শব্দহীন_বৃষ্টি
(৬)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________
এই সন্ধ্যায় পড়ালেখা নয় বরং আধো আলোছায়াময় ছাঁদে বসে ভিনদেশী তারা গানটা শুনতে বেশ লাগবে। সেই লাইনটা, “ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে ”
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে,,
–“ইশ, কি হলো আমার আমি বুঝি নারে”।ফোনটা কানে ধরে বলে চলছে মাহি। ওপাশে নিপা তার কথা শুনে বেশ বিজ্ঞের মত বলল, ” প্রথম প্রেমের গন্ধ পাচ্ছি বালিকা তোমার বুলিতে”।
–” ধ্যাৎ, প্রেম টেম কিছু না। কাল রাতে সমুদ্রদের গান শুনে মন ভালো লাগছিলো খুব৷ আর তাই বোধ হয় গানে এত আকর্ষণ পাচ্ছি”। মাহির কথাগুলো বিশ্বাস হলো না নিপার। সে আবার বললো, ” আকর্ষণ কি গানে পেয়েছিস নাকি সমুদ্রের সাদা টি-শার্ট ভাইয়ার উপর “!
–” পাগল নাকি তুই? সাগর ভাইয়ার তো চেহারাও ঠিকঠাক দেখি নি আমি৷ আর ছোট বেলায় যদি দেখেও থাকি তবে তা আর এখন মনে নেই “। মুখে মাহি এ কথা বললে ও মন বলছে নিপাই ঠিক। টান তো শুধু গান নয় ওই অস্পষ্ট দেখা মানুষটার প্রতিও লাগছে৷ কিন্তু মুখে স্বীকার করার জো নেই নয়তো দেখা যাবে কালই স্কুলে গিয়ে সমুদ্রকেই বলে দিবে। আরো কিছু মুহুর্ত দুই বান্ধবীতে আলাপ হলো। আজও মাহির ম্যাথ টিচার আসেনি তাই বাধ্য হয়ে কল করতে হলো। স্যার কোন কাজে গ্রামের বাড়িতে গেছে তাই এ সপ্তাহে পড়াতে পারবে না৷ মাহির বাবা শুনে বেশ চিন্তিত হলেন। এমনিতেই মেয়ে পড়াশোনায় যথেষ্ট অমনোযোগী তার উপর এমন টিউটরের না আসা মেয়ে নির্ঘাত ফেইল করবে। আজ যখন ভেজা কাপড়ে ছাঁদে দাঁড়িয়েছিলো মাহি তখন কাজের মেয়ে রাবু এসে পেছন থেকে ডেকে উঠলো। মাহি ছাঁদে তা সে জানতো না। কিন্তু মাহির ঘরে চা নিয়ে যাওয়ার পরই তার চোখে পড়ে পানির ঢল। বাথরুমের দরজা থেকে পানি দেখে দেখে আসতেই সেই পানির রেখা ছাঁদে এসে শেষ হয়৷ এমন সন্ধ্যার আগে স্কুল ড্রেস পরে ভেজা অবস্থায় ছাঁদে দাঁড়িয়ে ওপাশের ছাঁদে কি দেখছে সে? ভাবতেই মেয়েটা ভয়ে ভয়ে ডেকে উঠে, ” মাহি”!
মাহি পেছনে ফিরেই রাবুকে দেখে হেসে দেয়। সে বুঝতে পারছে রাবু আপা মনে মনে ভূতের ভয় পাচ্ছে। ভর সন্ধ্যায় ভেজা কাপড়ে ছাঁদের মাথায় দাঁড়িয়ে কি করতে পারে মানুষ!
