শব্দহীন_বৃষ্টি (৩৩)

0
1299

শব্দহীন_বৃষ্টি
(৩৩)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________

কালো মেঘে রাতের আকাশটা ভারী হয়ে আছে। থমথমে পরিবেশ আর ঘন অন্ধকারে বুকের ভেতরের জমা দুঃখ গুলো জোনাকির মত এদিক ওদিক উড়তে লাগলো ঘুরতে লাগলো সাগরের চারপাশে। ডান হাতের আঙ্গুল চেপে পাশে দাঁড়িয়ে আছে তিথি । কান্না থেমে গেছে তার সাগরের কাছে আসতেই। খুব অভিমান হয়েছে শৈবাল আজ সাগরের সাথে গিয়েছিলো হবু আত্মীয়ের বাড়িতে৷ বিকেলে বিয়ের ডেইট ফিক্সড করতে সবার সাথে শৈবালকেও নিয়ে গিয়েছিলো। আর তাতেই যতো কান্নাকাটি তিথির তাকে কেন নিয়ে যায় নি এই নিয়ে । বাড়ি ফিরতেই সাগরকে দেখে কান্নার বেগ বেড়েছে তার। প্রথমে তার বাবা,বড়বাবা আরো অনেকেই থামানোর চেষ্টা করেছে কেউ পারেনি। অথচ সাগর ডাকতেই চুপচাপ তার কাছে চলে এসেছে।কান্নাও থেমে গেছে। মেয়েটা এখন আর একেবারে পিচ্চিটি নেই তবুও পিচ্চিবাবুর মত সাগরের সাথে লেপ্টে থাকতে পছন্দ করে। সাগরের আদরই তার কাছে বেশি প্রিয়।ছাঁদের একপাশে রেলিংয়ে হেলে বসেছে সাগর তারই কোলের উপর বসিয়েছে তিথিকে৷ (চাঁদটা এখনো মধ্যাকাশে আসেনি সামন্য পূর্বে হেলে আছে। তাতেও অনেকটা আলোকিত হয়ে আছে ছাদটা। সাগর তার কোলে বসা তিথীকে ডেকে বলছে শোন বউ এইযে দেখ, জোছনা এই মায়াবি আলোর মাঝে অন্যরকম কোন রহস্যময় ব্যাপার আছে। নয়ত কেন মন খারাপ করিয়ে দেয় আবার কখনো বা মন খারাপটাকে ভালো করে দেয়! কেমন উদাস করে বিশাল আকাশের ওই সামান্য একটা চাঁদ। কতশত গল্প তাকে নিয়ে আমরা করি অথচ নিজের গল্প ভাবার জন্য একটা আপন মানুষ খুজে পায় না। একদিন তুইও বড় হবি এভাবেই কারোর জন্য একা বসে চোখের জল ফেলবি নয়তবা কারো কাঁধে মাথা রেখে সুখের গল্প করবি।
তিথী কিছুই বুঝতে পারে না শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।কারণ এমন ভারী কথা বোঝার মতো মন বা বয়স কোনটাই হয়নি। তবে এইটুকু বোঝে আজ তার বর মশাইয়ের কিছু একটা হয়েছে। তাকে এমন চেহারায় কোনদিন দেখেনি সে।
আস্তে আস্তে রাত গভীর হতে থাকে। একসময় তিথীও ঘুমিয়ে পড়ে সাগরের কোলে। সাগর চুপচাপ বসে থাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে। সে কাউকে ভাবছে মনে মনে! তার মন কি চাইছে এমন জোছনাময় রাতে তার পাশে মাহি নামক মেয়েটা বসে নানান পাগলামি করুক! উত্তর পায় না। কিন্তু প্রথম প্রথম যে বাচ্চা মেয়েটাতে তার যন্ত্রনা মনে হতো এখন তাকেই কেন মনে হয় আশে পাশে থাকলে সে কেমন উল্লসিত হয়ে পড়ে। একটা ঔদার্য প্রকাশ পায় তার ব্যাক্তিত্বে! সাগর বুঝতে পারে না, সেকি ভালোবেসে ফেলেছে মাহিকে? নাকি সে নিজেকেই বুঝতে পারে না। এতকিছু ভাবতে ভাবতেও তার কোন উত্তর খুজে পায় না, আবার মন থেকেও কোন সাড়া পায় না। ইদানিং তাকে কেমন যেন ছন্নছাড়া মনে হয়। মনে হয় সে যাই করছে তা প্রাকৃতিক দায়িত্ববোধ থেকেই করছে কিন্তু নিজের ভেতর থেকে কোন আগ্রহও আসেনা আবার কোন অর্থও খুজে পায় না।যেন করতে হয় তাই করা, কারো সাথে গল্প করতে হয় তাই গল্প করা বা আড্ডা দেয়া। সবই নিয়মমাফিক তবুও কি যেন নেই , কি যেন নেই।
এটা কি সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে যেদিন মাহিদের বাড়ি থেকে নেগেটিভ উত্তর পেয়েছে! তাও ভেবে পায় না সাগর।
রাত যখন আরো গভীর হয় সাগর আস্তে করে নেমে যায় ছাদ থেকে। তিথীকে তার রুমে রেখে নিজের রুমে ফিরে বিছানায় শরীর বিছিয়ে দেয়। যেন নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে সকাল হলেই আবারো রুটিনমাফিক জীবন শুরু। এ কেমন জীবন যাপন শুরু হলো ভাবতে ভাবতে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় সাগর।)

