#শখের_সাদা_শাড়ি_২,১৯,২০
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
১৯.
ইদানিং হৃদয়ে ঝড় চলছে।উর্মিকে হারানোর ভয় গ’লা চেপে ধরেছে সৌমেনের।সারাক্ষণ মেয়েটাকে নিয়ে ভয়। সন্ধ্যায় ফিরলো উর্মি। লতিফার বেগমের সাথে দেখা হতেই ভদ্র মহিলা অসন্তোষ স্বরে বললেন ” সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসার চেষ্টা করবে। ”
” জী আন্টি। ”
চলে গেলেন ভদ্র মহিলা। ঠিক কতখানি পরিবর্তন এসে গেছে। উর্মি অবাক ই হলো। চিন্তা ফেলে হাটছে ওমন সময় এলো সৌমেন। চোখ দুটো রক্তিম।
” কি হলো আপনার? ”
” ঘরে এসো। ”
পিছু এলো উর্মি। সৌমেন বুকে হাত গুজে দিয়ে অন্য দিকে তাকালো। তারপর ই বলল ” একটা প্রশ্ন করবো সত্যি বলবে? ”
” হ্যাঁ। ”
” আমায় ভালোবাসো? ”
” বাসি তো। ”
” তবে তোমার চোখে কেন মিথ্যে? ”
” কি বলেন? ”
” আমাদের দূরত্ব টাই কি সব কিছু প্রমাণ করে না। ”
” এমন কেন ভাবছেন। সময় টা আমাদের বিপরীত। আপনি সুস্থ হলেই…। ”
” আমার অসুস্থতা নিয়ে ভয় পাও তুমি?যদি আমি ম’রে যাই। এসব নিয়েই কি ইনসিকিউর? ”
” আপনার কি হলো বলেন তো। ”
” পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। ভালবাসি তোমায়। তবে আমার থেকে তুমি সর্বদা পালাতে চাও। কেন, কেন এমন করো। ”
ছেলেটা নিজের চুল খামচে ধরেছে। উর্মি দ্রুত এসেছে হাত ছাড়ালো। চিল্লিয়ে বলল” কি করছেন কি এসব! ”
” আই লাভ ইউ সো ভেরি মাচ। আমি থাকতে পারবো না তোমায় ছাড়া। ছেড়ে যেও না প্লিজ। ”
” যাবো না তো। ”
” কথা দিচ্ছো? ”
গলাটা ধরে এলো এবার। উর্মি উত্তর দিতে পারছে না। মেয়েটি কে শক্ত করে আলিঙ্গন করলো সৌমেন। বিন্দু মাত্র প্রতিক্রিয়া দেখায় না উর্মি। সৌমেন বলে ” জীবনে সব থেকে করুণ কাহিনী কি জানো? নিজের স্ত্রী কাছে থাকা সত্ত্বেও কাছে না পাওয়া। সারাক্ষণ ভয়ে থাকা। সংকটে উন্মাদ হওয়া। একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করা। আমার লাগবে না ভালোবাসা। শুধু তুমি দূরে যেও না। ”
কি অদ্ভুত শব্দ বলে যাচ্ছে সৌমেন। উর্মি পাখির ছানার মতো নুইয়ে রইলো। ছেলে টার সান্নিধ্য ভালো লাগছে। তবে আদৌ কি এটা উচিত?