রাত প্রায় ন’টা বেজে গেছে যখন মাহির মা আর শিমুল মামা বাড়ি ফিরলো। মাহিম(মাহির ভাই) ও গিয়েছিলো তাদের সাথে। বাড়ি ফিরতেই বলে দিলো আজ তারা কোথায় গিয়েছিলো৷ মাহির মা তো বেশ রেগে গেছেন মাহিমের উপর। কিন্তু তার চেয়েও দ্বিগুণ রেগে আছে মাহি। এ বয়সেই তার বিয়ে নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে মা এতোই কি বোঝা হয়ে গেছে সে? রাগে চোখজোড়া লাল হয়ে পানি টলমল করছে কিন্তু মাহি কাঁদছে না৷ শুধু বলে দিয়েছে বিয়ে নিয়ে যদি কোন প্রকার বাড়াবাড়ি হয় তবে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। কোথায় যাবে তা জানে না। চামেলি দমে যাওয়ার পাত্রী নয় এত ভালো সমন্ধ আবার ছেলে ও এমবিবিএস। তার ওপর ছেলের বাবার নিজের হাসপাতাল আছে। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছেলে। এমন প্রস্তাব কেউ ছাড়ে? হোক না মাহির বয়স কম প্রয়োজনে আকদ করে রাখবে দু’বছর সময় নিবে মাহি কলেজ শেষ করতেই উঠিয়ে দেবে।মাহির বাবা মনজুর মোর্শেদ পড়েছেন বিপাকে বউ যা বলছে তা একেবারেই খারাপ নয় কিন্তু মেয়ের ইচ্ছে বলে ও কিছু আছে। শেষ পর্যন্ত মাহির ইচ্ছেই রইলো এ বিয়ে নিয়ে আর কোন কথা উঠবে না। ছেলে নাকি মাহির ছবি দেখে পছন্দ করেছিলো কিন্তু এখন আর কোন কথা হবে না৷
____________________
সাথী আর যুথি আজ কিচেনে সন্ধ্যা থেকে।পায়ে ব্যাথার বাহানায় আজ সে দুই বোনকে জব্দ করেছে। এতটুকুনি মেয়ে এখনি বদলা নেয়। কবে যেন সাথী আর যুথি মিলে ড্রয়িং করেছিলো আর তাকে নাকি কালারস পেন্সিল ধরতে বারণ করেছিলো৷ তাই আজ সাগরকে বলেছে, “বরমশাই আমার পা ব্যাথা করছে “।
–” সেরে যাবে সোনা, আমি তো তোর জন্য মেডিসিন এনেছি বিকেলে৷ এখন কিছু খেয়ে মেডিসিন খাবি তারপর ব্যাথা গায়েব হয়ে যাবে। কি খাবি বল”? এই হয়েছে তিথির সুবিধা৷ সে ও ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছে বলেছে আমার খুব ইচ্ছে করছে সাথীপুর বানানো নুডলস খেতে খুব টেস্টি হয় “।
–” নুডলস খাবি! আমি বলে দিচ্ছি চাচীআম্মা কে এখুনি চলে আসবে তোর নুডলস “।
–” উহুম, আমি সাথীপুর নুডলস খাবো ইয়াম্মি আপুরটা ইয়াম্মি হয় আর কারোটা খাবো না”। তিথি যখন বলছিলো তখন সাথী, যুথি আর শৈবাল সোফায় বসে পপকর্ণ খাচ্ছিলো৷ তিথির কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো সাথী৷ যার অর্থ ভুল করেও সে এখন কিচেনে ঢুকবে না। পপকর্ণই তো ভাবি করে দিয়েছে পরেই না খাওয়া হচ্ছে। কিন্তু তিথি তো আরেক সেয়ানা বাচ্চা সেও গো ধরে রইলো খাবে তো সাথীপুর রান্না নুডলসই খাবে৷ সাগরের কাছে যেহেতু বলেছে সেহেতু সাথীকে করতেই হবে তাই সে আগে ভাগেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো পড়ার ঘরে যাওয়ার জন্য । কিন্তু ভাগ্য মন্দ বেচারীর সাগর ডেকেই উঠলো, ” সাথী নুডলস রান্না করতো আজ তোর রান্না খাবো৷ এক ঘন্টার ছুটি তোর এখন সাড়ে ছ’টা বাজে ঠিক সাড়ে সাতটায় পড়ার টেবিলে যাবি”। মোবাইলে সময় দেখতে দেখতে বলল সে৷ সাথী মনে মনে ইচ্ছেমত গালি দিচ্ছে তিথিকে কিছু করার নেই এখন। “না” বললে ভাইয়া ঠিক কান ছিঁড়ে ফেলবে।
সাথী রান্নাঘরে পা বাড়াতেই সাগর যুথি কে ডাকলো, “যুথি”!
–” জ্বি ভাইয়া”?
–” সাথী না এলে যে তুই পড়তে বসবি না তা আমি জানি৷ তুই তো চা বানাতে পারিস তাই না?” সাগরের বলা শেষ হতেই যুথির মুখের রঙ পাল্টে গেছে। এখন তাকে যে চা বানাতে হবে তা নিশ্চিত।
–” চা”!
