শব্দহীন_বৃষ্টি
(৫)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________
দূরে খুঁজি কাছে খুঁজি,, ওই সে বুঝি এই সে বুঝি,,
সকাল সকাল গুনগুন করতে করতেই স্কুলের জন্য তৈরি হচ্ছে মাহি। কাল রাতে যখন এই গানটা ওই সাদা টিশার্ট ভাইয়ার কন্ঠে শুনেছে তখন থেকেই মনে গেঁথেছে তার। বারবার মনে হচ্ছিলো জীবনে প্রথমবার সে কোন পুরুষের এত সুন্দর কন্ঠ শুনছে। এর আগে হাজারো ছেলে শিল্পীদের গান শুনেছে কিন্তু এতোটা অমায়িক কেউ গাইতে পারে না। তার উপর কিনা কোন বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই! কখন যে মাহি কাল রাতের ভাবনায় বিভোর হয়ে বাড়িতে পড়ার স্লিপার পড়ে স্কুলের জন্য বেরিয়েছে একটু ও খেয়াল নেই। খেয়াল হলো তখন যখন সে পৌঁছুলো ক্লাসরুমে৷ আজ রুক্ষ স্যারের ক্লাস না থাকলেও অসভ্যটা এসেছে একটা বই নিতে৷ আর তখনি তার স্বভাববশত নজরটা ঘুরলো মাহির মুখ থেকে পা পর্যন্ত।
–” কি ব্যাপার মাহি এসেম্বলি হয় না বলে কি কেডস সু পড়া ও ছেড়ে দিয়েছো নাকি”? স্যারের কথা শুনেই মাহি নিজের পায়ে তাকাতেই গলা শুকিয়ে এলো তার। এখন যদি হেডস্যার পর্যন্ত কথাটা যায় তবে নিশ্চিত পানিশড করবে। খুবই স্ট্রিক্ট হেডস্যারটা। কিন্তু নাহ, ভাগ্য ভালো জুনাইদ স্যার আর যাইহোক মাহিকে পানিশড হতে হবে এমন কোন কথা হেড স্যারের সামনে তুলবে না । বাকি রইলো ক্লাসমেটস তারা তো মাহির ভয়েই বলবে না এমনকি নিপার ও। নিপা হলো মাহির বেস্টু । স্বভাবে মাহি, নিপা দু’জনই একে অপরের কার্বণ কপি৷
ক্লাসের ফাঁকে মাহি আর নিপা করিডোরে গিয়ে দাঁড়ালো। গ্রুপ ক্লাসের জন্য তারা একটু পর তিনতলায় যাবে। সমুদ্র বেরিয়েছিলো তার বন্ধুদের সাথে। মাহি তাকে দেখেই ডেকে উঠলো, এ্যাই সমুদ্র শোন!
–“সমুদ্র কে ডাকছিস কেন”?নিপা জিজ্ঞেস করলো। ততক্ষণে সমুদ্র তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
–” ডাকলে কেন গ্রুপ ক্লাস করবে না? ফিজিক্স আজ ওয়াশিং ম্যাচ হবে কিন্তু “।
–” রাখো তোমার ওয়াশিং ম্যাচ। ফিজিক্স নিয়ে ভয় নাই আমার। আচ্ছা কাল রাতে ছাঁদে কে কে গান গাইছিলো “?নিপা ভ্রু কুচকে আছে কারণ মাহির কথা সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
–” গান তো আমি, সৈকত ভাইয়া আর সাগর ভাইয়া গাইছিলো”।
–” তোমাদের তিনজনের কন্ঠই কিন্তু অসাধারণ “।
–” থ্যাংকস।”
–“রাখো তোমার থ্যাংকস একটু ভুল বলছি বেস্ট ছিলো সাদা টিশার্ট ভাইয়ার কন্ঠ আর গানটা ও”।
–” এই তোরা কিসের গানের কথা বলছিস? কাল কি কোন অনুষ্ঠান ছিলো”? নিপা এবার প্রশ্ন করলো। গত বছর থেকেই হঠাৎ নিপার সমুদ্র কে ভালো লাগে। একই ক্লাসের হওয়ায় রেগুলার কথা হলেও কখনো নিপা তার ফিলিংস বুঝতে দেয় নি। মাহি একটু আধটু আন্দাজ করতো। কিন্তু সে চাইতো নিপার এই অনুভূতি গাঢ় না হোক। আর যাইহোক সমবয়সী রিলেশন কখনোই ভালো হয় না তার উপর সমুদ্র কি ভাবে নেবে কে জানে!
