শব্দহীন_বৃষ্টি (১০)

0
1037

শব্দহীন_বৃষ্টি
(১০)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________
শীত গিয়ে বসন্ত এসেছে আম গাছে মুকুল এসেছে সেই সাথে মুকুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা চারপাশ। শীত গেলেও শীতের রুক্ষতা এখনো রয়ে গেছে ত্বকে৷ প্রায় পনেরো মিনিট ধরে মাহি সোফায় বসে নিচের ঠোঁটের রুক্ষ ত্বকটাকে টেনে খামচে তোলার চেষ্টা করছে । ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনী ঠোঁটের চামড়ায় ব্যস্ত থাকলে ও দৃষ্টি ব্যস্ত সামনের দিকের সোফায় বসা সাগরের দিকে। কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে সে কক্সবাজার ট্যুর শেষ করে। হাতের বড় লাগেজটা পাশে রেখে কাঁধের ব্যাগপ্যাক সোফায় ফেলে গা এলিয়ে বসেছিলো। ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে পড়ে আছে। এক পলক দেখেছিলো সামনে বসা মেয়েটিকে কিন্তু বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে তার তেমন সংকোচ বোধ হয়নি বলেই এভাবে এখানেই বসেছে। সাগর আসতেই বাড়ির প্রায় সবাই ছুটোছুটি করে পানি আনছে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। সাগর বিরক্তি নিয়ে বলে দিয়েছে এখন কোন কথা না আধ ঘন্টা পর সবার জবাব দেবে তাই সাগরের মা ও গেছে কিচেনে হয়তো কিছু বানাবে ছেলের জন্য । মাহির দৃষ্টি একটিবারের জন্য ও নড়েনি। চোখ বন্ধ অবস্থায় সাগরের হঠাৎ মনে হলো এক জোড়া দৃষ্টি তাকে গভীরভাবে পরখ করছে। মনে হতেই চট করে সে চোখ খুলে তাকালো। যা ভেবেছে তাই হলো। সামনে বসা মেয়েটি তাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। কিন্তু কেন? সাগর যখন চোখ খুলে সোজা হয়ে বসেছে মাহির ধ্যান তখন ও ভাঙেনি। আর তাই সাগর হাতে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো কি? এবার মাহি বেশ লজ্জায় পড়লো। চোখ সরিয়ে বলল, ” কিছু না”। এরপর আর এক সেকেন্ড ও দেরি না করে বেরিয়ে গেল তাদের বাড়ি থেকে। আর সাগর ভাবছে, “এই পিচ্চি মাইয়ার আবার কি হইছে!”

নিরব আজকাল তেমন একটা আসে না মাহিদের বাড়ি৷ না আসার কারণটা অবশ্য মাহি। আগে প্রায় প্রতিদিনই তার কোন না কোন আবদার থাকতো যা পুরন করতে তাকে এ মুখো হতে হতো। কিন্তু গত কয়েকদিনে মাহি কেমন যেন পাল্টে গেছে। না প্রতিদিন কল দেয় আর না কোন কিছুর জন্য বায়না করে। তাই নিরব ও আসে না তবে খুব মিস করে মাহির আবদার গুলো। তবুও আজ একবার খালার বাড়ি যাবে ভেবেছে৷ সাথে করে মাহির প্রিয় আইসক্রিম ও নিয়ে যাবে।

সন্ধ্যার পর সাগরের ঘরে ভীর জমেছে সব ভাই বোনের। বাদ পড়েনি সৈকত ও। সবাই অপেক্ষা করছে দেখার জন্য সাগর কি কি এনেছে৷মা চাচীদের ও ডেকে আনিয়েছে গিফট তো তাদের জন্য ও আছে।

–“নাত জামাই কি মেলা জিনিস আনছো চিটাংগেত্তে ” বলতে বলতে দাদুনী সাগরের বিছানায় পা তুলে বসেছে। সৈকত আগে থেকেই বসা ছিলো দাদুনী সেখানেই তার গা ঘেঁষে বসেছে। আর এ নিয়ে বাচ্চা পার্টিতে ফিসফাস ও শুরু হয়েছে। দাদুনী এত আদুরে কেন সাজে সৈকত ভাইয়ার কাছে অথচ সাগর ভাইয়াকে কি ভয়টাই না পায়! বলে বলে ফিক করে হেঁসে দিচ্ছে।

