শব্দহীন_বৃষ্টি (১৫)(১৬)

0
939

শব্দহীন_বৃষ্টি
(১৫)(১৬)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
___________________________
ড্রয়িংরুমে বসে চায়ের কাপে অবিরত গটগট চামচ নাড়ছে শিমুল মামা। ঘুম থেকে উঠেই নাকি রওনা হয়েছে মাহিয়াদের বাড়ি। তার কারণ ওনার পাশে বসা দেহাতি চশমাওয়ালা ডক্টর আয়ান রশীদ। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বারবার তাকাচ্ছে মাহি ওই ভদ্রলোকের দিকে৷ নির্লজ্জ মার্কা হাসিতে ডক্টর সাহেব এদিকেই তাকিয়ে আছে। মাহি ডাইনিং এ আছে হাতের পরোটা মুখে পুরছে। মাহি যখন ঘুম থেকে উঠে মায়ের ঘরে গিয়েছিলো তখন ভদ্রলোকটি তার পরিষ্কার হাতে মাহির মা-বাবার ঘরের পুরনো পাখাটি ঠিক করছিলো। আর তাতেই মাহি চমকে গিয়ে চিৎকার করেছে৷ অথচ ডক্টর সাহেব একটু এগিয়ে এসে আস্তে করে বলল, ” এভাবে চিৎকার না করলে ও পারতে। আমি মানুষ ভূত নই”। সেই থেকেই মাহি বিরক্ত। কেমন অভদ্র লোক কারো বেড রুমে চলে গেছে। হোক তাদের ফ্যান নষ্ট দুনিয়ায় কি মিস্ত্রির অভাব? ডাক্তার কেন যাবে পাখা ঠিক করতে!

শিমুল মামা বিয়ের প্রস্তাব রিফিউজ করে দিয়েছিলো সেদিন রাতেই যেদিন মাহির মা ছেলে দেখে এসেছে। মাহি রাজী নয় তাই এ বিয়ের কথা আগানো সম্ভব নয়৷ কিন্তু এই চা চোখা ডাক্তার মাহিকে খুব পছন্দ করেছে । তার নাকি মাহিকেই চাই আর বিয়ে তো সে এখন করবে না। মাত্র তো এম বি বি এস শেষ হলো আরো কত কিছু করা বাকি৷ বিদেশে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই তাই এনগেজমেন্ট করতে চেয়েছে৷ আজ জোর করেই এসেছে ছেলেটা শিমুল মামাকে নিয়ে সরাসরি মাহির সাথে কথা বলতে।

–” দেখো বাবা আমাদের তোমাকে অপছন্দ হয়নি। উল্টো তুমি আর তোমাদের অবস্থা সবটাই আমাদের চেয়ে অনেক উপরে”।

–” তবে কেন রাজী হচ্ছেন না আন্টি? ”

–” আমার মেয়েকে তুমি দেখলেই ওর এখনও বিয়ের বয়স হয়নি। মাত্র তো ষোলো তে পা দিয়েছে।আর সে এখন কোনমতেই বিয়েতে রাজী নয় ”

–” আমি জানি আন্টি মাহির বয়স কেমন হবে আমি তো এখন বিয়ে করবো না। শুধু একটা অফিসিয়াল ব্যবস্থা করা আংটি পরিয়ে৷ আমি তো পড়ালেখার জন্য বিদেশে চলে যাবো আর মাহিও ডাক্তারি পড়বে শুনলাম। সেক্ষেত্রে ঠিকঠাক সময় ও পাবে পড়াশোনা করার বিয়ে তারপর। মাহি টেবিলে রাখা তার নাস্তাটুকু খেয়ে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে গেল। ব্যাগ নিয়ে আবার বের হয়ে সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। মাহি যে বেশ রেগে আছে তার মা বুঝে গেছেন। ডক্টর আয়ান রশীদ আরো কিছুক্ষণ কথা বলে হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন৷ আর যাওয়ার সময় মনে মনে ঠিক করলেন সঠিক সময়ে আবার আসবেন।

সাগরের আজ একটা ক্লাস আছে। মাস্টার্স এর ক্লাস আজই প্রথম করবে সে৷ বন্ধুদের মধ্যে শুধু জুয়েলই ভর্তি হয়েছে। বাকিরা চাকরি,ব্যবসা কিছু না কিছুতে ঢুকে গেছে । দোলা ঢাকায় এসেছে আজই আগামী সপ্তাহে সে চলে যাচ্ছে বিদেশে। স্কলারশিপ কনফার্ম হয়ে গেছে। সাগরকে কল দিয়েই বলেছে এখানে এসেছে। কিন্তু সেই এখানেটা যে শুধু সাগরের কাছে তা জানতো না।

–” ফ্লাইট কবে?”