সকাল থেকেই ঝুম বৃষ্টি। চৈত্রের খরায় যেখানে মাঠঘাট ফেটে চৌচির সেখানে আজকের এই বৃষ্টি আষাঢ়ে আবহাওয়া তৈরি করে দিয়েছে। কালও কলেজে যায় নি মাহি আজও যাবে না ভেবে বিছানায় পড়ে আছে । সকাল থেকেই বৃষ্টির জন্য মাহিমের কোচিংয়ে যাওয়া হয় নি এখন আবার স্কুলেও যাবে না বলছে। মায়ের বকুনি খেয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে দোর দিয়েছে। মাহি বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে ঘুম চোখে নেই। মোবাইলটা নিয়ে সময় দেখলো আট পঁয়ত্রিশ । অবচেতন মন আজও তৈরি সাগরকে দেখার জন্য সপ্তাহের পাঁচটা দিনই এ সময়ে সে জানালার পর্দার পেছনে লুকিয়ে থাকে। ততক্ষণ গেইটের দিকে তার দৃষ্টি স্থির থাকে যতক্ষণ না সাগর বেরিয়ে যায়। আজ রবিবার আজও নিশ্চয়ই যাবে এই ভেবেই মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো। বিছানা ছেড়ে জানালার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়লো। সময় কাটলো আধঘন্টা সাগরের দেখা নেই। সমুদ্রের কাছে কাল জেনেছে সমুদ্রের বিয়ের ডেট ঠিক হয়েছে৷ সমুদ্র খুব ফোর্স করেছিলো একিবার সাগরকে যেন বলে বিয়েটা না করুক।

