শব্দহীন_বৃষ্টি (৯)

0
1008

শব্দহীন_বৃষ্টি
(৯)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________
মধ্যরাত, জোৎস্নালোক পূর্ণ সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সাগরের নগ্ন পায়ে। সাগরপাড়ে চাঁদের স্নিগ্ধ কোমল আলোয় গা ভাসাতে হোটেল রুম ছেড়ে বেরিয়েছিলো সাত বন্ধু। সমুদ্রতীরে এলোমেলো হাওয়া আর চাঁদের শুভ্র আলোয় হঠাৎ করেই সাগরের মনে পড়লো গোলাপি রঙা সেই ডায়েরির কথা৷ ডায়েরির পশ্চাৎপিঠে থাকা সেই অর্ধছবির সেই মানবীর কথা। কি আশ্চর্যরকম সুন্দর এক অনুভূতির টের পাচ্ছে সে। ছয় বন্ধু একটু দূরেই কিছু একটা নিয়ে বেশ শোরগোল করছে অথচ সাগর নির্বিকার দূরে দাঁড়িয়ে সেই স্বপ্ন কুমারীকে কল্পনায় দেখার চেষ্টা করছে।

–” কি মামাহ দেবদাসের মত খাড়াইয়া কি চিন্তা করতাছো”? জুয়েল এগিয়ে এসে ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করলো সাগরকে। বাকিরা ও এদিকে আসছে। অপ্রস্তুত হয়ে সাগর বলল, ” সেই ছবিটা পুরো কেন ছিলো না”?

–“কোন ছবি!”

–” কিছু না, তোরা কি নিয়ে এমন চেঁচামেচি করছিলি”?

–“একটা কচ্ছপ পাইছে সুমন। ওইডারে ধইরা কি কি যে শুরু করছে শালারা৷ মনে হয় জীবনে কচ্ছপ আর দেখে নাই “।জুয়েল এর কথার মাঝে বাকি বন্ধুরা ও চলে এসেছে এদিকে। কাল সেন্টমার্টিন যাবে তা নিয়ে কথা তুলেছে। কথার মাঝেই সাগরের ফোন বাজলো৷ স্ক্রীণে নম্বর অপরিচিত। সাগর একবার সময় দেখলো রাত একটা পঁয়তাল্লিশ। এতো রাতে কে হবে ভাবতে ভাবতেই ফোন রিসিভ করে সালাম দিলো৷ ওপাশ থেকে নারীকন্ঠে সালামের জবাব ভেসে আসলো। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো কন্ঠস্বরের ব্যক্তিটিকে চিনতে৷

–” কেমন আছেন? আর এতো রাতে! ঘুমাননি?” সাগর প্রশ্ন করলো দোলাকে।

–” আছি ভালো। এত রাতে কল করে কি ডিস্টার্ব করলাম? আর তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর ” ঘুমালে নিশ্চয়ই ফোন করতাম না”।

–” তা ঠিক”। সংক্ষেপে জবাব দিলো সাগর৷ বন্ধুরা এখন ও হৈ চৈ করছে তাই সাগর হেঁটে একটু দূরে সরলো আবার।

–“কক্সবাজার ট্রিপ কেমন কাটছে”?

–” এই তো আলহামদুলিল্লাহ “।

–” আপনি নিশ্চয়ই ঘুরছেন এখনও “?

–” হ্যা”।

–“জিজ্ঞেস করলেন না কি করে বুঝলাম”? সাগর একটু করে হাসলো। নিঃশব্দ সে হাসি যা ওপাশের ব্যক্তির কর্ণকুহরে পৌঁছায় নি৷ “সমুদ্রের গর্জন শুনে টের পেয়েছেন আমি এখন বিচে”।

–” ওয়াও আপনি তো বেশ বুদ্ধিমান লোক “।

–” বেশ বুদ্ধিমান কিনা জানি না তবে বুদ্ধিমান অবশ্যই বলতে পারেন৷ আর এখন যে কারণে বুদ্ধিমান বলছেন সেটা সহজ সরল মানুষ ও সহজেই ধরতে পারতো।” সাগর বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলে গেল।

–“কি করে”?