–” আরেহ নাহ, অনুষ্ঠান নয় ভাইয়ার শালিকা বেড়াতে এসেছে তাই একটু রাত জেগে আড্ডা হয়েছিলো। মাহি তাদের ছাঁদ থেকে গান শুনেছিলো ” সমুদ্র বলল।
–” সাদা টি-শার্ট ভাইয়ার শালি”? কেমন যেন আৎকে উঠল মাহি। সমুদ্র আর নিপা তো অবাক এভাবে জিজ্ঞেস করার কি হলো!
–” কিরে এভাবে বলছিস কেন? তুই কি সমুদ্রের ভাইয়ের উপর ক্রাশ খেয়েছিস? উপ্স শেষ পর্যন্ত বিবাহিত ভাইয়ার উপর ক্রাশড, সো স্যাড!” নিপা হো হো করে হেঁসে উঠলো।
–” ধ্যাৎ! ”
–” খেলে খেতে পারো ক্রাশ সাগর ভাইয়া পিওর সিঙ্গেল। তবে ভাইয়া বয়সে তোমার চেয়ে অনেক বড়। বিবাহিত তো সৈকত ভাইয়া আর সাদা টি-শার্ট সাগর ভাইয়া ছিলো। এক কাজ করো আপাতত আমার উপর ক্রাশ খেয়ে কাজ চালাও “। বলেই সমুদ্র শার্টের কলার একটু টেনে হাসতে হাসতে চলে গেল গ্রপ ক্লাসের উদ্দেশ্যে। মাহি আর নিপা ও গেল৷ তবে নিপার চোখে এখনও আটকে আছে সমুদ্রের হাসিমাখা মুখটা। কি অমায়িক হাসি ছেলেটার। সমবয়সী না হয়ে একটু সিনিয়র হলে কি হতো!
সাগর একটা জবের জন্য এপ্লাই করেছিলো। ইন্টারভিউ বেস্ট হয়েছিলো আর জয়েনিং লেটার ও পেয়ে যাবে।কিন্তু এখানে এক শর্ত আছে। এক লাখ টাকা দিতে হবে তবেই জবটা পাকা হবে। আর এ নিয়েই সাগর বিড়বিড় করে কয়েকটা গালি ছাড়লো। তার পাশেই তার বন্ধু জুয়েল দাঁড়িয়ে ছিলো।
–” খিস্তি দেওয়া শেষ হইলে ডেট ঠিক কর কবে যামু কক্সবাজার “।জুয়েল প্রশ্ন করলো।
–” মন মেজাজ ভালো না কোথাও যামু না।”
–” মামা বাড়িতে সুন্দরী বেয়াইন থাকলে কি আর মন মেজাজ ভালো থাকে “? পেছন থেকে বলে উঠলো নয়ন।
–” ক্যান মামা তোমার বুঝি সুন্দরী বেয়াইন দেখলে মেজাজে ভোল্টেজ খায়”? সাগর ও মজা করলো। জুয়েল কল করেছিলো আজ একসাথে হবে সব বন্ধু। তাই সে মাত্রই এসেছে। অন্য বন্ধুরা ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেনি। কিছুক্ষণ তিন বন্ধুতে আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়ে যে যার বাড়ি চলে যায়। বাড়ি ফিরেই দেখতে পেল রান্নাঘরের সামনে শোরগোল। একটু এগিয়ে দেখা গেল তিথি পায়ে হাত দিয়ে কান্না করছে। পরনে তার আটপৌরে শাড়ি আবার হাত ভর্তি চুড়ি। হাতে পা আলতার রঙে লাল হয়ে আছে। কিছুটা লাল তার মুখ ও।
–” আমার বউ কান্না করছে কেন এভাবে। কে মেরেছে শুনি”?বলেই সাগর তিথিকে কোলে তুলে নিয়েছে।তিথির পা ফুলে গেছে তাতে সাগর হাত বুলাতে বুলাতে সবার দিকে এক নজর তাকালো। মা, চাচীরা সবাই চুপ হয়ে আছে। দাদুনী মুখ গোমড়া করে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। সবাইকে চুপ থাকতে দেখে সাগরের মেজাজ অনেকটাই খারাপ ছিলো এখন আরো দ্বিগুণ হলো।
–” কি সমস্যা মুখে কথা নাই কেন? তিথি পা ফুলেছে কি করে “? চিৎকার করেই বলল সে।
