শব্দহীন_বৃষ্টি (২৪)

0
850

শব্দহীন_বৃষ্টি
(২৪)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
__________________________
ভনভনানি কিছুতেই কমছে না। মাহির কানে তালা লেগে যাচ্ছে প্রায় কিন্তু কোথাও মৌমাছি চোখে পড়ছে না। সাগর ও খুব ভালো করে এদিক ওদিক দেখছে নাহ, নেই তো।

–” ভেতরে চলে এসো সবাই খুঁজবে নয়তো” বলেই সাগর হলের দিকে এগোচ্ছিলো। মাহি তার হাত টেনে ধরলো।

–” আমার ঘাড়ে,,, বলার সময় মাহির চোখ ছলছল করছিলো। সাগর আর কিছু জিজ্ঞেস না করে মাহির পেছনে দাঁড়িয়ে অল্প করে চুল গুলো সরিয়ে দিলো। দু’টো মৌমাছি খোলা চুলের মাঝে লেগে আছে তবে একটা ঘাড় ছুঁয়ে আছে। হুল ফুটিয়ে দিয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে। মাহি কান্না কান্না গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিলো সাগর বলতে না দিয়ে নিজ হাতেই মৌমাছি দু’টো কে তুলে নিয়েছে৷ নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষেছে। সাগরের ঘাড় ফুলে পাহাড় হয়ে আছে আর ব্যাথা তো সে বলতেই পারছে না। তাই মাহির অবস্থা তার বোধগম্য হতে সময় লাগেনি৷ কিন্তু সাগর যেভাবে সহ্য করতে পারে মাহি পারবে না। মনে পড়লো ছোট বেলায় মৌমাছি হুল ফোঁটালে দাদুনীর পানের বাটা থেকে চুন নিয়ে লাগিয়ে নিতো৷ এতে নাকি ব্যাথা কমে কিন্তু এই মুহুর্তে চুন পাওয়া সম্ভব নয়। আশেপাশে চা,পানের দোকান নেই। মাহি হাত, পা ছোড়াছুড়ি করছে মনে হচ্ছে। ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে নেই এদিকে কান্না ও করছে একটু একটু। কোন বুদ্ধি না পেয়ে সাগর মা’কে কল করলো। ফোন রাখতেই দ্রুত মাহিকে টেনে নিয়ে একটা দোকানে ঢুকলো ৷

–” কসমেটিকস শপে নিয়ে আসলেন কেন “? কান্না ভরা গলায় প্রশ্ন করলো মাহি।

–” ভাই মধু হবে আপনার দোকানে?” দোকানিকে উদ্দেশ্য করে বলল সাগর।

–” হ্যা” দোকানি জবাব দিলো। একটা মিনি সাইজ ছোট্ট মধুর কৌটা নিয়ে আবার সাগর চলল সেন্টারের দিকে। মাহির তখন ও আর্তনাদ চলছে যদিও তা খুবই সামান্য আওয়াজে। সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়েই সাগর মধুর কৌটা খুলে আঙ্গুলে মধু নিলো।

–” ঘাড় থেকে চুল সরাও। ” মাহি চুপচাপ তাই করলো। কিন্তু তার বুঝে আসছে না মধু দিয়ে কি হবে। কামড়েছে তো মৌমাছি আর মধু তো মৌমাছির নিজস্ব সম্পদ।মাহি যখন চুল সরিয়ে মনে মনে মৌমাছি আর মধু নিয়ে ভাবছে তখনই ঘাড়ে সাগরের আলতো স্পর্শ টের পেল। আবেশে চোখ বুঁজে আসছিলো কিন্তু দৈত্যের মত ব্যাথাটা সেই আবেশকে বিষের যন্ত্রণা বানিয়ে দিচ্ছিলো। কান্না কান্না ভাবটা তখন ও মাহির চলছিলো অথচ সাগর ও কামড় খেয়ে কি সুন্দর নির্বিকার আচরণ করছে।

–” ব্যাথা কমে যাবে খুব শিগ্রই আর একটু সহ্য করো।”