–” মাহি তুমি বললে ভাইয়া ঠিক ঠিক বাড়িতে কিছু একটা বলে বিয়েটা আটকে দেবে। ” সমুদ্র এতোটা ডেস্পারেট হয়ে বলছিলো যেন সে নিজেই তার আপন মানুষটিকে হারানোর পথে। আসলে ভালোবাসার নামে তার শুধু নিপার সেইদিনের আর্তনাদ মনে পড়ে যায়। নিপার কষ্ট একটু হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছিলো। নিপার বলা প্রতিটি কথায় কত যে যন্ত্রণা টের পাচ্ছিলো সমুদ্র তা শুধু সেই জানে আর তাই সাগর মাহির মধ্যকার সম্পর্ক প্রতিকূল হওয়ার আগেই সমুদ্র সামলাতে চাচ্ছে। কিন্তু মাহি অনড় তার সিদ্ধান্ত থেকে৷ যেখানে তার বাবা ফিরিয়ে দিয়েছেন সেখানে তার নিজের এগিয়ে যাওয়া মানেই বাবাকে ছোট করা। বাবার সম্মান নষ্ট করা। আর এই কথাটা শুনেই সমুদ্র ক্ষেপে বাজে একটা গালি দিয়ে বলেছিলো, ” থাক পরে বালের সম্মান নিয়ে তিন তিনটা লাইফের বরবাদির জন্য শুধু তুই দায়ী থাকবি মাহি শুধু তুই।” কথাটা মাহির কানে ঢোলের অনবরত বেজে চলা দুম দুম শব্দের মতোই বেজে চলছে। নিজেকে সামলানো দায় হয়ে গেছে রাতে যখন বাবা এসে বলেছে আগামি মাসের প্রথম সপ্তাহে সাগরের বিয়ে।বুকভাঙা কান্নার আওয়াজ মাহি শুনতে পাচ্ছিলো তখন নিজের মধ্যে । কিন্তু চোখে তখনও বর্ষন হয়নি। এখনও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টায় মত পাল্টালো কলেজে যাবে। কে সাগর কার বিয়ে ঠিক মাহি জানে না কিছু জানতে চায় ও না। যত দ্রুত সম্ভব ফ্রেশ হয়ে কলেজ ড্রেস পরে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মাহি। বাড়ি থেকে বের হতেই নিরবকে দেখা গেল গেইটের সামনে।

–” গাড়িতে উঠ মাহি।”

–” ভাইয়া কেমন আছো?”

–” ভালো আছি” বলেই নিরব গাড়িতে বসলো।

–” বাসায় যাবে না আম্মুর সাথে দেখা,,,,

–” গাড়িতে বস আমি খালামনি না তোর সাথে কথা বলতেই এসেছি।” মাহি বেশ অবাক হলো, এমন কি কথা যার জন্য অফিস টাইমে ভাইয়া তার সাথে কথা বলতে এসেছে৷ হঠাৎ বুকটা দুরুদুরু করতে লাগলো ভাইয়া কি সেদিন সাগরের ডেকে নেওয়ার ব্যাপারে কিছু বলবে? কই বাড়ি ফেরার পথে তো টু শব্দও করেনি। মাহি চুপচাপ নিরবের পাশের সিটে বসে পরলো।

হাত পা কাঁপছে সাথীর স্কুলে ঢোকার পর থেকেই খুব। নিহানকে তার বাবা পিটিয়েছে সেই ঘটনার প্রায় চার কি পাঁচ মাস হয়ে গেছে৷ এরপর নিহান বা তার পরিবার থেকে কোন প্রকার কোন হুমকি বা কোন জিজ্ঞাসা,অভিযোগ কিছুই আসেনি। চেয়ারম্যান সাহেব চাইলেই কোন একশন,রিয়্যাকশন দেখাতে পারতো। কিন্তু তেমন কিছুই করেন নি তাই সবাই ঘটনাটা ভুলেই বসেছে। কিন্তু আজ হঠাৎ স্কুলের ভেতরে নিহানকে দেখে দরদর কে ঘামতে লাগলো। আজ যুথিও স্কুলে আসেনি তার খুব জ্বর। বাড়ি ফেরার আগে স্কুলের কোন টিচারের ফোন থেকে বাড়িতে বলতে হবে কেউ যেন নিতে আসে এমনটাই ভাবছে সাথী ভয়ে।

কলেজের পাশেই ছোট ছোট কয়েকটা কফিশপ রয়েছে। নিরব গাড়ি থেকে নেমেই বলল আমার সাথে আয়। মাহি নিশ্চুপ অনুসরণ করে গেল নিরবকে। তারা একটা শপে ঢুকে একেবারে পেছনের দিকে এক কাপল টেবিলে বসলো। মাহি একপলকে পুরো শপটাকে দেখে নিলো। বেশ সাজানো গোছানো মনোরম পরিবেশ। ছয়টা টেবিলে দু’টো করে চেয়ার। সকাল বলেই হয়তো এখনও তেমন মানুষজন নেই। তারা দু’ভাইবোন ছাড়া আর একটা কাপল আছে এক পাশে। নিরব চেয়ার টেনে বসতেই মাহি জিজ্ঞেস করলো, ” ভাইয়া তোমার কি বেশি সময় লাগবে কথা বলতে?”

