শব্দহীন_বৃষ্টি
(১১)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________
ম্যাথ আমার কাছে করে কেমন বুঝলে নাহিদা? ক্লাসে সবার সামনেই হঠাৎ প্রশ্ন করলো জুনাইদ স্যার।
–“জ্বি স্যার বেশ ভালো বুঝি।” স্যার যে ইচ্ছে করে ক্লাসের মাঝে এই কথাটা তুলেছে তা মাহি আর নিপা বুঝতে পেরে মুখ টিপে হাসছে। নাহিদা এক সপ্তাহ ধরেই গণিত পড়ছে তার কাছে। পড়ছে বললে ভুল হবে স্যার ইচ্ছে করে পড়াচ্ছে। এর আগে কখনো তিনি স্কুলের কোন স্টুডেন্ট পড়াতেন না। ইদানিং বিভিন্ন ভাবে ক্লাস টেন এর সকল ছাত্রীকেই মোটামুটি পড়ানোর জন্য ফুসলাচ্ছেন। তার উদ্দেশ্য কোন না কোন ভাবে মাহিকে ও ভিড়াবে তার কাছে আর তখন মনের কথা গুলো একটু একটু করে জানাবেন। ভাগ্য মহাশয় তার কখনোই প্রেমের ক্ষেত্রে সুফল দেয় নি তাই এবারেও আশায় বালি।বিরক্তিভরা মুড নিয়ে ক্লাস শেষ করেছে মাহি। নিপা অবশ্য মজা পায় বেশ মাহির স্যারকে নিয়ে বিরক্ত হওয়া দেখে৷সমুদ্র আজ বারবার আঁড়চোখে দেখছে মাহিকে তা লক্ষ্য করেছে নিপা। কারণ নিপা ও সেইম কাজ করছে তবে সে দেখছে সমুদ্রকে। আঁড় চোখাচোখিতে হুট করে আবার নিপা সমুদ্র দু’জনে দু’জনের চোখাচোখি ও হয়ে গেল। এতে অবশ্য দু’জনেই বেশ লজ্জা পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
সারাদিন ক্লাস,কোচিং করে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরেছে মাহি। আজ মন খারাপ করেছে খুব তার। বাড়ি ফেরার পথে মার্কেটের পেছনের মোড়ে সে সাদা টি-শার্ট ভাইয়াকে দেখেছে বার্গার শপে। তাতে বেশ খুশিই হয়েছিলো সে কিন্তু চমকেছে সাদা টিশার্ট ভাইয়ার পাশে বসা কোঁকড়া চুলের মেয়েকে দেখে। দু’জনে কি মিষ্টি হাসি বিনিময় করছিলো আর গল্প করছিলো। ভেতরটা জ্বলছে মাহির। কোথাও একটু দুঃখ ভর করছে৷ কিন্তু কেন? কেন এ ক’দিনেই এই হঠাৎ দেখা লোকটাকে নিয়ে এত ভাবছে মাহি? কোন উত্তর নেই এই প্রশ্নের। মনের মধ্যে ক্লান্তি ভর করেছে সাগরকে সেই মেয়ের সাথে দেখে।
–” এভাবে এসেই কেন শুয়ে পড়লি মাহি? গোসল করে আয় আমি খাবার বাড়ছি।” চামেলি মেয়ের ঘরে এসে কথাটা বলেই থমকালো। মাহির মুখ কেমন ফ্যাকাশে লাগছে। মেয়েটার কি মন খারাপ?
–” খিদে নেই মা৷ একটু পর শাওয়ার নেবো।”
–” কিছু কি হয়েছে?”