–” আপনার ব্যাথা লাগছে না?” মাহি মধুর কৌটা সাগরের হাত থেকে নিয়ে নিলো।
–” একটু ঘুরুন তো”

–” কেন?” বলে ঘুরে দাঁড়ালো। মাহি ও আঙ্গুলে মধু লাগিয়ে হাত উঁচিয়ে সাগরের ঘাড়ে লাগাতে গিয়ে বুঝতে পারলো মানুষটা একটু নয় অনেক বেশিই লম্বা৷ হাত উঠিয়ে ঘাড় ছুঁতে পারলে ও ঠিকঠাক দেখতে পারছে না।

–” একটু ঝুঁকে দাঁড়ান তো।”

সাগর ছোঁ মেরে মধুর কৌটা নিয়ে নিলো মাহির হাত থেকে ” তোমাকে দিয়ে দিতে হবে না ভেতরে যাও তুমি।”

–” যাবো না আপনার কি? ”

–” আমার কিছুই নয়। তোমার ভাই আছে এখানে সেটা ভুলে যেও না “। বলতে বলতে সাগর নিজের ঘাড়ে ও একটু মধু লাগিয়ে নিলো।

–” ভালো কথা মনে করালেন। আপনার সাহস তো কম না আপনি আমায় জোর করে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্ধকার” এখানেই থেমে গেল মাহি৷ নিরব আসছে এদিকে। “যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়” বিড়বিড় করতে লাগলো মাহি।

–” সাগর ভাই! আপনি এখানে? ” নিরব জিজ্ঞেস করতেই অপ্রস্তুত হলো সাগর। তার পাশে যে মাহি আছে নিরব কি এখন ও খেয়াল করেনি?

–” ভাইয়া আমিই সাগর ভাইয়াকে ডেকেছি আমাকে না মৌমাছি কামড়েছে “। বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সাগর ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল, ” এ কি এক্টিং না অন্য কিছু”।

–” কিভাবে। কোথায় কামড়েছে সোনা আর তুই এখানে কেন। আমাকে বলিস নি কেন? ব্যাথা তো,,৷ অস্থির হয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে একের পর এক প্রশ্ন করেই চলছে নিরব৷ সাগর বুঝলো মাহি খুব আদরের বোন নয়তো এতোটা ও ডেস্পারেট হওয়ার কথা নয়৷ সাগর থামিয়ে দিয়েছে নিরবকে সে নিজেই বলল, ” ভয় নেই আমি মাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করছিলাম কি করা যায়। মা বললেন মধু কিনে হুল ফোটানো জায়গায় লাগিয়ে দিলে অনেকটাই ব্যাথা কমে যাবে৷

সাগরকে অনেক জোর করে আর ও একটা গান গাওয়াতে সক্ষম হয়েছে নিরব আর বাকি বন্ধুরা। তমাল নিজে জোর করায় আর না করতে পারেনি। বরের অনুরোধ বলে কথা। মেয়েপক্ষ চলে গেছে অনেক আগেই কিন্তু মাহি রয়ে গেছে। নিরব নিজেই দিয়ে আসবে বলেছে তাই নিপার মা ও আর টেনশন করেন নি। কিন্তু সাগরের কি হলো কে জানে সে খুব রেগে গেল মাহির চলে না যাওয়ায়। নিরব বোনের প্রতি এত কেয়ারিং অথচ এটা বুঝছে না এখানে এত এত ছেলের মাঝে বোনকে রাখা ঠিক হচ্ছে না। সবার দৃষ্টি কি একরকম নাকি? আর মাহি বা কেমন হ্যাংলা গেল না কেন৷ এলোমেলো চুলে অস্থির ভাবে হাত চালিয়ে কয়েকবার মাহি কে দেখে নিলো। তারপর কি ভেবে নিজেই বেরিয়ে গেল কমিউনিটি সেন্টার থেকে। এতক্ষণ তো মাহির বেশ ভালোই লাগছিলো৷ কিন্তু সেই ভালোলাগার কারণ ছিলো এলোমেলো চুলের সাদা টিশার্ট পরা ছেলেটা৷ যেই সাগর বেরিয়ে গেল অমনি মাহির বিরক্ত লাগছে পরিবেশটা। নিরবের কাছে গিয়েই ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলো চলে যাবে বলে। আর একেবারে নিজেদের বাড়িই যাবে বলে ঠিক করেছে এমনিতে ও নিপার কাছে গেলে নিপা কাঁদবে যা তার সহ্য হয় না৷ এখানে বসেই দেখা যাচ্ছে তমাল ফোন কলে ব্যস্ত মানে নিপার সাথেই কথা বলছে।