–” নিস্তব্ধ রাতে সমুদ্রের গর্জন দিনের কোলাহলের চেয়েও বহুগুণ বেশিই শোনা যায় “।এতখানি কথা শেষ করার পর আর কথা খুঁজে পেল না সাগর৷ পায়নি দোলা ও তাই কিছু সময় চুপ থেকে কল কাটলো তারা।

আজ দু’দিন হলো মাহি গান শিখতে আসে। কিন্তু এখানে আসার কারণ সে ঠিকঠাক ধরতে পারছে না। পরশু কত উৎসাহ নিয়ে বলে গেছে গান শিখতে আসবে৷ কিন্তু কাল এখানে আসার আধ ঘন্টা পরই সকল উৎসাহ মিলিয়ে গেল। গানের দিকে কোন খেয়ালই তার নেই৷ বারবার এদিক ওদিক তাকিয়ে সারাক্ষণ কি যেন খুঁজতে থাকে৷ কি খোঁজে তার দু’চোখ নিজেও বুঝতে পারছে না। প্রথম দিন আন্টি মানে সাগরের মায়ের সাথে গল্প করেই সময় পার হয়েছিলো৷ বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় শুধু মনে হয়েছে সাদা টি-শার্ট ভাইয়া কি বাড়িতে নেই? কিন্তু আজ একটু আগেই সে এ বাড়ি এসেছে। তিথি আর সাথীর সাথে আড্ডা দিচ্ছে৷ আর এই আড্ডার মাঝেই ফোন কানে ড্রয়িং রুমে এসেছে যুথি।হাতের ফোনটা সাথীর দিকে এগিয়ে দিলো, ” আপু ধর সাগর ভাইয়া কথা বলবে “।
সাগর নামটা শুনেই মাহি তাকালো যুথির দিকে৷ কান তার সজাগ সাথীর কথা শুনতে৷ কি বলে সাগর তা বুঝতে চেষ্টা করবে।

–” হ্যালো ভাইয়া বলো”।

–” ফাজিল মেয়ে সালাম কে দিবে”। ধমকে উঠলো সাগর।

–” স্যরি, আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া “।

–” ওয়ালাইকুম আসসালাম। আচ্ছা বল তো তোদের তিনটার জন্য কি শামুকের মালা আনবো নাকি বার্মিজ জুতো আনবো”?

— ” মালা আর জুতো ছাড়া আর কিছু নেই ভাইয়া “?

–” আছে তো অনেক কিছু কিন্তু তোদের তিন জনের জন্য একরকম এগুলোই ঠিক মনে হলো”। সাগরের কথা শুনে সাথীর মুড অফ হলো৷ এবার ও তিনজনের জন্য একরকম জিনিস আনবে, ভাল্লাগে না৷ প্রতিবারই সাগর যাই আনে তিন বোনের জন্য সেইম । অথচ সাথীর ভালো লাগে না একরকম সবসময়৷

–” ভাইয়া তোমার যা ভালো লাগে তাই নিয়ে এসো “।যুথি বুঝলো ভাইয়া কি বলছে তাই সে ফোনের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ” ভাইয়া আমার জন্য শামুকের গহনা আনবে প্লিজ”। সাথী ও তাই বলে দিলো৷ মাহি পাশেই বসা দেখে সাথী আবার বলল, ” ভাইয়া একটা জিনিস চাইবো”?

–“আবার কি”?

–” আমাদের জন্য যা আনবে তা কি চারটা এনে দিবে? একজনকে গিফট করবো”।

–“ওরে সেয়ানা সুযোগ পেয়ে আমায় ফকির বানাবি? তোদের জন্য আনছি তাতে হবে না আবার কাউকে গিফট ও করতে হবে, রাখ ফোন ” বলেই সাগর কল কাটলো। সাথীর খারাপ লাগেনি সে ভালো করেই জানে ভাইয়া মুখে না বললে ও নিয়ে অবশ্যই আসবে।