–” সময় তোর উপর ডিপেন্ড করবে কতক্ষণ লাগবে।” নিরবের কথার অর্থ মাহি ধরতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ” মানে?”

–” আমি কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবো তুি জবাব দিবি। জবাব কতটুকু সময়ে দিবি এটা তুই ভালো জানিস। ” মাহি খুব ভালো করে দেখে নিলো ভাইকে। এত সিরিয়াস নিরব ভাইয়াকে সে বোধ হয় জীবনে এই প্রথমবার দেখছে। তাই মনে মনে ভয়টাও কেমন একটু বেশিই লাগলো।

–” সাগর ভাইয়ের সাথে তোর কি কোন রিলেশন আছে?” নিরবের প্রথম প্রশ্নেই মাহির বুকে দামামা বাজতে শুরু করলো।চুপ করে আছে মাহি তা দেখে নিরব আবার বলল, ” সাগর ভাই তোকে ভালোবাসে?” এ কথার জবাবে মাহি ফট করে উত্তর দিলো, ” নাহ।”

–” আর ইউ শিওর? ” মাহি এবার চোখ তুলে চাইলো নিরবের দিকে৷ এ কথার জবাব যেন কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না মাহি৷ সাগর তাকে ভালোবাসে না! সত্যিই কি বাসে না? যদি ভালো না’ই বাসে তবে কেন সে শূন্য ছাঁদে মাহিকে খুঁজে বেড়ায়। প্রতি সকালে দোতলার জানালায় তার চোখ হন্য হয়ে কি খোঁজে, কাকে খোঁজে? তবে কেন পরশু রাতে এমন উন্মাদ হয়ে জানতে চাইছিলো মাহি তাকে এভোয়েড করে কেন৷ আর সত্যিই যদি সাগর তাকে ভালোবাসে তবে আগামী মাসে তার বিয়ে কেন হবে? কেন গেল সে নিজের বিয়ের তারিখ ঠিক করতে? ভালোই যদি বাসতো তবে কেন আমায় একটিবার বললো না তার অর্ধাঙ্গিনী অন্য কোন মেয়ে নয় শুধু মাহিয়া হবে। মাথাটা বড্ড ফাঁকা লাগছে মাহির৷ নিরবের কথার কোন জবাব তার কাছে নেই। নিরবো আলতো করে বোনের হাতটা ধরে বলল, ” তোর মনে কি চলছে আমি জানি না। তবে এটুকু আন্দাজ করতে পারি তুই খুব কনফিউজড রে সোনা। সাগর ভাইকে ভালোবাসিস তুই আমি জানতাম না। আর জানলে কখনোই খালুকে সেই বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে দিতাম না। খালামনি, খালু আমাকেও জানিয়েছিলো। সমুদ্রের সাথে আমি কথা বলেছি ইনফ্যাক্ট সমুদ্রই আমাকে কাল ফোন দিয়ে সবটা বলেছে৷ তুই কি চাস একটু বলবি আমায়?”

–” আমি কি বলবো ভাইয়া?” আকষ্মিক কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে বসলো মাহি।

–” তুই সাগর ভাইকে বিয়ে করবি কিনা শুধু সেটা বল।” নিরবের এমন কথা শুনে অসহায় চোখে তাকালো মাহি৷ এ কেমন কথা সে সাগরকে বিয়ে করবে কিনা? সে চাইলেই কি সম্ভব!