–” বুধবার। ”

–” আরো নয় দিন বাকি। ”

–” হুম।” বলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে দোলা আবার বলল, ” মিস করবে আমায়?”

–‘ কন্টাক্ট করো ওখানে পৌঁছে ।”

–” আমি জিজ্ঞেস করেছি মিস করবে আমায়?” দোলার এ প্রশ্নে সাগর অপ্রস্তুত হলো। সে নিজেও জানে না দোলাকে মিস করবে কিনা। এই যে সারাদিন দোলার সাথে তার কথা হয় না এ নিয়ে বিশেষ কোন খেয়াল আসে না তার। কিন্তু মেয়েটা অপেক্ষা করছে তার জবাবের। ক্যাম্পাসের পাশেই এক লেকের পাড়ে ঘাসের উপর বসে ছিলো তারা। দুজনের মাঝে কিছুটা দুরত্ব ছিলো এতক্ষণ সেই দুরত্ব হুট করেই ঘুচিয়ে দিলো দোলা৷ সাগর অপ্রতিভ গলায় বলল, ” আমাদের উঠা দরকার অনেকক্ষণ হলো “। আহত দৃষ্টিতে তাকালো দোলা যার অর্থ সাগর জানে। কিন্তু সে তো দোলাকে কখনও এতোটা ও ঘনিষ্ঠ ভাবে পেতে চায় না। সত্যি বলতে ক্ষণিকের ভালোলাগার বেশি কিছুই ছিলো না তার প্রতি৷ মেয়েটা সেধেই তো বন্ধুত্ব চেয়েছিলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে সাগর অগ্যতা দোলা কে ও উঠতে হলো। দূর থেকে আসায় সাগর অনেকটা জোর করলো দোলাকে বাড়ি আসার জন্য দোলাও রাজী হয়েছে।

সারাদিনের ক্লাস করা,কোচিং করা সব মিলিয়ে মাহি আজকাল বেশ ক্লান্ত থাকে। তার উপর রাত জেগে পড়া শরীর একেবারে দূর্বল হয়ে পড়েছে৷ আজ বিকেলে বাড়ি ফিরেই শাওয়ার নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। মাগরিবের পর তার মা অনেকবার ডেকে উঠাতে না পেরে হাল ছাড়েন । আজ হয়তো পড়তে যাবে না মাহি৷ এশার আজানের পর মাহির ঘুম ভাঙতেই চারপাশে চোখ বুলায়। বোঝার চেষ্টা করে এখন সময় কত হয়েছে। হঠাৎ দেয়াল ঘড়িতে চোখ পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে।

–” মা! মা! ”

–” কি হলো চেঁচাচ্ছিস কেন?”

–” আমাকে ডাকোনি কেন? পড়তে যাওয়ার ছিলো তো আমার।

–” ডেকেছি বহু বার তুই উঠিস নি। ”

–” তাই বলে উঠাবে না! এমনিতে উঠিনি তো কি হয়েছে। আমার পড়া,,,,,” শেষের বাক্যটা এতোই লম্বা ছিলো যে চামেলি ভাবছেন মেয়ে কি পাগল হলো?

তড়িঘড়ি একটা খাতা আর গণিত বইটা নিয়ে ভালোমতো ওড়নাটা পেঁচিয়েই বের হলো মাহি। পেছন পেছন মা খুব ডাকলো তবুও থামলো না সে। তাড়াহুড়ো করে যেতে যেতে অনেকটা হোচট খেয়ে পড়লো মাহি সাগরদের হল রুমে। সোফায় বসা শিলা তখন কপাল কুঁচকে তাকালো।

–” মাহি তুমি?”

–” জ্বি ভাবি পড়তে এসেছি সাদা টি-শার্ট,,, থুক্কু স্যার নামে সাগর ভাইয়া কি বাড়িতে আছে?”

