শব্দহীন_বৃষ্টি (১২)

0
1108

শব্দহীন_বৃষ্টি
(১২)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________
আনন্দমুখর আলো আধারিময় ছাঁদে প্রশান্তির হাওয়া যেখানে পূর্ণ সমুদ্র সেখানে অস্বস্তিতে গাট হয়ে গেছে। একটু আগেই সাথীর ঘরের দরজায় মাহিকে দেখে একটুখানি তারিফ করেছিলো৷ ওড়নার ওপর দিয়ে গলায় চিকন চেইনে ঝুলে থাকা পার্ল এর লকেট দেখে বলেছিলো, ” বেশ মানিয়েছে তোমার গলায়”। ব্যস এতটুকুর পর মাহির চমকে যাওয়া চেহারা দেখে লজ্জায় পড়েছে সমুদ্র৷ বারবার ভাবছে প্রশংসা করাটা কি বেমানান হলো নাকি সে এখনও সেই ভালোলাগার রেশ টেনে রেখেছে মনের মধ্যে! আর যাই হোক মাহি কিংবা ক্লাসের কোন মেয়ের প্রতিই এখন এট্রাকশন ভুল করেও লাগতে দেওয়া যাবে না। যাইহোক মাহির দিকেই তাকাবে না আর মনে মনে প্রমিজ করা হয়ে গেছে।

–” এই চিপায় দাঁড়াইয়া আছিস কেন”? হঠাৎ কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করলো সৈকত। ভাইয়ের এমন আচমকা স্পর্শে চমেকে গেছে সমুদ্র । তবুও একটু করে জবাব দিলো, ” কিছু না ভাইয়া”।

–” শিওর? ”

–“হুম।”

–” তবে যা গিয়ে একটু কাজ কর নিচে গিয়ে তোর ভাবীকে বল চা নিয়ে আসতে। ” সমুদ্র মাথা নেড়ে চলে গেল। ছাঁদে এক পাশে গ্রিল চিকেন এর ব্যবস্থা করা হয়েছে যার দ্বায়িত্বে আছে সমুদ্রের বাবা রিয়াদুল ইসলাম আর সাগর। মাগরিবের নামাজ আদায় করে সে সোজা ছাঁদে উঠে এসেছে। বিকেল থেকে কয়েকদফা চা,নুডলস,পাকোড়া, বিস্কিটস সাবাড় হয়েছে হালকা নাশতা হিসেবে৷ তাই আপাতত কারোই পেটে খিদে নেই৷ বেশ আনন্দে কাটছে সবার সময় আজ বহুদিন বাদে৷ মাহির মন প্রথমে খারাপ থাকলেও এখন আর একটু ও খারাপ নেই। ভুলেই গেছে সে মন খারাপ ছিলোই বা কেন। সাগর বসা ছিলো তার ছোট চাচুর পাশে ফোন আসায় উঠে দাঁড়ালো সে। এক নজরে ছাঁদের পুরো পরিবেশটা দেখে নিলো৷ এরপর গুটি গুটি পায়ে চলে গেল ছাঁদে থাকা দোলনাটির দিকে আর ফোন রিসিভ করেই বলল, “খুব ভালো সময়ে কল দিয়েছো”।

–” গুড নিউজ আছে নাকি “? দোলা আপ্লুত স্বরে জিজ্ঞেস করলো ফোনের ওপাশ থেকে।

–” উহুম, তেমন কোন নিউজ নয় তবে বাড়িতে পার্টি চলছে ছোট খাটো। সবাই খুব আনন্দ করছে। ভালো লাগছে বেশ সবাইকে এমন একসাথে দেখতে “।

–” ওহ ” দোলার উচ্ছাসে যেন ভাটা পড়লো। সাগর ও একটু অবাক হলো এমন গা ছাড়া জবাবে। সে হয়তো আশা করেছিলো একটু হলেও এক্সসাইটমেন্ট প্রকাশ করবে। পরে আবার ভাবলো হয়তো এটা আমার জন্য উত্তেজনাকর বলে কি তার কাছে ও হবে এমন তো কোন কথা নেই। নিজেই নিজেকে ব্যাখা করে সাগর। আজকাল ঘনঘনই কথা হয় সাগর দোলার। তবে শুরুটা দোলাই করে। সাগরের ভালো লাগে দোলাকে বলা যায় সে দেখতে সুন্দরী কিন্তু এর বেশি কিছুই না। মানসিক চিন্তাধারার দিক থেকে দোলা একটু বেশিই আপগ্রেডেড যা তার তেমন ভালো লাগে না।