–” তুমি হয়তো জানো না সাগর ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আর সেই বিয়ে আমার বাবাই ঠিক করেছে।” কথাটা বলে মাহি মাথা নিচু করে ফেলেছে। চোখ ছলছল হয়তো এখুনি জল গড়িয়ে পড়বে আর সেই জল সে কাউকে দেখিয়ে ফেলতে চায় না। যা তার অদৃষ্টেই নেই তার যন্ত্রণায় অন্য কাউকে শামিল করার কি দরকার! কিন্তু নিরব তো এতোটাও অবুঝ নয়। বোনের মনের ভেতর চলতে থাকা তুফান টের পেয়ে বাঁকা হাসে। মনে মনে ছক কষে ছোট্ট একটা প্ল্যান ভোজভাজির মত পাল্টে দেবে সাগরের বিয়ের সিদান্ত। এমনটাই ঠিক করে এসেছে নিরব আর সমুদ্র । নিরব আবার এও ভেবেছে তাদের এই প্ল্যানে ওই মেয়েটার ফিউচার যেন নষ্ট না হয়। কি করেছে বা করবে তা শুধু নিরব আর সমুদ্রই জানে। সমুদ্র ছেলেটা বয়সে ছোট হলেও বুদ্ধিতে নিরবের থেকে এক কাঠি উপরে তা বুঝে গেছে নিরব তাই আপাতত সে শুধু সমুদ্রের কথা মত মাহির মনের খোঁজ নিতে এসেছে। তেমন কিছু জানার প্রয়োজন নেই মাহি সাগরকে ভালোবাসে এটাই সব প্রশ্নের সমাপ্তি টেনে দিয়েছে। নিরব হঠাৎ বসা থেকে উঠে বলল, ” তোর ক্লাসের আরো আধ ঘন্টার মত বাকি। নাশতা করে চলে যাবি আমি অর্ডার করে দিয়ে যাচ্ছি। ” মাহি তখনও মাথা নিচু করে বসে আছে। হ্যা বা না কিছুই বলছে না নিরবও আর ঘাটায় না তাকে। একটা বার্গার আর কোল্ড ড্রিংক অর্ডার করে সে বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর একটা কিশোর বয়সী ছেলে এসে তার অর্ডারকৃত বার্গার আর ড্রিংক দিয়ে গেলে মাহি সেগুলো খায় না। ছেলেটাকে ডেকে তাকেই সেগুলো দিয়ে বেরিয়ে পরে কফিশপ থেকে।

সাথীর কোচিং শেষ হয়েছে মাত্রই। ক্লাস শুরু হবে ঠিক দশটায় তাই আপাতত ফ্রী । স্কুলের নিচ তলার বারান্দায় সাথী আর তার এক সহপাঠী দাঁড়িয়ে গল্প করছিলো তখনি এক জুনিয়র মেয়ে এসে বলল, ” সাথী আপু আপনার আম্মু এসেছে। মাত্রই অফিস রুম থেকে বেরিয়েছে আপনাকে ডাকছে।” প্রথমে একটু অবাক হলো সাথে বিষ্ময়ে প্রশ্ন করলো, আম্মুকে তুমি চেনো?”

–” হ্যা ওই যে আপনাদের সাথে কিছুদিন আগেও এসেছিলো৷ আন্টিই তো বলল উনি আপনার আম্মু।”

–” আম্মু,,, এখন কোথায় বলোতো?”

–” আন্টি গেইটের কাছেই দাঁড়ানো সাথে আরো কেউ ছিলো।” সাথী হয়তো খেয়াল করেনি মেয়েটা কথাগুলো ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে পারছিলো না। জড়িয়ে যাচ্ছিলো কথাগুলো। কিন্তু বিপদে পড়বে বলেই হয়তো তখন বুদ্ধিহীন হয়ে সাথী সেই মেয়ের কথাটাকে বিশ্বাস করে নিয়েছিলো৷ চুপচাপ বারান্দা ছেড়ে এগিয়ে গেল গেইটের দিকে। আর সেই যাওয়াই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো।