মাহি আজ প্রথম সা রে গা মা পা গেয়েছে। বলতে গেলে কথা বলার মত করে বলেছে৷ গান তার জন্য নয় এটা সে প্রথম চেষ্টায়ই মেনে নিয়েছে। কিন্তু সাগরের মা মানুষটা অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল। তিনি খুব ভালো করে বুঝিয়েছেন মাহি পারবে গাইতে শুধু একটু সময় আর পরিশ্রম লাগবে।কোন কাজই প্রথমবারেই ঠিকঠাক হয় না। মাহির ভালো লেগেছে উনার বলা কথা গুলো। এছাড়াও বেশ ভালো সময় কেটেছে এ বাড়িতে খারাপ শুধু লেগেছে তার চোখজোড়ার। কাঙ্ক্ষিত কোন কিছু দেখার সাধ যেন তার অপূর্ণ ছিলো যা মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সাথী,যুথির মুখে জানতে পেরেছে সাগর দু’দিন আগে কক্সবাজার গিয়েছে আর তাই জিজ্ঞেস করেছে তাদের জন্য কি আনবে। রাতে বাড়ি ফিরে মাহি মন দিয়ে পড়াশোনা ও করেছে নয়তো মা গান শিখতে দিবে না। রাতে নিরব কল করতেই জানতে পারলো নিরবের কাল কনসার্ট আছে। তাদের গ্রুপ এর ছেলেরা এলাকায় একটা কনসার্ট রেখেছে। বলে রাখা ভালো, নিরব ভালো গিটারিস্ট কিন্তু গানের গলা মোটামুটি ।নিরবের কনসার্টের কথা শুনে মাহি অবাক হয় কারণ নিরব ভাইয়া অনেকদিন যাবৎ কোন কনসার্ট করেনি। নিরবই আবার বলল, ” জানিস মাহি আমাদের কনসার্টের মেইন গিটারিস্ট আর সিঙ্গার যে সিনিয়র ভাইয়াটা তিনি তোদের এলাকার। কিন্তু আফসোস উনি নাকি আসতে…… ” নিরবের কথা কমপ্লিট হওয়ার আগেই কল কেটে গেছে। ব্যালেন্স শেষ নিরবের। মাহিও আর কল ব্যাক করেনি ভেবেছে ভাইয়া নিজেই আবার কল করবে পরে৷ রাতটা মাহির নির্ঘুম কাটলো এই ভাবনায় সে সাগরকে দেখতে ছটফট করলো কেন আজ? মাত্র একদিন অস্পষ্ট দেখায় এমন কি ছিলো যার জন্য এখন রোজ রোজ সে অপেক্ষা করে সাগরকে দেখতে? সাগর কম করে হলেও বয়সে তার থেকে ছয়-সাত বছরের বড় হবে। একজন প্রতিবেশি ভাইয়াকে দেখার জন্য ছটফট কেন করতে হবে? রাত তার কাটল এভাবেই কিছু অযৌক্তিক চিন্তা ভাবনায়।

রাতের স্বপ্ন দেখার পর সমুদ্র ও আর ঘুমাতে পারে নি৷ সকালে বিছানা ছেড়েই ব্রাশ হাতে ছাঁদে এসে দাঁড়িয়েছে৷ মাহিদের দোতলায় চোখ মেলে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে ছিলো কিন্তু চোখে পড়েনি মাহিয়া নুর এনি। স্বপ্নটা বড্ড বাজে ছিলো শেষে কিনা ক্লাসমেট এর উপর তার নজর আটকালো! ছি, এর চেয়ে ঢের ভালো ক্লাস এইটের তিন্নি। মেয়েটা রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে সমুদ্র কে দেখে। সে খবর সমুদ্র শুনেছে বন্ধুদের কাছ থেকে। কিন্তু এ বয়সে কোন মেয়ের দিকে নজর দিতে চায় না সে৷ সৈকত ভাইয়া বলেছে, ” উল্টা পাল্টা কিছু কানে আসলে কান ছিঁড়ে ফেলবে। আর সাগর ভাইয়া বলেছে জামা কাপড় খুলে সাত রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে রাখবে। ছি ছি মান সম্মান কিচ্ছু থাকবে না। আর ভাইয়া যেই ঘাড় ত্যাড়া লোক শেষে দেখা যাবে সত্যিই এমন করছে” । সমুদ্র উল্টো পায়ে ছাঁদ থেকে নেমে দ্রুত পায়ে নিচে গেল কথাগুলো মনে করেই যেন সাগর এখনই তাকে এই নিষিদ্ধ শাস্তি দিতে চলে এসেছে।