সাগর দোলার গল্প চলে অনেকক্ষণ আর এই সময়ে শিলা চা নিয়ে এসেছিলো। ডাকতে গিয়ে বুঝতে পেরেছে দোলার সাথে কথা বলছে তার দেবর।মনে একটু সন্দেহের সৃষ্টি হলেও তেমন পাত্তা দেয় নি।

ছাঁদে একটা লাইট ছিলো। আলগা তার টেনে আরো একটা লাইট যুক্ত করলো সৈকত। শামিয়ানা টাঙিয়ে ছিলো বিকেলেই এখন পরপর বড় দু’টো মাদুর একসাথে করে বিছিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভোজনরসিক সকল পুরুষ মানুষ গুলো আজ একসাথে সবাই। মাহির বাবা আর সাথীর বাবা সবার আগে বসেছে তারা দু’জনই পেটুক স্বভাবের। খাবারের পর্ব শুরু করার কথা বলেও একটু ভেজাল করলো বাড়ির বাচ্চাগুলো। তারা চিকেন গ্রিল করেও এখন খাবে না ঠিক করেছে। এটা থাকবে রাত বারোটায়। দাদুনী প্রথমে হামতাম করলেও পরে বললেন, ” যা তোগো মনমতো কর তয় আমারে আগে এট্টুখানি দিয়া নে আমি আবার ঘুমাইয়া যামু”। দাদীর মুখে বাচ্চামো কথা শুনে সৈকত খুব আদর করে দাদুনীকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে। ইশারায় শিলাকে বোঝালো, ” আসো তোমাকে ও একটু খাইয়ে দেই “। শিলা মুখ বাঁকিয়ে শব্দ করেই বলল, ” উহ ঢং”।

মাহির দৃষ্টি অস্থির ভাবে পুরো ছাঁদে পায়চারী করছে। এত সুখ সুখ লাগছে কেন এই ছাঁদটিতে? এক সারিতে তার বাবা আর সাথীর বাবা তাদের পাশেই তিথির বাবা পাশে শৈবাল। তিনি আদর করে বিরিয়ানি মুখে তুলে দিচ্ছে শৈবালের মুখে। যুথি আর সমুদ্র একটা কোল্ড ড্রিংকস এর বোতল নিয়ে টানাটানি করছে। বলতে গেলে সমুদ্র বয়সে বড় হওয়ায় জোর খাটাতে চাইছে আর যুথি ও ছাড়বে না বলে জেদ ধরেছে। সমুদ্রের মা ধমকাচ্ছেন দু’জনকেই। আহা! এমন শাষণ কত আদুরে এই শাসনে মন খারাপ করে না একটু ও। সাথীর মা,সাগরের মা আর মাহির মা তিনজনে বিরিয়ানি সার্ভ করছেন শিলা ভাবি সালাদ দিচ্ছেন সাথী ও সহযোগীতা করছে। ছেলেরা সবাই বসে গেছে মাদুরে। পুরো পরিবারের দিকে এক নজর দেখলে মনে হয় যেন কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে তাই এত মানুষ একসাথে। মাহি ছোট থেকে ছোট পরিবারে বড় হয়েছে। আত্মীয় বলতে অনেক আছে অথচ প্রতিনিয়ত এক বাড়িতে থাকার মত মা,বাবা,ভাই আর সে ছাড়া এক কাজের মেয়ে সে ও সারাদিন থাকে না। এত আনন্দ লাগছে মাহির এমন এক পরিবার দেখে মনে মনে নিজেকে নিজেই ধন্যবাদ দিলো। হ্যা, মনই তো করলো এমন এক মহৎ কাজ এ বাড়িতে আসার মত৷ না সেই রাতে অস্পষ্ট দেখায় ওই ব্যক্তিটার প্রতি আকর্ষিত হতো আর না এ বাড়িতে গান শিখতে আসার জেদ হতো। আর না এই পরিবারের মানুষ গুলো তাদের এতোটা আদরে এখানে ডাকতে আজকের এই মুহুর্তে। মাহি এক ধ্যানে বসে যখন এতসব ভাবনায় মগ্ন তখন একটা ছোট ঢিল ছুঁড়ে মারলো কেউ একজন তার ভাবনায়।