সাথী যখন গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো তখন দেখলো গেইটে আজ দাড়োয়ান নেই। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো তখন গেইটের সামনে একটা মানুষজনও ছিলো না। কৌতুহলবশত গেইট থেকে এক পা বের হতেই দেখতে পেল নিহান বসে আছে তবে অন্যদিকে তাকিয়ে। সাথীর হঠাৎ ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো মনটা কু ডাকতে লাগলো। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না সাথী গেইটের ভেতর ফিরে আসার আগেই কেউ খপ করে তার হাত আর মুখ চেপে ধরেছে। চোখ মেলে শুধু নিহান কে দেখলো এগিয়ে আসতে আর যে তার মুখ হাত ধরেছে সে কে তা দেখতে পায় নি। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় কোথা থেকে একটা সি এনজি এলো আর টেনে হিঁচড়ে নিহান আর তার সাথের জন মিলে সাথীকে উঠিয়ে নিলো৷ মাহি মাত্রই কফিশপ ছেড়ে রিকশা খুঁজছিলো। কলেজের ভেতর আর পা রাখার ইচ্ছে নেই আজ তাই একটু এগিয়ে স্কুলের মোড়েই এসেছিলো। হঠাৎ এমন সি এনজির পাশে ধস্তাধস্তি দেখতেই চিৎকার জুড়ে দিলো। আশেপাশে এক দু’জন চিৎকার শুনতেই জড়ো হচ্ছে ঠিক সেই মুহুর্তে সাঁই করে সি এনজিটা মাহির সামনে দিয়ে চলে গেল। মাহি বাকরুদ্ধ হয়ে মূর্তির মত রইলো তার হুঁশ হারিয়ে গেছে। হাত পা অসাড় হয়ে গেছে সি এনজি তে কাকে দেখলো সে? সাথী! ফাঁকা মস্তিষ্কে কয়েক মিনিট তার সেভাবেই কাটলো৷ কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন বের করেই প্রথমে সাগরের নাম্বার ডায়াল করলো। কল রিসিভ হলো না আবারও করলো এবারও রিসিভ হয়নি। পাগলের মত মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্ট খুঁজতে লাগলো আর কাকে কল দিবে? ততক্ষণে রাস্তায় আরো বহু মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। হতবুদ্ধি হয়ে মাহি আরেকটা সি এনজি দেখে উঠে বসলো। মাথা ঠিকঠাক কাজ করছে না শুধু বলল সামনের রাস্তায় যেতে একটা সি এনজির পেছনে একটা মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে। কে কোতায় বা কারা কিছুই গলা দিয়ে আসছে না তার। সি এনজি ড্রাইভারও ঘটনাটা দেখেছে পাশেই ছিলো লোকটা।কিছু জানতে না চেয়ে সোজা রাস্তায় গেল। একের পর এক ফোন করছে কখনো সাগর কখনো সমুদ্রকে। তাদের বাড়ির আর কারো নাম্বার মাহি জানে না। সমুদ্র এখন ক্লাসে থাকবে তাই হয়তো ধরছে না এই ভাবতেই সাগর কল ব্যাক করলো।

