শরৎের_তৃতীয়_দিবস,পর্ব-০১

0
240

#শরৎের_তৃতীয়_দিবস,পর্ব-০১
#Tahmina_Akhter

— ম্যাডাম, সর্ব’নাশ হইয়া গেছে। খালাম্মায় আমরণ অনশনে বইছে। আপনে যতক্ষণ অব্দি তার সিদ্ধান্তে রাজি না হইবেন ততক্ষণ অব্দি তিনি কোনো কিছুই খাইবেন না। এমনকি এক কাপ চা না। ম্যাডাম, খালাম্মার কষ্ট দেইখা আমার কষ্টে বুকটা….

মোবাইলটা রেখে দিলাম। খালা যেমন তেমনই ব’লদ একটা সঙ্গে রেখেছে। যেভাবে নাচায় সেভাবে নাচে। বিরক্তিকর শ্বাস ছেড়ে ডেস্কের ওপর থেকে ব্যাগটা নিয়ে রওনা হলাম খালাকে দেখার উদ্দেশ্য। আমার জন্য যখন এতকিছু তখন না যেয়ে কি পারি??

বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম খালা দিব্যি পায়ের ওপর পা তুলে বসে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। খালাকে এমন অবস্থায় দেখব মনে মনে এমনটাই ভেবেছিলাম তাই অতটা অবাক হইনি। কাঁধের ব্যাগটা সোফায় রেখে বসলাম। ততক্ষণে আমার খালার পার্সোনাল সেক্রেটারি জনাব জাকির হোসেন আমার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন,, আমি ওর হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে টি-টেবিলের ওপর রাখলাম৷ তার হাতের দেয়া পানি আমি কেন খেলাম না এটা নিয়ে তাকে কিছুটা হতাশ দেখাচ্ছে। কিন্তু,, আমার কি? সে যে খালার কথায় আমাকে এতদূর অব্দি এভাবে টেনে এনেছে এটা কি ঠিক করেছে?

— ছেলে তোর ব্যাংকে চাকরি করছে ; তোরই কলিগ। তোকে বারবার বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাত্তা না পেয়ে আমার কাছে এসেছে সাহায্যের জন্য। ছেলের কথাবার্তা চমৎকার। তোর দিক থেকে বিবেচনা করলে সে তোর জন্য পার্ফেক্ট।

খালা আমার ওপর পাশের সোফায় বসে কথাগুলো বললেন। আমি চুপ করে সবকথা শুনছি।

— সে আমার কলিগ,, কথাবার্তা চমৎকার উপস্থাপন করতে পারে তাই তোমার কাছে মনে হচ্ছে সে আমার জন্য পার্ফেক্ট। কথাবার্তায় কুপোকাত করতে পারা মানুষ গুলো বড্ড ভয়ংকর হয়। সোজাসাপটা,,ধারালো কথা বলতে পারে এমন মানুষ খুঁজে এনে তোমার বলদকে দিয়ে আমাকে কল করে জানিয়ো। ফারদার,, এর আগে আমাকে কল করে বিরক্ত করবে না। কারণ,, বিয়ে নামক জোরজবরদস্তির ব্যাপারটা আমার কাছে জঘন্য মনে হয়।

মেহের কথাগুলো বলে কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে বাড়ির বাইরে চলে যাচ্ছে। রুমানা সেইদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। কাপে থাকা অবশিষ্ট চা শেষ করলো। আয়েশ করে পা দিটো গুটিয়ে সোফায় বসলো। জাকিরকে ইশারা করলো পানের বাটা দেয়ার জন্য। জাকির টি-টেবিলের ওপর থেকে পানের বাটা এগিয়ে দিলো। রুমানা পানের বাটা থেকে পান নিয়ে খুব সুন্দর করে একখান পান সাজিয়ে রাজকীয়ভাবে মুখে পুরলো৷

— ম্যাডাম,, আপনে হইছেন আমার আম্মার মতো। যা কিছু করেন তাতেই একটা রাজা রাজা ভাব থাকব। আমার তো শরীরের ঘাম ছুইটা গেছে। এভাবে তো মনে হয় বাদশাহ শাহাজাহান তার মুখে পান পুরে নায়!

জাকিরের কথায় রুমানা আশাহত হলেন। বিরক্ত হয়ে পানের বাটা জাকিরের হাতে দিয়ে বললেন,,,

— কথা একটু কম বলবা। তুমি অতিরিক্ত কথা বলো। যেখানে যতটুকু দরকার ততটুকু বলো না। আর যেখানে দরকার নেই সেখানে মশলাপাতি লাগিয়ে বলতে থাকো।

জাকির জিহবায় কামড় দিয়ে দুগালে থাপ্পড় দিয়ে বলছে,,,

— তওবা তওবা ম্যাডাম। জীবনেও আর এমন ভুল হইব না।

রুমানা কিছুই বললেন। মোবাইল হাতে নিয়ে তিনিও ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন।

জাকির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু একটা কথাই ভাবছিল আসলে সে কোথায় কম বেশি কথা বলে ফেলেছে? ম্যাডাম যতটুকু শিখিয়ে দেন ততটুকুই বলে। হয়তো অভিনয়টা মন দিয়ে উজার করে ঢেলে দেয় তাই হয়তো… স্বপ্ন তো ছিল নায়ক হবার কিন্তু গরীব ঘরের ছেলে দেখে আজ স্বপ্ন স্বপ্ন রয়ে গেছে। কিন্তু,, অভিনয়টা রয়ে গেছে সেই আগের মতো। সুযোগ পেলে অভিনয়ের জন্য জান-প্রাণ ঢেলে দিতে কার্পন্য বোধ করবে না।