ডিভোর্সের ফাইল টা হাতে নিয়ে কেঁপে উঠলেন সওলাত খান। সমস্ত সম্পর্ক তো বহু পূর্বেই শেষ করে এসেছেন মিষ্টি। তবে কাগজে কলমে কেন আলাদা হতে হবে! তিথির সাথে কথা কাটা কাটি হলো আজ। আচানাক রেগে উঠলেন তিনি। ” বিগত এতো গুলো বছর তো আমার সাথেই সংসার করলে। তবে কেন ঐ মহিলার নিকট যাওয়া লাগে এখন। ”
” মুখ সামলে কথা বলো। ঐ মহিলা কি কথা! সে তোমার গুরুজন। ”
” সতীন আবার গুরুজন! ”
” তিথী! ”
” চেঁচাবে না। আমার সন্তান এখানেই দাঁড়িয়ে। তুমি নিশ্চয়ই চাও না ও জানুক বাবা মায়ের অবৈধ সন্তান হিসেবেই ওর পরিচয়। ”
তিথীর গালে চড় টা বসালেন সওলাত। রাগে ওনার শরীর কাঁপছে। তিথী দ্বিগুন জ্বেলে উঠলেন। সওলাতের কলার চেপে বললেন ” দীর্ঘ দিনের সংসারে আমায় কখনো হাত লাগাও নি। আজ সেই মহিলার জন্য আমার আঘাত করলে। কি আছে ওর মাঝে যা আমি দিতে পারি নি। রূপে গুনে আমি ওর থেকে হাজার গুন উপরে। তবু….! ”
” তোমার এই মানসিকতার জন্যেই আজ তোমাকে ঘৃনা করছি আমি। এতো দিনে আমি বুঝতে পারলাম মিষ্টি কে তুমিই বলেছো ডিভোর্সের কথা। ”
” হ্যাঁ বলেছি। আমার স্বামীর সমস্ত চাহিদা মেটানোর জন্য আমি একাই যথেষ্ট। এতো বছর ধরে আমার সাথেই থেকেছো তুমি। কখনো তো অন্য কাউ কে প্রয়োজন পরে নি। তাহলে কাগজে কলমে সম্পর্ক রেখে কি লাভ? ”
” মুখে লাগাম দাও তিথী। তিতির এখানেই আছে। ”
” কেন? ও জানবে না ওর বাবার চরিত্র কতো টা পবিত্র। স্ত্রী থাকা সত্ত্বে ও অন্য মেয়ের সাথে বিয়ের আগেই মেলামেশা করেছে। অবৈধ সন্তানের বাপ হয়েছে। ”
লজ্জায় নত হয়ে এলো সওলাতের মুখ। তিনি তিতিরের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন মেয়েটা কিছুই বুঝতে পারছে না। বাবা মা কে কখনো এমন ভাবে ঝগড়া করতে দেখে নি। সবটাই নতুন। সওলাত মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ” ঘরে যাও সোনা।”
” ও যাবে না। ”
” রাগিও না তিথী। এমনি তেই অনেক বলেছো আজ। ”
চলে যায় তিতির। সওলাত ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন
” নোংরা মহিলা! নষ্টামি নিশ্চয়ই আমি একা করি নি। তোমার মতো মেয়েদের তো পতিতা বলা হয়। হাজার টাকা দিলেই পাওয়া যায়। স্ত্রীর মর্যাদা পেয়েছো এটা তোমার ভাগ্য। ”
তিথী হু হু করে কেঁদে উঠলেন। সওলাত খান নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছেন একাধিক নারী সঙ্গ কতো টা বিপদজনক। সময় গুলো ফিরে পাওয়া গেলে তিনি নিশ্চয়ই মুছে ফেলতেন এটা।
তুলি আর নয়নের শারীরিক বিপর্যস্তের জন্য সৌজন্য কে দায়ী করা হয়েছিল। সেটা অনেক অংশ প্রমানিত। তবু ও সৌজন্যের হেল দোল নেই। খবর টা বাতাসের গতিতে চলে যাচ্ছে। আজ ও আগলে নিলেন মাহফুজ সাহেব। ভদ্র লোকের নিকট কৃতজ্ঞ না হয়ে পারলো না উর্মি। সৌজন্য বেল পেতেই উর্মি এলো কাছে।
” আমাদের জন্য কি একটু ভাববে না তুমি? ”
” আল্লাহ আছেন তো। আমার মতো কদাচিৎ মানুষের থাকা না থাকা সমান। ”
” তুমি বুঝলে না ভাইয়া। ”
” বুঝি আমি। তুই আমার লক্ষী বোন। নিজেকে ভরা নদী তে ডুবিয়ে দিয়ে ও সকলের জন্য ভাবিস। তবে জানিস তো কিছু সময় স্বার্থপর হতে হয়। ”
” ভাবি কি বি’ষ দিয়েছো তুমি? ”
” প্রমান তো হয়েছেই। ”
” তুমি তাকে ভালোবাসতে ভাইয়া। ”
” একদম ঠিক। ভালোবাসতাম তবে বাসি না আর। ”
হতাশ কন্ঠ টা উর্মি নামিয়ে নিলো। গাড়িতে উঠে বসতেই সিগারেট ধরায় সৌজন্য। ভাইয়ের পানে তাকিয়ে থাকে উর্মি। হঠাৎ ই বলে ” ভাবি নাকি দেখতে চেয়েছে তোমায়। ”
” আমি চাই না। ”
” আমার ও তাই মনে হয় যাওয়ার দরকার নেই। যারা আমাদের জীবন কে অতিষ্ঠ করে দিয়েছে তাদের সাথে আর কোনো যোগাযোগ নয়। ”
” হু। ”
মুখ ভর্তি ধোয়া নিয়ে দু সেকেন্ড বাদে ছাড়লো সৌজন্য। খোচা খোচা দাড়ি গুলো বড় হয়ে এসেছে। মুখের মধ্যে আগে একটা দ্যুতি খেললে ও এখন আছে কেবল ব্যথা। উর্মি চুপ থাকতে পারছে না। তবু চুপ থাকতে হচ্ছে।এক পর্যায়ে ভাই এর কাঁধে মাথা এলিয়ে বলল ” জীবন টা এতো কঠিন কেন ভাইয়া? ”
মাহফুজ সাহেব লতিফা বেগম কে বললেন ” তুমি বুঝতে চেষ্টা করো।সৌমেন কে সুস্থ করার জন্য উর্মি ছাড়া আর কোনো অপশন নেই আমাদের। ”
” তাই বলে প্রতারণা করবে আমার সাথে?”