–” এখন! তুমি তো সন্ধ্যায় পড়ো তাই না? আজ এতো রাতে?” বলেই সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় শিলা।

–” আজ বিকেলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই আম্মু ডাকেনি। কিন্তু আমার তো জরুরি কয়েকটা অংক বোঝার ছিলো।”

–” সাগর বোধ হয় নামাজে গেছে কাল করো”। শিলা আর মাহির কথার মাঝেই দাদুনী এলো সেখানে। তিনি শুনেছেন শিলা আর মাহির কথা। কিন্তু সাগর তো বাড়িতেই আছে মসজিদে যায় নি আজ।

–” সৈকতের বউ তুই কি আন্ধা নি? সাগর বাড়িত আছে হের ঘরেই।” শিলা ভড়কে গেছে দাদুনী এভাবে বলায়। সে নিজেও জানে সাগর বাড়িতেই কিন্তু কেন যেন আজকাল মাহিকে তার সন্দেহ হয়। কিশোরী মেয়ে সীমাহীন আবেগে বশীভূত হয়ে আছে। সাগরের প্রতি তার দৃষ্টি একটু অন্যরকম ঠেকছে। এদিকে দোলা ও আকৃষ্ট এই ছেলেটার প্রতি তা সে আগে থেকেই জানে। হয়তো এজন্যই মাহিকে একটু দূর রাখার চেষ্টা করে আজকাল। কালকেও পড়ানোর সময় কোন এক কাজের কথা বলে বাইরে পাঠিয়েছিলো সে সাগরকে।

উদোম গায়ে এ্যাশ কালার ট্রাউজার পড়ে ঘরে পায়চারী করছে সাগর। সাথী আজ তার ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা চাবি পেয়েছে দেয়ালে থাকা তার ছবির পেছন থেকে। অনেক খুঁজেও যখন সে ওই চাবির তালা সন্ধান পেলো না তখন জিজ্ঞেস করেছে, ” ভাইয়া এটা কিসের চাবি?” তখনই মনে পড়েছে আবার সেই স্বপ্নকুমারীর কথা। কোথায় গেলে দেখা মিলবে সেই মেয়েটির৷ আজকাল কৌতুহল আগের থেকে অনেক বেশি বেড়ে গেছে তার এই মেয়েকে নিয়ে বাড়ির সামনে পেয়েছে সেই ডায়েরি। তবে কি মেয়েটা আশেপাশেই থাকে? আবার মনে হচ্ছে নাহ, দূরের কারো ও হতে পারে। হয়তো ভুল করেই ফেলে গেছে। সাগর যখন তার স্বপ্ন কুমারীর ভাবনায় বিভোর হয়ে চরকির মতো ঘরের চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে তখনই ঘরে প্রবেশ করে মাহি। বেখেয়ালেই সাগর ধাক্কা খায় মাহির সাথে। শক্ত প্রশস্ত বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে টালমাটাল অবস্থায় পড়ে। ভাগ্যিস দরকার কাছেই ছিলো পড়তে পড়তে বেঁচে যায়।কিন্তু এই বেঁচে যাওয়া ও দমবন্ধকর প্রমাণিত হয় মাহির জন্য । বুকের ভেতর আচমকা এক ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায় কয়েক সেকেন্ডে । ধুকপুক শব্দটা যেন বেড়ে যায় হৃৎপিণ্ডের। একটু কি চিনচিনে ব্যাথা ও হচ্ছে! মাহি বুঝে উঠতে পারলো না। তবে এই মুহুর্তে সাগর সামলে নিয়েছে নিজেকে। তার ও যে হৃৎপিণ্ডে কিছু একটা হয়েছে সেটা ঠিক টের পেয়েছে। কিন্তু পাত্তা দেওয়ার মত গাঢ় কোন অনুভূতিই হয় নি। দ্রুত সরে গিয়ে এদিক ওদিক কিছু খুঁজতে খুঁজতে প্রশ্ন করলো, ” তুমি এত রাতে এখানে কেন?”

–” আপনার সাথে থাকতে আসছি।” অস্পষ্ট ভাবে এ কথাটা বললে ও জোড়ে বলল, ” স্যরি স্যার আমি ঘুমিয়ে পড়ায় আসতে পারিনি “।

–” তো এখন আসতে কে বলেছে?”