–” মাহি কি সেই মেয়ে যার জন্য তুই কিছুদিন ধরে পাগলপর মত আচরণ করছিস?” তামিম প্রশ্ন করলো সাগরকে । তার কোলে তার এক বছরের ছেলে ঘুমিয়ে আছে৷ সাগর জবাব দিলো না পাশ থেকে জুয়েল বলল, ” ঠিক ধরেছিস দোস্ত শালা এই বাচ্চা মাইয়ার জন্য পাগল হইছে।”

–” বাজে বকিস না’তো জুয়েল” রেগে বলল সাগর।

–” বাজে কি আবার? বলিস নাই মাহি যে তোর পিছে পাগল হইছে বছরের ও বেশি৷ তুই মাইয়ারে পাত্তা দেস নাই খালি ওই ডায়েরি না কি জানি পাইছোস ওইকানে এক মাইয়ার ছবি দেইখা”। জুয়েলের কন্ঠস্বর উঁচু হলো কিছুটা।

–” আচ্ছা তুই থাম জুয়েল৷ তোর তো রাস্তা ক্লিয়ার। বন্ধুদের মধ্যে তুই আর সাগরই বাকি ছিলি বিয়ের জন্য তোরটা তো ঠিক। আমি বলি কি সাগর আমার এক শালি আছে দেখতে সুন্দরী আবার তোর মতই গানে বেশ ভালো। ”

–” আমার কথা বাদ দে তোর ছেলে ঘুমাইছে। ওরে ভাবির কাছে দিয়ে আয়৷ আর আমি বাড়ি যাচ্ছি কাল না ও আসতে পারি। ”

–“জুতা চিনিস মামা? নতুন এক জোড়া স্যান্ডেল আছে আমার সেগুলা তোর গালে পড়বো।” তামিম বলল।

–” জোড় করিস না তো ঢং বাড়বো হিরোর। চেহারা তো এমন করে রাখছে যেন ছ্যাকা খাইয়া ব্যাকা সে। ”

–” জুয়েল চুপ কর শালা নয়তো এই রাস্তার মোড়েই কুন কইরা যামু।” সাগরের গলা এবার উচু হলো ততক্ষণে তামিম এর ছেলের ঘুম ভেঙে গেছে। নিরব ও মাহিকে নিয়ে বের হয়েছে৷

–” ওহ, ভাইয়ারা আপনারা সবাই এখানে আড্ডা দিচ্ছেন। ”

–” হ্যা, তুমি কোথায় যাচ্ছো নিরব? ”

–” তমালের শ্বশুড় বাড়িতে ভাইয়া। মাহিকে দিয়ে আবার বাড়ি ফিরবো “বলতে বলতে নিরব গাড়ির কাছে চলে গেছে। তামিম এই মাত্র খেয়াল করলো মাহিকে।

–” মেয়ে তো মাশাআল্লাহ । বাড়িতে বলে তোর বিয়েটা ও পাকা করে নে সাগর।” তামিম মজা করছে।

–” চুপ কর শালা। আর একটা কথা ও বলবি না। জুয়েল গিটার নিয়ে আয় আমার বাড়ি ফিরবো”।

–” ওরে বাবা নায়িকাকে দেখে এখন ওনি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। গিটার আমি আনতে ভেতরে যাবো আর ওনি নায়িকাকে চোখে হারাবেন।” জুয়েল রসিকতা করছে। সাগর বুঝলো এখন বন্ধু দু’জন এসবে তাকে জ্বালিয়ে মারবে তাই নিজেই চলে গেল গিটার আনতে৷ মাহি আর নিরব ততক্ষণে চলে গেছে গাড়ি করে।