” তুমি জানতে পারলে কখনোই মেনে নিতে না এসব। সেই জন্যেই তোমাকে বলি নি আমি। ”
” আমার লজ্জা হয়। উর্মির সামনে যেতে গেলে বুক ভারী হয়ে যায় আমার। ”
” তুমি কষ্ট পেও না। আমরা আমাদের সন্তানের সুস্থতা কামনা করি কেবল। ”
” মেয়েটাকে আমার বড় পছন্দ। ওকে যদি রেখে দিতে পারতাম। ”
উত্তর করলেন না মাহফুজ সাহেব। তিনি নিজেও বড্ড জ্বালায় আছেন। সৌমেন এর চিকিৎসা টা যেন বেশ ধীরস্থির। কথা গুলো শুনতে পেয়ে দরজার কাছ থেকে সরে এলো সৌমেন। পরিবার এমন এক শব্দ যা স্বার্থপর করে দিতে পারে মুহূর্তেই। সবাই স্বীয় পরিবার ও নিজের জন্য স্বার্থপর। ভীষণ স্বার্থপর!
বিকেলে বের হলো সৌমেন। এর জন্য বেশ কাঠখড় পোড়াতে হলো। ছেলেটা দীর্ঘ দিন একা বের হয় নি। অসুস্থতার নাটক করে করে সত্যিই নিজেকে অসুস্থ বোধ হয়। মাইশা আর কল্লোল দাঁড়িয়ে আছে নদীর ঘাটে। সৌমেন এসেই বলল
” নিজেদের শুধরে নিও। আমাকে মা’রার জন্যেই এসেছিলে তোমরা। ”
দুজনেই চুপ। সৌমেন চেইক দিয়ে বলল
” এ দুনিয়ার সবাই স্বার্থপর। আর ভাগ্য বড় বিচিত্র। আমাকে মা’রার জন্য পাঠানো হয়েছিল তোমাদের। অথচ সেই তোমরাই আমার কাজে লেগে গেলে। বেশ ভালো অভিনয় করেছো। ”
” ধন্যবাদ স্যার। ”
” নাউ লিভ। দেশে যেন আর না দেখি। ”
” জী স্যার। ”
” চালাকি করার চেষ্টা করো না। এমনিতে ও দেশে থাকলে বাঁচতে পারবে না। আমার পেছনে অনেক শত্রু আছে। যাদের নিকট থেকে এসেছিলে তাঁরা কতো টা ভয়াবহ তা হয়তো জানো। আমি তাদের সাথে সমস্ত চুক্তি ফিরিয়ে নিবো। আর লোকশান হওয়া টাকা ও দিয়ে দিব। সেহেতু আমার ক্ষতি করার জন্য তাদের আর কোনো কারণ নেই। তবে তোমরা সাবধান। ”
শুকনো ঢোক গিললো মাইশা আর কল্লোল। সম্পর্কে ওরা দীর্ঘ দিনের প্রেমিক প্রেমিকা। স্বপ্ন ছিলো অভিনয়ে যাওয়ার। তবে টাকা ছাড়া অভিনয় জগতে পা রাখা সহজ নয়। তাই এই ভয়ঙ্কর কাজ টা করার জন্যে রাজি হয়। তবে বছর দুই যেতেই ধরে ফেলে সৌমেন। আর তারপর ক্ষমা চায় ওরা। সৌমেন এর মস্তিষ্ক তখন অন্য প্ল্যান করছিল। তবে হঠাৎ করেই যখন উর্মি এলো তখন প্ল্যান বদলে গেল। আর পুরো খেলা টাই পরিবর্তন হয়ে গেল। সৌমেন দীর্ঘশ্বাস লুকালো। মাইশা আর কল্লোল চলে গেছে। সন্ধ্যার সূর্যাস্ত যেতে দেখে একরাশ মন খারাপ হলো ওর। স্বীয় জীবনের সাথে উর্মি কে জড়িয়ে আসলেই ভুল হয়ে গেছে। মেয়ে টাকে ছাড়া ওর নিশ্বাস অবরুদ্ধ হয়ে আসে!
