শব্দহীন_বৃষ্টি (২১)

0
979

শব্দহীন_বৃষ্টি
(২১)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________

–” হা করো “।

–” কেন?”

–” দেখছো না হাতে মিষ্টি।”

–” তো কি হয়েছে? তুমি কি খাইয়ে দিবে নাকি!” চোখ বড় বড় করে বলল মাহি।

–“তাই তো করছিলাম। তোমার ইচ্ছে না হলে খাওয়াবো না। অবশ্য আমার ভাই থাকতে আমার হাতে খাওয়ার কথা ও না।” বেশ চিমটি কাটার মত বলল সমুদ্র । মাহি তো খালি গলায়ই বিষম খেলো এমন কথায়। হতবুদ্ধি হবার ব্যবস্থা মাহি’র। সমুদ্র এটা কেন বলল খুঁজে পায় না।

–” আরেহ আরেহ ভাবী সাহেবা কি হলো আপনার। ভাইয়া কে ডাকবো?” হো হো করে হাসছে সমুদ্র। বেশ লাগছে তার মাহিকে জ্বালাতে। লাগবে না’ই বা কেন হবু ভাবী বলে কথা। কাল রাতে যখন তিথি সবার সামনে ছাঁদে ভাবী ছিলো বলল তখন থেকেই হাওয়া বেগম সন্দেহ করছেন সাগরকে। যেহেতু ছাঁদের কথা উঠেছে তবে মেয়ে তিনি মাহিকেই ধরে নিয়েছেন। কারণ তাদের বিল্ডিং আর মাহিদের বিল্ডিং লাগোয়া। রেলিং দু’টো গা ঘেঁষা। গলির শেষ বিল্ডিং তাদের আর তাদের পরই মাহিদের এরপর অন্যদের বাড়ি। চোখের সামনে বড় বলতে এই একটাই মেয়ে আছে। আর তাই তো হাওয়া বেগম আজ সকালে সাগরের বিয়ের কথা তুলেছিলো৷ ইশারা ইঙ্গিতে সাগরের মা আর চাচীকে মাহির কথা বুঝিয়েছেন সমুদ্র তো দাদুনীকে হাড়ে হাড়ে চেনে। একবার যেহেতু বলেছে তবে জল শেষ অব্দি মাহিতেই আটকাবে।

মিষ্টিমুখ আর হলো না মাহির। সমুদ্রের ফাইজলামিতে সে বেশ লজ্জা পেয়েছে৷ সাগরকে ভালোবাসার কথা এতদিন শুধু নিপা জানতো। সাগর ও জানতো কিন্তু এখন সমুদ্র ও তা বুঝে গেছে ভাবতেই লজ্জা লাগছে তার।তবে মিষ্টিমুখ তো সে করবেই শুধু রাত হবার অপেক্ষা ।

–“পাগল হয়ে গেলি নাকি?” বেশ ঝাড়ি মেরেই বলল নিরব।

–” লাগবে না তোমার হেল্প আমি একাই যাবো।” মুখ ফুলালো মাহি।

–” কেন বুঝতে চাস না বলতো? আর তোর এত কি দরকার পড়লো ওদিকটায় যাওয়ার এমন সন্ধ্যে বেলা।”

