শব্দহীন_বৃষ্টি (৮)

0
1020

শব্দহীন_বৃষ্টি
(৮)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
__________________________
অস্পষ্ট দেখায় কাউকে এতোটা ভালো কি করে লাগতে পারে? মাহি জানে না শুধু জানে সেদিন রাতে দেখা পাশের বাড়ির সাদা টি-শার্ট ভাইয়া তার কিশোরী মনে এক অজানা আলোড়ন তৈরি করেছে। আজ ও ম্যাথ টিচার আসবে না সেই সুযোগে মা’কে নিয়ে যাবে ও বাড়ি।

–” আম্মু আজ কিন্তু সন্ধ্যায় আমরা সাগ… সাথীদের বাড়ি যাবো”।

–” কোন সাথী”? মাহির মায়ের প্রশ্ন।

–” ওই যে ও বাড়ির সাথী। হাওয়া দাদুনীর নাতনি।”

–” ওহ, তাদের বাড়ি কেন যাবো”?

–” ভুলে গেলে গান শিখতে যাবো তো”।

কাল টিফিন আওয়ারে মাহি আর নিপাকে স্কুলে ঢুকতে সাহায্য করেছে সমুদ্র । ইশারা দেখেই সে বুঝেছিলো কি ঘটেছে। প্রথমে ভেবেছিলো তাদের ধরা খাওয়াবে। শেষ পর্যন্ত মাহির মুখের দিকে তাকিয়ে সবটা এলেমেলো হয়ে গেল। রোদে লাল হয়ে যাওয়া গাল দু’টোতে চোখ পড়তেই তার কিশোর মনে এক অনুভূতির তীব্র ধাক্কা লেগেছিলো। আর মুহুর্তেই মন বদলে দাড়োয়ানকে গেইট থেকে সরিয়ে নিয়েছিলো কোন বাহানায়। যাওয়ার সময় একটু বুদ্ধি খাটিয়ে গেইট খুলিয়েছিলো আরেক বন্ধুকে দিয়ে৷ ছুটির সময় ধন্যবাদ জানানোর সুবাদে মাহি কথা বলেছে সমুদ্রের সাথে। এক ফাঁকে জেনেছিলো সাগর গান শেখাবে কিনা? যতদূর জানা গেল ও বাড়িতে গানের শিক্ষক সাদা টি-শার্ট ভাইয়ার মা মানে সমুদ্রের জেঠি মা। শিখতে চাইলে তাকে জোর করা যায়। অনেক ভেবে মাহি বলেছে তবে সে ও শিখবে সাগরের মায়ের কাছেই। আর তাই কাল স্কুল থেকে এসেই মায়ের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে ও বাড়ি যাবে বলে। নিরবকে কাল বলতেই বড় খালামনি নিজে চামেলিকে ফোন করেছিলেন। মাহি যা চায় তাই যেন করে৷ মাহির মা প্রথমে রহস্যজনক ভেবেছিলো বড় বোনের এহেন আচরণ কিন্তু এরপর খুবই বিরক্ত । মেট্রিক পরীক্ষার্থী মেয়ে জেদ ধরেছে গান শিখবে আর তিনিও তাতে সায় দিচ্ছেন৷ সুস্থ জ্ঞান সম্পন্ন কোন ব্যক্তি কি বলবে এমন কিছু? চামেলির তা মনে হয় না৷

তিথির পায়ের ব্যাথা সেরে গেছে কাল রাতেই। সকাল থেকেই দৌড়াদৌড়ি করে বাড়ি মাথায় করে রেখেছিলো। সন্ধ্যে হতেই সাগরের চোখ রাঙানিতে পড়তে বসেছে। মাস্টার্স এর ক্লাস করবে কি করবে না তাতে মনস্থির করতে পারেনি সাগর তাই আজকাল বাউণ্ডুলে হয়ে দিনভর আড্ডা দিয়ে সময় কাটায়। তবে বাবার নির্দেশে আড্ডার সাথে সাথে সন্ধ্যে হলে বাড়ির সব গুলো ছেলেমেয়ের পড়া চেইক করার দ্বায়িত্ব তার ঘাড়ে৷ আজও বসেছে পড়াতে তখনই আগমন ঘটে মাহি আর তার মায়ের৷ স্টাডি রুম নিচ তলায় ড্রয়িংরুমের পাশেই হওয়ায় সোফা থেকেই শোনা যাচ্ছে ছেলে মেয়ে গুলোর পড়ার শব্দ। ফাঁকে ফাঁকে কানে আসছে সাগরের ছোট বড় হুংকার।