–” এমন ভাবে বলছিস যেন আজ প্রথমবার শুনলি! যা চুপচাপ চা বানা আর সবার জন্য বানাবি”।তিথি মহা খুশি আজ সাথীপু, যুথিপু দু’জনে রান্নাঘরে।
_______
মাহির রাগ শেষ হয়ে গেছে বাবা যখন বলেছে এখন বিয়ে নিয়ে কোন কথা হবে না। কিন্তু মাথায় তো কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে তার সেটা কিভাবে বলা যায় বাড়িতে! ভাবতে ভাবতেই বাবা মায়ের ঘরে এসে ঢুকলো মাহি। বাবা চা হাতে কিছু কাগজপত্র ঘাটছিলেন। মা ঘরে নেই এই সুযোগ।
–” কিরে পড়তে বসলি না কেন এখনো “? বাবা কাগজে চোখ রেখেই প্রশ্ন করলেন।
–” আব্বু একটা কথা বলতে এসেছি”?
–” কি কথা”?
–“আম্মু কই”?
–” এটা বলতে এসেছিস”? হাতের কাগজটা বিছানায় রেখে মাহির বাবা তার দিকে তাকালো।
–” নাহ, আব্বু আমি গান শিখতে চাই”।
–” কিহ”?
–” হুম, প্লিজ আব্বু তুমি আম্মুকে বলো না প্লিজ প্লিজ প্লিজ লক্ষী আব্বু”।
–” মাহি তুই কি ভুলে গেছিস তুই এবার ক্লাস টেইনে পড়িস? আর চার মাস পর তোর টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে “? কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বললেন মনজুর সাহেব।
–” আমার মনে আছে আব্বু, আই প্রমিজ পড়াশোনায় কোন গাফিলতি আসবে না”। মাহি খুব জোর দিয়েই বলল এরই মাঝে তার মা ও ঘরে ঢুকে শুনলেন।
–” ফাইজলামি পেয়েছিস? সারাবছর এমনিতেই ঠিকঠাক লেখাপড়া করিস না। ঢং করে নিপার সাথে জোড়া দিয়ে নিয়েছিস সাইন্স সে পড়া ও পারিস না এখন আবার গান”! চামেলি যথেষ্ট পরিমান রেগে আছেন মেয়ের কথা শুনে৷ যে মেয়ে সারাবছর টিউশন এর বাইরে একটু বই ছোঁয় না। সে এখন গান শিখবে বলে পড়াশোনা লাটে উঠাবে। মাহি নাছোড়বান্দা ন্যাকা কান্না শুরু হয়েছে তার।
আজ নয়তো দু’দিন এর মধ্যে সে ঠিক গান শেখা শুরু করবে কিন্তু এখন তাকে ভাবতে হচ্ছে শিখবে কার কাছে? সাদা টি-শার্ট ভাইয়া কে বললে কি তিনি শেখাবে!
___________________
অনলাইনে সাতটা এসি বাসের টিকিট কেটেছে সাগর। কক্সবাজার যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে গেছে মোটামুটি রকমের। পরশু রাতে রওয়ানা হবে৷ কথা ছিলো বারো জন বন্ধু যাবে কিন্তু পাঁচ জন এর যাওয়া ক্যান্সেল হয়ে গেছে বিভিন্ন ব্যস্ততায়। সন্ধ্যায় চা,নুডলস পর্ব সেরে সাগর ফ্রী থাকায় সাথী,যুথি আর সমুদ্রের পড়া চেক করছে সাথে সাথে ট্রিপের টিকিট ও কেটে নিয়েছে৷ দোলা দু’বার এদিকটায় এসে ঘরে গেছে৷ মনে হচ্ছে মেয়েটা কিছু বলতে চায় কিন্তু কোন কারণে বলতে পারছে না। তৃতীয় বার যখন দোলা আবার এলো এদিকটায় সাগর তখন নিজেই ডাকলো, “দোলা তুমি কি কিছু বলবে “? সাগরের ডাকে একটু ইতস্তত করে বলে উঠলো, আসলে হয়েছে কি বসে বসে বোর হচ্ছিলাম। তাই আপু বলল এখানে কোথাও নাকি ভালো একটা রেস্টুরেন্ট আছে একটু ঘুরে আসতাম”।