–” গেলে যাবে না গেলে না বলো। এত প্রশ্ন করো কেন , হুহ।” মাহি কলই কেটে দিলো। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে মাহি নিরবকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে নিপার বাড়ি যাবে বলে। বেচারা বলেছে কাল নিয়ে যাবে আজ প্রচন্ড মাথাব্যাথা। কিন্তু মেয়েটা শুনছেই না। জেদ দেখাচ্ছে এক্ষুনি যাবে। গাড়ি আছে নিরবদের চাইলে গাড়ি পাঠাতে পারতো কিন্তু তাদের পুরনো ড্রাইভারটা নেই এখন আর। নতুন ড্রাইভার কে তেমন ভরসা করে ছাড়তে পারলো না আবার সন্ধ্যে করে নিরব যেতে ও চাইছে না। হয়তো কাল সকালেই নিয়ে যেত কিন্তু মাহির ধৈর্য্য কম সে মা’কে মিথ্যে বলে বেরিয়ে গেল। নিজেদের গলি ছেড়ে বাজারের মোড়ে আসতেই দেখা গেল সাগর দাঁড়িয়ে আছে । সম্পূর্ণ ফরমাল লুক একদম ক্লান্ত দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তার এত মনোমুগ্ধকর লুক এর মাঝে সবচেয়ে নজরকাড়া লাগছে তার এলোমেলো চুল গুলো।রিকশা থামিয়ে এখানেই নেমে গেল সে। পকেট থেকে ফোন বের করে সাগর কাউকে কল করতে নিচ্ছিলো।

–” রাস্তাঘাটে একটু কম সাজলে কি হয়? না’কি মেয়ে পটাতে এমন ভাব নিয়ে বের হোন”! একদম মুখোমুখি হয়ে মাহি জিজ্ঞেস করলো। আনএক্সপেক্ট কন্ঠস্বর শুনে ভালো করে তাকায় সাগর। কল কেটে ফোনটা আবার পকেটে ভরে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কি সাংঘাতিক মেয়ে ভর সন্ধ্যায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেমন শাষন করে কথা বলে।

–” ভ্রু দু’টো সোজা করুন। এভাবে তাকাবেন না আমার দিকে ভয় লাগে আমার।” মাহির এবারের কথায় সাগরের মনে হলো সে কোন কমেডি শো দেখছে আর মাহি সেই শো তে উপস্থাপক এর কাজ করছে।

–” আর ইউ কিডিং উইদ মি!” বিষ্ময়কর চাহনিতে তাকিয়ে বলল সাগর৷

–” এমনটাই মনে হলো?”

–” আমার কোন কিছুতে তোমার ভয় লাগে কথাটা খুবই হাস্যকর। ইচড়েপাকা, চরম বেয়াদব মেয়েটা নাকি আমায় তাকানোতে ভয় পায়। “তাচ্ছিল্যের স্বর সাগরের। “তা এ সময়ে এখানে একা কি করছো?” মাহি জবাব দিলো না উল্টো সামনের দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ” আসুন আমার সাথে আর হ্যা ঘাড় ত্যাড়ামি করার চিন্তা ভুল করে ও করবেন না। ” এ কেমন মেয়ে গায়ে পড়ে অধিকার খাটায়। বাজারে কোন প্রকার সিনক্রিয়েট না করে বসে ভেবে সাগর ও মন্থর গতিতে মাহির পিছু গেল। মিষ্টির দোকানে ঢুকে গেল মাহি । সাগর কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই মাহি জিজ্ঞেস করলো, ” পকেটে টাকা কত আছে আপনার?” এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সে।

–” টাকা জেনে তুমি কি করবে? মিষ্টি খাবে!”

–” তা নয়তো কি গাড়ি কিনে বসে আছেন অথচ আমায় মিষ্টি খাওয়ালেন না”।

–” বাড়িতে পৌঁছে যাবে মিষ্টি ফিরে চলো। ”

–” নাহ, আমি এখানেই খাবো “।
মাহি নাছোড়বান্দা সে দোকানে দাঁড়িয়েই রসমালাই খেয়ে তবেই বাড়ি ফিরেছে। নিপার কাছে আর যাওয়া হলো না ফিরেছে সাগরের সাথেই তবে দু’জন আলাদা রিকশায় উঠেছিলো। বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে খেয়েছে রামধমক। তাতে কি মাহির তো আজ চাঁদ রাত লেগে গেছে মনে হচ্ছে । সাগর আজ দোকানে বারবার তাকে আঁড়চোখে দেখছিলো। অদ্ভুত এক শিহরণ ছিলো ওই দেখাতে৷ অনুভুতিরা বড্ড বেপরোয়া হয়ে উঠেছে আজ। রাত আরেকটু বাড়লেই ছাঁদে যাবে সে ঠিক করেছে। সাগর নিশ্চয়ই থাকবে তখন।