চলবে……
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
#শখের_সাদা_শাড়ি_২
২০.
সিগারেট মুখে নিলো সমীর। উর্মি সেটা ফেলে দিতেই আবারও প্যাকেট বের করলো। এবার পুরো সিগারেটের প্যাকেট টাই ফেলে দিলো। সমীর তাকালো। ” কি হয়েছে তোমার? দেবদাস এর মতো কেন করো। ”
” দেবদাস ই তো আমি। ”
” এসব ফালতু কথা ছাড়বে না নাকি। ”
” আমার জীবন টাই ফালতু। ”
” সমীর! আমি কিন্তু চলে যাবো। ”
” চলেই তো গেছো। ”
” অদ্ভুত! ”
” অন্যের স্ত্রী তুমি। যাকে ছোঁয়া যায় না। যাকে বুকের ভেতর পিষে ফেলা যায় না। সব সময় হৃদয় জ্বালা পোঁড়া করে। ”
বড্ড করুণ শোনালো সমীরের কন্ঠ। উর্মি তৎক্ষনাৎ হাত ধরে বলল ” সব টা জেনে ও এখন এমন সব কথা বলবে? ”
” আমার একা জানা তে কি যায় আসে উর্মি? সবাই তো জানে তুমি সৌমেন ভাইয়ের স্ত্রী। কেন সবাই কে বলছো না বিয়ে টা হয় নি। সব টা মিথ্যে ছিল। ”
” তুমি কষ্ট পাচ্ছো? ”
” অনেক বেশি। এতো ঝামেলা আমি আর নিতে পারি না। সব টা ঠিক করা যায় না উর্মি? ”
একটু ভাবলো উর্মি। সৌমেন অনেক টাই সুস্থ। এখনি সঠিক সময়। এর পর হয়তো ঘটনা বদলে যেতে পারে। সমীর উর্মির হাত টা বুকে চেপে ধরলো। ” আমি চাই আমাদের বিয়ে টা হয়ে যাক। আমার ভীষণ ভয় হয় উর্মি। তুমি তো তোমার প্রতিশ্রুতি রেখেছো তাই না? ”
” দেখি কি করা যায়। ”
” আমি অপেক্ষায় থাকবো। ”
ফেরার সময় উর্মি অনেক কিছু ভেবেছে। সৌমেন আজকাল কাছাকাছি আসতে চায়। এভাবে কোনো একদিন ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে। তাছাড়া সৌমেন অনেক টা সুস্থ। তাই প্রতিশ্রুতির খেলাপ ও ঘটে নি। মনে মনে সে স্থির করলো আজ ই মাহফুজ সাহেব এর সাথে কথা বলবে। জানাবে সব টা। এভাবে আর থাকা কি যায়?
