শব্দহীন_বৃষ্টি (১৩)

0
1028

শব্দহীন_বৃষ্টি
(১৩)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________
“নামাজ পড়ে এসেছো?” শামসুন্নাহার তাসবীহ হাতে সোফায় বসতে বসতে সাগরকে প্রশ্ন করলো । মাত্রই মাগরিবের নামাজ পড়ে ফিরেছে সে।

–” হ্যা “। ছোট করে জবাব দিলো সাগর।

–” বসো একটু কিছু বলার আছে”। সাগর অবাক হয়নি মায়ের কথায়। যখনি মা কিছু একটা বিশেষভাবে বলতে চায় তখনি এমন তুমি করে সম্মোধন করে তাদের দু’ভাইকে।

–” কোন ব্যাপারে”?

–” তুমি তো আজকাল ফ্রী আছো। তোমার বাবার সাথে নাকি ব্যবসায় ঢুকবে না। আর তোমার চাকরিটা ও এখন হচ্ছে না তাই,, একটু থামলেন শামসুন্নাহার। আবার বলতে লাগলেন ” তাই আরকি কয়েকজন স্টুডেন্ট জোগাড় করে নিলে তোমারই ভালো হতো। আমি নিজেও একজন ঠিক করেছি আশা করি আপত্তি করবে না”।

–” আপত্তি তো করা উচিত নয় কিন্তু স্টুডেন্ট পড়াতে গেলে মাথা ঠিক থাকে না বাড়ির গুলোকে পড়িয়েই পাগল হয়ে যাই”।

–” আমি জানি কিন্তু এই মেয়েটা অতি শান্ত স্বভাবের তাই তোমার কোন সমস্যাই হবে না”।

–” কিহ! কোন মেয়ে স্টুডেন্ট আমি পড়াবো না মা অসম্ভব । মেয়ে গুলো বেশি ফাজিল হয়। সমুদ্র কে এক ধমক দিলে সে চুপ অথচ সাথী,যুথি,,, ”

সাগরকে থামিয়ে দিয়ে তার মা বলল, ” সাথী,যুথি তোমার বোন ছোট থেকেই তোমার আদর আহ্লাদ পেয়েছে তাই ভয় পেলেও তেমন কাজে লাগে না কিন্তু মাহি তো আর তোমার সাথে অতো ফ্রী নয়”।

–” মাহি? মনজুর আঙ্কেল এর মেয়ে মাহিয়া?”

–“হ্যা”।
মায়ের মুখে ‘হ্যা’ শোনার পর সাগরের কিছুটা রাগ হলো। ওই ক্যাবলার মত লুচু মেয়েকে কি করে পড়াবে? কাল রাতেই তো দেখলো কেমন আজব ভাবে তার দিকে চেয়ে ছিলো। আরেহ এতটুকু বাচ্চা মেয়ে বুইড়া এক পোলার দিকে ওরকম করে তাকালে কতোটা নির্লজ্জ আর বেহায়া মনে হয় মেয়েটাকে! মায়ের সাথে তর্ক করার ইচ্ছে বিন্দু পরিমান নেই সাগরের। পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে সে বড্ড ভালোবাসে কিন্তু তাদের মধ্যে মা আর দাদুনী সবচেয়ে স্পেশাল। বলতে গেলে বাবার চেয়েও বেশি দাদুনী প্রিয় তবে বাবাকে সে আজও খুব ভয় পায়।