–” ওহ তো ভাবি আমাকে বললেই পারতো৷ বিকেলে ওদিকটায় বেশ মজাদার ফুচকা, বেলপুরি পাওয়া যায় আবার পার্কে ও যাওয়া যেত বাচ্চা গুলার ও ঘোরাফেরা হয়ে যেত “।সাগর বেশ প্রফুল্ল চিত্তে বললেও দোলার যেন কথা গুলো পছন্দ হয় নি। কারণ সে তো শিলার সাথে প্ল্যান করেই এ সময়ে বাইরে যেতে চেয়েছে। সাগরকে স্টেশনে প্রথম দেখার পরই তার ভালো লেগেছে। কিন্তু সেই ভালোলাগা সে সাগরের চোখে ও দেখতে চায়। কথার ফাঁকে শিলাকে বলেছিলো সাগর খুব হ্যান্ডসাম আর বিশেষ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মনে হয়৷ আর আজ যখন তিথির জন্য তার উপর রেগে গেল তখন যেন দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর কিছু ছিলো তার চেহারায়৷ শিলা কথা শুনেই বুঝেছে দোলা হয়তো সাগরের প্রেমে পড়েছে কিন্তু সাগর খুব কঠিন মানুষ। তাকে পেতে হলে আগে তার মনে ও ভালোলাগার সৃষ্টি করতে হবে। আর তার জন্য একসাথে কিছুটা সময় কাটানো দরকার। সাগর আর দোলা বেরিয়েছিলো একসাথে কিন্তু বেশি সময় একসাথে কাটাতে পারেনি। দোলার মধ্যে সবসময় একটা অহংকারীভাব, টাকার গরম ভাব বিদ্যমান আর সাগরের পারসোনালিটি রাগী,কঠিন যতোটা মানুষের প্রতি দয়াশীল ভাব ও ঠিক ততোটা৷ রাস্তায় কোন গরীব রিকশাওয়ালা দেখলে সাগর তাতে চড়তে চেয়েছে অথচ দোলা নাক সিটকে বলেছে এর চেয়ে ভালো ট্যাক্সিতে যাই। ফুটপাতে কোন ফাস্টফুড দেখে সাগর এগিয়ে গেলে দোলা বলেছে ” ওয়য় ইট’স আনহাইজিনিক এর চেয়ে ব্যাটার রেস্টুরেন্টে ঢুকবো। আমার কাছে টাকা আছে চলুন “। কথাটা সাগরের গায়ে লেগেছিলো। তার নিজের ইনকাম না থাকলেও তার বাবা ভাইয়ের এতটুকু ক্ষমতা আছে সে যে কোন পাঁচ তারা হোটেলে নিজ ইচ্ছেমত খেতে এবং খাওয়াতে পারবে৷ কিন্তু মেয়েটার এই অহংবোধ মোটেও ভালো লাগেনি। অন্তত গত দু’দিন মেয়েটার চেহারা দেখে যে পরিমাণ মুগ্ধ হয়েছিলো আজ তার মন বুঝে ততোটাই তিক্ততা অনুভব করেছে৷ বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে গিয়ে মনে মনে ঠিক করেছে এই মেয়ে কিংবা এর মত কোন মেয়েকে নিয়ে সে ভুল করেও ভালোলাগার কথা ভাববে না।
__________________
কাল রাতে বেশ খানিকটা সময় মায়ের সাথে ঘ্যানঘ্যান করেছে মাহি৷ তবুও যখন গান শেখার জন্য অনুমতি পাশ করাতে পারেনি তখন সে চালাকি করে বড় খালামনিকে ফোন করেছে৷ আর এখানেই তার কাজ হয়ে গেছে৷ বড় খালামনি বলে দিয়েছে প্রয়োজনে লেখাপড়া ছেড়ে দেবে তবুও ওর গান শেখা নিয়ে ঝামেলা হবে না। সে চাইছে তবে অবশ্যই শিখবে৷ নিরব তার মায়ের কথায় বিরোধিতা করলেও বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত নিজের মায়ের আর মাহির জেদের জন্য বলেছে মাহির মায়ের কাছ থেকে অনুমতি সেই নিয়ে দিবে হয়েছেও তাই। কিন্তু মাহি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছে না। আজকাল তার যে প্রবলেমই হোক না কেন বড়খালামনি কে বললেই সমাধান হয়ে যায় এমনকি খালামনি নিজেই সবাইকে বলেছে মাহি যেন কোন ব্যাপারেই মন খারাপ না করে। কিছু তো আছে রহস্য!
চলবে
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)