–” মাহিয়া নাম তাই তো? তুমি সাথীর সাথে এ পাশে বসো “। সাগরের কথায় মাহি চমকে তাকালো সামনে। সাদা টি-শার্ট, ব্লু জিন্স এলোমেলো চুল,হাতে মোটা সিলভার রঙের ঘড়ি পায়ে লটোর স্যান্ডেল আর সবচেয়ে চোখে লাগার মত ব্যাপার ছিলো খোঁচা দাড়ি ভর্তি শক্ত চোয়াল। কথা বলার সময় ও কেমন মুখের ভাব কঠিন মনে হলো মাহির ঠিক যেন এংগরি ইয়াংম্যান। কয়েক সেকেন্ডে মাহি তাকে এতোটাই গভীরভাবে দেখে নিচ্ছে যা দেখে সাগরের নিজেরই অস্বস্তি লাগলো। পরে ভাবলো বাচ্চা মেয়ে এভাবে তাকিয়েছে তো কি হয়েছে! কিন্তু নাহ, মাহি যেন ভুলেই গেছে চোখ সরাতে তার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা ও হঠাৎ থমকে গেছে। মুহুর্তটা দমবন্ধকর মনে হচ্ছে এ কেমন অনুভূতি।
মাহির এমন ফ্রিজড অবস্থা দেখে সাগর সরে গেল সামনে থেকে কিন্তু মনের মধ্যে একটা ছোট্ট ধাক্কা লেগেছে মাহির দিকে তাকিয়ে। মুখটা কেমন যেন পরিচিত মনে হলো। নিঃসন্দেহে সে মাহিকে আগেও বহুবার দেখেছে তখন হয়তো মাহি আরো ছোট ছিলো। কিন্তু আজকে এতো কাছ থেকে দেখার পর অন্যরকম পরিচিত মনে হলো। কোথাও কি আলাদাভাবে দেখেছিলো সে এই মেয়েটিকে? উহুম এলাকার বাইরে কোথাও দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না।

রাতের খাওয়ার পর্ব শেষে মাহির মা,বাবা চলে গেছে । সাথী,যুথির আবদারে বাড়ির বড়রা মাহি আর মাহিমকে রেখে দিয়েছে। রাতে এখানে থাকবে তারা। দুনোমনো করে চামেলি আর মনজুর সাহেব ও রাজি হন তাদের রেখে যেতে।

রাতে এগারোটার পর আবার ছাঁদে জড়ো হলো বাড়ির ছেলে মেয়েরা। শুধু শৈবাল আর তিথি ঘুমিয়ে পড়েছে। তিথি অবশ্য কান্না করে ঘুমিয়েছে তার বর নাকি আজ তাকে বকা দিয়েছে। রাতের খাবারের সময় সাগর নিজে খাইয়ে দিচ্ছিলো তিথিকে আর তখন শৈবাল ও খেতে চেয়েছিলো। কিন্তু তিথি বাঁধ সাধে সাগর অনেক বলে একটু দিবে কিন্তু তিথি তো নাছোড়বান্দা । আর তাই সাগর ধমকেছিলো। ছাঁদে আবার আড্ডা হবে শুনে মাহি বেশ উৎফুল্ল, উত্তেজনা নিয়ে এসেছিলো। মন বলছিলো সেই ব্যক্তিটাও থাকবে এখন। আরো একটু লুকিয়ে তাকে দেখে নিবে কে জানে এমন সময় আর এ জীবনে আসবে কিনা? কিন্তু এমন কিছুই হলো না সাগর আসে নি। শেষ পর্যন্ত সৈকত আর শিলা ও আসে নি। মন খারাপ হলো আবার মাহির তাই বলে উঠলো, ” ঘুম পাচ্ছে”। সমুদ্র ভড়কে গেল ছাঁদে আসারই কি দরকার ছিলো। অবশেষে জমলো না আর মধ্যরাতের আড্ডা। সবাই নিচে চলে আসলো । তাদের শখের গ্রিল চিকেন,সস,ক্রিম আর রুটি পড়ে রইলো যেমন তেমন করে। সবাই যার যার মত ঘুমোতে চলে গেছে।