“মাহিপু আজ থেকে তুমি আর সমুদ্র ভাইয়া একসাথে পড়বে তাই টেবিলে জায়গা তোমাদের।” সাথী কথাটা বলেই নিজের ব্যাগটা নিয়ে বিছানায় বসলো।
মাহি বিকেলেই এসেছিলো কিন্তু গান আর শেখা হলো না। আর শিখবে ও না বলে ঠিক করেছে। গান শিখতে আসার পেছনে যে কারণ ছিলো তা এখন ম্যাথ পড়া দিয়েই হয়ে যাবে। মানে সাদা টি-শার্ট ভাইয়াকে দেখার কাজ। বরং আগে সুযোগের অপেক্ষা করতে হতো এখন আর তা হবে না। একদম কাছাকাছি, মুখোমুখি ইশ, কি লজ্জা মুখোমুখি ও থাকবে। ধ্যাৎ এখানে তো সমুদ্র ও থাকবে। মাহির আনন্দে ভাটা পড়লো সমুদ্র থাকবে মনে হতেই। বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো মাহি তখনই সমুদ্র ঢুকলো রুমে। মাথায় তার টুপি হয়তো নামাজ পড়েই সোজা পড়ার ঘরে এসেছে। এই বাড়িতে দু’টো স্পেশাল ঘর আছে যা মাহি এই এক সপ্তাহ আসা যাওয়া করে জেনে গেছে। একটা এই পড়ার রুম যেখানে বড় একটা টেবিল, মাঝারি সাইজের বেড আর বিশাল এক বুক শেলফ। এতে বইয়ের সংগ্রহ ও অনেক। আর একটা ঘর মিউজিক আর এক্সারসাইজ ইন্সট্রুমেন্ট এর। সৈকত আর সমুদ্রের মিউজিক ইন্সট্রুমেন্টস এর জোগাড় আর এক্সারসাইজ তো জনাব সাগর আহমেদ এর প্রয়োজনে৷ এমনিতেই পেটা শরীর উঁচু প্রশস্ত দেহ তার ওপর তার ফিটনেস কেয়ার এ বডি হয়েছে একদম পর্বতের মত।

–” সমুদ্র আর মাহিকে উপরে সাগরের ঘরে পড়াবে “। তাহমিনা এসে জানালো কথাটা।

–” মা আমি ভাইয়ার ঘরে পড়বো না। ওখানে গেলেই আমার মনোযোগ সব গিটারে চলে যাবে পড়া হবে না ” সমুদ্র বলল। মাহি তো চমকের ওপর চমক পাচ্ছে। নতুন টিচার সাগর তা শুনেই চারশো ভোল্টের ঝটকা খেয়েছিলো এখন আবার তার ঘরে পড়বে? আহ্ কেমন এক শিহরণ খেলে গেল মনের মধ্যে মাহির। সে তো চুপচাপ বইপত্র গুছিয়ে দাঁড়িয়ে গেল যাওয়ার জন্য এদিকে সমুদ্র মায়ের সাথে বাকবিতন্ডায় লেগে আছে। সে কিছুতেই যাবে না ওখানে পড়তে। এরই মধ্যে একজন মহিলা এসে ঢুকলো এ ঘরে৷ নতুন টিচার ইনি সমুদ্র ছাড়া বাড়ির বাকি চার বাচ্চাকে পড়াবেন আজ থেকে৷ এবার সমুদ্র বুঝলো কিছুতেই এখনে আর পড়া হবে না। সাগর খুবই বিরক্ত হয় পিচ্চুগুলাকে পড়িয়ে তাই মহিলা শিক্ষক জোগাড় করেছে সাথীর মা। এ পৃথিবীতে একমাত্র মহিলাদেরই ধৈর্য্য শক্তি সীমাহীন যা সাগরের কোন কালেও তেমন নেই। বাধ্য হয়েই সে এতদিন বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছে। কিন্তু এখনও মসিবত রয়ে গেছে মাথায় সমুদ্র সাথে নতুন জুটেছে মাহি।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে সাগর৷ দোলা ফোন করেছে কথা বলছে৷ সাগরের মন নেই সেই কথায় অনেকটা ভাবলেশহীন ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে সে চায়ের কাপ নিয়ে। আজকের রাতটা একটু বেশিই অন্ধকার মনে হচ্ছে বোধ হয়! আকাশটা কি মেঘলা? সাগর নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো। ওপাশ থেকে একা একাই কথা বলে চলছে কিন্তু তার কথার কোন জবাবই সাগর দিচ্ছে না। উদাসী সন্ধ্যা তার মনের আঙিনায় হুট করেই নিয়ে এলো সেই ডায়েরির স্বপ্নকুমারীর মুখখানা। চোখের পলক ফেলতেই মনের চোখে ভেসে উঠলো সেই আধখানা মুখছবি। আধো ঠোঁট, একখানা চোখ আর গালের এক পাশ। কোথায় গেলে খুঁজে পাবে সে ওই মুখের মানবীকে?