–” দাদুনী সেটা চিটাংগ না চট্টগ্রাম আর ভাইয়া গিয়েছিলো কক্সবাজারে ” সমুদ্র দাদীকে সঠিক শব্দ শিখিয়ে দিতে লাগলো। কিন্তু ফিসফিসানি আর হাসি তখনও থামেনি।

–” একদম হাসাহাসি করলে ঘর থেকে বের করে দেবো “। ধমকে বলল সাগর আর তাতেই সবার হাসি অফ হয়ে গেল।

সাগরের মা আর তিথির মা চলে আসছে বাকি রইলো ছোট চাচী। কিন্তু বাচ্চারা আর অপেক্ষা করতে চাইছে না তাই সাগর লাগেজটা খুলে ফেলল। প্রথমেই বের করলো অনেক গুলো আচারের প্যাকেট তার সবটাই সাগর মায়ের হাতে দিলো। মা সবাইকে ভাগ করে দিবে৷ এরপর বের হলো তিথি আর শৈবাল এর জন্য বেশ কিছু খেলনা যা পেয়ে তিথি উঠে গিয়ে চটাস করে সাগরকে চুমু দিলো, ” থ্যাংকু বর মশাই”। কিন্তু শৈবাল তার গুলো নিয়ে মুখ ফুলিয়ে নাড়াচাড়া করছে।

–” বাহ্ তিথিতো বেশ চালাক গিফট পেয়ে বরকে আদর করছে। কিন্তু এই বুড়ো মুখ ফুলিয়েছে কেন”? সৈকতের কথায় সবাই শৈবাল এর দিকে তাকালো। সত্যিই চুপ করে বসে আছে সে দেখে বোঝাই যাচ্ছে কিছু একটা অপছন্দ হয়েছে।

–” কি হয়েছে শৈবাল”?সাগর জিজ্ঞেস করলো।

–” তিথির খেলনা গুলো বেশি সুন্দর । আমায় একটা কচ্ছপ দাও নি তিথির কচ্ছপ প্রজাপতি সব আছে”।সবার এবার খেয়াল হলো আসলেই প্রত্যেকটা খেলনা দু’টো থাকলেও কচ্ছপ আর প্রজাপতি একটা করে আছে আর তা তিথির কাছে। বাধ্য হয়ে সে দু’টো সাগর তিথির থেকে নিয়ে বলল, ” আরেহ ভুল করে চলে গেছে তিথির কাছে। এ দু’টো তো নতুন মেহমানের জন্য এনেছি” বলেই সৈকতের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো সাগর৷ ইঙ্গিতটা ঘরের বড়রা সবাই টের পেয়ে হাসছে৷ কিন্তু সৈকত বেশ লজ্জা পেয়েছে ভাগ্যিস এখানে তার বউ উপস্থিত নেই নয়তো বেচারি আরো বেশি লজ্জা পেত। সাগর একে একে সবার গিফট সবাইকে দিয়েই মাকে বলল, ” খিদে লাগছে”। মা চলে যেতেই সবাই চলে গেল। সবার শেষে সাথী আর যুথি যাচ্ছিলো সাগর ডাকলো, ” সাথী তুই কার জন্য যেন মালা বেশি করে আনতে বলেছিলি নিয়ে যা সেটা”।

ঢকঢক করে আইসক্রিম এর বাক্স সাবাড় করে দিয়েছে মাহি আর মাহিম মিলে। নিরব নিয়ে এসেছে আসার সময়। কিন্তু দু’ভাইবোন টানা হেঁচড়া করে আমি খাবো আমি খাবো বলে অর্ধেকটা গলিয়ে ফেলেছে৷ আর তাই এখন আইসক্রিম কে দুধের মত ঢোকে গিলছে।
–” গানের দৌড় কতটুক”? নিরব প্রশ্ করলো। মাহি বক্সে থাকা আইসক্রিমে শেষ ঢোক গিলে বলল, ” হাঁটি হাঁটি পা পা চলছে এখন”।
–“তোর কি মনে হয় তুই গান শিখতে পারবি”।