নিরব কল দিয়েই ঝেড়েছে মাহি কে। কত্তো সাহস মেয়ের বারণ করা সত্বেও একা একা বেরিয়ে যায়। মাহি অবশ্য সে ঝাড়িতে পাত্তা দিলো না তার আজ মন খুব ভালো।সাগরকে আজ একদম বর বর ট্রিট করতে পেরে কল্পনার রাজ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে সে। মনে মনে ভাবছে কখনও কি হবে সাগর আর সে স্বামী-স্ত্রী! ইশ, লজ্জা লাগছে কি ভাবছে এসব!

–” কোন জবাব দিলা না তোমরা? ” গলার স্বর কঠিন করে বললেন হাওয়া বেগম৷ সামনে দুই ছেলের বউ চুপচাপ বসে আছে।

–” কি জবাব দেবো আম্মা আপনার নাতি আর ছেলের সাথে আগে কথা বলা দরকার।” শামসুন্নাহার জবাব দিলেন।

–” হেইডা আমি কমু কিন্তু তার আগে তোমরা দুইজন মাইয়ার বেপারে কি ভাবলা।”

–” আম্মা, মেয়ে তো আমাদের চোখের সামনেই বড় হলো। আর আপনি যেহেতু বলছেন সাগরের পছন তাহলে আর আমরা অমত করার কে? ” তাহমিনা একবার শ্বাশুড়ি আর একবার সাগরের মায়ের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেই ফেলল। সাগরের মা ও জা’য়ের সাথে একমত হলেন৷ কিন্তু হাওয়া বেগম যথেষ্ট প্যাচানো মহিলা। হঠাৎ করেই ধমকে উঠলেন, ” আক্কেল জ্ঞান কি বাপের বাড়ি গেছে তোমাগো? সাগর পছন্দ করলেই মানমু নাকি । মাইয়া সংসারি হইবো কিনা হেইডা বাছবিচার করতে কইছি। এক বউ তো আনছো জমিদার বাড়ির তারওপর পোলার পছন্দের কি লাভ হইলো? ঠেংঙ্গা দেখাইয়া গেলো না আমার নাতিরে নিয়া আলেদা থাকতে।” হাওয়া বেগমের কথায় ক্ষোভ ঝড়ে পড়ছে। কলিজার টুকরো তার সৈকত। বাড়ির প্রথম নাতি বংশের প্রথম আলো। আজকাল বড্ড কষ্ট পায় হাওয়া বেগম সৈকতের কথা ভেবে ভেবে। ন্যাকি কান্না করে করেই দু’বউমাকে নিয়ে ঠিক করলেন সাগরের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবেন মনজুর সাহেবের বাড়ি। তার আগে একবার বড় ছেলের সাথে ও কথা বলবেন। দাদুনীর পরিকল্পনা সম্পর্কে আধ ঘন্টার মধ্যেই বাড়ির সকলে জেনে গেল শুধু অজ্ঞাত রইলো সাগর। এমনকি দূরে থাকা সৈকতকে ও জানিয়ে দিয়েছে সমুদ্র। রাতের খাবার শেষে এক প্রকার আলোচনা হয়েই গেল মাহির বাবার কাছে যাবেন শহিদুল ইসলাম ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আর তা খুব শিগ্রই।

নিপা অবিরত কেঁদে চলছে। মাহি কত করে বোঝাচ্ছে কাঁদিস না আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। কিন্তু নিপা কিছুতেই কান্না থামাচ্ছে না৷ হাতে গোনা মাত্র এক সপ্তাহ আছে বিয়ের। নিপার তো বয়স ও এখন আঠারো হয়নি। মাহি আর নিপা দু’জনেই সতেরোতে পা দিয়েছে সবে৷ কিন্তু নিপার বাবা মা এসব নিয়ে ভাবেন না। কিন্তু মাহির বাবা খুব সচেতন যদিও মাহির মা আবার একটু উল্টো। ভালো ছেলে পেলে তিনি পারলে এখুনি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন।