–” ইয়ে মানে। ” মাহি আর কিছু বলার আগেই সাগর তাকে নিচে স্টাডি রুমে বসতে বলেছে। নিচে বসাক, উপরে বসাক কিছু যায় আসে না শুধু কথা হলো অংক কোনটা পারে না বলবে এখন?

–” ভাবী রাগ না করলে একটা কথা বলবো?” রাতের খাবার তৈরি করতে করতে খুব বিনীত স্বরে তাহমিনা বলল কথাটা সাগরের মায়ের উদ্দেশ্যে। তখন রান্না ঘরে কেবল তারা দু’জনই উপস্থিত ছিলো৷

–” কি বলবি বল না অনুমতি নেওয়ার কি আছে আর রাগই করবো কেন তোর সাথে?” শামসুন্নাহার সরল মনেই বললেন।

–“আমার মনে হয় শিলা এখানে থাকতে চাচ্ছে না।” কেমন একটু চাপা স্বরে বলল তাহমিনা।

–” এখানে না থাকলে কোথায় থাকবে?” একটু স্তম্ভিত হলো যেন শামসুন্নাহার।

–” আমি কয়েকদিন আগে শিলার ফোনে কথা বলা শুনেছি। আমার মনে হলো সে কাউকে বলছিলো ফ্ল্যাটে যাওয়ার একটা রাস্তা বের করতে হবে। সেদিন কথাগুলো পুরোপুরি পরিষ্কার বুঝিনি তাই কিছু বলিনি তোমায় কিন্তু,,, ”

–” কিন্তু কি তাহমিনা?”

–” আজ আমি স্পষ্ট শুনেছি শিলা কাউকে বলছে, ” বুড়িটাকে একদম সহ্য হয় না। সুযোগ পেলেই সৈকতের সাথে চিপকে থাকে। আমাদের হাজবেন্ড ওয়াইফ এর প্রাইভেসিতেও ঢুকে পড়ে। আর পরিবারের সবাই তো যৌথ ভাবে থাকার নামে আমাদের সব টাকাই খরচ করে ফেলে৷ আমি কিছু বলতে ও পারি না সৈকতকে “। সংক্ষেপে তাহমিনা সবটা বলার পর দরজায় তাকাতেই চমকে উঠলো। জয়নব( সাথীর মা)দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। সবটাই শুনেছে সে আর মনে মনে কষ্ট ও পেয়েছে৷ এই পরিবারে একমাত্র ইনকামে কমতি সাথীর বাবা রিয়াদুল ইসলাম এর৷ খরচ বেশি ইনকাম কম তাই মাস শেষে তার পক্ষ থেকে খরচের টাকাটা দেয় ও কম। এ নিয়ে অবশ্য সাগর বা সমুদ্র কারো বাবারই কোন অভিযোগ নেই। উল্টো তারা দু’জন মিলে ছোট ভাইটাকে সাহায্য করতো৷ কিন্তু আজ জয়নব কষ্ট পেল নিজেদের অভাবটার জন্য । ভাই বা ভাবীরা কেউ কিছু বললেও কষ্ট লাগতো না কিন্তু ছেলের বউরা কিছু বললে ব্যাপারটা গায়ে লাগারই মত৷

–” দশ মিনিট সময় দেবো এর বেশি এক সেকেন্ড ও নয় “। সাগর বলতেই মাহি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল বই খাতা খুলতেই তো চলে যাবে দশ মিনিট।

–” ভাইয়া আজকে না জ্যামিতি করবো। ”

–” সপ্তাহের মাঝে কখনো জ্যামিতি করাবো না বলে রাখছিলাম।”

–” তবে! ”

–” তবে কি?”

–” আপনাকে দেখে চলে যাবো দশ মিনিট একটু চুপচাপ বসেন তো!” মৃদুস্বরে বলল মাহি কিন্তু সেই মৃদু আওয়াজে সাগর কিছু একটা টের পেয়েছে৷ কিন্তু কি তা বুঝতে পারলো না। একের পর এক অংক খুঁজেই চলছে অথচ কোন সমস্যাই পেল না। সাগর অপ্রসন্ন হয়ে বলল, ” তুমি কি সত্যিই অংক না পেরে এসেছো?”

–” সাহর করে একদম সত্যি বলবো স্যার?