মাহফুজ সাহেব বসেছিলেন। তিনি সবে জানতে পেরেছেন উর্মির মতামত। প্রথম দিকে একটা দ্বিমত থাকলে ও পরে তিনি ভাবলেন আর কত দিন? এই যে নাটক টা চললো এতে উর্মির উপর কতোই না প্রভাব পরেছে আর পরবেও। উর্মি কেবল একজন সেবিকার মতো দায়িত্ব পালন করেছে। তাছাড়া টাকা পরিশোধ করার কথা ও জানালো। মাহফুজ সাহেব বললেন
” তুমি যখন বলছো তখন আমি আর আটকাবো না। আর টাকা টা তোমার পারিশ্রমিক। আমার সন্তানের জন্য অনেক করেছো, এতে আমি কৃতজ্ঞ। ”
” সময় টা খুব ই ভয়ংকর স্যার। আমি ও চাই সৌমেন স্যার সুস্থ হোক। তবে এভাবে আর থাকা যাচ্ছে না। ”
” বুঝতে পেরেছি। জীবনে সুখী হও। ”
লতিফা বেগমের নিকট এসে মাথা নিচু করলো উর্মি।
” আমাকে মাফ করবেন আন্টি। আর ও কিছু সময় আমি থাকতে পারছি না। এভাবে একজন অবিবাহিত মেয়ে হয়ে, স্ত্রীর মতো অভিনয় করার টা কতো কষ্টের সেটা আশা করি বুঝেছেন আপনি। ”
লতিফা চুপ রইলেন। ওনি কথা বলতে পারছেন না। উর্মি কেবল হাসলো। মাহফুজ সাহেব বললেন ” সৌমেন এর সাথে দেখা করবে? ”
” হুম। কিছু কথা তো বলতেই হয়। ”
সূর্য টা একটু একটু করে আঁধারে ডুবে গেল। সৌমেন সেটাই দেখছিল। তবে ঘরে কারো প্রবেশ অনুভব করার পর ও বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। উর্মি কিছু ফুটেজ নিয়ে এসেছে। সৌমেন কে সব টা দেখাবে আজ।
” বসো। ”
” আমার কিছু কথা আছে। ”
” বসে বলা যাবে না? ”
” হু। ”
” চা খাবে? ”
” না। ”
” ঠিক আছে। বলো কি বলবে। ”
” কিছু সত্য। ”
” কেমন সত্য? ”
” যা এতো দিন মিথ্যে ছিল। ”
সৌমেনের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠেছে। সৌমেন বলল ” কি বলতে চাইছো? ”
” আমাদের বিয়ে, আমার পরিচয় সবটা আজ খোলসা করতে এসেছি। ”
” তুমি নিশ্চয়ই কোনো ভাবে আমাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছো। ”
” না। আমি আপনাকে সত্যি টা জানাবো কেবল। ”
চট করে মেয়েটির হাত টেনে নিলো সৌমেন। পর পর দুটো চুমু খেল। উর্মির হৃদটা কেমন ধক করে উঠেছে। হাত টা ছাড়িয়ে বলল ” আমি মাইশা নই স্যার। আমি উর্মি, মূলত মাইশা আপনাকে বিশেষ ধরনের বিষ প্রয়োগ করেছিল। যার ফলে আপনার মস্তিষ্ক কিছু স্মৃতি ভুলে যায়। আপনি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেন। আমাকে গুলিয়ে ফেলেন মাইশার সাথে। আর এটাই বিপদ ডেকে আনে। ওমন সময় আমার পরিবারের উপর খুব চাপ যাচ্ছিল। সাগরিকার অপারেশন সহ সবটার জন্য আমাকে রাজি হতে হয় এই শর্তে। আপনার বাবা আমাকে শর্ত দেন আপনাকে বিয়ে করতে হবে। তবে আমি সেটার জন্য রাজি ছিলাম না। কারন আমি অন্য একজন কে খুব বেশি ভালোবাসি। ভাগ্য আর সময় টা খুব ই বাজে যাচ্ছিল। সেই জন্যে রাজি হতে হয় এই শর্তে। তবে আমি জানাতে চাই যে আমাদের বিয়ে টা হয় নি। আমাদের বিয়ে তে থাকা সমস্ত পেপারস নকল ছিল। সবটা ছিল কেবল একটা নাটক। এই বিষয় টা শুধু আমি মাহফুজ স্যার আর আমার আপা জানতো। তেমনি ছিল আমাদের শর্ত। আশা করি আপনি সবটা বুঝতে পেরেছেন। সব প্রমাণ আর ফুটেজ আমি আপনাকে দিয়ে গেলাম। আমাকে মাফ করবেন, আমি কেবল ভালো টাই চেয়েছি