কে ঘুমে বিভোর করা জরুরী ছিল। আচানাক ওর মন খারাপ হতে শুরু করেছে। অভিমানের দেয়াল ডিঙিয়ে সমীরের নাম্বারে কল করে বসলো। সমীর ধরে চটপট। উর্মি চমকিত হয়। স্তম্ভিত বুকে হাত রেখে অনুভব করে ফোনের অপর পাশের মানুষ টা ও ওর মতো ভালো নেই। দু চোখ এর কোন ঘেঁষে জল গড়ায়। উর্মি ফুপিয়ে উঠে। সমীর নিশ্চুপ! যেন গল্প সাজায় নিজের হাতে। কিছু সময় চলে যায়। সমীর মুখ খুলে ” কল করেছো কান্না শোনাবে বলে? তাহলে বরং কাল শুনবো। আজ রাখি। ”

ফ্যাচফ্যাচানি ফেলে উর্মি প্রশ্ন ছুড়ে ” এতো রাত অব্দি জেগে আছো তুমি। ”

” হুম। নতুন কি আর। আগে ও তো জেগে থাকতাম রাত ভর। ”

” তখন ফোনের এপাশে আমি থাকতাম সমীর। ”

” আজ ও তো আছো। ”

নাকের পাটা লাল হয়ে আসে। উর্মি বিহ্বল! হতভম্ব হয়ে যায় ছেলেটার কাঠ কাঠ জবাবে। ইচ্ছে করছে দু গালে শক্ত হাতে লাল করে দিতে। ছেলেটা কি বুঝে না ওর মনের অবস্থা! দুজনেই ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে। উর্মি পেছন ঘুরে দেখে বেঘোরে ঘুমায় সৌমেন। উৎকণ্ঠিত হয়ে যাওয়া তে ব্যলকনিতে চলে আসে। গলার স্বর নিচু করে। ” তুমি খুব কষ্টে আছো সমীর? এই সব টা হলো আমার জন্য। আমি খুব ই স্বার্থপর। খুব বেশি অন্যায় করেছি।”

ডুকরে ডুকরে বলতে শুরু করেছে উর্মি। সমীর এর মন টা ভেঙে যায় যেন। আজ এ পরিস্থিতির জন্য কাকে দায় দিবে ঠিক ঠাওর হয় না। তবু সান্ত্বনা দেয় ” ভাগ্যে যা ছিল সেটাই হয়েছে উর্মি। তুমি নিজেকে দোষোরোপ করতে পারো না। ”

” কেন ভাগ্য এমন টা করলো? ”

” সেটা তো জানি না আমি। তবে একটা কথা বলতে পারি এই যে তুমি আমি এই মাঝ রাতে কথা বলছি এটা ঠিক না। এটা অন্যায়।”

প্রথম দিকে কথা গুলো বুঝতে না পারলে ও সমীর যখন আবার বলল তুমি অন্য কারো স্ত্রী তখন উর্মির হাত কেঁপে উঠলো। ফোন টা পরে যেতে নিলে খপ করে ধরে ফেলল আঁচলে। উর্মি ভীষণ অসহায়। সমীর এর বলা কথা টা ওকে দাহ্য করেছে। মনে হয় এটা খুব অন্যায়! আবার মনে হয় এটা কে অন্যায় বললে ভুল হবে। এই টা কোনো বিয়েই নয়। এসব ভাবনার অতলে হারিয়ে গিয়ে রাত্রি অতিবাহিত করে! কাক সকালে অনুভব হয় চোখ দু খানা জ্বলছে ভীষণ। ঘুম হয় নি সারা রাতে। একটু ঘুমের তৃষ্ণায় চোখ দুটো ছটফট করছে। ঝিমুতে ঝিমুতে উর্মি ঘরে আসে। কাল রাতে সৌমেন কে যেমন করে ঘুমাতে দেখেছে এখনো তেমন ভাবে শুয়ে আছে। ঘুমন্ত সৌমেন এর মুখের দিকে তাকিয়ে উর্মির চোখে থাকা ঘুম হারিয়ে যায়। কতক্ষণ চেয়ে ছিল খেয়াল নেই। তবে যখন খেয়াল হলো তখন ভীষণ ভাবে লজ্জায় পরলো। সৌমেন হাত নাড়াচাড়া করছে এখন। উর্মি নিজেকে তটস্থ করে মুখে হাসি ফুটায়। কালকে ডাক্তার এর সাথে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন উর্মি যেন সর্বদা সৌমেন এর সাথে হাসি খুশি থাকে। কখনো যেন মুখ গোমড়া না করে। তাহলে সৌমেন এর ব্রেনে প্রভাব পরবে না। কারন উর্মিকেই মাইশার সাথে গুলিয়ে ফেলে। এটা খুব ই জটিল রোগ কি না!