–” ভাইয়া আসবো?” সমুদ্রের ডাকে ঘোর ভাঙে সাগরের । কানের কাছ থেকে ফোন নামিয়ে ঝটপট কলটাই কেটে পেছন ফিরে।

–” আয়। ” বলেই বারান্দা ছেড়ে ঘরে প্রবেশ করে সাগর। দেখতে পায় সমুদ্রের পাশে দাঁড়ানো মাহিকে। মাহি ও সাগরকে একবার দেখে নেয়, “আজও এলোমেলো চুল”। মাহির একবার ইচ্ছে হয় বলতে, ” আপনাদের বাড়িতে কি কোন চিরুনি নেই? আবার মনে হয় না এই চুল গুলো এমন আলুথালু অবস্থায়ই বেশ লাগে”।

মাহির আজও এমন অপলকভাবে তাকানো দেখে সাগর গলা খাঁকড়ি দিয়ে উঠে, ” চেয়ারে গিয়ে বসো “৷ সমুদ্র টেবিলের দিকে দৃষ্টি দিয়ে ভাবে এখানে চেয়ার দু’টো আছে আরেকজন কোথায় বসবে!

–” আরেকটা চেয়ার বাইরে থেকে নিয়ে আসবি। গাধা কোথাকার।” সাগর হয়তো সমুদ্রের মনের কথা বুঝেছিলো তার চোখ দেখেই তাই ধমকে উঠেছে। এতে বেচারা বেশ লজ্জা পেয়েছে। তারই সহপাঠীর সামনে ভাইয়া এমনটা না করলে ও পারতো তারওপর সহপাঠী যদি হয় মেয়ে তাহলে তো কথাই নেই।মুখটা পেচার মত করে সমুদ্র বেরিয়ে গেল আরেকটা চেয়ার আনতে৷ মাহি বসলো একটা চেয়ার টেনে। কি লাভ হলো এখানে পড়তে এসে? নিচে সমুদ্র বলছিলো তার নাকি এ ঘরে গিটার দেখে পড়ায় মন বসবে না আর আমার! এই ঘরের মানুষটাকে দেখে তো আর কিছুই চোখে পড়বে না আমার। মন তো আরো আগেই চলে গেছে পড়াশোনা থেকে।

হাওয়া বেগম খুব চেঁচামেচি করছেন বউদের সাথে৷ তার বউমারা ও একটু চুপসে গেছে শ্বাশুড়ির চিল্লানো যুক্তিযুক্ত। এক ষোড়শী কন্যাকে পাঠিয়ে দিয়েছে বাড়ির দুই ছেলের সাথে। হোক না ছেলেরা অতি ভদ্র,সভ্য কিন্তু ছেলে তো। পরের বাড়ির মেয়ে বিশ্বাস করেই আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। পড়ার ঘরে নতুন মেডাম আছে তো কি হয়েছে এত বড় সোফারঘর আছে সেখানেই পড়তে পারতো। শিলা এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে অনেকদিন। বাড়ির সবাইকে পছন্দ করলেও মনে মনে দাদুনীকে খুব অপছন্দ তার। প্রথম প্রথম সৈকতকে নিয়ে ঘনঘন ঘুরতে যেত এ নিয়ে দাদুনী বলেছিলো, ” এত্তোই যদি ঘুরাঘুরির শখ তয় বিয়া না করলেই পারতি। সংসারে তো তর মন লাগে না “। সেদিন নতুন বউ হওয়ায় মুখ খোলেনি শিলা। এরপর কথা উঠলো তার জিন্স আর কুর্তি পড়া নিয়ে। শিলা শুধু উসকেছিলো সৈকত কে যেন প্রতিবাদ করে। কিন্তু সেদিনও হতাশ হলো শিলা। সৈকতের কাছে তার দাদুনী জান প্রাণ তাই দাদুনীর সাথে তাল মিলিয়ে বলেছিলো, ” শিলা তোমাকে শাড়িতে একদম পরীর মত লাগে আর সেলোয়ার-কামিজ এ তো মায়াবী লাগে। ” সবটাই মন ভোলানোর ফন্দি সৈকতের। এরপর ও বহুবার বহু জিনিসে দাদী নামক মহিলাটি অনেক রেস্ট্রিকশন জারি করেছিলো। শিলা অনেকবার সৈকতের সাথে তর্কে জড়িয়েছিলো তাতে বিশেষ লাভ কিছুই হয়নি। মনে মনে ক্ষোভ পুষে গেছে শুধু । আজও দাদুনীর এত চিল্লাচিল্লিতে ত্যক্ত শিলা বলেই ফেলল, ” দাদুনী এতোই যদি আপনি মাহি কে নিয়ে চিন্তিত হন তবে ও ঘরে গিয়ে বসলেই তাদের সামনে বসে থাকলেই তো পারেন “।