–” আমি আসলে শাড়ি পড়েছিলাম আপুর থেকে নিয়ে। তা দেখে তিথি ও বায়না ধরেছে তাই তাকে ও পরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বাড়িতে ওর মাপের কোন শাড়ি না থাকায় বড় শাড়িই কোনমতে পেচিয়ে পরিয়েছি। আর ও শাড়ি পরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে,,” দোলা আর কথা শেষ করতে পারেনি তার আগেই সাগর অগ্নি চক্ষু নিয়ে তাকাতেই দোলা থেমে যায়। কি ভয়ংকর সেই চাহনি যা দোলা আজ অব্দি কারো দেখেছে বলে তার জানা নেই।
–” সাগর “! সাগরের মা নাম ধরে ডাকলো তাকে।এই মুহুর্তে সাগর যে কোন প্রকার বাজে ব্যবহার করে ফেলতে পারে তা সবাই জানো দোলা ছাড়া। তিথি সাগরের কলিজার টুকরো একদম। বাড়িতে সব ভাই বোন একদিকে তিথি আরেক দিকে।এ নিয়ে অবশ্য বাকি দু’বোনের বেশ অভিযোগ তার কাছে ভাইয়া তাদের কম ভালোবাসে। বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য তিথি তাছাড়া স্বভাবে ও খুব পাকা তাই এতোটা আদুরে সে। সাগর মায়ের ডাকে নিজেকে কন্ট্রোল করে নিয়েছে নয়তো দোলা বাড়ির মেহমান সেকথা ভুলেই রেগে কিছু বলে ফেলতো। তিথিকে নিয়ে সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলো, ” বরফ লাগিয়েছো পায়ে”? তিথি চুপ সাগরকে জড়িয়ে ধরে তার কোলেই চুপটি করে বসে আছে। কান্না থেমে গেছে কোলে আসার পরই। এই নিয়ে অবশ্য দোলা মনে মনে রেগে গেছে তিথির উপর। “অসভ্য, ফাজিল মেয়ে ভাইয়ের কোলে উঠেই ব্যাথা শেষ এতক্ষণ ঢং করে কান্না করছে যত্তসব ফালতু মেয়ে ” বলে মনে মনে গালিও দিচ্ছে।
সাগর বসে আরো কিছুক্ষণ বরফ লাগিয়ে একটু ব্যাথার মলম দিয়েছে তিথির পায়ে । দাদুনী সেই যে সোফায় বসেছে মুখ গোমড়া করে এখন পর্যন্ত আর কোন রা করেনি। সাগর দেখেও ইগনোর করেছে তা টের পেয়ে শুরু হয়ে গেল বিলাপ। দাদুনী সবচেয়ে বেশি আবদার খাটায় সাগরের উপর, আর অভিযোগ করে সব সৈকতের কাছে৷ কিন্তু এই মুহুর্তে সৈকত অফিসে তাই অপেক্ষায় আছে কোন এক উছিলায় সাগরকেই বলবে বাড়িতে আসা মেহমান মেয়েটি তার মোটেই পছন্দ নয়। বাজে মেয়েছেলে একটা তার জন্য তিথি পায়ে ব্যাথা পেয়েছে। দাদুনী বারবার বারণ করা সত্বেও শাড়ি পরিয়েছে সে তিথিকে৷ আর এজন্যই তার ক্ষোভ দোলার উপর।
দুপুরে খাবার খেতে বসে সাগর চুপচাপ খাচ্ছিলো আর তিথিকে ও খাওয়াচ্ছিলো পাশের চেয়ারে বসে৷ দোলা ও তখন এসে বসেছিলো সাগরের মা আর সাথীর মা খাবার সার্ভ করছিলেন। দোলা ধীর গলায় বলল, “স্যরি, আমি বুঝতে পারিনি তিথি এভাবে হার্ট হবে”। কথাটা যে সাগরের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই কারো। কিন্তু সাগরের মা বুঝতে পারছে না মেয়েটা স্যরি কেন বলবে এতে তার তো কোন দোষ নেই। কিন্তু মুখে কিছু বলেন নি। তিনি গত এক দিনেই দোলার চোখে বেশ মুগ্ধতা দেখেছে সাগরের জন্য। বাড়িতে আর কেউ খেয়াল করেছে কিনা জানেন না তিনি। শুধু নিজে বুঝে গেছেন মেয়েটা একটু অন্যরকম ভাবছে সাগরকে নিয়ে।