সৌমেন কে নিয়ে নিচে নামে উর্মি। নাস্তার টেবিলে বসে এক মনে খাবার শেষ করেই বেরিয়ে পরে। সৌমেন তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। পর পর ই বলে উঠে
” মাইশা কে নিয়ে আমি ঘুরতে যাবো। ”

সকলের চোখ বড় বড়। খাবারের টেবিলে বসে থাকা মাহফুজ সাহেব খাবার খেতে খেতে বললেন ” তুমি কি করে যাবে সৌমেন? ”

” কেন বাবা আমি কি ছোট? অদ্ভুত তো! ”

গোমড়া মুখে রুটির শেষ টুকরো টা রেখে উঠে গেল সৌমেন। ওর আচারণে খুব একটা অবাক হয় নি কেউ। এটা হওয়া টা স্বাভাবিক তবে সৌমেন কে নিয়ে একা একা উর্মি বের হবে কি করে?

উর্মি কে ফোন করলেন মাহফুজ সাহেব। বাসা থেকে অনেক টা পথ চলে এসেছে উর্মি। তাই বললো বিকেলের কথা। তবে সৌমেন সেটা মানতে নারাজ। ছেলেটা বাবার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো এক প্রকার। ” আমার কথার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে। আগে তো খুব বলতে কেন ঘুরতে নিয়ে যাই না। আর এখন খুব মজা পেয়েছো তাই না? ”

” স্যার আপনি, শান্ত হোন। আমি একটা কাজে এসেছি। একটু সময় দিন আমায়। ”

” ওকে। তোমার কাছে সময় আছে আধ ঘন্টা। ইয়েস এই আধ ঘন্টার মধ্যে তুমি আমার কাছে আসবে। ”

মহা ফ্যাসাদে পরলো উর্মি। এই ঝামেলা যেন একটু একটু করে বেড়েই চলেছে। নিজের চুল নিজে ছিড়তে পারলে বোধহয় স্বস্তি মিলতো। রাগে আক্রোশে হাঁটতে শুরু করে উর্মি। দ্রুত হাঁটতে গিয়ে পরে যেতে যেতে বেঁচে যায়। তবে হাতের কব্জি তে বেশ অনেক টা ছিলে যায়। পথযাত্রী একজন মহিলা এসে আঁকড়ে ধরে। না চাইতে ও চোখের কোনে জল এসে যায়। মহিলা টি পানি এগিয়ে দেয়। হাতের কব্জি তে পানি দেয় উর্মি। ছিলে যাওয়া স্থানে পানি পরাতে দাহ্য পদার্থের মতো করে জ্বলে উঠে। শিউরে উঠে। যন্ত্রণায় যেন শরীর অষাঢ় হয়ে আসে।

দোকান থেকে কিছু কিনছিলো আলিদ। উর্মি কে দেখে চিনতে অসুবিধা হয় না। পাশে থাকা মহিলার হাত বরাবর চোখ দিতেই বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটেছে। দোকানের বিল পরিশোধ করে রাস্তা ডিঙিয়ে আসে। উর্মি তখন চোখ বন্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
” কি হয়েছে। হাতে র’ক্ত! কি করে হলো।”