–” আমার ঠোঁটের অবস্থা ভালো হলে ও মনের অবস্থা ভালো নেই”। খুবই হতাশ সুরে বলছে মাহি পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সাগর৷ তারা গুণবে বলে ঠিক করেছে মাহি। তারা তো আজ আকাশেই নেই আর না আছে চন্দ্রিমা তবে আছে তার সাদা টিশার্ট ভাইয়া। এর চেয়ে বেশি কি চাই তার!

–” তুমি বড় হচ্ছো মাহিয়া কথাটা কেন বুঝতে চাও না?”

মাহি হেঁসে দিলো সাগরের কথায়। ” আমি বড় হচ্ছি মানলেন তবে”।

–“না মানার কি আছে৷ আমি যতদূর জানি তোমার বয়স সমুদ্রের সমান হবে মানে সতেরো, আঠারো।”

–” আপনার মনে হচ্ছে আমি বড় হয়ে গেছি। তার মানে তো বিয়ের প্রিপারেশন নিতেই পারি৷ ”

–” কেন নয়! নিরব তো বেস্ট পাত্র হবে তোমার জন্য যথেষ্ট সিনসিয়ার একটা ছেলে।”
অন্ধকার রাতে ছাঁদে আজ আবছা আলোটুকুও নেই। সাগর জানে সে যত রাত করেই ছাঁদে আসুক না কেন পাশের বাড়ির পাগল মেয়েটা ঠিক ঠিক হাজির হবে। আর ছাঁদের আলোয় কারো চোখে যদি পড়ে দু’ছাদে দু’জন ছেলেমেয়ে নির্ঘাত বদনাম রটবে। ছেলেটার কিছু না হলেও মেয়েটার চরিত্র নিয়ে কথা আসবে৷ কেউ এই পাগলি মেয়ের পাগলামো ভর্তি অনুভূতির কথা জানতে চাইবে না শুধু বলবে, “পাশের বাড়ির মেয়েটি পাশের বাড়ির ছেলের সাথে রাত বিরেতে দেখা করে।” সাগর এ ও জানে মাহি তাকে দেখলে চুপচাপ থাকবে না বকবক করাই তো এর স্বভাব। তাই আজ ইচ্ছে করেই ছাঁদের আলো না জ্বেলেই এসেছিলো৷ আর এই কারণেই সে দেখতে পাচ্ছে না মাহি কেমন অগ্নিমূর্তি হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে৷

–” নিরব আমার ভাই হয় বড় ভাই। কথাটা মনে রাখবেন আজকের পর ভুল করে ও এই ভুল কথাটা উচ্চারণ করবেন না আদারওয়াইজ,,,,

সাগর থামিয়ে দিলো মাহিকে ” আদারওয়াইজ হোয়াট?” মাহি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মুখে রা নেই তাই সাগর আবার ব্যঙ্গ করেই বলল অনেকটা ” আদারওয়াই হোয়াট মিস. মাহিয়া!”

কয়েক সেকেন্ড এর ব্যবধানে মাহির দু’হাত সাগরের ঘাড়ের পেছনে , অধরজোড়া সাগরের ওষ্ঠে আবদ্ধ, আঁখিযুগল বন্ধ। আর সাগর! তার দু’হাত দু’দিকে প্রসারিত হাওয়ায় স্থির। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিস্তব্ধ। এতোটাই নিস্তব্ধ যে দু’জনের হৃৎস্পন্দনের ডিপ ডিপ শব্দটা ও যেন দু’জনের কানে লেগে যাচ্ছে । ফুরফুরে বাতাসে আজ কোথাও যেন অনুভূতির #শব্দহীন_বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে।

চলবে

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here