সাথে নিজের পরিবার কে বাঁচিয়েছি। আপনাকে বিয়ে করে ঠকাতে চাই নি আমি। আর আমি নিজেকে বিক্রি করার মতো কাজ টা ভাবতে ও পারি না। হয়তো আমার প্রাণ দিয়ে রক্ষা করতাম আমার পরিবার কে। তবু নিজে কে বিক্রি করতাম না। কেবল নিজের সময় টুকু বিক্রি করেছি। আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন স্যার। আমি জানি আপনার যখন সবটা মনে পরবে,আপনাকে বিয়ে না করার জন্য তখন আপনি নিজে এসে কৃতজ্ঞতা জানাবেন আমায়। আমি ও সেই দিনের অপেক্ষায়। ”
সব ফাইল ফুটেজ রেখে চলে গেল উর্মি। সৌমেনের চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু নেমে যায় আড়ালে। মেয়েটির যাওয়ার পানে তাকিয়ে শুধু বলল ” আমার জীবনের সাথে তোমাকে না জড়ালে ও পারতাম উর্মি। বড্ড বেশি যন্ত্রণা হয় আমার। আমি যে হারিয়ে ফেললাম তোমায়। আমার জীবনে হুট করে চলে আসা বউ তুমি, আজ নিজ থেকে ভেঙে দিলে সব টা। ”
স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো উর্মি। কিছুটা কষ্ট হলে ও বুকের ভেতর শান্তি অনুভব হয়। মিথ্যে দিয়ে তৈরি সবটাই কেবল মিথ্যে হয়। আর সেটা তে শুধু অশান্তি থাকে। বুকের ভেতরে থাকা পাথর টা নেমে যাওয়া তে উর্মির মন ফুরফুরে। জামা কাপড় গুছিয়ে তখনি বের হয়ে এলো। বাসা থেকে বের হয়ে খবর টা জানালো সমীর কে। স্থির হয়ে এলো সমীর এর দুই চোখ। অবশেষে মেয়েটি ওর নামে দলিল হতে চলেছে। সমীর বলল
” কোথায় আছো তুমি? ”
” এই তো বের হলাম মাত্র। ”
” সেখানেই থাকো আমি আসছি। ”
” সেকি, আমি একা যেতে পারবো তো। ”
” উর্মি! আমি এলে সমস্যা? এতো দিন পর একটু শান্তি পেলাম আর তুমি…”
” আরে বাবা ঠিক আছে। আসো তুমি। আমি অপেক্ষায় আছি। ”
” হুম। ”
” আর শোনো, সাবধানে এসো। ”
” আমার জীবনের সব সাবধানতা উড়ে গেছে উর্মি। আমি যে কি খুশি বলে বোঝাতে পারছি না।
” আসেন মিস্টার। আপনাকে বহু দিন ধরে খুশি দেখি না। ”
” এখনি আসছি। ”
ফোনে মসগুল ছিল ছেলেটা। এক হাতে ফোন নিয়ে ড্রাইভ করাতে ট্রাক এসে গেল সামনে। সমীর দ্রুত ব্রেক চাপলো। ট্রাক চালক ও যথা সম্ভব মোড় ঘুরিয়ে নিলো। ধুলো উড়লো বেশ। সমীরের ফোনের কল টা এখন ও একটিভ। কথা বলে যাচ্ছে উর্মি। নিজেকে সামলে বলল ” আসছি উর্মি। এখন রাখি। ”
ট্রাক চালক বের হলেন। গুমোট তার মুখের ভঙ্গিমা।
” সাবধানে গাড়ি চালান বাবা। এখনি তো দূর্ঘটনা ঘটতো। যাক আল্লাহ রক্ষা করছে। ”
” জী চাচা। খুব ই দুঃখিত। ”
চলে গেলেন লোক টা। সমীর মনোযোগ দিলো ড্রাইভে। উর্মি প্রায় অনেক টা সময় ধরে গেটের কাছে দাঁড়ানো। নিজ রুমের ব্যলকনি থেকে দেখছিল সৌমেন। ব্যথায় বুক টা কেমন করছে। মেয়েটির জন্য এতো মায়া কেন হয় ওর?
সমীর যখন এলো তখন সৌমেন এর দু চোখে যন্ত্রণা। যেন এখনি চোখ ফেঁটে বেরিয়ে আসবে জল। সমীরের সাথে উর্মি কে দেখে খুব কষ্ট হলো। তবু দাঁড়িয়ে রইলো বহুক্ষণ। বিচ্ছেদ বেদনার আর্তনাদ গুলো তীব্র থেকে তীব্র হয়ে বুকের মধ্যস্থলে করতে লাগলো আন্দোলন।
** আগামী পর্বে সমাপ্তি হবে। তারপর ই আসবে নতুন গল্প মাতাল হাওয়া। **
চলবে…
কলমে ~ ফাতেমা তুজ