–” না না আপনি স্যরি বলবেন না প্লিজ। আমিই বোকার মত রেগে গিয়েছিলাম। আ’ম স্যরি। আমারই বোঝা উচিত ছিলো তিথি যেভাবে ব্যাথা পেয়েছে তাতে আপনার কোন দোষ নেই “। সাগরের কন্ঠে লজ্জাবোধ। সত্যিই এখানে দোলার করার কিছু ছিলো না। তিথি জোর করেছে বলেই তাকে অত বড় শাড়িটা পেচিয়ে দিতে হয়েছিলো। সাগর আর দোলার কথার মাঝেই দাদুনী এসেছেন টেবিলে। দোলার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন৷
–” বড় বউ, খিদা লাগছে খাবার দেও আমারে”। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন হাওয়া বেগম।
–” মা’তো বাবার জন্য শরবত নিয়ে ঘরে গেলেন দাদুনী। আপনি বসুন আমি দিচ্ছি আজকে “।শিলা কথাটা বলেই প্লেট দিলো হাওয়া বেগমের সামনে। একে একে ভাত তরকারি ও এগিয়ে দিলো কিন্তু তিনি সেগুলো ছুঁয়ে ও দেখলেন না। সবসময় বড় বউ কিংবা মেঝো বউয়ের হাতেই তার পাতে খাবার দিতে হয়। নইলে বৃদ্ধা খাবার খেতে চান না এ বাড়িতে৷ তার নাকি এই দুই বউমা আর নিজের মেয়ে ছাড়া কারো খাবার মুখে উঠে না। সাগর আর দোলা তখনও ডাইনিংয়ে ছিলো। তারা খাওয়ার ফাঁকে অনেক রকম কথাবার্তা বলল। তিথি খাওয়ার ফাঁকে একবার বলেই ফেলল, ” বরমশাই তুমি না বলেছিলো খাবার টেবিলে বেশি কথা বলতে নেই”। তিথির মুখে এমন কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়েছিলো সাগর৷ বেচারা নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেছে৷ কত সময় খেতে বসে বাড়ির সকল পিচ্চিকে বলেছে, ” খাওয়ার সময় কথা বলা ঠিক নয় ” আজ নিজেই সেই কথা ভুলে গেছে।
বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে মাহি গোসলে ঢুকে গেল। স্কুল ড্রেস সমেত শাওয়ার নিয়ে আবার ছাঁদে চলে গেল। মাহির মা বাড়িতে ছিলো না। পুরো বাড়িতে শুধু তাদের ছুটা কাজ করে মেয়েটা ছিলো৷ মাহির মা’ই নাকি একে আজ রাত পর্যন্ত থাকতে বলেছে। মাহি বাড়িতে একা থাকবে বলে। শিমুল মামার আনা প্রস্তাব পেয়ে মনে মনে একটু রাজিই তার মা। তাই মাহির অগোচরেই আজ গিয়েছে ছেলের বাড়িতে৷ বিকেলে বের হয়েছে তাই পৌঁছুতেই সন্ধ্যা হতে পারে ঢাকার রাস্তায় যেই জ্যাম। মাহি ভেজা কাপড়েই ছাঁদে এসে দাঁড়ালো। একবার সমুদ্রদের ছাঁদে খেয়াল করলো নাহ, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বারবার শুধু সেই কন্ঠস্বরটা কানে বাজছে। আবছা আলোয় সাদা টি-শার্ট ভাইয়াকে সে দেখেছে কিছুটা যখন তিনি রেলিং থেকে সরে গুডনাইট বলেছিলো৷ কয়েক সেকেন্ড এর সেই অস্পষ্ট দেখায় কিছু একটা ছিলো। সেই কিছু একটা কি মাহি জানে না তবে সেই কিছু একটা যে তার কিশোরী মনের জানালায় ধাক্কা দিয়েছে এটা ঠিক বুঝেছে মাহি।
–” মাহি” হঠাৎ কারো পরিচিত কন্ঠের ডাক শোনা গেল৷
চলবে
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)