পাত্র হিসেবে তমাল খুবই ভালো। তার বাড়ির মানুষজনের ব্যবহার ও অমায়িক। তমাল এর পরিবারে তামিম আর তমাল দু’ভাই আর মা-বাবা। বোন নেই বছর দুই হলো তামিম বিয়ে করেছে। বাবার ব্যবসা দুই ভাই দেখাশোনা করে৷ অর্থনৈতিক দিক থেকে তাদের অবস্থা নিপাদের চেয়ে বহু গুণ উপরে। আর তমাল ও মানুষ হিসেবে যথেষ্ট কেয়ারিং,লাভিং। কিন্তু এতসবে তো মন মানছে না নিপার। সে ক্ষণে ক্ষণে সমুদ্রের জন্য শেষ হয়ে যাচ্ছে ।

দিনটা শুক্রবার নিপার বিয়ে আজ। মাহির মা-বাবা আর মাহিম তৈরি হচ্ছিলো নিপার বিয়েতে যাওয়ার জন্য মাহি তো দু’দিন ধরে সেখানেই আছে।হঠাৎ করেই ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রীণে ভেসে উঠলো শিমুলের নাম। চামেলি চুল পরিপাটি করতে করতেই ফোন ধরলো।

–” হ্যালো”

–” আপা দুলাভাই বাড়িতে থাকলে একটু ফোনটা দাও “। কথাটা বলার সময় গলা কেঁপে উঠলো শিমুলের। চামেলি কি মনে করে বলল, ” সব ঠিক আছে তো?”

–” হ্যা, তুমি দাওনা। ”

–” কি হয়েছে আমায় বল ভাই আমার কিন্তু টেনশন হচ্ছে। ” চামেলির চাপাচাপিতে শিমুল বলেই দিলো বড় ভাই পলাশ এর হার্ট এটাক হয়েছে। এদিকে মাহিম এর কাল থেকে পরীক্ষা । মাহি বিয়ে বাড়িতে কি করবে কোন কিছু না বুঝেই হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো ততক্ষণে মাহির বাবা ফোন হাতে নিয়ে শিমুলের কাছ থেকে সবটা শুনে নিয়েছে।

হাওয়া বেগম আর শামসুন্নাহার দু’জনে খুব পরিপাটি হয়ে মাহিদের বাড়ি আসছিলেন। সিঁড়ি গোঁড়ায় আসতেই চামেলির কান্নার আওয়াজ পেলেন। বউ শ্বাশুড়ির কিছুই বোধগম্য হলো না কি হয়েছে । শামসুন্নাহার অনেকটা ব্যস্ত ত্রস্ত পায়ে দোতলায় উঠে এলেন শ্বাশুড়ি মা’কে রেখেই। সদর দরজা খোলা দেখে সোজা ভেতরেই ঢুকে গেলেন। চামেলি সোফায় বসে কান্না করছেন একদম বাচ্চাদের মত করে। মনজুর সাহেব ভেতরের ঘরে কোনমতে ব্যাগ গোছাচ্ছেন এক্ষুনি গ্রামে রওনা দেবেন৷ মাহিম মায়ের পাশেই বসা ছিলো। শামসুন্নাহার মাহিমকে জিজ্ঞেস করতেই জানালো বড় মামা হার্ট এটাক করেছেন৷ হাওয়া বেগম ধীরে সুস্থে উপরে এলে জানতে পারলেন সবটা তাই বউমা’কে ইশারা করলেন কি করবেন? সাগরের মা ইশারায় বোঝালেন এই পরিস্থিতে ঠিক হবে না ওসব কথা বলা৷ তাই নিজেদের ভেবে আসা প্রসঙ্গ না তুলে চামেলিকে সান্ত্বনা দিলেন এবং আশ্বস্ত করলেন মাহিমের পরীক্ষা নিয়ে না ভাবতে। শামসুন্নাহার মাহিমকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যাবেন বলে তার ও কিছু কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিলেন।

চলবে

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here