–” না’তো” বলেই মাহি আবার বলল, ” মা শোনো”। চামেলি তাকালো মেয়ের দিকে অপেক্ষা করছেন মেয়ে কি বলতে চায় তা শুনতে।
–” আমার না আজ খুব মন খারাপ হয়েছে কিন্তু কেন হয়েছে তা জানি না”। আমতা আমতা করেই বলল মাহি। মা তার কথা গুরুত্ব সহকারে নিলো বলে মনে হলো না।
–” কিসের মন খারাপ ? টিফিনে বোধ হয় কিছু খাসনি তাই এমন লাগছে। যা গোসল সেরে খেতে আয় “। চামেলি চলে গেছে কথাটা বলে। তিনি ভুলে গেছেন তার মেয়েটি এখন কিশোরী। দেহের সাথে তার মন ও এখন বেড়ে উঠেছে৷ শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। অথচ ভুলে গেছেন মেয়েটি এখন মানসিক দিক থেকে বেড়ে উঠেছে তার পরিবর্তন অবশ্যই লক্ষ্য রাখা উচিত মা হিসেবে। হয়তো প্রথম পরিবর্তন বলে তার ধর্তব্যে আসেনি ব্যাপারটা। মা চলে যেতেই মাহি শাওয়ারে গেল। আজ মন একটু ও চাচ্ছে না গান শিখতে যেতে৷ সত্যি বলতে ও বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছেটা হুট করেই যেন চলে গেছে। শাওয়ার নিয়ে ডাইনিং এ যেতেই দেখলো সাথী আর যুথি বসে আছে সোফায়।
–” ওই তোমরা কখন এলে? ”
–” একটু আগেই ” যুথি বলল।
–” আপু তুমি কি এখন খাবে? ” সাথী জিজ্ঞেস করলো।
–” কেন?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো মাহি৷
–” চলো খেতে হবে না এখানে। আমরা আজ পার্টি করবো জেঠি মা বলেছে আজ গান শেখাবে না৷” সাথী কথাটা বলতেই মাহি বলল, ” ভালো হয়েছে৷ আজ আমার ও যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না। ”
–” বললেই হলো নাকি? দাদুনী আমাদের পাঠিয়েছে এক্ষুনি তোমাকে নিয়ে যেতে। ভাবী তে বলেছে আমাদের শাড়ি পরিয়ে দেবে চলো চলো।” তাড়া দিলো সাথী৷ মাহির মা শুনেছে তাদের কথা আবার সাগরের মা শামসুন্নাহার ও একটু আগে বারান্দা দিয়ে ডেকেছিলো। তখনই বলেছে, ” ভাবী আমাদের বাচ্চা গুলো আজ পার্টি করবে বলছে তাই মাহিকে ও থাকতে বলছে। কিছু মনে না করলে ওকে পাঠিয়ে দিয়েন আর সন্ধ্যায় আপনি, মনজুর ভাই মাহিমকে নিয়ে আইসেন”।
সবই ঠিক ছিলো কিন্তু চামেলি ভাবছে বাচ্চাদের পার্টি হলে তারা হাজবেন্ড ওয়াইফ কেন যাবে। কয়েক বছর তেমন একটা আনাগোনা হয়নি এই দুই প্রতেবেশির মধ্যে। মাহির জোর করে গান শিখতে চাওয়ার পর থেকে আবার যেন আগের মত আলাপ শুরু হয়েছে৷তবে ভালোই লাগছে চামেলির । শহিদুল ইসলাম খুব যত্ন করে তার পরিবারকে এক করে রেখেছে৷ চামেলি ভাবে বিংশ শতাব্দীতে এমন সুখী যৌথ পরিবার আদৌও খুঁজলে আর দু’টো পাওয়া যাবে না হয়তো। আজকাল সবাই নিজের বলতেই বোঝে সবটা। আমাদের বলতে কিছু হয় না অথচ ওই বাড়িটির দিকে তাকালে মনের মধ্যে এক রকম প্রশান্তি আসে। চামেলি ও বড় হয়েছে এক বড় যৌথ পরিবারে। তার বাবা চাচারা সবাই একসাথে থাকতেন। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে সেই পরিবার এখন তো তার নিজের দু’ভাই একসাথে থাকে না চাচারা তো পরের ব্যাপার। আর বিয়ে হলো এমন পরিবারে যেখানে তার স্বামীর কোন ভাই বোন কিছুই নেই। চাচাতো ননদ,দেবর পেয়েছে কিন্তু তারা ও কেউ দেশে থাকে না। অবস্থা বেশ ভালো হওয়ায় তারা দেশ ছেড়ে বিদেশে স্যাটেল হয়েছে। আজকাল বড্ড একা লাগে চামেলির স্বামী আর দুই সন্তান ছাড়া আর কেউ নেই এমন মনে হয়।
মাগরিবের আযান হতেই বাড়ির বড়রা সবাই নামাজের জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল। বাসায় ছেলে বলতে সমুদ্র আর শৈবাল ছিলো। মায়ের ধমক খেয়ে সমুদ্র ও শৈবালকে নিয়ে মসজিদে গেছে। বাকি রইলো সাথী আর মাহি। যুথি আর তিথিকে ও শিলা ভাবি যাওয়ার সময় নামাজের জন্য নিয়ে গেছে। সাথী পিরিয়ড এর জন্য পড়তে পারবে না কিন্তু মাহি খুব লজ্জা পাচ্ছে। এ বাড়িতে সবাই রেগুলার নামাজ পড়ে৷ মাহি অবশ্য পড়ে নামাজ কিন্তু প্রায়ই সে দুই কি তিন ওয়াক্ত পড়ে। এ নিয়ে মায়ের মুখের শূলে তাকে প্রতিদিনই চড়তে হয়। মাহির অস্বস্তি হচ্ছে সাথী বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো, ” মাহিপু তুমি কি নামাজ পড়তে পারবে?”