–” হুম, সত্যিটাই শুনতে চাচ্ছি।”

–” শুধু মাত্র আপনাকে কাছ থেকে দেখার জন্য এখানে আসি। পড়তে আসা তো বাহানা মাত্র।” অকপট স্বীকারোক্তি মাহির। সাগর বুঝে পায় না এমন একটা কথা শোনার পর কি জবাব দেওয়া উচিত। শুধু মনে হলো সে ঘামছে দরদর করে।

–” বইখাতা উঠাও আর এই মুহুর্তে বাড়ি ফিরে যাও মাহিয়া”।

–” কেন স্যার?”

–” কারণ আমি চাচ্ছি”।

–” আপনি এই চাওয়াটা বাদ দিয়ে অন্য একটা চাওয়া রাখলেই পারেন। ”

–” এ্যাই মেয়ে কি বলছো এসব?”

–” কিছু না ”

–” গুড, যাও এবার।”

–” যদি না যাই?” চিবুক উঁচু করে সাগরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল মাহি৷

–” থাপ্পড় চেনো?”

–” না চিনলে ও আপনার কাছ থেকে চিনতে চাই না” বলেই মুচকি হাঁসে সে।

–” তোমার মত ইঁচড়েপাকা মেয়ে আমি আর দু’টো দেখি নি। ” রেগে যায় সাগর৷

–” দেখার কথাও না মাহিয়া অনলি ওয়ান পিস স্যার এই দুনিয়ায়।”

–” তুমি কি যাবে? ” প্রচন্ড রেগে বলে সাগর। এবার বোধ হয় কপালে শনি রবি সব লেগে যাবে৷ সাদা টি-শার্ট ভাইয়ার মুখের রং পরিবর্তন হয়ে গেছে। চোয়াল জোড়া ও তার রুপ বদলে নিয়েছে সত্যি বলতে এমন লুকই মাহির চোখে অসাধারণ লাগছে৷ আফসোস এই লুকটাতে বেশিক্ষণ দৃষ্টি দিতে পারলো না মাহি। ভয়ে বই খাতা উঠিয়ে রুম ত্যাগ করলো। যাওয়ার সময় আবার ফিরে এসে উঁকি মেরে বলে গেল, ” ট্রাস্ট মি, অনুভূতিটা আমার খুব গাঢ় আপনার প্রতি”.

চলবে

#শব্দহীন_বৃষ্টি
(১৬)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
___________________________
শীতের শেষে এক পশলা বৃষ্টির পরে দেখেছিলো সাগর এক পাশের বাড়ির ছাঁদে এক কিশোরী কন্যা। শাড়ির আঁচল তার কাঁধ গড়িয়ে পড়েছিলো নিচে।গল্পের শুরুটা তাদের এমনই ছিলো। শীতের শেষের এক রাত্তিরে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছাঁদে অস্পষ্ট দেখায় শুরু হয়েছিলো মাহিয়ার ভালোলাগার গল্প। ফাঁকফোকর তৈরি হওয়ার আগেই সেই ভালোলাগার গল্প গড়িয়ে ভালোবাসার বুনন হলো। একপাক্ষিক সে গল্প অবাধ্য কিশোরী মেয়েটিকে খুব সহজেই উন্মাদ করে দিলো। সাগর মজে গেছে তার কুড়িয়ে পাওয়া ডায়েরির স্বপ্নকুমারীর প্রেমে। আধোমুখের প্রতিকৃতি অবলীলায় দাগ টেনে গেছে তার মনে৷ দু’জন মানুষ এর মনে দু’টি আদল রাজত্ব গড়ে তুলেছে তাদেরই অজান্তে৷ শীত গিয়ে গ্রীষ্ম এসে গেছে। মাহির সেই রাতের ভালোলাগার স্বীকারোক্তি কেড়ে নিয়েছিলো তার সকল সুযোগ সাগরকে কাছ থেকে দেখার। পরদিনই জানিয়ে দিয়েছিলো সে পড়াতে পারবে না মাহি কে লুকিয়ে গিয়েছিলো কারণটা। সেদিনের পর মাহিও আর আসেনি এ বাড়ি। সাথী,যুথি বহুবার ডাকা সত্বেও এড়িয়ে গেছে বাহানা করে। আজ দেড় মাস পর আবার ও পা রাখছে সে সাগরদের বাড়ি। সামনের মাসেই টেস্ট পরীক্ষা। মাহির স্কুলে টিচার ব্যবস্থা হলেও সেখানে আর পড়া হয়ে উঠেনি। সমুদ্রের মুখে শুনেছে সাগর মেয়েটা নাকি কারো কাছেই ম্যাথ পড়ে না। সামনে পরীক্ষা কি করে হবে ভাবতেই সমুদ্র যেচে কথা বলেছে এ বিষয়ে সাগরের সাথে। আর তাই সাগর খবর পাঠিয়েছে মাহিকে আসার জন্য । জেদ আঁকড়ে বসে থাকা মেয়েটা হুট করেই জেদ ভুলে ঝটপট তৈরি হয়ে চলে এলো সাগরদের বাড়ি। কে বলবে গত দেড় মাস এই মেয়েটাই এ বাড়ির গেইটের ভেতর পা ফেলেনি। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া আসার সময় পর্যন্ত ঘাড় বাঁকিয়ে এদিকটায় তাকায়নি৷কিন্তু আজ পা বাড়িয়েছে সমুদ্র বলেছে সাগর তাকে ডেকেছে। এক মুহুর্ত দেরি না করে ম্যাথ করার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। সমুদ্র একবার ও বলেনি সাগর তাকে কেন ডেকেছে তবুও সে তার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। মন বলছিলো আজ কিছু হবে, কিছু তো হবে।