–“আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন ভাবিরা “? মাহির মা চামেলি সালাম দিয়ে প্রশ্ন করলো সমুদ্র আর সাথীর মা’কে৷ সোফায় বসে সাথীর মায়ের মাথায় তেল লাগাচ্ছিলেন তিথির মা তাহমিনা। চামেলিকে দেখে দু’জনেই হাসি হাসি মুখে সালামের জবাব দিলেন। কুশল বিনিময়ের মাঝে উপস্থিত হলেন সাগরের মা৷ তিনিও হাসি মুখে ভালমন্দ জিজ্ঞেস করলেন৷ মাহিকে দেখেও সবাই বেশ সওয়াল-জওয়াব করে ফেলেছেন৷ মেয়ে বড় হয়ে গেছে মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর হয়েছে আগের থেকে আরো কত কি। কিছুক্ষণের মধ্যেই জমে গেল মহিলাদের আড্ডার আসর। খুশি হয়েছেন সকলেই বহুদিন বাদে পাশের বাড়ির ভাবী আসায়। মাহির আড্ডা ভালো লাগছিলো তবুও মনে অস্থিরতা ও বাড়ছিলো৷ হুট করেই চলে এসেছে গান শেখার আবদার নিয়ে৷ একটিবারও ভেবে দেখেনি গান কেন শিখবে আর সাগরের মা আদৌ তাকে শেখাবেন কিনা? তার তো কন্ঠ গান শেখার মত ও নয় তবে এত কেন আগ্রহ! মনের ভেতর হঠাৎই উদ্বেগ শুরু হলো ” সাগর কই” ভেবেই৷ সে কি এখানে ওই ব্যক্তিটাকে দেখতেই এসেছে? নাকি গান শেখার আগ্রহ থেকে? অবশ্য ভেতর ঘর থেকে আওয়াজ ভেসে আসছিলো কারো ধমকের ওটা সাগরই হবে হয়তো। মনকে প্রশ্ন করে উত্তর মেলে না। শুধু মনে হচ্ছে মা এখানে আসার কারণটা ভুলে গেছে একটিবার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার৷

–” মা” বলে ডেকে উঠলো মাহি।

–” কি “?

–” বলো” ইশারা করলো মাহি তার মা’কে৷ সবাই কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মাহির ইশারা পেয়ে তার মা বলতে লাগলো, ” ভাবী আমি এসেছিলাম আবদার নিয়ে”। সাগরের মা শামসুন্নাহার এর উদ্দেশ্যে বললেন চামেলি।

–“আবদার”! অবাক হলেন খুব সাগরের মা।

–” হ্যা ভাবী আবদার,অনুরোধ দু’টোই বলতে পারেন”। কথার মাঝেই উপস্থিত হলেন হাওয়া বেগম। মাহি দাদুনীকে দেখেই আগে একটা লম্বা করে সালাম দিয়েছে। সে ভালো করেই জানে হাওয়া বেগম সালাম দেওয়া মানুষকে কতোটা পছন্দ করে। আবদারের কথা শুনে শামসুন্নাহার প্রশ্ন করলেন, “কিসের আবদার”?

–” গান শেখানোর” মাহির ঝটপট উত্তর৷

–” ওহ, কিন্তু আমিতো গান শেখানো ছাড়ছি প্রায় অনেকদিন”।কথাটা শুনেই মাহির মন খারাপ হলো। দাদুনী খেয়াল করেছেন আর তাঁর মোটেও ভাল্লাগে নি বাচ্চা মেয়েটার মন খারাপ করা। নিজেই বললেন, ” কি এমন কাম আছে তোমার কও দেখি? আজাইরা বইয়া না থাইকা পরত্যেক দিন এট্টু কইরা মাইয়াডারে গান শিখাই ও লগে তিথিরে ও “। শ্বাশুড়ির কথায় শামসুন্নাহার আশ্চর্য হয়ে তাকালেন। যেন এমন কথা জীবনে তিনি দ্বিতীয়টি শোনেন নি। বাড়ির প্রতিটা কাজের দায়ভার তার উপর অথচ শ্বাশুড়ি বলে কিনা তিনি আজাইরা সময় কাটান”! কিন্তু শ্বাশুড়ির মুখের উপর কখনো কিছু বলেন নি তাই আজও চুপ রইলেন। ঠিক হলো গান শেখাবেন তবে সময়টা বিকেলে হবে আর খুবই অল্প সময়। মাহির পরীক্ষার পর অনেক সময় থাকবে তখন না হয় বেশি সময় নিয়ে শেখাবেন।