–” কল দিয়েছিলে?” এরপর সাগর আর কিছু বলার সুযোগ পায়নি৷ মাহি কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলতে পারলো সাথীকে কে বা কারা সি এনজিতে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। রাস্তাটা বলতেই সাগর আর কিছুই শোনেনি। নিজের ডেস্ক ছেড়ে এক দৌড়ে অফিস থেকে বের হয়েছে।কিছুটা দৌড়ে এগোনোর পর আবার ফিরে অফিসে এসেছে বাইকের চাবিটা নিয়ে আবারও দৌড়ে বের হয়ে বাইক স্টার্ট দিয়েছে৷ বুকে ভয় নিয়ে বাইকে সে ছুটছে মাহির বলা কলেজ রোডের দিকে। কোথায় যাবে কতদূর কিছুই জানে না। সেই মুহুর্তে ভুলে গেছে একটিবার বাড়িতে ফোন করবে কিনা। মাহি সি এনজি ফলো করে দশ মিনিটের মাথায় সেই সি এনজি পেয়ে গেছে এমনকি সি এনজি থামাতেও পেরেছে কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য সি এনজিতে সাথী বা ওই ছেলেদের কাউকে পায়নি৷ সাগর ততক্ষণে ওই রাস্তায় পৌঁছে গেছে। মাহির সি এনজির ড্রাইভার ওই ড্রাইভারকে আটকে রেখেছে রাস্তার লোকজনও জড়ো হয়ে গেছে। পাবলিকের হাতে মার খাবার ভয়ে সেই ড্রাইভার মুখ খুলল। সাগর এসে থামতেই আগে ড্রাইভার এর মুখে ঘুষি মেরে বসলো। কলার চেপে আরো একবার মারতে নিলে ড্রাইভার বলে দিলো সে কিছু করতে চায়নি। এই এলাকারই একজন নামী লোকের ছেলে তাকে ভয় দেখিয়ে এ কাজ করার সাহায্য নিয়েছে। সাগরের আর বুঝতে বাকি নেই কে সে তবুও ড্রাইভারকে ছাড়লো না সে। যেখানে নিহানদের রেখে এসেছে সে পর্যন্ত নিয়ে গেল। কলেজ রোডের উত্তর দিকে কিছুটা জায়গা জঙ্গলের মত। সেখানে বহু পুরাতন একটা বাড়ি আছে স্থানীয় লোকেরা পোড়াবাড়ি বলে। সাথীকে নিহান সেখানেই নিয়ে গেছে। হন্য হয়ে ছুটে গেছে সেখানেই সাগর, ড্রাইভার, মাহি আরো কিছু সেই এলাকারই লোক৷ ঘটনা ঘটার আধঘন্টাও পেরোয়নি তারা পৌঁছে গেছে সাথীর কাছে। পোড়াবাড়িতে ঢুকতেই মাহির ফোন বাজলো। সে রিসিভ করেনি । মাহি সাগরের পিছু পিছু বাড়িটির ভেতর ঢুকেই চমকে উঠলো সাথীর আর্তনাদ! সাগরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ চলকে গেল যেন মুহুর্তেই সে বাড়িটির বন্ধ দরজাটায় সর্বশক্তি দিয়ে লাথি বসিয়ে দিলো। ভাঙেনি দরজাটি তাই আরো কয়েকবার লাথি দিলো। লাথির সাথে হুংকারও ছাড়লো।সাথে আসা লেকজনও এবার এগিয়ে একসাথে দরজায় আঘাত করতেই ভেঙে গেল বিশাল আকারের দরজাটি। দরজা ভাঙতেই মাহি চিৎকার করে উঠেছে সামনেই ফ্লোরে পড়ে আছে সাথীর নিথর দেহ৷ ঘরটির পেছন দিক দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছে নিহান আর তার সাথে ছেলেটি। কয়েকজন মিলে দু’জনকে ধরতে গেলে সাগর তার বোধ জ্ঞান সব হারিয়ে নিহানকে চেপে ধরে। সেই মুহুর্তে যেন ঐশ্বরিক কোন শক্তি এসে ভর করে সাগরের শরীরে। দিকদিশা হারিয়ে অনবরত মারতে থাকে নিহানকে। কখনো ঘুষি কখনো লাথি ঠিক নিহানের বুক বরাবর। মাহি কাঁদছে সাথীকে ধরে, সাগরকে ডাকছে সেদিকে সাগরের আর কোন খেয়াল নেই৷ সে মারবে নিহানকে মেরে ফেলবে আজ। তার কলিজায় প্রথমবার হাত দেওয়ার দুঃসাহস করেছিলো তখন ছেড়েছে এটাই তো ভুল। এবার আর ছাড়বে না। সাগর যখন উদ্ভ্রান্তের মতো নিহানকে বেদম মারছিলো তখন অনেকেই আটকানোর চেষ্টা করেছিলো৷ “সাগর ভাইয়া” থামাতে পারেনি হঠাৎ কানে এলো সাথীর অস্পষ্ট গলা। সাগর থেমে যায় একদম সাথীর মাথার কাছে বসে পরে হাঁটু গেড়ে।চোখ বন্ধ করে ফেলে বোনের দিকে চোখ পড়তেই। গায়ের কাপড়টিও নেই ঠিকঠাক। সাথীর রক্তে কালো ফ্লোর রঙ্গিন হয়ে যাচ্ছে। মাহি সাগরের হাতটা চেপে ধরে বলে, ” চলুন দেরি করলে সর্বনাশ,,, সাগর আর শোনেনি কিছু। কোলে তুলে নেয় তার কলিজার টুকরোকে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকায়নি। স্থানীয় লোকেরাই প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে পুলিশে খবর দেয়। নিহানকেও হাসপাতালে নেয় তবে পুলিশ আসার পর। আর নিহানের সেই বন্ধুটি পলাতক হয়। অর্ধদিনের মধ্যেই ঘটে যায় সাগর মাহির জীবনে দেখা প্রথমবার কোন আপনজনের সর্বনাশ।

চলবে
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here