–” ভেতরে আসবো?”

–” ওহ তুমি, এসো।”

–” অন্যকারো অপেক্ষা ছিলো বুঝি?” বলতে বলতেই মাহি ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো ঠিক সাগরের মুখোমুখি৷ হঠাৎ যেন ঘরময় এক সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে৷ মাতাল করা এক মনোমুগ্ধকর ঘ্রাণ৷ মাহির কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে সেই ঘ্রাণে। কোন পারফিউম লাগায় সাগর! খুব জানতে ইচ্ছে করলো তার কিন্তু এই মুহুর্তে ইচ্ছেটাকে দমন করে ভালো করে দেখতে লাগলো সাগরকে। গত দেড় মাসে একদিন ও বাদ যায়নি মাহির তাকে দেখা তবুও আজ মনে হচ্ছে বহুদিন বাদে দেখলো। হ্যা বহুদিন পরই দেখছে কাছ থেকে ঠিক এক হাতের দুরত্ব দু’জনের মাঝে।

–” বই, খাতা,নোটস সব নিয়েই এসেছো? ”

–” হ্যা, আমি জানি আপনি আমায় পড়তে ডেকেছেন। ”

–” এতোটা কনফিডেন্স আসলো কি করে? ”

–” জানি না”।

–“নিচে স্টাডি রুমে গিয়ে বসো ওখানেই পড়াবো” বলে সাগর ঘুরে দাঁড়ালো। টেবিলে রাখা মোবাইলটা হাতে নিতে হাত বাড়াতেই মাহি দপ করে বসে পড়লো চেয়ার টেনে।

–” এখানে বসছো যে?”

–” এখানেই পড়বো।” মাহির এ কথার পর সাগরের কি হলো কে জানে সে আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ ম্যাথ বইটা টেনে পরিসংখ্যান এর সূত্র গুলো জিজ্ঞেস করলো । হাতে বই আর দৃষ্টি ছিলো মাহির মুখের উপর। মাহি চোখ বন্ধ রেখে গটগট করে সূত্র গুলো বলছে। কিন্তু তাতে কি? সাগরের খেয়াল তো সূত্রের মধ্যে নয় সে তো মাহির চোখ,ঠোঁট আর গালে কিছু খুঁজে চলছে।সাগরের দৃষ্টি শব্দহীন শীতল স্তব্ধ বৃষ্টির মত গড়িয়ে পড়ছে মাহির চোখ মুখে৷ কোথা ও কি মিল আছে এই মেয়েটির সাথে তার স্বপ্ন কুমারীর?

–“এবার কি করবো?”

–” এক পাশ ঢেকে ফেল।” সম্মোহিতের মত তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে কথাটা বলে ফেলল সাগর। হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করে বসলো মাহি।

–” কি ঢাকবো?” মাহির প্রশ্নে যেন হুঁশ এলো তার। এ কি বললাম আমি!

–“তুমি গ্রুপ সাবজেক্ট এর জন্য কি টিউশন নাও?”