স্কুলে বসে মাহি আজ একটা অংক করছে নিপার কাছে। অংকের শিক্ষক ছুটিতে থাকায় তার কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তাই নিপা যতটুকু পারে বুঝিয়ে দিচ্ছে৷

–” প্রেম কেমন রে নিপু”?

–” হোয়াট”! ভীষনরকম চমকালো নিপা এই প্রশ্ন শুনে।

–” এমন করে চেঁচাস কেন”?

–” প্রেম কেমন এটা কেমন প্রশ্ন “?

–” যেমন তুই শুনছিস। এবার উত্তর দে”।

–” আমি কি করে বলবো আমি কি দু’একটা প্রেম করেছি নাকি”?

–” ভালো তো বাসিস সেটা কেমন”? খাতার উপর কলম চালানো বন্হয়েছে মাহির। এবার উদাস গলায় প্রশ্ন করলো । কিন্তু মন মতো জবাব সে পেলো না নিপার কাছে।

–” ভালোবাসা৷ ও জানি না আমি কেমন হয়”।

–“মিথ্যা কেন বলিস? ভালোবাসা না জানলে তুই সমুদ্রকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখিস কেন”? মাহির এবারের প্রশ্নে বেশ অপ্রস্তুত হলো নিপা। বান্ধবী যে তার অনুভূতি এতোটা গভীরভাবে জেনে গেছে তা টেরই পায়নি মেয়েটা।

–” কি যা তা বলছিস আমি কাউকে ভালোবাসি না “। জোর গলায় বলতে চাইলো নিপা কিন্তু গলা থেকে শব্দটা বের হলো না। শুধু বলল, ” তোকে কে বলল এসব”?

–” কেউ বলেনি আমি বুঝতে পেরেছি “।

–” কি বুঝেছিস”?

–” তুই সমুদ্রকে ভালোবাসিস। প্রতি মিনিটে কমপক্ষে পাঁচ সাত বার ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাস যেদিকে সমুদ্র বসে। সাইন্স গ্রুপ তুই ডাক্তার ইন্জিনিয়ারি হবি এই ভেবে নিস নি। নিয়েছিলি সমুদ্র নিবে শুনে। ক্লাসে কখনো সমুদ্র উপস্থিত না থাকলে তোর আর ক্লাসে মন বসে না। যেদিন সমুদ্র কোন টিচারের কাছে মার খায় তুই ও সেদিন ইচ্ছে করে মার খাস। এমন ও দিন গেছে যখন তুই পড়া পারা সত্বেও পড়া দিস নি শাস্তি পাওয়ার জন্য । এমনকি তুই ক্লাস এইটের তিন্নির উপর ও কড়া নজর রাখিস কারণ মেয়েটা সমুদ্র কে প্রপোজ করেছিলো”। নিপার দিকে না তাকিয়েই গড়গড় করে সব গুলো কথা বলেই মাহি চুপ হলো৷ একটিবার তাকিয়ে দেখলো না তার বলা কথাগুলো শুনে নিপার চোখমুখের অভিব্যক্তি কতখানি পাল্টে গেছে। তাকিয়ে দেখলো না তার এত প্রিয় বান্ধবীটি কতখানি আশ্চর্য হয়ে তাকে দেখছে।মাহির যেন মনেই হলো না একটিবার তাকানো দরকার পাশে বসে থাকা মেয়েটিকে বরং সে আরো একবার মুখ খুলল, ” আমি মনে হয় কারো প্রেমে পড়েছি নিপু ভালোলাগার শুরু না হয়েই ভালোবাসার পর্যায়ে চলে গেছি। মাত্র একদিনের অস্পষ্ট দেখায় অথবা মনমুগদ্ধকর কন্ঠ শুনে কাউকে ভালোবেসে ফেলেছি। ”

চলবে
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here