” আলিদ ভাই! কবে এসেছেন।”

” এটা হলো কি করে। অনেক টা ছিলে গেছে দেখছি। ”

” দ্রুত হাঁটায় গতি সামলাতে না পেরে পরে যাচ্ছিলাম। রাস্তার ধারে টিন দিয়ে দেয়াল করা ছিল। সেখানেই লেগেছে। ”

” ইস। কি যে করিস। ”

ভদ্র মহিলার দিকে কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকায় উর্মি। মহিলা টা চলে যান। আলিদ এক হাতের সাহায্যে উর্মি কে টেনে ধরে। আজ ও ছেলেটা কতো সুন্দর রয়েছে। ভরাট মুখে খোচা খোচা দাড়ি। উর্মির চোখ দুটো লেগে আসে। এতো টা বিমুগ্ধ হয় যে ভুলে যায় ব্যথার কথা।

গাড়ির কাছে এসে আলিদ বলে ” বোস ভেতরে। আমি হালকা পাতলা মেডিসিন আর ব্যান্ডেজ নিয়ে আসি।”

” লাগবে না আলিদ ভাই। ”

” চুপ কর। একেই তো মহৎ কর্ম করে বসে আসিছ। আর আবার মুখে মুখে তর্ক। ”

হঠাৎ ই হেসে ফেলে উর্মি। কেন যেন এই দুঃখের মাঝে ও হাসি পেল ওর। আলিদ তাকাতেই মুখ টিপে হাসতে শুরু করলো। অস্বস্তি তে পরলো আলিদ। ” কি হয়েছে টা কি। এমন পাগলের মতো হাসছিস কেন? ”

” মনে আছে আলিদ ভাই? আমি যে বছর ভার্সিটি তে যাই। সে বছর ই আপার সাথে আপনার গভীর প্রণয়। আর আপা কে ভেবে আমায় ফুল দিয়েছিলেন। পরে যে কি লজ্জা টা পেলেন। পুরো এক সপ্তাহ স্যরি স্যরি বলে টেক্সট করেছেন। তখন আবার আপার সাথে আপনার নীরব দন্ড চলে। যদি ও বা ছিল গভীর প্রেম। ”

শেষের কথাতে আলিদ চমকে উঠে। তবে বেশি ক্ষণ সে চমক থাকে না। উর্মি আবার বলতে লাগল ” আপা এই জীবনে আমার থেকে একটা কথাই লুকিয়েছে। অবশ্য আমি জেনে গিয়েছিলাম কোনো ভাবে। আপনার সাথে আপার তিন বছরের রিলেশন ছিল সেটা তো আমার অজানা নয়। অনেক বুঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। যাতে বাবার কথা তে আপা আপনাকে ছেড়ে না আসে। তবে আপা শুনে নি আমার কথা। ”

অপ্রস্তুত হয়ে পরলো আলিদ। উর্মি সরস হেসে বলল
” রক্ত পরা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন বরং যাই। ”

” তোকে পৌছে দিবো। ”

” অন্য একদিন। আজ আপনি অস্বস্তি তে আছেন। আসি আজ। ”

ব্যাগ নিয়ে হাঁটা লাগায় উর্মি। আলিদ এর হাত টা কাপছে। চোখ দুটো তিমিরে ফোঁটা পদ্মফুলের মতো চকচকে। জলে ডুবে যাওয়া দু চোখ আজ বাঁধন হারা হতে চায়। মনের দুয়ার খুলে বলতে চায় ” কেন সেদিন তুমি আমায় বুঝলে না। কেন বুঝলে না আমার না শব্দের মাঝেই লুকিয়ে ছিল হ্যাঁ। ”

কলমে ~ ফাতেমা তুজ
চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here