–” বললেন না তো কি ঢাকবো?”

–” আমার প্রশ্নের জবাব দাও। ”

–” হ্যা, পড়ি।”

–” কার কাছে পড়ো জানতে চাইবো না। শুধু জানতে চাই সেই টিচারই তো ম্যাথ করাতে পারে তবুও এখানে আসার জন্য বাহানা করেছিলে কেন?”

–” এখানে পড়তে আসার ব্যাপারটা আমার অজান্তে ঠিক হয়েছে৷ আপনি বিশ্বাস করুন আর নাই বা করুন এটাই সত্যি “।

–” বলতে চাচ্ছো আমার কাছে টিউশন নেওয়ার কথাটা তুমি বলোনি?”

–” বলতে চাচ্ছি না এটাই সত্যি। টিউশন আমি না আমার মা ঠিক করেছিলো৷ সম্ভবত আমার স্যার আর পড়াবে না এ কথাটা মা আপনার মা কিংবা স সমুদ্রের মায়ের সামনে বলেছিলো৷ ”

–” আর তাতেই তুমি রাজী হয়ে গেলে?”

–” এমন করে বলছেন যেন আমি আপনাকে বিয়ে করার প্রস্তাবে রাজী হয়েছি।” বেশ কড়া গলায়ই বলল মাহি। একটু কি বেশিই বলে ফেলছে! সাগর কিছুটা অপ্রস্তুত হলো নিজের বোকামিতে৷

–” এতোটা ত্যাড়ামি না করে সোজা উত্তর দিলেই তো পারো।”

–” আপনি কি জানেন আমি আপনাকে একদম অন্যরকম জানতাম৷ ঠিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ যার গম্ভীরতায় একটা ম্যানলি ভাব রয়েছে৷ যার কন্ঠস্বরে একধরনেড ঝংকার তৈরি হয়। যা মনের ভেতর এক উত্তাল ঢেউয়ের সৃষ্টি করে। সত্যিকারের সাগর মনে হত আপনাকে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল৷ আপনি একদম অন্য আর দশজন ছেলের মতোই ছ্যাচড়া স্বভাবের। যেই দেখলেন একটা মেয়ে আপনাকে ভালোবাসে অমনি ভাব নিচ্ছেন। আসছি আমি ভালো থাকবেন আর শুনুন প্রতিদিন সকালে অত সেজেগুজে স্কুলে যাওয়ার ঢং টা ও আর করবেন না নইলে আমি সাইনবোর্ড বেঁধে দেব স্কুলের সামনে উইদ ইউর বিগ সাইজ ফটো৷ “সাগর আহমেদ এর দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালে তাকে শূলে চড়ানো হবে “। তুফানের বেগে চলে গেল মাহি কথা গুলো বলেই৷ সাগর স্তব্ধ এসব কি হলো? মাহি তাকে কি একটু ধমকি দিয়ে গেল! নাকি ছ্যাচড়া উপাধি দিলো? হঠাৎ মনে হলো মেয়েটা আসলে বেয়াদব। শুধু বেয়াদব নয় চরম বেয়াদব।