–” হ্যা, আমি পড়তে চাচ্ছি “। ধীর গলায় বলল মাহি।
–“৷ ওহ তো তুমি কিছু বললে না কেন? আমারই ভুল আম্মু বলেছিলো তোমাকে নামাজের ব্যবস্থা করে দিতে। আমি ভাবলাম এখানে না ও পড়তে পা,,,
–” নামাজ নিয়ে এখানে আর ওখানে কি বলো! ইবাদত তো যেখানেই থাকি না কেন করতে তো হবে।আমি তো আলসেমি করেই মিস করি বেশিরভাগ সময়।” বলতে বলতে মাহির গলা কেঁপে উঠল। সে কি লজ্জা পাচ্ছে! হতে পারে ইবাদত নিয়ে যে আলসেমি করে সে যে মানুষ বোকা তা কে না বলবে। কথার মাঝেই সাথী আর মাহি নিচে গেল৷ ওযু করে নামায পড়ে মাহি খেয়াল করলো সাথী রুমে নেই। জায়নামাজ উঠিয়ে মাহি ঘর থেকে বের হতে গেলেই দেখতে পেল সামনের ঘরের দরজায় সাগর দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই বুকের ভেতর ধকধক করে উঠলো। মনে পড়লো আজকের দেখা সাগরের সাথে সেই মেয়েটিকে। মনে পড়লো দু’জনের হাসিমাখা মুখ। বুকের ভেতর ধকধকানি সাথে যোগ হলো মন খারাপের রোগ। এ কেমন অনুভূতি! এক অচেনা লোককে দেখে ভালোলাগা শুরু এখন আবার তার জন্যই খারাপ লাগা। মাহির অস্থির লাগছে খুব৷ এ বাড়িতে থাকাটাই কি তাকে অস্থির করছে? নাকি এই লোকটাকে দেখতে পাওয়া, নাকি এই লোকটার পাশে একটা মেয়েকে দেখা? কি আজগুবি সব চিন্তা ভাবনা।
–” মাহিপু চোখ বন্ধ করো”। সাথী হাতের মুঠোয় পুরে কিছু এনেছে। মাহি এবার সাগরের থেকে নজর সরিয়ে সাথীর দিকে তাকালো। সাগর তার ঘরের সামনে ছিলো এখন বোধ হয় ভেতরে ঢুকে গেছে৷
–” চোখ বন্ধ করবো কেন?”
–” আহ্! আপু করোই না।”
মাহি চোখ বন্ধ করতেই সাথী একটা লকেটসহ চেইন গলায় পড়িয়ে দিলো।
–” এটা কি সাথী?”
–” কেমন লাগলো সেটা বলো? ”
–“ভীষণ সুন্দর কিন্তু,,,
–” কোন কিন্তু নয় পড়ে থাকো এটা তোমার। সাগর ভাইয়া কক্সবাজার থেকে আসার সময় এনেছে।”
মাহির একটু অবাক লাগলো আবার খারাপ ও লাগলো৷ সে কেন নিবে এই লকেট? সাগর নিশ্চয়ই এটা তার বোনদের জন্য এনেছে। সাথী মেয়েটা খুব বোঝে মাহিকে। বয়সে দু’বছরের ছোট হলেও বুদ্ধিতে মাহির আগে।
–” ভাইয়া এটা তোমার জন্যই এনেছে তাই অত না ভেবে পড়ে থাকো “।
মাহি একবার আলতো হাতে ছুঁয়ে দেখলো লকেট টা তারপর সাথীর ড্রেসিং টেবিলের সামনে। চিকন সিলভার রঙের চেইন এর মধ্যে সাদা পার্ল বসানো ছোট্ট একটি লকেট৷ মাহি লকেটটাকে ভালো করে ছুঁয়ে দেখলো কয়েকবার। হঠাৎ করেই যেন বুকের ভেতর ধকধকানি বন্ধ হয়ে গেল৷ এখন মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস বুঝি তার গলায় আটকে গেছে। ঠিক সেই জায়গায় যেখানটায় লকেট টা ঝুলছে৷
মাগরিবের পর সব ভাইবোনেরা ছাঁদে উঠে গেল৷ আর মহিলারা কিচেনে ঢুকেছে বিরিয়ানি রান্না করবে বলে৷ বাড়ির পুরুষরা অবশ্য ছাঁদে আছে ছেলে মেয়েদের সাথে শুধু সৈকতের বাবা শহিদুল ইসলাম ছাড়া। তিনি বেজায় গম্ভীর মুখো মানুষ।এসব হৈ হল্লাতে যোগ দেওয়া যেন খুব কঠিন কাজ মনে হয় তার। অথচ বাড়ির সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ সৈকতের দাদুনী৷ তিনি এখন সকলের সাথে ছাঁদে আছেন। আর একটু পরপরই এমন সব কথা বলছেন যা শুনে বাচ্ছারা খিলখিলিয়ে হাসছে। এতসবের মাঝে দেখা গেল শিলা বেশ মুখ ফুলিয়ে আছে। সৈকত অফিস থেকে ফিরেই এখানে এসেছে অথচ শিলা চাচ্ছিলো সৈকত এখন কিছু সময় তার সাথে বসুক আলাদা সময় দিক কিন্তু নাহ সৈকত সোজা চলে এসেছে ভাই বোনদের কাছে।
–” বেশ মানিয়েছে তোমার গলায় ” কথাটা শুনতেই মাহি চমকে উঠলো।
চলবে
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)