সাগর সবাইকে পড়া দিয়ে একটু বের হচ্ছিলো। আজ সিগারেট খুব টানছে তাকে৷ চেইনস্মোকার না হলেও ডেইলি একটা কি দু’টো সিগারেট তার খেতেই হয়। গত দু’বছরে হয়েছে এই সিগারেট এর অভ্যাসটা। প্রথমবার ব্রেক আপ হওয়ার পর খেয়েছিলো সেই থেকেই খায় তবে লুকিয়ে। বাবা, ভাই কিংবা পরিবারের অন্য কেউ জানে না এই ব্যপারটা। স্টাডি রুম থেকে বের হতেই সোফায় চোখ পড়লো। সকালের সেই মেয়েটা বসে আছে সাথে মনজুর আঙ্কেল এর ওয়াইফ৷তবে এতে সাগরের তেমন কোন ভাবান্তর হলো না। মাহিকে সে কখনো দেখেছে বলেও মনে হলো না তার দৃষ্টি দেখে। সামনে দিয়ে যাবার সময় মাহির মা’কে সালাম দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। চামেলি বেগম ভালো করে তাকে দেখেই বলে ফেলল, ” মাশাআল্লাহ সাগর তো একদম বড় হয়ে গেছে৷ একেবারে জেন্টেলম্যান”। মায়ের মুখে সাগরের প্রশংসা শুনে মাহির কি হলো কে জানে, আনমনেই হাসলো সে । কেন হাসছে তা জানে না।

বাড়ি ফিরেই খুশিতে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে লাফাচ্ছে মাহিয়া। কাল থেকেই গান শিখবে ও বাড়িতে গিয়ে। “ইশ, কাল থেকে রোজ দেখবে সেই অস্পষ্ট ব্যক্তিটাকে। ধ্যাত কি অস্পষ্ট বলছি আমি আজই তো স্পষ্ট দেখলাম উনাকে৷ কন্ঠ শুনে যতোখানি মুগ্ধ হয়েছিলাম দেখার পর ওনাতেই বিভোর থাকতে ইচ্ছে করছে”। বিড়বিড় করে এমন ধারা কতশত কথা বলছে মাহি আপনমনে। দিন দুনিয়ার সকল খেয়াল তার লোপ পেয়েছে। সব কিছুই কেমন যেন বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে যাচ্ছে আজ। মায়ের কড়া আদেশ গান শিখতে হলে মেট্রিক এর রেজাল্ট গোল্ডেন আসতে হবে। সবই ঠিক শুধু সমস্যা ম্যাথ টিচার নেই গ্যাপের কারণে চর্চা হচ্ছে না। যদি পরীক্ষায় খারাপ করে? এই ভাবনা মাহিকে আরো উত্তেজিত করে দিচ্ছে। রাতের খাবার খেয়ে নিজের ঘরে ফিরেছে মাহি। এক এক করে ম্যাথ নোট’স, খাতা, বই সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে বিছানায়। যে করেই হোক তার পুরো মন এখন শুধু পড়াশোনায় নিবদ্ধ থাকবে। কিন্তু কেন? গান শিখতে নাকি ও বাড়ির সাদা টি-শার্ট ভাইয়াকে দেখতে! গড়মিল হয়ে যাচ্ছে মাহির ভাবনায়।

রাত যখন এগারোটা সাগর তখন বসে বসে লাগেজ গোছাচ্ছিলো। কাল কক্সবাজার যাওয়ার ডেইট। আলমারি থেকে প্রয়োজনীয় কাপড় বের করতে গিয়ে মনে পড়লো আবার সেই ডায়েরির কথা। মনে পড়লো আধো দেখা আদলখানির কথা। কি মিষ্টি হাসি ভরা ঠোঁট দু’টো। এই প্রথম কারো হাসি মাখা ঠোঁট আর মায়াবী চোখ সাগরকে আকৃষ্ট করেছে। ভার্সিটিতে প্রথমবার প্রেমে পড়েছিলো সে লিমা নামের এক জুনিয়র মেয়ের। সেই মেয়ে গাইতো খুব ভালো আর সম্পর্কের শুরু গানের মাধ্যমেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই গায়িকা টিকতে পারেননি নিজের কন্ঠের মাধুর্যে সে অহংকারী হয়ে ছিলো। পরবর্তী তে আরো একজনের সাথে প্রেম করেছিলো। সেই মেয়েটি ও টিকলো না বেশিদিন। রাগী সাগরের সাথে পায়ে পা মেলানো হয়ে উঠেনি তার তাই অচিরেই বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিলো। ওই দু’জনের একজনও সাগরের মনে বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেনি। কিন্তু এই অজানা অচেনা ডায়েরির মেয়েটি একদম মেজেশিয়ান এর মত জাদু করে ফেলেছে তাকে। সাগর যখন এগুলো নিয়ে চিন্তার সাগরে ডুবেছে তখন মনে হলো মেয়েটি কিশোরী না যুবতী তাই তো বেঝা যায় না ছবিটি দেখে।

সমুদ্র বসে আছে শিমুল গাছের নিচে আর তার মুখোমুখি বসে আছে মাহি। মনের সুখে দু’জন একে অপরের হাত মুঠোয় পুরে গল্প করছে। ভালোলাগার গল্প একটু একটু ভালবাসার গল্প। মধ্যরাত, ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলো সমুদ্র। এ কেমন স্বপ্ন দেখলো সে?

চলবে
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here