সকালে মাহির ঘুম ভাঙতেই মনে পড়লো আজ তার ম্যাথ ক্লাস পরীক্ষা আছে। মাথায় হাত পড়লো, রাতে এ বাড়িতে আড্ডায় মজে ভুলেই গেছে সে। কোন রিভিশন নেই আল্লাহ জানে কি লিখবে। সাথী ও সবে ঘুম থেকে উঠেছে। মাহিমকে ডেকে দিতে বলল মাহি। রাতে সমুদ্রের সাথে ঘুমিয়েছে সে। সাথীর মা তখনই ঘরে ঢুকলেন মেয়েদের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে। তিনি জানালেন মাহিম একটু আগেই চলে গেছে। মাহিকে নাস্তা করে যাওয়ার কথা বললে সে জানালো দেরি হয়ে যাবে পড়া বাকি আছে।

আজ স্কুলে এসে প্রথমেই নিপাকে জিজ্ঞেস করলো তার ম্যাথ টিচার কি তাদের পাড়ায় আসতে পারবে? নিপা জানে মাহির টিচার এক সপ্তাহ ধরে পড়াচ্ছে না কিন্তু তাতে নতুন টিচার কেন দরকার এই এক সপ্তাহ সে নিজেই হেল্প করবে। মাহি বলল, ” আমার স্যার আজ কল করে জানিয়েছে তিনি একটা ভালো জব পেয়েছেন। তাই আর পড়াতে পারবেন না। এই মাসটা ও কমপ্লিট করা সম্ভব নয়।” নিপা বলল সে আজই তার টিচার কে বলে দেখবে৷ ভালোই দিয়েছে পরীক্ষা আজকে৷ সবটাই চুরি করে মানে নিপার থেকে দেখে দেখে লিখেছে৷ ছুটির পর বাড়ি ফিরে জানতে পারলো মা তার জন্য শিক্ষক পেয়ে গেছে। মাহি কথাটা শুনে খুশি হলেও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করলো না শিক্ষকটা কে? শাওয়ার নিয়ে খাবার খেয়ে একটুখানি বিছানায় গা এলিয়েছিলো। হঠাৎ কানের কাছে মায়ের গলা শোনা গেল, “শোয়া পাঁচটা বাজে গান যদি এতোই শেখার ইচ্ছে থাকে তবে এক্ষুনি যা। মাগরিবের পর থেকে আবার ম্যাথ করতে হবে”।

–” মা! স্যার কি সন্ধ্যায়ই পড়াতে আসবে “?

–” আসবে না তুই যাবি বরং ওখানেই থাকবি।”

–” মানে কি?” শোয়া থেকে ঝট করে উঠে বসলো মাহি। স্যার কি তাকে স্যারের বাড়িতে পড়াবে! এই ভাবনার মধ্যে ও মাহির একবার ও মনে হলো আগে প্রশ্ন করা দরকার তার ম্যাথ টিচার কে।

–” মানে আবার কি সাগর বাড়ি এসে পড়াতে পারবে না। সন্ধ্যায় তার ভাইবোনদের পড়া দেখে সে নিজেই। আর সমুদ্র তো তোর ক্লাসেরই তোরই সুবিধা হবে একসাথে পড়লে ” চামেলি কথাটা শেষ করেই ঘর ত্যাগ করলেন। মাহি মিনিট দুয়েক সময় কিছুই বুঝলো না। এরপরই সে এক গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো। তবে সেই চিৎকার খুশির,দুঃখের নাকি চমকানোর না অবাক কিসের সে নিজেই জানে না। শুধু কানে বারি খাচ্ছে মায়ের বলা কথা গুলো থেকে একটাই শব্দ ” সাগর”।

চলবে

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here