নিজের ভাড়া বাসায় এসে দম ছাড়লো মেহের। পুরো রাস্তা জুড়ে মেহেরের কেমন হাসফাস লাগছিল! কাউকে বিয়ে করার কথা উঠলে মেহের নার্ভাস ফিল করে। কারণটা জানা আবার অজানা। রুমে ঢুকে ব্যাগটা খাটের ওপর রেখে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পরলো। চোখদুটো চলন্ত ফ্যানের দিকে। চোখে পুরনো স্মৃতি,, মনে সেই একজনের নাম,, ঠোঁটে তার নাম অনবরত উচ্চারণ করা সবটাই সেই আগের মতো আছে। কিন্তু,, সেই মানুষটা তার নয়। সে অন্য কারো। মেহেরের আপনজন কেউ নেই,, একান্ত হৃদয়ের মানুষ বলতেও কেউ নেই। ওই একজন খালা আছে যে কিনা মেহেরকে বিনাস্বার্থে ভালোবাসে। ওর জীবন কি করে সাজিয়ে দেয়া যায় এই নিয়ে ভাবতে থাকে। মানুষটা যতদিন আছে ততদিন এই পৃথিবীতে মেহেরের মাথায় গাছের ছায়া আছে। এরপর,, মেহের একা ; সম্পূর্ণ একা।

রাতটা কোনোমতে পার হলো। সকালে দুটো পাউরুটির পিস খেয়ে ব্যাংকে চলে গেলো। অন্যান্য দিনের মতো আজও নিজের ডেস্কের সামনে বসলো। পিয়নকে বলে এককাপ ধোঁয়া ওঠা রং চা আনিয়ে তাতে চুমুক দিলো। ধীরে ধীরে চা শেষ করলো। তারপর,, কাজে মনোযোগী হলো। গ্রাহক আসছে টাকা তুলছে,,কেউ জমা রাখছে,, কেউ নতুন অ্যাকাউন্ট খুলবে,, কেউ মারা গাছে তো তার নমনী এসেছে টাকা পাওয়ার উপায় জানতে৷ রোজকার একই ঘটনা।

ডেস্কের সামনে নতুন গ্রাহকের নাম ঠিকানা ফরমে পূরণ করছিল। এমন সময় একটি কাগজে ধরা হাত এগিয়ে আসে মেহেরের সামনে। মেহের ফরম পূরণ করা বাদ দিয়ে কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো।।।

—-ভালোবাসা কি মানুষকে ডুবায়? নাকি মানুষ ভালোবাসাকে ডুবায়? প্রথম প্রশ্নটা লোকমুখে প্রচলিত কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্ন আমার মনে একান্তই উদয় হয়েছে কিনা তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় আছি। ত্রিশ বছর বয়সে এসে প্রথমবারের মতো হলো আমার পাশে কাউকে প্রয়োজন যাকে আমি আমার মনের সকল ভার দিতে পারব । কিন্তু,, অবাক করা বিষয় হচ্ছে আমার এই বয়সে এসে এমন সিদ্ধান্ত শুনে সকলেই হতবাক। কারণ,, যেই আমি কোনো একসময় প্রেমে অসফল হয়ে বলেছিলাম জীবনে বাঁচতে হলে কারো সঙ্গ’র প্রয়োজন নেই ধ্যানধারণা নিয়ে ফিরতাম সেই আমি বিয়ে করব! যার মুখে একটাই প্রবাদ ছিল,, পৃথিবীতে এসেছি একা ; যাবো একা সেই আমি একে একে দুই হতে চাচ্ছি! ব্যাংকের চাকরি,, সাপ্তাহিক ছুটিতে ভাইয়ের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরতে যাওয়া। ব্যস এতটুকুতেই আমার জীবনটা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু,, কেউ একজন হুট করে এসে আমার নিয়মমাফিক চলা জীবনটাকে নিমেষেই বদলে ফেলেছে। আমি নিজের ওপর চরম মাত্রায় বিরক্তবোধ করছি। কারণ,, এমন একটা বয়সে এসে নিজের এমন পরিবর্তনের কথা কারো কাছে শেয়ার করতে পারছি না। শুধুমাত্র আপনার কাছে বললাম। এখন আমার কি করা উচিত?

কাগজটা ডেস্কের ওপর রেখে বিরক্ত হয়ে মেহের চেচিয়ে বলে উঠলো,,,

— কে দিয়েছে এই কাগজটা?

ব্যাংকের সবাই মেহেরের আকস্মিক কান্ড দেখে হতবিহ্বল হয়ে যায়। পাশের ডেস্কের মিমি এসে মেহেরকে বললো,,

— কি হয়েছে? কোথায় আছো এটা ভুলে গেলে নাকি?

মেহেরে টনক নড়ে। কাগজটা দুমড়েমুচড়ে হাতের মুঠোয় রেখে মিমিকে বললো,,

— কি হলো আমার বুঝতে পারছি না! তুমি যাও এন্ড আ’ম ভেরি ভেরি সরি অল অফ ইউ।

সবাই মেহেরের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজ নিজ কাজে মনোযোগী হলো।

মেহের তার নতুন গ্রাহকের কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে বিদায় জানালো। এবার নতুন গ্রাহক এলো। এবং মেহেরের খুব পরিচিত একজন মানুষ। এসেই হাসিমুখে মেহেরকে জিজ্ঞেস করলো,,

— কেমন আছো মেহেরজান?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here