দেড় মাস পরের সাক্ষাৎটাতে ও মাহির রেকর্ড খারাপ রইলো সাগরের কাছে। কে জানতো এই খারাপ রেকর্ডই একদিন সাগরের চোখে তাক লাগিয়ে পাওয়া না পাওয়ার আকুল আবেদন হয়ে দাঁড়াবে। সময়টা ঠিক এক বছর পরের৷ মাহি কলেজে পড়ছে৷ সমুদ্র ও পড়ছে তবে সে এখন রাজশাহী তে। হোস্টেলে শিফট হয়েছে৷ সাগরদের বাড়ির সুখ শান্তি গুলোও ছিন্নভিন্ন অনেকটা। শিলা আর সৈকত মাস ছয় হলো আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে। সুখের দেয়ালে চির ধরানোর কাজটা করেছেই শিলা আর তার পরিবার। একক পরিবারে বড় হওয়া শিলার মন বিতৃষ্ণায় ভরে গিয়েছিলো হরদম কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে থাকতে। নিজের প্রশান্তি খুঁজতে গিয়ে পরিবার থেকে আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। সৈকত প্রথম প্রথম রাজী না হলেও পরে মা বাবার কথা রাখতে গিয়ে শিলার ইচ্ছে পুরন করে। বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্যই যেন ভেঙে পড়েছে সৈকত দূরে থাকায়। তবু মুখ ফুটে কেউ কথা তোলেনি৷ সাগর একটা জব করছে স্যালারি নেহায়েত কম নয়। শিলা আলাদা হওয়ার পরই যেন হঠাৎ সাথীর মায়ের মাথায় বুদ্ধি এলো৷ আসলে বুদ্ধি না কুবুদ্ধি বোঝা যায় না। ইনিয়েবিনিয়ে সাথীর মা ও আলাদা থাকার কথা তোলে। হাওয়া বেগম ভেঙে পড়েন বাড়ির অবস্থা দেখে। হুট করেই যেন বৃদ্ধা শক্তিহীন হয়ে গেলেন৷ সৈকতের জন্মের পর সৈকতকে ছাড়া থাকার কথা তিনি কখনও ভাবতে পারতেন না। অথচ এখন কতদিন হয়ে গেল বাড়ির বড় নাতিটাকে চোখের দেখা দেখতে পান না। সৈকত ও দিন দিন কেমন গুমোট হয়ে পড়েছে। নিঃসঙ্গ যাযাবর লাগে তার নিজেকে। দিনভর অফিস আর রাতে ফিরে বন্দী ফ্ল্যাটে সময় কাটে খুব বাজেরকম৷ থেকে থেকে শুধু মনে পড়ে বাড়ির সবার সাথে কাটানো সময়। মাঝরাতের আড্ডা,দাদুনীর আদুরে ডাক, মায়ের শাষন, চাচীদের স্নেহ বাবা আর চাচাদের উপদেশ আর ভাইবোনদের আবদার। সব মিলিয়ে ক্লান্ত দেহের শক্তি হিসেবে আপন মানুষদের সঙ্গের খুব অভাব তার। শিলা প্রায়ই মা,বোনদের সাথে এখানে সেখানে যায়। বাড়ি ফিরে রাতেও সৈকত একা পড়ে থাকে৷ চাইলেই বাড়িতে যাওয়া যেতে পারে কিন্তু এতে নিশ্চয়ই শিলা তার পরিবারের চোখে খারাপ হবে।

সমুদ্র আর মাহির মধ্যে বন্ধুত্ব অনেক ভালো আর কাছের৷ সমুদ্রের করা সন্দেহই সত্যি তা সে জানতে পেরেছে। মাহি তার ভাইকে ভালোবাসে কিন্তু ভাইয়া! ভাইয়া কাকে ভালোবাসে জানে না সে৷ তবে মন থেকে চায় ভাইয়ার জীবনে মাহি থাক। মেয়েটা ভাইকে ভালোবাসে খুব। নিশ্চয়ই সে তার ভাইকে খুব সুখে রাখবে । শিলা ভাবীর মত কষ্ট দিবে না পরিবারকে আলাদা করে দিবে না। কিন্তু ভাইয়ার মনে কি তা কি করে জানা যায়? সমুদ্রের মনে মাহির প্রতি আকৃষ্টতা অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো৷ মাহির পরে আরো কত মেয়ের প্রতি সেই মোহ জাগ্রত হয়েছিলো। ভাগ্য ভালো সমুদ্র নিজেকে সামলে রেখেছে৷ বলতে গেলে সাগরের ভয়ে বাধ্য হয়ে নিজেকে সামলেছিলো।

এস এস সি পরীক্ষার কিছুদিন আগে কোন এক কারণে মাহি গিয়েছিলো সাগরদের বাড়ি। সাথী, যুথির ঘরে বসে খোশগল্পে মেতে ছিলো তিনজন৷ আর তখনই সাগরের প্রবেশ সেই ঘরের দরজায়। মাহি তখন দু’হাত উঠিয়ে নিজের এলোচুল হাত খোঁপা করার চেষ্টায় লাগলো। সাগর যেখানে দাঁড়িয়েছিলো সেখান থেকে মাহির শুধু অর্ধেক মুখটাই চোখে পড়লো। সাথেসাথেই যেন বুকটা ধক করে উঠলো। এক পাশের গাল,চোখ ঠোঁট! সবটাই কি তার স্বপ্নকুমারীর মত?

চলবে
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here