প্রথমদিনই মাহি গণিতে খুব বাজে অবস্থায় পড়লো সাগরের কাছে৷ পুরনো অংক গুলোই করতে দিয়ে একটাও আদায় করতে পারেনি৷ সমুদ্র সব গুলোই পেরেছে অথচ মাহি কিছুই পারেনি৷ সাগর খাতার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলেছে। যার ফলে কপালের ঠিক মাঝখানে দু’টো লম্বা রেখার উদয় হয়েছে। মাহি এক দৃষ্টিতে সেই রেখা দু’টোকে দেখছে। এরই মাঝে সাগর কিছু বলেছে বোধ হয় তাকে যা সে শুনতেই পায় নি। মাহির দিক থেকে কোন প্রকার রেসপন্স না পেয়ে আবার বলল, ” তুমি কি এ বছরে কোন অংকই করো নি “? সমুদ্র খেয়াল করেছে মাহির ড্যাবড্যাবানো দৃষ্টি আর সে এ ও জানে ভাইয়া এখন নিশ্চিত মাহির কান ছিঁড়ে ফেলবে।মায়া হলো খুব মেয়েটা মার খাবে? শত হলেও মাহি তার দু’একদিনের ক্রাশ। বুদ্ধি করে একটা বই নিয়ে আস্তে করে টেবিলের নিচ দিয়ে মাহির কনুইতে মারলো৷

–” আউ, মারলে কেন? ” মাহি প্রশ্ন করলো সমুদ্র কে। সাগর ও তাকালো কি হলো দেখার জন্য ।

–” পড়ে যাচ্ছিলো বইটা। ভাইয়া তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছে জবাব দাও।”

–” কি?” অবাক হলো মাহি ভীষন কারণ সে নিজ ধ্যানে এতোই মগ্ন ছিলো যে সাগরের কথা শুনতেই পায়নি।

–” গণিত কি কিছুই পারো না তুমি?”সাগর আবার বলল।

–” পারি তো।”

সাগর আবার কয়েকটা অংক দিলো করতে। এরপর সমুদ্রের খাতা দেখতে লাগলো। মাহি এবার ও অংক কিছু ঠিকঠাক করতে পারছে না। সত্যি বলতে তার মন এখন অংকে নয় সাগরের মুখের দিকেই আটকে আছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা মশা ভনভন আওয়াজ করতে করতে সাগরের গালের সামনে ঘুরতে লাগলো৷ সাগর টের পাচ্ছে কিন্তু সে অংক দেখায় ব্যস্ত। মাহি কয়েক সেকেন্ড মশাটাকে খেয়াল করে বিড়বিড় করে উঠলো, ” এই খোঁচা দাঁড়ি ভরা জঙ্গলে ঢুকলে ও রক্ত খুঁজে পাবি বলে মনে হয় না যেই শক্ত চোয়াল ওনার”। মাহির বিড়বিড় করার মাঝেই সাগর আর সমুদ্র দু’জনেই একসাথে বলল, ” কিহ?” মাহি থতমত খেয়ে গেল।

চলবে
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here