–” না পারলে ও চালাতে তো হবেই “।

–” কেন”! নিরব অবাক হলো খুব কিন্তু মাহি ভড়কে গেল। কি বলতে সে কি বলছে।

–” না মানে চেষ্টা তো করতেই হবে ভাইয়া শখ যেহেতু হয়েছে”।

–“তা কর কিন্তু দেখিস শখ পুরন করতে গিয়ে পড়াশোনার ক্ষতি করিস না “।

–” তেমন কিছুই হবে না ভাইয়া “।

–” তাই যেন হয়। আচ্ছা একটা কথা বল”।নিরব এবার একটু সিরিয়াস হয়ে তাকালো মাহির দিকে৷

–” কি বলবো”?

–” কি হয়েছে তোর”? এ প্রশ্নে মাহি যেন আসমান থেকে ধুপ করে মাটিতে পড়লো।

–” আমার আবার কি হবে “? বলেই মাহি নিজেকে দেখতে লাগলো।

–” কিছুই যদি না হয় তবে আজকাল ফোন করিস না কেন? কোন আবদার ও তো করিস না “।মাহি এবার বুঝতে পারলো ভাইয়াকে সে আজকাল কোন কিছুর জন্য জেদ দেখায় না বলে হয়তো ভাইয়া তাকে মিস করে। তার আবদার গুলো শোনার হয়তো অভ্যাস হয়ে গেছে ভাইয়ার৷ আর হবে না’ই বা কেন এক ভাইয়াকেই তো সে ছোট থেকে খুব জ্বালায়। আর তো কেউ নেই তার জ্বালা সহ্য করার মত। এই কথা গুলো মাহি আর নিরবের কাছে সম্পূর্ণটা ভাই বোনের মধ্যকার থাকলেও দরজার বাইরে থেকে শুনতে পেয়ে তা অন্যরকম ব্যাপার বলে মনে করলো কেউ একজন। আর সেই কেউ একজনটা মাহির মা৷

রাতের খাওয়ার পর মাহি বেশ কিছু সময় পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলো। রাত বারোটার পর সে ঘুমিয়ে আবার ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেছে৷ ঘুমটা ভেঙেছে একটা স্বপ্ন দেখার পর। আর তখনই আওয়াজ এলো চারপাশে ফজরের আজান হচ্ছে । মাহি সচরাচর ফজর নামাজটা মিস করে যায় কিন্তু আজ আর তা হলো না। ঘুম ভাঙার পর নামাজ পড়ে ছাঁদে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করলো৷ ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় কোমল আলোয় মাহির বেশ ফুরফুরে লাগলো নিজেকে৷ আর সেই সাথে মনে পড়লো কি স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙেছিলো।

“সবুজ অরন্যে ঘেরা এক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলো মাহি। তার ঠিক পাশেই দাড়ানো শুভ্র কাপড়ে এক পুরুষ৷ পুরুষ বললে ভুল হবে ঠিক যেন সুপুরুষ৷ মাহি একমনে সেই পাহাড়ের আড়ালে সূর্যডুবি দেখছে আর পাশে দাঁড়ানো পুরুষটি গাঢ় দৃষ্টিতে তখন শুধু মাহিকে দেখছে”৷ স্বপ্ন এতটুকুই আর এই স্বপ্নে সেই পুরুষটির মুখ কিছুতেই স্পষ্ট ছিলো না। মাহি বারবার চেষ্টা করছে মনে করার কিন্তু সে ব্যর্থ্য। ভোরের সূর্য উঁকি দিয়েছে পুর্বদিগন্তে৷ মাহির মুখে সেই আলোর হালকা রশ্মি পড়ছে। আর তখনই হঠাৎ চোখে পড়লো পাশের বাড়ির ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে কেউ৷ সেই কেউ টা অবশ্য মাহির অস্পষ্ট দেখা মানবটিই৷ সাদা শার্ট গায়ে দাঁড়িয়ে আছে সাগর পূর্ব দিকেই মুখ করে। সাগরকে দেখেই এক বিদ্যুৎ এর মত ঝলকানি খেলে গেল মাহির পুরো দেহ মন জুড়ে৷ স্বপ্নে দেখা পুরুষটি কে দেখতে এমনই ছিলো!

চলবে
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here